যক্ষ এবং জাতিস্মর | আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প । রহস্য প্রেমীদের জন্য

১.
“এই ছেলে, তোমার নাম মৃন্ময়?”

মৃন্ময় প্রতিদিন সকালবেলায় একা-একা মাঠে চলে আসে। মাঠের ঠিক পাশেই বিশাল এক গাছ ডালপালা ছড়িয়ে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে তার ছায়া বিছিয়ে রেখেছে। তারই নিচে গোটা কয়েক বাচ্চা নিয়ে পন্ডিত মশাই তার টোল খুলে বসেছেন। বাচ্চাগুলো সব মৃন্ময়ের-ই বয়সি হবে, এই বছর ছয় কি সাত? বাচ্চারা গা দুলিয়ে সুর করে তাদের পাঠ শেখে। মৃন্ময় আড়াল থেকে লুকিয়ে তাদের দেখে আর মনে-মনে স্বপ্ন বুনে সে-ও একদিন টোলে বসে তাদের সাথে এমন ছন্দে-ছন্দে পাঠ শিখবে। তবে তার স্বপ্ন কি আদৌ কখনও সত্যি হবে? সে কি ততটা ভাগ্যবান? আজ পাঠশালা ছুটি হয়ে গেছে অনেক আগেই, তবুও মৃন্ময় বাড়ি ফেরেনি। ভর দুপুরে সব শুনশান। এই নিরবতাটাই তার বেশ লাগছে। মৃন্ময় ভাবে যদি আর কখনো বাড়ি না ফেরা যেত তবে বেশ হত। মা আজ খুব মেরেছে। অবশ্য প্রায়ই মারে কিন্তু মৃন্ময়ের এতোদিনে সব গা সয়ে গেছে। তার তো বাবা নেই, তাই মায়ের শাসনের পর আদর দেবার মতোও কেউ নেই। দূর্ভাগ্যবশত তার জন্মের দিনই তার বাবা মারা গেছে, নয়তো একমাত্র সন্তান হিসেবে সে-ও হয়তো দুধে-ভাতে, আদরে-আহ্লাদে বড় হত। মা মাঝেমধ্যেই তাকে বলে ‘অপয়া’। আচ্ছা, ‘অপয়া’ কথাটার অর্থ কী? মৃন্ময় যখন আনমনে এসব ভাবছিল ঠিক তখনই একটা গমগমে কণ্ঠস্বর তার চিন্তায় ইতি টেনে দেয়।

–“এই ছেলে, তোমার নাম মৃন্ময়?”

মাঠের পাশে হাটা পথটাতে একটা বিশাল পালকি থেমে আছে। কণ্ঠস্বরটা ভেসে আসছে সেই পালকির ভেতর থেকে। বৃদ্ধ এক লোক সেখান থেকে মাথা বের করে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। বৃদ্ধের চেহারাটা মলিন, চোখদুটো কেমন যেন রুগ্ন তবুও গায়ের দুধে আলতা রঙটা এখনো বেশ চোখে ঠেকছে। পোশাকের বেশভূষাও জমকালো। দেখে তো মনে হচ্ছে ইনি খুব বিত্তবান কেউ হবে। মৃন্ময় তীব্র কৌতূহলে পালকির আগন্তুকের উদ্দেশ্য ‘হ্যাঁ’ সুলভ মাথা ঝাকায় আর তাতেই লোকটার রুগ্ন চোখদুটো যেন মুহূর্তের জন্য জ্বলে ওঠে।

–“আমি তোমাকে নিতে এসেছি। শুনলাম তোমার খুব কষ্ট। তাই তুমি এখন থেকে আমার বাড়িতেই থাকবে। যাবে আমার সাথে?”

নিতান্ত দরিদ্র ঘরের সাধারণ এক বালককে যদি এমন হোমড়াচোমরা কেউ এই ধরণের একটা প্রস্তাব দিয়ে বসে তবে প্রাথমিকভাবে তার ক্ষেত্রে রাজি হয়ে যাওয়াটাই বোধহয় স্বাভাবিক। শিশুমন তো আর যুক্তিতর্কের ধার ধারে না। মৃন্ময়-ও কোনো কিছু না ভেবেই একবাক্যে রাজি হয়ে যায়।

–“আমি যামু তোমার লগে। তয় তুমি কি জানো ‘অপয়া’ কারে কয়?”

এতটুকু বাচ্চার মুখে হঠাৎ এমন অপ্রাসঙ্গিক একটা প্রশ্ন শুনে চমকে যায় আগন্তুক। কিন্তু পরক্ষণেই মুখে হাসি এনে বলে,

–“সে কথার অর্থ যাই হোক না কেন? তোমার সাথে তার কোনো যোগ নেই। যে আমার ঘরের লক্ষীকে রক্ষার দায়িত্ব নেবে তার জীবনের সাথে ঐ শব্দের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। চলো, মৃন্ময় বাবু। আজ দুগ্ধস্নান করে শুদ্ধ হয়ে তোমার অভিষেক হবে। আমার লক্ষীর ভান্ডারের রক্ষক হবে তুমি, যতদিন না আমি আবার ফিরে আসছি।”

মৃন্ময় এসব ভারি-ভারি কথার আর কোন অর্থ খুঁজতে যায় না। তৎক্ষনাৎ চড়ে বসে পালকিতে। এই বেশ হলো, আর বাড়ি ফিরে যেতে হবে না। মা’র হাতেই ঠ্যাঙানিও খেতে হবে না। এই লোক নিশ্চয়ই তাকে দু’বেলা পেট পুড়ে খেতে দেবে, ওটুকুতেই সে খুশি।

আগন্তুকের মুখে আত্মতৃপ্তির হাসি। তার এতদিনের মনঃকামনা আজ পূর্ণ হতে চলেছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে এই অমূল্য নীলপদ্মের খোঁজ পাওয়া গেছে। একে কিছুতেই আর হাত ছাড়া করা যাবে না, সে যেকোন মূল্যেই হোক।

সেদিন গভীর রাতে রাজ্যের একপ্রান্তে যখন গোপনে দেবীর আরাধনা শেষে এক নিস্পাপ বালকের জীবন্ত সমাধি তৈরির তোরজোর সম্পন্ন, অপরপ্রান্তে ঠিক তখনই এক সদ্য সন্তানহারা বিধবা মায়ের গগনবিদারী আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠছে বাতাস। “ঘরে ফিরি আয় বাপ। আর কহনো মারতাম না, এই দেবী মা’র দিব্যি কেটে কইছি”। কিন্তু স্বয়ং দেবী মা যে তখন তার আরেক ভক্তের ভক্তিতে প্রসন্ন, তাই এক্ষেত্রে সে নির্বাক এবং বধির।

এর কিছুদিন পর…
অঢেল ধনভাণ্ডারের উপর মৃন্ময় নেতিয়ে পড়ে আছে। সাথের খাবার-পানীয় সবটাই ফুরিয়ে গেছে, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় শরীর অবসন্ন। ঘি’য়ের প্রদীপটা তো নিভে গেছে সেই কবেই। এখন শুধু তার জীবন প্রদীপ নেভার অপেক্ষা।

২.
অর্নব এই প্রথমবার স্ব-পরিবারে নিজের দেশের মাটিতে পা রাখল। তার পূর্বপুরুষ বাঙালি হলেও অর্নবের জন্ম বিদেশে এবং সেখানেই বেড়ে ওঠা। শুধু সে কেন, তার বাবা-কাকাদেরও কখনো এদেশের হাওয়া-বাতাস গায়ে মাখবার সুযোগ হয়নি। গত কয়েক পুরুষ ধরেই তাদের পরিবার বিদেশেই মাটি কামড়ে পড়ে আছে। আসলে পাশ্চাত্যের আধুনিকতায় যে একবার গা ভাসিয়েছে তার কি আর ইচ্ছে করে এত সহজে ওসব ছেড়ে আসতে? কোথায় বিলেতি কায়দায় স্যুট-টাইয়ের সাহেবিয়ানা আর কোথায় অজপাড়াগাঁয়ের ধুতির মালকোঁচা।অর্নবেরও হয়তো কখনো এখানে আসা হতো না, সে-ও যে সাহেবি জীবনের সাথে অভ্যস্ত না তেমনটাও নয়। পেশাগতভাবে অর্নব একজন লেখক, তার জনপ্রিয়তা এতটাই তুঙ্গে যে বিলেতি সাদা চামড়ার জাতির কাছেও তার নাম বহুল সমাদৃত। কিন্তু ঐ যে একটা কথা আছে না, শেকড়ের টান। তার ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই ঘটেছে। নয়তো হঠাৎ-ই কেন তার মনে খেয়াল জাগবে যে জাতে বাঙালি হয়েও খোদ বাংলা ভূমির মানুষের কাছেই যদি তার পরিচিতি না গড়ে ওঠে তবে এই লেখক জীবনের স্বার্থকতা কী? নাহ, এটা তো বড্ড লজ্জাজনক। শুনেছে দেশে তাদের পূর্বপুরুষের বিরাট বাড়ি আছে। সেখানে একবার গিয়ে পড়লে মন্দ হয় না। নিজের ভিটেও দেখা হবে আবার দেশটাকেও চেনা হবে। এবার সময় হয়েছে নিজের শেকড়ের কাছে ফিরে যাবার। ব্যাস, যেই ভাবা সেই কাজ। তারপর থেকেই এই বাংলা ভূমির প্রতি তার আকর্ষণের শুরু। আর সেই আকর্ষণই আজ তাকে এতদূরে নিয়ে এসেছে। কিন্তু তার স্ত্রী নীলিমার মাঝে এর ছিটেফোঁটাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না বরং স্বামীর এই খামখেয়ালিতে সে চরম বিরক্ত। নীলিমা-ও জাতিতে বাঙালি কিন্তু বিদেশে বেড়ে ওঠার দরুন এই অচেনা দেশের প্রতি তার কোনো টান আজ অব্দি জন্মায়নি। এই মুহূর্তে তার ভ্রু-যুগল একেবারেই কুঁচকে আছে। যদি তার বিরক্তির ব্যারোমিটার এই অবস্থাতেই স্থির থাকে তবে আশা করা যায় অতি শীঘ্রই কপালে স্থায়ী ভাঁজ পড়ে যাবে। তবে তাদের একমাত্র পুত্র সৌহার্দ্য যে খুব খুশি সেটা তার মুখ-ই বলে দিচ্ছে। বাধভাঙ্গা আনন্দ যেন তার চোখে-মুখে উপচে পড়ছে। বয়স সবে সাত পেরিয়েছে, তবে দস্যিপনার শেষ নেই। বাবা – মা’র শত বারন স্বত্ত্বেও সে বারবার ট্যাক্সির জানালা দিয়ে মাথা বের করে দিচ্ছে আর প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে দুজনকেই ব্যতিব্যস্ত করে তুলছে। অর্নব হাসি মুখে সেসব প্রশ্নের উত্তর দিলেও নীলিমা একেবারে নিশ্চুপ। বিমানবন্দরে প্লেন থেকে নামার পর ট্যাক্সি যতক্ষণ শহরের মাঝে ছিল ততক্ষণ নীলিমা মোটামুটি নির্বিকারই ছিল। যেই রাস্তা শহর ছেড়ে মফস্বলের দিকে মোড় নিলো, নীলিমার মুখটাও চুপসানো শুরু হলো। কি এদোঁ গ্রামে এসে পড়া গেলো রে বাবা! এখানে মানুষ থাকে কি করে? তাই বারবার অর্নবকে প্রশ্ন করে যায় নীলিমা, “আর কত দূর?” আর অর্নবও মুখে হাসি রেখে প্রতিবারই এক উত্তর দেয়, “এই তো, আর বেশিক্ষণ নয়।” নীলিমা ভাবে সন্ধ্যা নামতে আর বেশি বাকি নেই, অর্নব কি ঠিক মতো ঠিকানাটা মেলাতে পেরেছিল? যদি ভুল করে থাকে তবে যে বিপদ না হয়ে যায় না। এই অচেনা অঞ্চলে কে তাদের সাহায্য করবে? মনে মনে প্রার্থনা করে সে, তার এসব আশঙ্কা যেন মিথ্যে হয়। হঠাৎ তার ধ্যান ভাঙে সৌহার্দ্যের চিৎকারে, “আমরা এসে গেছি। এই তো আমার ক্যাসেল। সবাই নামো, নামো।” ট্যাক্সি একরাশ ধুলোর ঝড় তুলে একটা বিরাট ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে যায়। অর্নব আর নীলিমা দুজনেই বেশ অবাক হয়, সৌহার্দ্য এই বাড়ি চিনল কি করে? যেখানে তারা দুজনই ঠিকানা নিয়ে হিমসিম খাচ্ছিল, সেখানে ও একবার দেখা মাত্রই বলে দিলো? কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, প্রচুর শিশুতোষ বাংলা বই পড়ার কল্যাণে সৌহার্দ্য জানে জমিদার বাড়ি বলতে ঠিক কি বোঝায়। শিশু মাত্রই কল্পনা প্রবণ, এই বাড়িটা নিয়ে ওর অবচেতন মনের ছবিটা হয়তো কাকতালীয় ভাবেই মিলে গেছে। এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। এতক্ষণ এত বিরক্তি নিয়ে থাকলেও বাড়ির চেহারা দেখে নীলিমার মুখ হা হয়ে যায়। বাড়ি না বলে বরং এটাকে প্রাসাদ বলাই ভালো। ফটকের কাছে শ্বেতপাথরের ফলকে বাড়ির নামটা এখনো টিকে আছে, “অমরালয়”। অমর নারায়ণ চৌধুরী ছিলেন অর্নবদের বংশের প্রথম জমিদার। তার আমলেই এই বাড়ির গোড়াপত্তন হয়েছিল তাই বাড়ির নামটাও তার নামের সাথে মিলিয়ে রাখা। বাড়ির বয়স যে শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে, চারপাশ প্রায় ভঙ্গুর। তবুও তার নিজস্ব কি যেন এক মোহে আচ্ছন্ন করে রেখেছে সবাইকে। “অমরালয়” নামের মতো বাড়িটাও কি সত্যিই ইন্দ্রপুরী না কী? ঠিক সে সময় বাড়ির ভেতর থেকে এক বুড়োকে বেড়িয়ে আসতে দেখা যায়। সে-ই হয়তো এই বাড়ির বর্তমান কেয়ারটেকার হবে, ট্যাক্সির হর্ন শুনে দেখতে এসেছে। অবশ্য কেয়ারটেকারকে আগেই চিঠি লিখে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল যে তারা আসছে। বুড়ো এসেই হঠাৎ করে তাদের সামনে উপুড় হয়ে গড় প্রনাম করে বসে, “আসুন ছোট সাহেব। আপনাদের জন্য সব ব্যবস্থা করা আছে”। বুড়োর এই আচরণে অর্নব একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে যায়, “আরে আরে, করছেন কি? আমরা তো গণ্যমান্য কেউ নই, আপনার মতোই নিতান্ত সাধারণ মানুষ”। আর ঠিক তখনই সৌহার্দ্য তার বাবা-মা’কে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে একেবারে অন্যরকম মূর্তি ধারণ করে বসে। গোধূলির আলোয় স্পষ্ট দেখতে পায় ওরা সৌহার্দ্য চোখ-মুখ কঠিন করে গম্ভীর স্বরে বলছে, “নো। আই’ম দ্যা ল্যান্ডলর্ড, জমিদার সৌহার্দ্য নারায়ণ চৌধুরী”।

৩.
বুড়ো কেয়ারটেকারের নাম হরিহর। তার পূর্বপুরুষরা সকলেই সেই জমিদারির সূচনা থেকেই এই পরিবারের সেবায় নিযুক্ত ছিল। পালকি বাওয়া, তামাক সাজা, পাখা টানা এসব কাজের পাট তো সেই কবেই চুকে গেছে। তার উপরে কয়েক পুরুষ ধরে চৌধুরী পরিবার বিদেশে আছে। তাই এখন আর হরিহরের কোনো কাজ নেই বললেই চলে। শুধু এই বিশাল ‘অমরালয়’ দেখাশোনা বাবদ বিদেশী বাবুরা যা মজুরি পাঠায় তাই দিয়েই হরিহরের দিন চলে যায়। একা মানুষ, বিয়ে-থা করেনি। তাই আজও মাটি আঁকড়ে এখানেই পড়ে আছে। এসব হরিহরের মুখ থেকেই শোনা। লোকটা বেশ করিৎকর্মা, এই অশীতিপর বুড়োর কাজের নিপুণতায় অর্নব এবং নীলিমা দুজনেই অবাক। তারা আসার পর থেকেই বুড়ো তাদের সেবাযত্নের কোনো ত্রুটি রাখছে না। ঘরদোর ঝাঁড়পোছ করা, রান্নাবান্না সব কিছুই সামলাচ্ছে একা হাতে। এমনকি সকালের বেড টি থেকে বাথরুমে স্নানের গরম জলের ব্যবস্থাটা পর্যন্ত করে রাখছে।

আজ খুব ভোরেই অর্নব-নীলিমার ঘুম ভেঙে গেছে। সকালের মৃদু আলো আবছা মতো গায়ে এসে পড়ছে। পূর্বের খোলা জানালা দিয়ে হিমশীতল হাওয়া দিচ্ছে। একেবারে স্বর্গীয় অনুভূতি! আজকের সকালটা খুব সুন্দর। অর্নব তো এই কদিন লেখালেখি নিয়েই পড়েছিল। নীলিমাকেও তেমন একটা সময় দেয়া হয়নি। তাই দুজনেই সিদ্ধান্ত নেয় যে আজ তারা এই পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখবে। এখানে আসার পর থেকে বাড়ির অন্দর মহল ছাড়া আর কিছুই দেখা হয়নি। হরিহরকে বলতে হবে আজ তাদের সবটা ঘুরিয়ে দেখাতে। সৌহার্দ্য তখনও ঘুমাচ্ছে। থাক ঘুমাক, ওর ওপরে এই দীর্ঘ পথ যাত্রায় প্রচুর ধকল গেছে। তাছাড়া বাচ্চাটা এই নতুন পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছে না। এই কদিন যাবৎ একেবারে অদ্ভুত আচরণ করে যাচ্ছে। সারাক্ষণ একা একা কি যেন ভাবছে আর কিছু জিজ্ঞেস করলেই মেজাজ খিটমিট করছে। তাই ওরাও ওকে খুব একটা ঘাটাচ্ছে না। থাক না কিছুদিন ওর নিজের মতো, এই তো ক’দিন পরেই ওরা এখান থেকে শহরে চলে যাবে। শহুরে পরিবেশ পেলেই আবার হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে।

হরিহর সকালের জলখাবার দিয়ে মাথা নিচু করে নিরবে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। এটা সে প্রতিদিনই করে, এই নীরবতার অর্থ ছোট সাহেবের পরবর্তী ফরমায়েসের অপেক্ষা করা সেটা অর্নব এতদিনে বুঝে গেছে।

–“হরিহর কাকা, আমাদের তো এখনো এই বাড়ির বাহিরের দিকটা ঘুরে দেখা হয়নি। আপনি আমাদের আজ সবটা ঘুরিয়ে দেখাবেন তো?”

–“এমন করে বলছেন কেন ছোট সাহেব? আমরা আপনাদের অনুরোধ নয়, আদেশ পালন করতে অভ্যস্ত। হুকুমের গোলাম”।

অর্নব হরিহরের কথার প্রতিবাদ করতে গিয়েও কিছু বলে না, আসলে বিনয় বস্তুটা এই লোকটার মাঝে প্রচুর আছে। হয়তো এটা তার বংশগতভাবেই পাওয়া।

‘অমরালয়’এর অন্দর মহলের চেয়ে তার বাহিরটা আরো দ্বিগুণ সুন্দর। বিশাল বাগান আর শান বাধানো পুকুর ঘাট সবটা মিলিয়ে একেবারে হুলস্থুল ব্যাপার। নানারকম নাম না জানা ফুল মৃদুমন্দ বাতাসে তার সৌরভ ছড়িয়ে পরিবেশটাকে আরো সুন্দর করে তুলেছে। অর্নব লক্ষ্য করে নীলিমা অবাক দৃষ্টিতে আসেপাশে ঘুরে দেখছে। আসলে বিদেশের মাটিতে এমন দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য তাদের কোনোদিনই হয়নি।

–“কি ব্যাপার, মিসেস অর্নব নারায়ণ চৌধুরী? আমি যে হেলাফেলা কেউ নই সেটা এবার বুঝেছেন তো? যাকে বলে একেবারে ডাকাবুকো জমিদার”।

অর্নবের কথায় নীলিমা শব্দ করে হেসে ওঠে। অর্নবও যোগ দেয় সেই হাসির মাঝে। কিন্তু হঠাৎ তাদের চোখ যায় পুকুরের পার ঘেষে ঝোপের আড়ালে ছোট্ট দুটো পায়ের দিকে। পা দুটো হাটু পর্যন্ত পুকুরে ডুবিয়ে ছপছপ করে জল ছেটাচ্ছে। অজানা এক বিপদের আশংকায় বুক কেপে ওঠে দুজনের। এক দৌড়ে ছুটে যায় সেই ঝোপের কাছে। সৌহার্দ্য তো উপরের ঘরে ঘুমাচ্ছিল। কোন ফাকে উঠে চলে এসেছে কে জানে?

–“তুমি একা একা এখানে এলে কি করে? তুমি তো সাতার জানো না, যদি জলে পড়ে যেতে?”

সৌহার্দ্য একেবারে নির্বিকার হয়ে উত্তর দেয়,

–“আমি তো এখানে প্রায়ই আসি, এই পুকুর ঘাটের সবটাই আমার চেনা, একেবারে নিজের হাতের তালুর মতো।”

৪.
অর্নবদের থাকার জন্য আপাতত দুটো ঘর পরিষ্কার করা হয়েছে। এর একটা তারা বেডরুম হিসেবে ব্যবহার করছে আর আরেকটাতে অর্নব নিজের স্টাডি রুম বানিয়েছে। এই ঘরটা স্টাডি রুম হিসেবে বেশ। একটা ছোট্ট চেয়ার টেবিলও আগে থেকেই রাখা আছে, দুপাশে বুকশেলফে হয়তো একসময় বই ছিল তবে এখন যা আছে সেগুলোকে কোনভাবে আর বই বলা চলে না। পোকার আক্রমণে এখন সবটাই জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। টেবিলের ওপরে একটা লণ্ঠন জ্বলছে, ইলেক্ট্রিসিটি গেছে সেই কখন। লণ্ঠনের আলোতে অর্নব দেয়ালে ঝোলানো বিশাল অয়েল পেইন্টিংটার দিকে তাকিয়ে আছে। এই ছবির মানুষটিই জমিদার অমর নারায়ণ চৌধুরী। তিনি-ই না কী একসময় এই ঘরটাকে নিজের অবসর কাটানোর জন্য নানানরকম বইপত্র দিয়ে সাজিয়েছিলেন। পড়াশোনা ছিল তার কাছে নেশার মতো। পূর্বপুরুষের এই গুণটি-ই কি অর্নব পেয়েছে? কালের বিবর্তনে ছবির জৌলুশ হয়তো খানিকটা মিইয়ে গেছে তবুও ছবিতে তার মুখের গম্ভীর ভাবটা এখনো বেশ বোঝা যাচ্ছে, আর চোখ দুটো যেন এখনো জীবন্ত। অর্নব খুব মন দিয়ে ছবিটা দেখছে কারণ তার বাবা-কাকাদের মুখে উনার সম্পর্কে খুব অদ্ভুত এক গল্প শুনেছে সে। জমিদার অমর নারায়ণ চৌধুরী তার জমিদারিত্ব বংশ পরম্পরায় পাননি, উনার পিতা ছিলেন নিতান্তই একজন সাধারণ মানুষ। উনার এই বিশাল জমিদারির উৎস কি তা এখন আর কেউ সঠিকভাবে বলতে পারে না। তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য হলো উনার কাছে না কী অগাধ ধনরত্ন ছিল। শেষ বয়সে এসে খুব কঠিন এক অসুখে পড়েন তিনি। কোনো এক দৈবিক উপায়ে বুঝতে পারেন তার আয়ু অতি দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, হাতে আর খুব বেশি সময় নেই। তাই উনার মাথায় একটা খেয়াল চেপে বসে যে করেই হোক মারা যাবার আগেই তার ধনরত্নগুলোর একটা ব্যবস্থা করে যেতে হবে। এগুলো তার সারাজীবনের কষ্টের সঞ্চয়, তাই কৌশলে সব লুকিয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু তবুও যদি কেউ এগুলোর খোঁজ পেয়ে যায়? তাই অবশেষে এক হৃদয়বিদারক সিদ্ধান্তে উপনীত হন তিনি, তার অগাধ সম্পদের রক্ষক হিসেবে একজনকে যক্ষ করে রেখে যান। যক্ষ ব্যাপারটা এমন যে একটা ছোট্ট বালককে নিজের লুকোনো ধন-সম্পদের সাথে অল্প কিছু খাবার আর পানীয় দিয়ে মাটির নিচে ছোট্ট একটা ঘরে আটকে রাখা হয়, অল্পদিনেই সেসব খাবার-পানীয় ফুরিয়ে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় বালকটির মৃত্যু ঘটে। তবে মৃত্যুর পরও তার আত্মা মুক্তি পায় না। অশরীরি হয়ে এক অযাচিত পাহারার দায়িত্বে নিযুক্ত থাকে সে। যদি কখনো সেসব ধনরত্ন তার সত্যিকারের উত্তরাধিকারীর হাতে পরে তাহলেই তার মুক্তি ঘটবে। আর যদি উত্তরাধিকার সূত্রের বাহিরে কেউ সে সম্পদ হাতাতে যায় তবে যক্ষের হাতেই তার মৃত্যু ঘটে। অমর নারায়ণ চৌধুরী তার মৃত্যুর সময় বলে গিয়েছিলেন এ জন্মে তিনি যা ভোগ করে যেতে পারলেন না, তা তিনি ঠিকই ভোগ করবেন তবে সেটা তার পরের জন্মে। তিনি আবার ফিরে আসবেন এই বংশেরই পরবর্তী উত্তরাধিকারী হয়ে। কথিত আছে ধনরত্নগুলো এই বাড়িরই কোথাও লুকোনো আছে। তবে এর খোঁজ পরবর্তীতে আর কেউ পায়নি। অর্নবের বাবা-কাকারা বরাবরই কুসংস্কার বিবর্জিত। তারা কখনো এই ধরনের কোনো যুক্তিহীন কিছু বিশ্বাস করেননি তাই ওসব খোঁজার চেষ্টা করার তো কোনো মানেই হয় না। তবে অর্নব আজ এই কথাগুলো ভাবছে সম্পূর্ণ অন্য কারণে, এখানে আসার পর থেকেই সৌহার্দ্য একেবারে আমূল পাল্টে গেছে। পরিবর্তনগুলো একেবারে চোখে পড়ার মতো। হরিহর লোকটাকে সৌহার্দ্য বেশ অপছন্দ করে। এর কারণ জিজ্ঞেস করাতে একবার বলেছিল, “চাকর-বাকরের মাঝে আবার পছন্দ-অপছন্দের কি আছে? অর্নব ওর এই কথায় খুব অবাক হয়েছিল, কারণ এমন কথা বলার মতো শিক্ষা সৌহার্দ্য কখনই পায়নি। তার ধারণা অমর নারায়ণ চৌধুরীর চরিত্রের কিছু অংশ সৌহার্দ্যর মাঝেও কিঞ্চিৎ লক্ষনীয়। তাছাড়া এই বাড়ি সম্পর্কে ও এমন কিছু তথ্য মাঝেমধ্যে বলে যেগুলো অর্নব কিংবা হরিহরও জানে না। তবে কি অমর নারায়ণ চৌধুরী যা বলে গিয়েছিলেন তাই করে দেখিয়েছেন? কিন্তু পরক্ষণেই আবার সে ভাবনা নাকচ করে দেয় সে, সৌহার্দ্য এখনো নিতান্তই নাবালক, তাছাড়া এই অদ্ভুত গল্পটা তারও জানা। হতে পারে এরই একটা বিরূপ প্রভাব পড়েছে ওর শিশু মনে। এই গল্পটা চট করে মাথায় গেঁথে যাবার জন্য অনেকাংশে দায়ী এখানকার পরিবেশ, তাই এখানে আর বেশিদিন থাকাটা বোধহয় ঠিক হবে না। যক্ষ বলতে যেমন কিছু হয় না তেমনি জাতিস্মর শব্দটিরও বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই।

৫.
আজ সারাদিন আকাশ জুড়ে অঝোর ধারার বর্ষণ ছিল। হঠাৎ মাঝরাতের দিকে মেঘ কেটে গিয়ে বিশাল চাঁদ উঠেছে। কৃষ্ণপক্ষ চলছে বোধহয়, জ্যোৎস্না যেন দিনের আলোকেও হার মানাচ্ছে। সত্যিই প্রকৃতির মন বোঝে কার সাধ্যি!

বাগানের ভেজা মাটিতে ছোট-ছোট পদচিহ্নগুলো পুকুর ঘাটের দিকে গেছে। আর চুপিচুপ সেই চিহ্ন অনুসরণ করে সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে আরেকটি ছায়ামূর্তি। বুকের মাঝে যত্নে পুষে রাখা বহুদিনের লোভটা যেন আজ আরো প্রবল হয়ে উঠছে। এতগুলো বছর যেই সোনার হরিণের খোঁজে সে মরিয়া হয়েছিল আজ তার হদিস মিলতে চলেছে।

পুকুরের জলে হাটু অব্দি ডুবিয়ে বসে আছে সেই ছোট্ট পদচিহ্নের মালিক। জলের উপর বিরাট এক রুপোর থালার প্রতিচ্ছবি ভাসছে, একরাশ মুগ্ধতায় সেদিকেই তাকিয়ে আছে সে। হঠাৎ জলের মাঝে তার প্রতিবিম্বের ঠিক পেছনেই পরিচিত সেই ছায়ামূর্তির আভাসে চমকে ওঠে সে তবে কিছু বলার আগেই মাথায় শাবলের অতর্কিত আঘাতে মুহূর্তের মধ্যে জলে পড়ে যায় তার ছোট্ট শরীরটা। মৃদু একটা গোঙানি শুধু শোনা যায়, তবে সেটাও ঝিঁঝিদের তীব্র কোরাসের শব্দে হারিয়ে যায় দ্বিতীয় কারো কানে পৌঁছানোর আগেই।

তারপর সেই নৃশংস শাবলের একের পর এক আঘাতে ঘাটের পলেস্তারা খসে মাটি গভীর হতে থাকে। একসময় তলের দেখাও মেলে, তবে সোনার হরিণ হস্তগত হবার আগেই শ্বাসনালীতে আরেকজোড়া হাড় জিরজিরে ছোট্ট হাতের চাপে ভবলীলা সাঙ্গ হয় সেই ছায়ামূর্তির।

সকালে ঘুম ভাঙার পর নীলিমা আবিষ্কার করে সৌহার্দ্য ঘরে নেই। শত ডাকাডাকির পরও সারা না পাওয়াতে মনটা কু ডেকে ওঠে তার। তৎক্ষনাৎ অর্নবকে জাগিয়ে দুজনেই হন্তদন্ত হয়ে ছেলেকে খুঁজতে বেরিয়ে যায়। বাড়ির অন্দরের প্রতিটি কোণে তন্নতন্ন করে খুঁজেও যখন ছেলের দেখা মেলে না ঠিক তখনই সেদিনকার পুকুর ঘাটের ঘটনাটা মনে পড়ে যায় তাদের। আর ভাবা মাত্রই তড়িৎ গতিতে সেখানে ছুটে যায় দুজনে। কিন্তু তারা তো জানেনা যে কাল মাঝরাতে সেখানে কোন নাটকের যবনিকা পতন হয়ে গেছে।

পুকুর ঘাটের শানটা ভেঙে বিশাল এক চারকোনা গর্ত হয়ে আছে। পাশেই একটা শাবল ছুড়ে ফেলা হয়েছে, বেশ বোঝা যাচ্ছে এই অস্ত্রের সাহায্যেই গর্তটার সৃষ্টি। কৌতূহলী হয়ে সেই গর্তের ভেতর দৃষ্টি দিতেই চমকে যায় দুজনে। পাহাড়সম ধনরত্নের ওপর হরিহরের রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে দেহটা হাটু গেড়ে আছে। একটা ছোট্ট নরকঙ্কালের হাতের চাপে তার চোখদুটো উল্টে আধহাত জিভ বেরিয়ে গেছে। হরিহর যে অনেক আগেই মারা গেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। উফ, কি বিভৎস! হঠাৎ এমন অস্বাভাবিক এক দৃশ্যের অবতারণায় দুজনেরই গা গুলিয়ে আসে আর ঠিক তখনই তাদের চোখ যায় পুকুরের ঠিক মাঝ বরাবর জলে ভেসে থাকা ছোট্ট আরেকটা নিষ্প্রাণ দেহের দিকে। সেটা অন্য কারোর নয়, তাদেরই সবেধন নীলমনির। (সমাপ্ত)

ঈশিতা জুবায়ের এর অন্য আরেকটি গল্প পড়ুন >>অভিভাবক । ভালোবাসার গল্প – ঈশিতা জুবায়ের

এমন আরেকটি  রহস্য গল্প পড়ুন >>  রক্ত মাতৃকা

রক্ত মাতৃকা – অঙ্কিতা-ঘোষ | আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প

যক্ষ এবং জাতিস্মর | লেখক পরিচিতি | আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত রহস্য গল্প

লেখক: ঈশিতা জুবায়ের

গল্প: যক্ষ এবং জাতিস্মর

জনরা: রহস্য

ঠিকানা: কেরানীগঞ্জ, ঢাকা

পড়াশোনা: উচ্চমাধ্যমিক

পেশা: গৃহিণী

 

ishita-zubayer-ঈশিতা-জুবায়ের-আত্মপ্রকাশ-লেখক
লেখক – ঈশিতা জুবায়ের

লেখকের কথাঃ প্রচুর বই পড়তে ভালোবাসি, এককথায় যাকে বই পোকা বলা চলে। মূলত বইয়ের প্রতি এই ভালোবাসা থেকেই লেখিকা হবার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সেই সাথে ছবি আঁকার কিঞ্চিৎ দক্ষতা রাখি।।

আরিফ উল্লাহ্

http://www.attoprokash.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *