মাসুদ রানা ও তার দল >> আরিফ মিলন । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প

আরিফ মিলনের লেখা  ‘মাসুদ রানা ও তার দল‘ মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছোটগল্পটি আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প প্রতিযোগিতা ০২ এ প্রথম স্থান অর্জন করে এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখা  ‘চিলেকোঠার সেপাই‘ বইটি পুরস্কার হিসেবে জিতে নেয়।

এক.
ছেলেটির নাম মাসুদ রানা। বয়স দশ-বারো। বয়সের তুলনায় গায়ে গতরে বেড়ে গেছে দেড়গুণ। লিক লিকে শরীর। তল্লা বাঁশের মত পা। সূচের মত তীক্ষ্ম চাহনী।

পোষ্ট মাস্টারের বাড়িতে যখন আসল, সবাই তাকে দেখে চুপ হয়ে গেল। পোষ্ট মাস্টারের ছোট ছেলে রাসেল তার বন্ধু। রাসেল কান্না ভেজা চোখে বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। আঁচলে মুখ গুঁজে বসে আছে রাসেলের মা। চার বছর বয়সের রাসেলের ছোট ভাই মায়ের আঁচল ধরে কাঁদছে। পাড়ার মহিলা পুরুষেরা জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে।

মাসুদ এগিয়ে যায় রাসেলের কাছে। রাসেল মাথা নিচু করে থাকে। কোনো কথা বলে না। মাসুদ জিজ্ঞাসা করে, কি হইছে?
রাসেল কোনো উত্তর দেয় না। মাসুদ আবার জিজ্ঞাসা করে, আমারে কবি না, কি হইছে?

রাসেলের সাথে মাসুদের গলায় গলায় ভাব। এক সাথে সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। বনে বাঁদাড়ে, ঝোপ জঙ্গলে দিন কাটে। রাসেল ভাল ছাত্র। মাসুদ ভবঘুরে। পড়াশোনায় মনোযোগ নেই।

মাসুদ রাসেলের শরীর ধরে ঝাঁকি দেয়। উত্তেজিত গলায় বলে, কি হইছে যে, আমারে কওয়া যায় না।

পাশ থেকে সাতাশ বছরের হিরু কাকা বললেন, ও তোরে কি কবো? তোর বাপেরে যাইয়া জিগা গা। বজ্জাতের পুলা বজ্জাত কোনেকার।
পাশ থেকে এক মহিলা চেঁচিয়ে বললেন, সর্বনাশ কইরা এহন আইছে দরদ দেহাবার।

মাসুদ রানা চিৎকার করে বলল, ক্যান কি হইছে? আমার বাপে কি করছে?

কেউ একজন তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, ক্যান তুই জানস না, তোর বাপ রাজাকার। মাস্টার সাবরে মিলিটারী ক্যাম্পে ধরায় দিছে।

মাসুদের মাথা নিচু হয়ে যায়। কোনো কথা বলে না। পোষ্ট মাস্টারের বাড়ি থেকে দ্রুত বের হয়ে আসে।

দুই.
খা খা রোদে মাঠের কালভার্টের উপরে এসে বসে পড়ে মাসুদ রানা। চোখে জল জমে ওঠে। সে জলে তার বাবার ছবি ভেসে ওঠে।

জব্বার ফকির বললে এখন আর কেউ তার বাবাকে চিনে না। জব্বার রাজাকার বললে সবাই এক নামে চিনে। বাবার সামনে কেউ কিছু বলে না। সালাম দিয়ে চলে। মূল্যহীন জব্বার ফকিরের মূল্য বেড়ে গেছে রাজাকার নাম যোগ হওয়ার পরে।

বাবাকে নিয়ে মাসুদ রানা অনেকের মুখে অনেক কথা শুনেছে। আড়ালে আবডালে, আকারে-ইংগিতে; কখনো সরাসরি। কোনোটাই সুখের কথা নয়।

তিন দিন আগের ঘটনা। রাতে মা বাবাকে বললেন, আমরা গরীব মানুষ। আপনে এইসবের মধ্যে থাইকেন না। লোকে ভালা কয় না।
জব্বার রাজাকার ক্ষেপে গেল। ধমকে উঠে স্ত্রীকে বলল, মাইয়া মানুষ কি বুঝো, হুম কি বুঝো? বেশি কথা কবা না। কইলে টুটির উপরে পাড়া দিয়া মাইরা হ্যালামু।

মাসুদ সেদিন প্রথম বাবার মুখের উপর কথা বলেছিল➖ মাতো ঠিকই কইতাছে। আপনে যা করতাছেন তা ভাল করতাছেন না।

বাবা রেগে গিয়ে বলল, হাটুর সমান পুলায় কয় কি! থাপড়ায়া সব কয়টা দাঁত ফেলায় দিমু। দেশ ভাগ হারাম। বেইমানগো কাম।
অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলে জব্বার রাজাকার। সে কথায় মন গলে না বউ ছেলের।

স্ত্রী তার স্বামীকে অনুনয়ের সাথে বললেন, যা করার তা মাইনষে করব। আপনে আমার মাথা খান। কন যাবেন না।
মাসুদ রানা মায়ের মুখের কথা কেড়ে নেয়। উচু গলায় বলে, হ মা ঠিকই কইছে। মাইনষের কটু কথা হজম হবার চায় না।

জব্বার রাজাকার ছেলের গালে কষে থাপ্পড় মারে। চেঁচিয়ে ওঠে বলে, ছোট পুলাপান মানুষ; পুলাপানের মত থাকবি।

একরোখা স্বভাবের মাসুদ রানা। বাবার চোখে তার তীক্ষ্ণ চোখ রাখে। ঝাঁঝালো গলায় বলল, ভাল মন্দ আমরাও বুঝি। চামচামি করার সাধ একদিন মিটব।

জব্বার রাজাকার ছেলেকে মারতে উদ্যত হন। মা স্বামীর পা জড়িয়ে ধরেন। কেঁদে বললেন, ওরে আর মাইরেন না। ও ছোট পোলাপান মানুষ।

জব্বার রাজাকার স্ত্রীর দিকে আঙ্গুল উচিয়ে বলল, কথাডা জানি মা পুলার মনে থাকে। হারামজাদী কোনেকার! হারামী পুলা পয়দা দিছে।

“ঘরের শত্রু বিভীষণ” বলতে বলতে এক ঝটকায় গলায় মাফলার পেঁচায় জব্বার ফকির। ঘরের মেঝেতে কয়েক ঘা লাথ্থি মেরে হনহন করে বেড়িয়ে পড়ে।

ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মাসুদের মা। বিরান মাঠের এই কালভার্টে বসে মায়ের সেই সকরুণ কান্না ভেজা মুখ ভেসে ওঠে মাসুদের। এক দলা থুতু ফেলে রাস্তার ধূলায়।

তিন.
বিদ্যুৎবেগে বাড়িতে ঢুকে মাসুদ। মা বলে ডাক দেয়। মাসুদের ডাকে মা ছুটে আসেন। কান্নায় ভেঙে পড়েন। চিৎকার করে বলেন, ওরে তোর আব্বায় নাকি বিলকিসরে মিলিটারী গো কাছে তুইল্যা দিছে। ঐ পাড়ার মোসলেম মোল্লারেও নাকি তুইল্যা নিয়া গেছে।

মাসুদ হেশেল পাড়ে বসে পড়ে। বলে, কও কি! পোষ্ট মাস্টাররেও তো নিয়া গেছে।

মাসুদের মা তারস্বরে চিৎকার করে বলে, পরামানিকত্বের লোভে হ্যার মাথা গেছে।
মাসুদ ক্রুদ্ধ হয়ে বলে উঠল, যেই মানুষ মাইয়া গো মিলিটারীর হাতে তুলে দিবার পারে; হ্যার মুখে আর যাই হোক দেশের কথা মানায় না।

কথাটি শেষ করে মাসুদ বেড়িয়ে যায়। মা পেছন পেছন ছুটে আসেন। চেচিয়ে বলেন, কই যাস রে বাপধন আমার। ওরে যাস না। আয় ফিরে আয়।

মাসুদ রানা ফিরে আসে না। ছুটে চলে। বিকেলের রোদে কালভার্টে বসে নিজের শরীরকে পোড়ায়। তারপরে উঠে দাঁড়ায়।

কামরুলকে বাড়ি থেকে ডেকে আনে। একে একে সেলিম, রফিক, দুখা, শফিক, রাজু, কালুকেও ডেকে নেয় ওদের সাথে।

ওরা সাতজনে রইস উদ্দিনের বাঁশ ঝাড়ে গোল হয়ে বসে। চুপিচুপি সলাপরামর্শ করে। কেউ কেউ ভয় পায়। মাসুদ তাদেরকে সাহস যোগায়।

কাজে নেমে পড়ে সবাই। রাজু দৌড়ে বাড়ি গিয়ে দা, দড়ি নিয়ে আসে। বাঁশ কাটে। বাতা তৈরি করে বাঁকিয়ে গুলাল (ধনুক) বানায়। কঞ্চি কেটে তীর বানায়। তীরগুলো কালু সূচালো করে।

রফিক দুখা বাঁশের অগ্রভাগ দিয়ে পটকা বানায়। পটকা ফুটানোর জন্যে পিপলট্রি গাছের গুটি (ফল) সংগ্রহ করে। বল্লা গুটাও পেড়ে নেয়। যদি কোনো কারণে আঠার প্রয়োজন হয়।

রাজু মাসুদকে মনে করিয়ে দেয় পটকার চেয়ে ছিটক্যা হলে ভাল হয়। সেলিম বলল, আমার ঘরে দুইডা ছিটক্যা আছে।
শফিক বলল, আমার কাছে কিন্তু এক ব্যাগ মাটির গুলতি পুড়াইন্যা আছে। এইডা হইলে খাসা হইব।

মাসুদ শফিককে বলল, তুই বাজারে যা। যাবি আর আইবি। ছিটক্যার লাইগ্যা রবার্ট কিনা আনবি। আমি নিম গাছের ডাল কাটতাছি।

চিকন কিন্তু শক্ত প্রকৃতির ত্রিকোণাকার নিম গাছের ডাল কাটে মাসুদ। শফিক ফিরে আসলে ইলাস্টিক রাবারের ফিতা সেট করে। আগুনে পোড়ানো মাটির গুলতি লাগিয়ে খেজুর গাছের হাঁড়ি লক্ষ্য করে হাত তাক করে মাসুদ।

ইলাস্টিক রাবার টেনে ধরে ছেড়ে দিতে দিতে মাসুদ কামরুলকে জিজ্ঞাসা করে, মিলিটারীরা কয়জন হবার পারে রে?
কামরুল উত্তর দেয়ার আগেই খেজুর গাছের হাঁড়ি ছিদ্র হয়ে যায়। সবাই হাত তালি দেয়। মাসুদ আবার বলল, কেরে কামরুল কিছু কইলি নাতো।
কামরুল বলে, কইলাম তো। আট দশজন হইব।
মাসুদ বলল, চল তাইলে। আইজ সব কয়টারে শেষ করুম।

চার.
মাগরিবের আযান হয়েছে। কিন্তু তখনও অন্ধকার নামেনি। কালভার্ট পাওয়ার আগেই রাস্তার নীচে খেসারীর ক্ষেতে শুয়ে থাকে ওরা। সবার হাতে ছিটক্যা। গুলতি সেট করে অপেক্ষায় থাকে।
মাসুদ বলে, আমারডায় কাম হইলে তোরা মারবি। না হইলে নাই। এইহানে কাম না হইলে যা করার ক্যাম্পে করতে হব।

বলতে না বলতে মিলিটারীর গাড়ি ছুটে আসতে থাকে। মাসুদ সোজা হয়ে বসে। বাম হাতে ছিটক্যার নিচের ডাল শক্ত করে ধরে। ডান হাতে ইলাষ্টিক রাবার টেনে ধরে। ত্রিকোণাকার দুই ডালের মধ্য দিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ্য স্থির করে।

মাসুদ দেখে নেয় ড্রাইভারের জানালা খোলা আছে কি-না। “কপাল মনে হয় ভাল” বলে ইলাষ্টিক রাবার জোরে টেনে ধরে ছেড়ে দেয়। গুলতি ছুটে যায়। ড্রাইভার স্টিয়ারিং ছেড়ে লাফিয়ে ওঠে। মাসুদ উৎফুল্ল হয়ে বলল, কাম হইছে। আয় তোরা।

মূহুর্তের মধ্যে গাড়ি উল্টে গিয়ে কালভার্টের সাথে ধাক্কা খায়। ধাক্কা খেয়ে ডোবার পানিতে গাড়ি আছড়ে পড়ে।

ড্রাইভারসহ তিনজন মিলিটারী। দৌড়ে গিয়ে তাদেরকে রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে। বন্দুক কেড়ে নেয় মাসুদ। সাত জন মিলে তিনজনকে টেনে নিয়ে যায় বাঁশ ঝাড়ে। বন্দুকের বেনেট দিয়ে আচ্ছা মতন পেটায়। শক্ত করে বাধে। রাজু বলল, জীবন গেলেও ছুটবার পারব না।

মাসুদ বলল, বন্দুক চালাইতে পারবি কে কে?
শফিক বুকে হাত দিয়ে বলল, আমি পারুম। সিনেমায় যহন চালাইবার দেখছি তহন পারমুই।

মাসুদ আর রফিক বন্দুকক কাঁধে তুলে নেয়। যাওয়ার আগে বেঁধে রাখা মিলিটারীর দিকে তাকায়। কালু বলল, শালাগো মুখে বল্লা গুটার আঠা লাগায় দেই। মুখ আঠা আঠা হইলে শান্তি পাইব।

যেই কথা সেই কাজ। একে একে বল্লা গুটা ফাটিয়ে মিলিটারীর মুখে, ঠোঁটে, চোখে ঘষে দেয়। কামরুল হেঁসে বলে, শুকাই টান ধরলে মজা বুঝব।
মাসুদ বলল, এগো পরে দেখমু। আগে ক্যাম্পে যাওয়া দরকার। এতগুলা মানুষের জীবন।

সাতজন কিশোর মাঠের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে। মাইল তিনেকের পথ। কৃষ্ণপুর স্কুলে ক্যাম্প। ওরা যখন পৌঁছলো তখন এশার আযান হয়ে গেছে।

স্কুলের পেছনে পুকুর। পুকুরের পাড়ে আসতেই ওদের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। দূর থেকে যতটুকু বোঝা যায়, পাঁচজনকে চোখ বেধে লাইন করে দাঁড় করানো। মিলিটারীর কমাণ্ডার খিস্তিখেউড় করছে। পোষ্ট মাস্টার চাচা সহ সবাই কাকুতি মিনতি করছে।

কামরুল উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, ক্যারে বিলকিস বুবুরে তো দেহা যায় না।
মাসুদ বলে, হাচাই কইছস। বুবুরে কই রাখছে।
শফিক ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, কিছু হয় নাই তো।
মাসুদ রেগে গিয়ে বলে, অলক্ষুইনা কথা কবি না।
কালু চাপা স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে, ঐ যে বিলকিস বু।

সত্যিই তো। আলুথালু শাড়িতে নির্বিকার বসে আছে ওদের বিলকিস বুবু। মাসুদ রানার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। রাজু, আর কালুকে নির্দেশ দেয়, তোরা চুপচাপ পুকুর পাড়ি দে। ওগো সামনে গিয়া চুপ চাপ মাথা বাইর কইরা থাকবি। সময়মত পটকা মারবি। তারপরে আমি দেখতাছি।

মাসুদের কথামত দুজনে পুকুরে নামে। বাকী পাঁচজন পুকুরের পাড় ঘেষে ঐপাড়ের কোণায় গিয়ে অবস্থান নেয়।

রাজু আর কালু পটকা ফুটায়। মিলিটারীরা কি যেন বলে। একজন মিলিটারী মাসুদদের এদিকে আসতে থাকে। তাকে এক হ্যাচকা টানে টেনে নেয়। মুখের দুই পাটি দাঁতের মধ্যখানে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধে। যেন কোনো কথা বলতে না পারে। তারপরে হাত পা বেঁধে ফেলল। মিলিটারীর বন্দুক কেড়ে নেয় কামরুল। বুকে সাহস নিয়ে বলে, খালি টাইনা ধরাই তো কাম।
মাসুদ তার পিঠ চাপড়ে দেয়। বলে, সাবাস। পারবি। আর দেরী করন ঠিক হব না।

রাজু আর কালু ছিটক্যায় গুলতি বসায়। লক্ষ্য স্থির করে। মাসুদ, রফিক, কামরুল দূর দিয়ে মাটির উপরে বুক ঘষে এগিয়ে চলে। বন্ধুক টানতে কষ্ট হচ্ছে। ওদের চাইতে বন্ধুক বড়। দুখা আর সেলিম পুকুরের কোণাতেই থাকে।

গুলতির আঘাতে সোরগোল পড়ে যায়। চিৎকার করে চেঁচিয়ে ওঠে মিলিটারী শুয়োরেরা। মাসুদ চিৎকার করে বলে, যা আছে কপালে। গুলি কর।

একে একে ফায়ার করে। মিলিটারীরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। রাজু আর কালু উঠে এসে সবার চোখের কালো কাপড় খুলে দেয়। তারাও তাদের সাথে লেগে পড়ে।

মাসুদের গুলিতে তিনজন মিলিটারী মাঠে পড়ে আছে। একজন হয়ত মারা গেছে। আরও চারজনকে ওরা বেঁধে ফেলেছে। সেলিমের ছোড়া তীরের আঘাতে এক মিলিটারীর চোখ গেছে। সে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। শফিক আর কামরুল দুজন মিলিটারীর বুকে বন্দুকের নল ধরে আছে।

বিলকিস বুবু চিৎকার করে বললেন, খালি ধইরা আছস ক্যা। মার, শুয়োরের বাচ্চা গো মার।

শফিক, কামরুল আর দেরী করে না। দুই বুকে গুলির শব্দে আকাশে বাতাসে যেন মূহুর্মূহু বিজয় ধ্বনি বেঁজে ওঠে।

দুখা হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে বলল, ঐ দ্যাখ, ক্যারা জানি পলাইতাছে।

মাসুদ বন্দুক হাতে লাফিয়ে ওঠে দৌড় দেয়। তার সাথে সাথে দুখাও। বিলকিস বুবু চেঁচিয়ে বললেন, হগ্গলেই যাইস না।

মাসুদ, দুখা দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে ওঠে। সামনে কে আছে? ওদের জানা নেই। শুধু জানে, ভাল লোকেরা পালায় না। পাপই মানুষই তাড়িয়ে ফেরে।

লোকটি ক্ষেতের ইটে ধাক্কা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। তার ওপরে মাসুদ, দুখাও গিয়ে পড়ে। দুখা তাকে জাপটে ধরে বলে, ক্যারা আপনে? পলাইতেছেন ক্যান?
মাসুদ রানা নিজেকে দ্রুত সামলে নেয়। লোকটির বুকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে ধরে।

জব্বার রাজাকার ভয়ে ভয়ে বলে, বাজান তুই।
মাসুদ শান্ত সুরে বলে, হ আমি।

বন্দুকের গুলির শব্দে আশপাশের বাঁশ ঝাড়, ঝোপ জঙ্গল নড়ে ওঠে। পাখিরা কিচিরমিচির করে। বাদুরেরা ডানা ঝাপটাতে থাকে।

দুখা ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, এইডা তুই কি করলি মাসুদ। বাপেরে মারলি।
মাসুদ নির্বিকার চিত্তে বলল, হ মারলাম। এমন বাপ থাকনের চাইতে না থাকা ভাল।

দুখা বলল, তাই বইলা।
দুখার কথা শেষ হয় না। মাসুদ বলল, আমি জব্বার রাজাকারের পোলা। এ কলঙ্ক জীবনেও মুইছা যাব না। তারপরেও কলঙ্ক গায়ে নিয়া ঘুরা আর ঘরে রাইখা দেওয়া এক কথা না।

দুখা মাসুদকে বুকে জড়িয়ে নেয়। মাসুদ দুখাকে বুকে নিয়ে বাবার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। চোখের জল গড়িয়ে পড়ে।

চাপা কান্নার আর্তনাদে মাসুদের বুক ফেটে আসে। দুখার পিঠের জামা হাতের মুঠে শক্ত করে ধরে। মাসুদ চিৎকার করে বলল, আমি জব্বার রাজাকারের পুলা। আমি রাজাকারের পুলারে দুখা, আমি রাজাকারের পুলা। এ কলঙ্ক জীবনেও মুইছা যাব না।

দুখা কোনো কথা বলে না। মাসুদকে স্বান্তনা দেয়ার ভাষা তার জানা নাই। শুধু বলে, নু যাই; ওরা আমাগো লাইগা বইয়া আছে। (সমাপ্ত)

পড়ে নিতে পারেন >> আরিফ মিলনের লেখা >> সামাজিক ছোটগল্প উপঢৌকন‘।

আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প প্রতিযোগিতা – ০২ এ দ্বিতীয় স্থান অধিকারী মোঃ টুটুল ইসলাম এর গল্প >> সাইকো বনাম ব্রাসি লুকো

উপঢৌকন । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প । লেখক পরিচিতি

লেখকঃ আরিফ মিলন
ছোটগল্পঃ মাসুদ রানা ও তার দল
গল্পের জনরাঃ মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছোটগল্প
দেশের বাড়িঃ নাটোর
পড়াশোনাঃ বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং। (বর্তমানে একটি বেসরকারী কম্পানিতে চাকুরীরত)

আরিফ-মিলন-arif-milon-attoprokash-writter

লেখক – আরিফ মিলন

লেখার মাধ্যমে সামাজিক অসংগতিগুলো তুলে নিয়ে আসাই আরিফ মিলনের মূল লক্ষ্য। তাঁর মতে-

“সঠিক সামাজিক পরিবর্তনের জন্য হাস্যরসাত্বক বিনোদন নির্ভর নয়, সঠিক বোধ এবং রস সম্পন্ন সাহিত্য সংস্কৃতির পরিচর্যা করা আবশ্যক”।

সে লক্ষ্যে তিনি অনবরত কাজ করে যাচ্ছেন।

আত্মপ্রকাশ সম্পাদক

http://attoprokash.com

আত্মপ্রকাশে অপ্রকাশিত গল্প এবং বুক রিভিউ এবং প্রবন্ধ প্রকাশ করতে যোগাযোগ করুন (ইমেইল-attoprokash.blog@gmail.com) অথবা ফেইসবুক পেইজ ইনবক্স। সর্বনিম্ন ১০০০ শব্দ হতে যেকোনো ঊর্ধ্ব সীমার ছোট গল্প গ্রহণযোগ্য। আপনার গল্প আত্মপ্রকাশ বিচারকদের দ্বারা নির্বাচিত হলে আপনাকে জানানো হবে এবং তা সরাসরি প্রকাশ করা হবে আত্মপ্রকাশে। আপডেট জানতে ফেইসবুক গ্রুপে সক্রিয় থাকুন।

7 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *