বাংলা বানান বিভ্রান্তি । সেলিম রেজার ধারাবাহিক বানান শিক্ষা। পর্ব – ০১

সমৃদ্ধ বাংলা ভাষায় অসংখ্য বানান নিয়েই আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে। যা কোনো ক্ষেত্রে আমাদের বানানের ব্যবহার না জানার কারণে হয়ে থাকে। আবার কিছু বানান বিভ্রান্তি ব্যকরণ গঠিত কারণেও হয়ে থাকে। সেলিম রেজার ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত, বাংলা বানান নিয়ে বিভ্রান্তিকর কিছু পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার তথ্যমূলক পোস্ট আত্মপ্রকাশে প্রকাশ করা হচ্ছে। বাকী পর্বগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ করা হবে।

বাংলা বানান বিভ্রান্তি এবং সংশোধন । সেলিম রেজা

রচনার ভাগসমূহ

উল্লেখ্য যে, আমি কোনো ভাষাবিদ বা বানান বিশেষজ্ঞ নই। ভাষা ও বানান নিয়ে লিখিত বিভিন্ন, বইপুস্তক, জার্নাল থেকে সংগ্রহ এবং গুণীজনদের সাথে আলোচনা করে আপনাদের সুবিধার্থে এই পোস্টটি সাজানোর চেষ্টা করেছি। কারো কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট বক্সে করতে পারেন। যথাযথ উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবো। বাংলা বানান শিক্ষায়, যে যে ব্যবহারগুলো উল্লেখ করা হয়েছ এই পর্বে-

  • না এবং নি এর ব্যবহার
  • পড়া এবং পরা এর ব্যবহার
  • ঠাণ্ডা এবং গণ্ডগোল এর ব্যবহার
  • তৈরী এবং তৈরি এর ব্যবহার
  • বুঝা এবং বোঝা এর ব্যবহার
  • বিসর্গ এর ব্যবহার(ঃ)

না এবং নি এর ব্যবহার

আসুন প্রথমেই ‘না’ এবং ‘নি’- এর ব্যবহার জেনে নেই।

না– বাচক “না” সতন্ত্র পদ হিসাবে ব্যবহার করতে হবে।
যেমন- রিমি পড়াশোনা করে না।
তেমনি- করি না, খাই না, যাই না, দেখি না। অর্থাৎ “না” সব সময় আলাদা বসবে।

★ আবার “নি” সমাসবদ্ধ হিসাবে একত্রে ব্যবহার করতে হবে।
যেমন-, জান্নাতুল মমির পরীক্ষা চলছে। তাই সে কাজটি করেনি।
তেমনি ভাবে- করিনি, খাইনি, যাইনি, দেখিনি।
অর্থাৎ “নি” সব সময় একত্রে লিখতে হবে।

পড়া এবং পরা (“র” আর “ড়” এর ব্যবহার) এর ব্যবহার

পরা আর পড়া এক নয়। কেবল পরিধান অর্থেই “র” বা পরা ব্যবহার হয়। বাকি সব ক্ষেত্রেই “ড়” বা পড়া ব্যবহার করা হয়।

পরা
★ মাহবুব পাঞ্জাবী পরেছে।
★ সোনিয়া চশমা পরে।
★ মহুয়া মণি বোরকা পরে।
★ জারা লালশাড়ি পরে বইমেলায় বেড়াতে গিয়েছে।
★ ফারাবি সেদিন নীল শার্ট পরেছিল কিন্তু আজ একটি সাদা ময়লা সার্ট পরে এসেছে!
★ রোদসী জান্নাত চোখে কাজল পরতে পছন্দ করে।
★ নীরা মাজহার শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে ব্লাউজ পরেছে।
★ ছোট্টবেলার দেখা ফ্রক পরা রূপবতী বালিকার সাথে আর কখনও দেখা হয় নাই।

পড়া
★ তাসনিম রিমি রাত জেগে বই পড়ে।
★ সিন্থিয়া প্রেমে পড়েছে।
★ রূপন্তী পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে।
★ তুষার গাছ থেকে আম চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লো।
★ সুস্মিতা শশী স্বপ্ন দেখে খাট থেকে পড়ে গেল।
★ ভীষণ গরম পড়েছে।
★ জেদনির রাগ পড়ে গেছে।
★ তন্ময় ভারি বিপদে পড়ে গেছে। সে রাইটার্স ব্লকে পড়েছে।
মনে রাখবেন শুধুমাত্র পরিধান অর্থেই “র” ব্যবহার হবে বাকি সব জায়গায় “ড়” ব্যবহার করতে হবে।

ঠাণ্ডা এবং গণ্ডগোল (“ন” এবং “ণ” এর ব্যবহার) এর ব্যবহার

“ঠাণ্ডা” তৎসম শব্দ নয় কিন্তু গণ্ডগোলের “গণ্ড” তৎসম। আর “গোল” হচ্ছে ফরাসি।
ট- বর্গ বুঝেন তো?
ট, ঠ, ড, ঢ – এই চারটি বর্ণের পূর্বে যদি “ন” ধ্বনি থাকে এবং সেই “ন” দ্বারা যদি যুক্ত বর্ণ তৈরী হয় তাহলে সর্বদাই “ণ” মুর্ধন্য হবে।
যেমন-
ঘণ্টা, কণ্ঠ, ঠাণ্ডা, দণ্ড, কণ্টক ইত্যাদি
(সুত্র- ড. হায়াৎ মামুদ রচিত ” বাংলা লেখার নিয়ম কানুন” পৃষ্ঠা -৪২)
বিদেশী শব্দের শেষে nt/ nd থাকলে মুর্ধন্য “ণ” হবে।
যেমন – প্যাণ্ট, ব্যাণ্ড, লণ্ঠন, বাস স্টাণ্ড, ইণ্ডাষ্ট্রি
(হায়াৎ মামুদ -৩৮ পৃষ্টা)
কিন্তু বাংলা একাডেমি প্যাঁচ লাগায়া দিছে। তাদের প্রমিত বানান রীতি ২.০৩ মতে বিদেশী শব্দের শেষে nd/ nt থাকলে “ন” ব্যবহার করতে বলেছে।
এক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির সদস্যরা একমত হতে পারে নাই। তাই “ঠাণ্ডা” এবং “ঠান্ডা” দুটিই ব্যবহার করা যেতে পারে।

তৈরী এবং তৈরি এর ব্যবহার

দুটো বানানই সঠিক। কিন্তু এর মধ্যেও জটিলতা আছে। সব জায়গায় সব সময় তৈরী এবং তৈরি ব্যবহার করা যাবে না।
যদি অতীত এবং ভবিষ্যৎ নির্দেশ করে তবে দীর্ঘ ই-কার হবে। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে “তৈরী” ব্যবহার হবে।
যেমন- ফারাবি একটি শার্ট তৈরী করেছিল। (অতীত)
তাহসিন শনিবার একটি ব্যানার তৈরী করবে। (ভবিষ্যত)

আবার যদি বর্তমান বা সতত কোনো কিছু নির্দেশ করে তবে “তৈরি” ব্যবহার হবে।

যেমন- অর্না একটি কেক তৈরি করছে। (বর্তমান)


বুঝা এবং বোঝা এর ব্যবহার

“বুঝা” এবং “বোঝা” শব্দ দুইটি নিয়ে আমাদের অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে যাই। আসুন দেখি আসলে কী অবস্থা।
বুঝ= বোধ, বিচার, জ্ঞান, প্রবোধ, সান্ত্বনা
যেমন- তানিয়া কী বলেছে, তার কিছুই বুঝতে পারি নাই। বুঝা গেল সে একটি ভুল করেছে।
খেয়াল করে দেখবেন দ্বিতীয় বাক্যে অনেকেই ভুল করে “বোঝা” শব্দটি ব্যবহার করে থাকে।
★ সুমনাকে বুঝ দিয়ে কোনো লাভ নাই। সে খুব জেদি মেয়ে।
★ নীরা মাজহার তাকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সে বুঝতে চায় না।
( প্রবোধ, সান্ত্বনা অর্থে)

বোঝা= ভার, মোট, দায়িত্ব।
যেমন- মমির বোঝা টানার শক্তি নাই। সংসারের বোঝা টানা অনেক কঠিন কাজ।
সাহেদ, তুমি না জেনে এত বড় বোঝা নিতে গেলে!

বোঝাই= পূর্ণ বা ভর্তি
যেমন- চোরাইমাল বোঝাই ট্রাকটি পুলিশ আটক করলো।

বিসর্গ এর ব্যবহার(ঃ)

বিসর্গ একটি বাংলা বর্ণ—এটি কোনো চিহ্ন নয়। বর্ণ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। বিসর্গ (ঃ) হলো অঘোষ ‘হ্‌’-এর উচ্চারণে প্রাপ্ত ধ্বনি। ‘হ’-এর উচ্চারণ ঘোষ কিন্তু বিসর্গ (ঃ)-এর উচ্চারণ অঘোষ। বাংলায় ভাষায় বিস্ময়াদি প্রকাশে বিসর্গ (ঃ )-এর উচ্চারণ প্রকাশ পায়। যেমন— আঃ, উঃ, ওঃ, ছিঃ, বাঃ ।

পদের শেষে বিসর্গ (ঃ) ব্যবহার হবে না।
যেমন— ধর্মত, কার্যত, আইনত, ন্যায়ত, করত, বস্তুত, ক্রমশ, প্রায়শ ইত্যাদি।
পদমধ্যস্থে বিসর্গ ব্যবহার হবে। যেমন— অতঃপর, দুঃখ, স্বতঃস্ফূর্ত, অন্তঃস্থল, পুনঃপুন, পুনঃপ্রকাশ, পুনঃপরীক্ষা, পুনঃপ্রবেশ, পুনঃপ্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।

শব্দকে সংক্ষিপ্ত রূপে প্রকাশে বিসর্গ ব্যবহার করা হলেও আধুনিক বানানে ডট ( . ) ব্যবহার করা হচ্ছে।
যেমন—
ডাক্তার>ডা., ডক্টর>ড., লিমিটেড> লি. ইত্যাদি।
বিসর্গ যেহেতু বাংলা বর্ণ এবং এর নিজস্ব ব্যবহার বিধি আছে—তাই এ ধরনের বানানে (ডাক্তার>ডা., ডক্টর>ড., লিমিটেড> লি.) বিসর্গ ব্যবহার করা যাবে না। কারণ বিসর্গ যতিচিহ্ন নয়।

সতর্কীকরণ: বিসর্গ (ঃ)-এর স্থলে কোলন ( : ) কোনোভাবেই ব্যবহার করা যাবে না।
যেমন— অত:পর, দু:খ ইত্যাদি। কারণ কোলন ( : ) কোনো বর্ণ নয়, চিহ্ন।
যতিচিহ্ন হিসেবে বিসর্গ (ঃ) ব্যবহার যাবে না।
যেমন— নামঃ তানজিনা তানিয়া থানাঃ সিংড়া জেলাঃ নাটোর।

বাংলা বানান বিভ্রান্তি । সেলিম রেজার ধারাবাহিক বানান শিক্ষা। পর্ব – ০২

বাংলা বানান নিয়ে বিভ্রান্তির হার বেশ ভয়াবহ। সেখান থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিবে সেলিম রেজার সহজ বানান শিক্ষা। পরবর্তী পর্বগুলো ক্রমানুসারে প্রকাশ করা হবে

 

আত্মপ্রকাশ সম্পাদক

http://attoprokash.com

আত্মপ্রকাশে অপ্রকাশিত গল্প এবং বুক রিভিউ এবং প্রবন্ধ প্রকাশ করতে যোগাযোগ করুন (ইমেইল-attoprokash.blog@gmail.com) অথবা ফেইসবুক পেইজ ইনবক্স। সর্বনিম্ন ১০০০ শব্দ হতে যেকোনো ঊর্ধ্ব সীমার ছোট গল্প গ্রহণযোগ্য। আপনার গল্প আত্মপ্রকাশ বিচারকদের দ্বারা নির্বাচিত হলে আপনাকে জানানো হবে এবং তা সরাসরি প্রকাশ করা হবে আত্মপ্রকাশে। আপডেট জানতে ফেইসবুক গ্রুপে সক্রিয় থাকুন।

1 Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *