উপঢৌকন । আরিফ মিলন । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প

আরিফ মিলনের লেখা  ‘উপঢৌকন‘ ছোটগল্পটি আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প প্রতিযোগিতা – ১ এ চতুর্থ স্থান অর্জন করে এবং পাওলো কোয়েলহোর লেখা আন্তর্জাতিক বেস্টসেলার ‘দ্য এ্যালকেমিস্ট‘ বইটি জিতে নেয়।

।।এক।।
আজ ঈদের পরের দিন। মাহবুব আজ স্বস্ত্রীক শশুর বাড়ি যাবেন। ঝড় বাদলের দিন। কখন আকাশ কালো করে ঝড় উঠে আসে, বৃষ্টি নেমে বসে বলা যায় না। আর এজন্যই সকাল সকাল রওনা দেয়া বিশেষ প্রয়োজন। তার স্ত্রী বার বার করে অনুরোধের ভঙ্গিতে আবদারের সুরে গতরাত থেকেই জানিয়ে আসছেন সাম্প্রতিককালের আবহাওয়ার খবরাখবর। যদিও খুব বেশি দূরে নয় পিত্রালয়। মাইল তিনেকের পথ। হরহামেশাই নানান খবরাখবরে কারণে অকারণে যাওয়া পড়ে। কিন্তু গত পনের দিন হলো মায়ের বাড়ি যাওয়া হয় নাই। তবু অন্য সময়ে আর ঈদের সময়ে মায়ের বাড়ি যাওয়া এক কথা নয়। যারপরনাই মাহবুবের স্ত্রী খুবই উত্তেজিত এবং প্রকাশে কিছুটা উদগ্রীব।

মাহবুবের রাজ কপাল। শালা, শালী আর সুমুন্দিতে ভরপুর শশুড়বাড়ি খাসা খানদানী বংশ। সবাই বড় বড় সরকারী বেসরকারি অফিসের অফিসার। সে হাইস্কুলের সামান্য একজন অংকের শিক্ষক হলেও সবার কাছেই তার সমান কদর। এক বাপের দুই মেয়ে কিন্তু বড় জামাই বলে কথা। বড় মেয়ে হিসেবে বাবার অপত্য স্নেহের নিরুঙ্কুশ অংশীদার মাহবুবের স্ত্রী। তাই তো তার স্ত্রীর নাম মণি। চোখের মণি। বাবার দেয়া আদরের নাম। হাইস্কুলের অংকের শিক্ষক হিসেবে শশুড়বাড়ির সামাজিকতা রক্ষা আপাত দৃষ্টিতে কষ্টকর মনে হলেও ঐ রকম কোন সমস্যা নেই। পর্যাপ্ত সাপোর্ট আছে সবার পক্ষ হতে। কই মাছের তেল দিয়ে কই মাছ কীভাবে ভাজা যায় সেই সমন্ধে তার স্ত্রীর যথেষ্ট জ্ঞ্যান আছে। সেভাবেই তিনি তার স্বামীকে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে পরিচালিত করেন।

রোযা শুরু হওয়ার আগেই নানান জনের পক্ষ হতে নানান রকম উপঢৌকন তার গৃহে আসা শুরু করেছে। শার্টের পিস, প্যান্টের পিস। পান্জাবী-পাজামা। জুতো স্যান্ডেল। সবকিছু। সাথে নগদ অর্থও। সমানভাবে স্ত্রীর জন্যও। জনে জনে ফোন কল আর জনে জনে দাওয়াত। সকালে শাশুড়ি ফোন দিলে বিকেলে শশুড়। রাতে আবার উভয়ের যুগল ফোন। অন্যরা তো আছেই। সবার এক দফা এক দাবী, ঈদ তাকে তার শশুড় বাড়িই করতে হবে। সকলের এই উদার ভালবাসাকে নানা অজুহাতে ঈদের দিন পর্যন্ত উপেক্ষা করা গেলেও তারপরে আর বিলম্ব করা নিতান্তই অনুচিত। অতএব পরের দিন সকাল সকাল শশুড় বাড়ি অভিমুখে রওনা দেয়া অবশ্য কর্তব্য।

তার স্ত্রী সকাল হতে চড়ুইপাখির মত সারাবাড়ি ফুরুৎ ফুরুৎ করে উড়ছে। অল্প সময়েই তার সমস্ত কিছু গোছানো সুসম্পন্ন। নিজেও প্রায় প্রস্তুত। চোখে একটু কাজল আর ঠোটে লিপষ্টিক দিলেই হয়। মাহবুবও প্রস্তুত। বড় সুমুন্দির দেয়া শার্ট প্যান্টে তাকে দারুণ মানিয়েছে। “বড় ভাইয়ের চোখের পছন্দ এখনও ঝকঝকে”, বলছিলেন তার স্ত্রী। মাহবুব বলছিল, ছোট শ্যালকের দেয়া জুতোর কথা। ছোট শ্যালক নতুন চাকরী পেয়ে ঈদ উপলক্ষে তাকে কালো রঙের দামী জুতো কিনে দিয়েছে। “পোশাক যত ভালই হোক, জুতা যদি মনের মত না হয় তবে ভাব আসে না”, মাহবুবের স্পষ্ট মতামত। আর একটা জিনিস তার খুব পছন্দ হয়েছে। একমাত্র শ্যালিকার দেয়া হাত ঘড়ি। হাতটাকে বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। টাইটানের ঘড়ি। সাড়ে ছয় হাজার টাকা দাম। তার একমাত্র ছোট শ্যালিকা খরচ বাঁচিয়ে তার জন্য কিনেছে। ছাত্র জীবন থেকেই খুব শখ ছিল হাতে ঘড়ি লাগানোর। কিন্তু কখনো হয়ে উঠেনি। অপূর্ণ স্বাদকে পূর্ণতায় পরিপূর্ণ তা সকলের কাছেই দৃশ্যমান।

মাহবুব নিশ্চিত তাদের জন্য কেনা এই জিনিসগুলো পছন্দ করেই কেনা। দাম দেখে কেনা নয়। দাম দেখে কোন কিছু কিনলে সত্যিকার অর্থে তা পছন্দ হয়েছে কিনা তার নিশ্চয়তা দেয়া দূরুহ। দাম দেখে নয়, মান দেখেই এগুলি কেনা হয়েছে মাহবুব সে বিষয়ে নিশ্চিত। শশুড়কুল তার জন্যে যেখানে এত এত কিছু করে সেখানে সে যা কিছু করেছে তা যৎসামান্য। সেও সবার জন্যই কেনাকাটা করেছে। সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা বোনাস পেলেও ঈদের কেনাকাটা প্রায় চারগুণ। যারা তার জন্য পাঁচ টাকার সম্মান দেখিয়েছে সেখানে তাদেরকে দুই টাকার সম্মান না দেখালে আত্বসম্মানবোধে কড়া আঘাত হানে। এবিষয়ে তার স্ত্রী তড়িৎকর্মা। বাপ, ভাই, বোন, ছোট থেকে বড় সবার জন্যই রয়েছে কিছু না কিছু। বাদ যায়নি কাজের মেয়েটাও। কিছু না কিছু দিতে না পারলে নিজ বাড়িতে স্ত্রীর মান থাকে কোথায় আর তারই বা শশুড় বাড়ির সম্মান কিভাবে রক্ষা পায়?

শশুড়ের দেয়া গাঢ় লাল রঙের মোটর সাইকেল যোগে সকাল সকাল রওনা দিয়ে সকাল সকাল স্বস্ত্রীক শশুড়ালয় পৌঁছালেন মাহবুব। সকলের উষ্ণ অভ্যর্থনায় সিক্ত হলেন। পিতৃালয়ে পৌছে তার স্ত্রী যেন প্রাণ ফিরে পেল। মাঝে মাঝে যেই স্ত্রী নিশ্চল হয়ে যায় সেই স্ত্রী আজ তিনদিন যাবৎ সদা হাস্যোজ্জল, দূর্বার চঞ্চল। ফড়িংয়ের ন্যায় উড়ে, কাঠবিড়ালির মত নড়চড়ে। তাছাড়া শশুর বাড়ি আসলেই মাহবুবের প্রতি তার স্ত্রীর দায়িত্ব যায় কমে। মাঝে মাঝে সামনে এসে হাজিরা দিয়ে যাওয়া আর সেই সাথে এই বাড়ির নানান জনের সমন্ধে নানান ধরণের মূল্যহীন গল্প করে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন কাজ নেই। মা কি বলল, ভাইয়েরা কি করল, ভাই বউ গুলো কোন কোন মজার ঘটনা ঘটালো। হাসিমুখে তার সবিশেষ বর্ণনা। স্ত্রীর হাসিমুখ দেখে মাহবুব সাহেবের মনে প্রশান্তি জাগে। ইস্ আপন গৃহে বউ যদি এমনই হাসি খুশি থাকত। কেন থাকে না, কেন পারে না সে প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই।

তার সেবা যত্নের ভার বহনের জন্যে শ্যালক-শ্যালিকারা সর্বদা দন্ডায়মান। আর শাশুড়ী মহাশয়া ঐদিকে অন্ন ব্যঞ্জনে ভারী ব্যস্ত। খাওয়া দাওয়া তো নয় যেন রাজভোগ। সকালে ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই হরেক রকমের নাস্তার আয়োজনে নাস্তানাবুদ হওয়ার যোগাড়। তার কিছু পরেই সকালের খাবার। দুপুরের ভারী খাবারে পেট এত ভারী হয়ে উঠে যে তা হালকা করার জন্য পেট মহাশয় রীতিমত ব্যাকুল হয়ে উঠে। রাতের খাবার বাদই দিলাম। মাহবুবের নিজেকে মাঝে মাঝে গরু মোটাতাজা করণ গরুর খামারের একজন গর্বিত সদস্য মনে হয়। সবার এত এত আদর সম্মানে সে নিজেকে খাঁচায় পোষা পাখিও মনে করে। বিশেষভাবে শ্যালক-শ্যালিকারা যখন তার সেবা করে। মনে হয় সে খাচায় বন্দী পাখি আর তাকে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েগুলো মনের আনন্দে খাবারের দানা দিয়ে যাচ্ছে আর খেলা করছে।



সবকিছুতেই সবার উপর্যুপরি তদারকি আর বাড়াবাড়ি রকম আতিথেতায় প্রশান্তচিত্তের বদলে অন্তর যেন ক্লিষ্টতায় আকর্ণ পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। অতিরিক্ত ভালবাসা আর বাড়াবাড়ি সম্মান প্রাপ্তির ক্লান্তি নেহায়েত কম নয়। তথাপি এই সকল বিষয়ে কারও কাছে অভিযোগও করা যায় না, মন খুলে সমস্যার কথা বলা যায় না। চতুর্দিকে যেখানে শুধু না পাওয়ার হাহাকার, সেখানে পাওয়ার ব্যথায় কাতর এক নিরীহ ব্যক্তির কথা কেইবা শুনবে। আর সেই কোন সাহসে বলে।

।।দুই।।

তিন দিন হলো মাহবুব শশুড় বাড়িতে আছেন। আজ বাড়ি ফিরতে চাইছেন। স্ত্রীকে বললেন, “আবহাওয়ার অবস্থা বিবেচনায় সকাল সকাল রওনা হওয়া দরকার।” তাঁর কথায় স্ত্রীর সম্মতি আছে কিন্তু কার্যক্রমে তার কোন লক্ষণ নেই। কিছু সময় পরে যখন তার শাশুড়ি আসলেন তখন স্ত্রীর স্থবিরতার প্রকৃত কারণ স্পষ্ট হয়ে উঠল। তার শাশুড়ি জোর গলায় অধিকারের সুরে বললেন, ” আজ নাকি বাড়ি যাবে মাহবুব? হঠাৎ করে আজ যাবে কেন? মণি তো কিছু বলল না।” অনুযোগের সুরে বললেন, “রাগ করনি তো বাবা? তোমাদের মধ্যে কোন কিছু হয়নি তো”। মাহবুব লজ্জা পেল। বলল, “না মা, তা হবে কেন! আমরা যে আজ যাব তা আপনার মেয়ের সাথে আগে থেকেই তো ঠিক করা।” মাহবুবের শাশুড়ি তার মেয়ের দিকে তাকাতেই সে চোখ ফিরিয়ে নিল। তিনি আন্দাজ করতে পারলেও বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন। তিনি বললেন, “সে যাই হোক বাবা! এভাবে হঠাৎ করে যাওয়া যাবে না। সবাই আছে। কবে আবার সবাই এক হবে তার ঠিক নেই। আর দুদিন থাক, তারপরে যাওয়া যাবে।” মাহবুব অত্যন্ত ভদ্রতার সাথে বললেন, “তিন দিন তো থাকলাম মা। আমার একটু যাওয়া দরকার। আবার আসব।”

শাশুড়ি অবশেষে রাজী হলেন কিন্তু দুটি শর্তে। প্রথমত, তার জন্য রাজহাঁসের মাংস রান্না হচ্ছে। দুপুরে না খেয়ে যেতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, মাহবুবের স্ত্রী এক দিন বাদে যাবেন। সবাই আছে। আজ গেলে সবাই খুব মন খারাপ করবে। অগত্যা তার স্ত্রীকে রেখে যাওয়ার ব্যাপারে সম্মতি দিলেন। দিলেন বললে ভুল হবে, দিতে হলো। মাহবুবের ফেরার খবরে অনেকেই একটু আধটু অসন্তুষ্ট হলো। সকলের অভিযোগ, অনুযোগের প্রকাশ বিস্তর। তবু আজ আর থাকতে পারলেন না। স্ত্রী সাথে না যাওয়ায় কেন যেন মন খারাপ হলো। অসন্তুষ্ট হলেন কিন্তু অসন্তোষ প্রকাশ করলেন না। মনের ক্ষোভ মনেই রাখলেন, কাউকে বুঝতে দিলেন না। যাওয়ার সময় স্ত্রীকে একা পেয়ে অল্প কথায় বললেন, “পরশু একটু তাড়াতাড়ি এসো। বেশি দেরী করো না”। সবার সাথে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে শশুরালয় ত্যাগ করলেন।

।।তিন।।

মাহবুবের মন আজ বিষন্ন। বিষন্ন হবার এমন কোন কারণ নেই। তবু সন্ধ্যা থেকেই মন ভীষণ রকমভাবে বিক্ষিপ্ত, খানিকটা চিন্তিত। ঘুমানোর জন্য আলো নিভিয়ে শুয়ে আছেন। অন্ধকার ঘর। সামান্য আলো থাকলেও তিনি ঘুমিয়ে শান্তি পান না। অথচ ছোট বেলায় ঘরময় আলো না থাকলে ঘুমাতে পারতেন না। ভয়ে গা ছম ছম করত। গাঢ় অন্ধকারের শান্ত পরিবেশেও তার মন উসখুস করছে, শরীরে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিছানা থেকে উঠে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি পান করলেন। পানি পানে নাকি চিন্তা মুক্ত হওয়া যায়। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আরেক গ্লাস পানি পান করে জানালার বাইরে জাম গাছটার দিকে তাকালেন। মাহবুবের কেন যেন মনে হচ্ছে কোন কিছুই তার নয়। এমনকি সে নিজেও নিজের নয়। নিজের বলতে কিছুই নেই তার। সবকিছুই অন্যের। অন্ধকার ঘরে শুয়ে শুয়ে সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, দিনে দিনে সে কিভাবে অন্যের হয়ে গেছে। বিখ্যাত মানুষেরাও অন্যের হয়। নিজেকে বিসর্জন করে অন্যের কল্যাণে। কিন্তু মাহবুব অন্যের হয়েছে বিক্রি হয়ে।

অন্ধকার ঘরে বিছানা হাতড়ে মেহগনি কাঠের খাট স্পর্শ করেন। ঘরের চতুর্ময় বহুমূল্যের মেহগনি কাঠের তৈরি দামী আসবাবপত্র। ড্রেসিংটেবিল, ওয়্যারড্রোব, সোকেস, সোফাসেট, ডাইনিং টেবিলসহ যাবতীয় রকম অত্যাধুনিক ফার্নিচার এবং বিলাস ব্যসনের উপকরনাদি দ্বারা তার পুরো আবাসভবন সুসজ্জিত। এসবের সবকিছুই তার শশুরবাড়ি থেকে প্রাপ্ত। তার স্ত্রী যেদিন পৃথিবীর বুকে ভূমিষ্ট হয়, সেদিন নাকি তার শশুর মহাশয় তিনটি মেহগনি গাছের চারা রোপণ করেছিলেন। সেই তিনটি গাছ কেটে মেয়ের বিয়ের সময় বেড রুম, ড্রয়িংরুম, কিচেনরুমসহ সক্কল প্রকার রুমের সর্বপ্রকার ফার্নিচার তৈরি করে একদিন বিকেলে ছোট ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন জামাই বাড়িতে।

এভাবেই একদিন সকালে টিভি, ফ্রীজ আসে, আরেকদিন বিকেলে মোটরসাইকেল এসে হাজির। অন্য আরেকদিন ঘর গেরস্থালির জন্য ঝাড়ু হতে শুরু করে যত প্রকার সামগ্রী দরকার তার সবই আসলো। পালা করে সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে তিন চার বার এত প্রকারের এত এত জিনিস আসলো যে তা রাখার রীতিমত স্থানাভাব দেখা দিল। যে জিনিসের যে রকম মর্যাদা তাকে সেরুপ স্থানে রাখা দরকার। অন্যথায় তা সৌন্দর্যবর্ধনের পরিবর্তে সৌন্দর্যহানি করে। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটলো। মাহবুবের পিতার বহুকষ্টে উপার্জিত অর্থে সদ্য নির্মিত দোচালা টিনের মাত্র তিনটি দালান ঘর ঐ সকল বহমূল্যের আসবাবপত্র ধারণ করবার পক্ষে যথেষ্টই অনুপযোগী।

কোন মেয়ে তার সংসারে কোন প্রকার কষ্টে থাকুক তা পৃথিবীর কোন বাবা-মা চান না। মাহবুবের শশুড় তো আরও পারেন না। একদিন মেয়ে বাড়ি বেড়াতে আসলেন। তিনি দেখতে পেলেন তার পাঠানো উপহারসামগ্রী স্থানাভাবে যত্নহীন সাজানো গোছানো। মনমত সাজানো না থাকায় মনে মনে কষ্ট পেলেন। মাহবুবের শশুড় খুব ভাল মানুষ। মেয়ের জন্য তার মন আরও বড়। বিনয়ের অভাব নাই। বেয়াইকে হাতজোড় করে বললেন, “একটি কথা বলতাম যদি আপনি কিছু মনে না করেন।” অতি বিনয়ের সাথে বুঝিয়ে বললেন যে, তিনি তিনি তার জামাতার জন্য একটি ফ্ল্যাট বাসা নিজ ব্যয়ে তৈরি করে দিতে চান যদি তার অনুমতি থাকে। এটাও বলতে ভুললেন না যে, সেই বাসায় সবাই মিলে মিশে থাকুক এটাই তার একান্ত মনস্কামনা। মান্যলোকের মান রাখতে অনেক সময় চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ মেলে না। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটলো।

ছয় মাসের মধ্যে মাহবুবের বাবার জায়গায় শশুরের অর্থায়নে সুদৃশ্য ফ্ল্যাট উঠে গেল। গ্রামময় আলোচনা এমন ব্যাপকতা লাভ করল যে, তার শশুরের দেয়া ফ্ল্যাটবাড়ির নিচে তার বাবার দেয়া ভিটে মাটি চাপা পড়ে গেল। পাড়া মহল্লার মোড়ে, বাজারের চা স্টলে সুদৃশ্য ফ্ল্যাটের আলোচনা শোভা পেল। সব আলোচনা শেষে মাহবুবের শশুড় কত বড় বিত্তশালী লোক আর তার মন কতখানি সুবিশাল তাই পরিচিতি পেল। এলাকার ছেলে হিসেবে মাহবুবের স্বভাব চরিত্রের সুনাম সর্বজনবিদিত। অনেকেই বলাবলি করলো এমন ছেলের ভাগ্যে এমন শশুর জুটবে নাতো কার ভাগ্যে জুটবে। অনেকেই নিজেদের সাথে তুলনা করে পরিতাপ করতে লাগলো। অনেকেই আবার এমন ভাল ছেলেটা বিক্রি হয়ে গেল বলে আক্ষেপ করতে লাগলো।

মাহবুব তার বাবা মাকে আর সেই ফ্ল্যাটে আনতে পারলেন না। যে বাড়িতে সারাজীবন কাটিয়েছেন, যে মাটি তার পূর্ব পূরুষের আবাসস্থল সেখান হতে তারা নড়বেন না। পিতা-মাতার এই মনস্কামনা মাহবুব আগে থেকে বুঝতে না পাড়ায় অনুতাপে পুড়তে লাগলো। এসবই পুরাতন কথা আজ নতুন করে কানে বাজতে লাগলো।

মাহবুবের আজ নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। নিজের জায়গায় বাড়ি অথচ নিজের নয়। তার ভিতরে বাহিরে বহুমূল্যের যা কিছু আছে তার সবই শুরু থেকে আজ অব্দি নানা সময়ে নানা উপলক্ষে শশুরের পাঠানো বিশেষ উপহার। সে নিজে যে পোশাকগুলো পড়ে সেগুলোর অধিকাংশই শশুরবাড়ির দেয়া। চার জোড়া জুতার তিন জোড়াই তার শশুর বাড়ির পক্ষ হতে প্রাপ্ত। যা কিছু দৃশ্যমান তার সবই শশুরের। শুধু ভিতরের গুলোই নিজের। মাহবুব এসবের কোন কিছুই চেয়ে নেয়নি। খুশি মনে ভালবেসেই নানা সময়ে নানা ভাবে তার শশুর বাড়ি হতে পাঠানো। কিন্তু আজ তার মনে হচ্ছে, খুশি মনে দিলেই খুশি হয়ে সবকিছু নিতে নেই। অন্যথায় বিক্রি হতে হয় প্রত্যক্ষ নয়তবা পরোক্ষভাবে।



মাহবুবের স্ত্রীকে খারাপ বলা চলে না। শশুর-শাশুড়িও ভাল, সজ্জ্বন। সবাই ভাল। তার ব্যাপারে কেউ কখনো বিরুদ্ধাচরণ করেনি। আতিথেয়তায়, আন্তরিকতায় কারও কোন কমতি নেই। আর এই কমতি না থাকাই তাকে যেন তারা কিনে নিয়েছে দিনে দিনে। তার প্রতি শশুরকুলের অকৃত্রিম ভালবাসা এবং আন্তরিকতার প্রতিদানে কখন যেন সে নিজে তাদের প্রতি অত্যধিক যত্নশীল হয়ে পড়েছে। বুঝতে পারেনি কখনো। দেয়ালের একপাশে থাকলে আরেকপাশ অগোচরে থেকে যায়। একদিকের যত্নে আরেকপ্রান্ত হয় অবহেলার শিকার। এসব কিছুই আজ মনে হচ্ছে মাহবুবের মনে।

তাঁদের কাছাকাছি থাকতে গিয়ে নিজের পিতা মাতাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে মনের অজান্তেই। ব্যাপক না হলেও অল্প অবহেলা তৈরি হয়েছে কোন না কোন ভাবে। মাহবুব এবারের ঈদেও বাবার জন্য একটি ধবধবে সুন্দর পাঞ্জাবী, আর মায়ের জন্য একটি নীল পাড়ের টাঙ্গাইলের শাড়ী কিনে দিয়েছে। তবু মনে হচ্ছে কোথাও কোন ঘাটতি ছিল। কমতি ছিল কোথাও না কোথাও, কোন কিছুর। মাহবুবের বুকের ভেতরটা খচখচ করে। আসলেই তো। সবার কেনাকাটায় কতশত পরিকল্পনা হলো, আলোচনা হলো। কার কোন রঙ পছন্দ, কার কোন সূতায় স্বাচ্ছন্দ্য, কে কোনটায় খুশি হবে। কিন্তু বাবা মায়ের বেলায় তো কোন আলোচনা করার সুযোগ পায়নি। মাহবুবের মনে হল, দিতে হবে তাই তালিকায় কিছু একটা লিখে দেয়া ছাড়া কিছু হয়নি। ঈদও বাবা মায়ের সাথে ঐভাবে করা হয়নি। যেভাবে করা উচিত। সে যেন সবকিছুই করেছে দায়সারাভাবে। কোন কিছুই যেন মন থেকে নয়।

মাহবুব বিছানা থেকে উঠলো। অনেক খুজে খুজে একটি শার্ট পেল। এই শার্টটি তিন বছর আগে তার বাবা দিয়েছিল। চাকরী পাওয়ার আগের বছর। অনেকদিন পড়া হয়নি। এক কোণায় ভাঁজ করা ছিল। শার্টটি ময়লাটে হয়ে গেছে। তবু সেটি গায়ে তুলল। মাহবুবের মনে হচ্ছে এটিই তার ঈদের শার্ট। নিজের ভিতরে সে এক অন্য রকম অনুভূতি অনুভব করলো। ঘর থেকে বেড়িয়ে রাতের অন্ধকারে টর্চ লাইট জ্বালিয়ে এগিয়ে চলল।

মাহবুব বাড়ির গেটে কড়া নাড়ল। তার মা গলা উচিয়ে বললেন, গ্যাদা আইছস? মাহবুব অবাক হয়ে ভাবলো, তার মা কি জানত সে আসবে? তার তো আসার কথা ছিল না। প্রচন্ড গরমে বাড়ির উঠোনে বাবা মা বসে আছে। তাঁদের সাথে সেও বসলো। আজ কি রান্না হয়েছে জিজ্ঞাসা করলো। সে ভুলেই গিয়েছিল আজ রাতে তার খাওয়া হয়নি। তার মা ব্যস্ত হয়ে বললেন, “তোর বাপ কইলো আজ তুই আইবি। তাই টাকি মাছের ভর্তা করছি, ঢেড়স ভাজি আর মসুর ডাল। গরুর গোস্তও রাখছি তোর জন্যে। যা যা অনেক রাত হইছে, হাত মুখ ধুইয়া আয়”। অন্ধকারে মাহবুবের চোখের জল দেখা গেল না। জিজ্ঞাসা করা হলো না, আজ সে আসবে এমন কথা তো তার বাবাকে বলে নাই সে। কল তলায় মুখ ধুতে ধুতে গলা উচিয়ে মাকে বলল, মাগো মণি আজ আসে নাই। আইজ আর বাড়ি যামু না। নাও আইজক্যা আমরা পাটি পাইড়া উঠানে ঘুমাই। কারেন্টও নাই। দক্ষিন দিক থাইক্যা দেখো কেমন ঠান্ডা বাতাস ছাড়ছে।

”মা, তোমার মনে আছে আমরা যেদিন নানীর বাড়ি যাইতাম সেদিন ফজরের আগেই ঘুম ভাইঙ্গা যাইত”- জিজ্ঞাসা করে মাহবুব। “আব্বা, আপনার মনে আছে? আপনার দুই পায়ের মধ্যেখানে আমার পা দুইট্যা নিয়া মাথাটা বুকে কইর্যা্ ঘুমাইতেন”। মাহবুবের আজ যেন সকল লজ্জা মুছে গেছে, ঘুচে গেছে সকল দ্বিধা, সংকোচ। বিড়বিড় করে হরেক রকমের স্মৃতিতে ভাসিয়ে তুলেছে বাড়ির উঠোন। আর তার বাবা-মা সেই আগের মতই জবাব না দেয়ার মত করে দিতে দিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তা সে বুঝতেই পারেনি। মাহবুব আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার ভাবনার আকাশ বিস্তার লাভ করে।

একজন মানুষের আত্বমর্যাদাটুকুই যদি না থাকে তবে নিজের বলতে আর কি অবশিষ্ট থাকে? নিজেই যদি সে নিজের না হয় তবে সে অন্যের। আর সেই অন্যজনই যদি তার নিজের না হয় তবে সে কার জন্য, কিসের জন্য? বললেই তো বলা হয় না আবার না বললেও বলা হয়ে যায় কতকিছু। কিনলেই কি কেনা যায় সবকিছু? এজীবন তো তাদেরই যাদের থেকে তার শুরু, এজীবন তো তাদের জন্যই যাদের জীবন তার থেকে শুরু, যাকে নিয়ে শুরু। কেউই তো পর নয়, সবাই আপন।

মাহবুব অস্ফুট স্বরে ধরা গলায় মনে মনে বলে, “ক্ষমা করে দিও মা।”

আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প প্রতিযোগিতা – ১ এ পঞ্চম স্থান অর্জনকারী ‘লাল জামা’ সামাজিক ছোটগল্পটি পড়তে ক্লিক করুন>>> লাল জামা । আসিফ আহমেদ । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প

উপঢৌকন । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প । লেখক পরিচিতি

লেখকঃ আরিফ মিলন
ছোটগল্পঃ উপঢৌকন
গল্পের জনরাঃ সামাজিক
দেশের বাড়িঃ নাটোর
পড়াশোনাঃ বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং। (বর্তমানে একটি বেসরকারী কম্পানিতে চাকুরীরত)

আরিফ-মিলন-arif-milon-attoprokash-writter
লেখক – আরিফ মিলন

লেখার মাধ্যমে সামাজিক অসংগতিগুলো তুলে নিয়ে আসাই আরিফ মিলনের মূল লক্ষ্য। তাঁর মতে- “সঠিক সামাজিক পরিবর্তনের জন্য হাস্যরসাত্বক বিনোদন নির্ভর নয়, সঠিক বোধ এবং রস সম্পন্ন সাহিত্য সংস্কৃতির পরিচর্যা করা আবশ্যক”। সে লক্ষ্যে তিনি অনবরত কাজ করে যাচ্ছেন।

আত্মপ্রকাশ সম্পাদক

http://attoprokash.com

আত্মপ্রকাশে অপ্রকাশিত গল্প এবং বুক রিভিউ এবং প্রবন্ধ প্রকাশ করতে যোগাযোগ করুন (ইমেইল-attoprokash.blog@gmail.com) অথবা ফেইসবুক পেইজ ইনবক্স। সর্বনিম্ন ১০০০ শব্দ হতে যেকোনো ঊর্ধ্ব সীমার ছোট গল্প গ্রহণযোগ্য। আপনার গল্প আত্মপ্রকাশ বিচারকদের দ্বারা নির্বাচিত হলে আপনাকে জানানো হবে এবং তা সরাসরি প্রকাশ করা হবে আত্মপ্রকাশে। আপডেট জানতে ফেইসবুক গ্রুপে সক্রিয় থাকুন।

5 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *