বাংলা বানান বিভ্রান্তি । সেলিম রেজার ধারাবাহিক বানান শিক্ষা। পর্ব – ০৭
সমৃদ্ধ বাংলা ভাষায় অসংখ্য বানান নিয়েই আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে। যা কোনো ক্ষেত্রে আমাদের বানানের ব্যবহার না জানার কারণে হয়ে থাকে। আবার কিছু বানান বিভ্রান্তি ব্যকরণ গঠিত কারণেও হয়ে থাকে। সেলিম রেজার ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত, বাংলা বানান নিয়ে বিভ্রান্তিকর কিছু পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার তথ্যমূলক পোস্টের সপ্তম পর্ব আত্মপ্রকাশে প্রকাশ করা হচ্ছে। বাকী পর্বগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ করা হবে।
বাংলা বানান বিভ্রান্তি এবং বানান সংশোধন । সেলিম রেজা । পর্ব – ০৭
রচনার ভাগসমূহ
উল্লেখ্য যে, আমি কোনো ভাষাবিদ বা বানান বিশেষজ্ঞ নই। ভাষা ও বানান নিয়ে লিখিত বিভিন্ন, বইপুস্তক, জার্নাল থেকে সংগ্রহ এবং গুণীজনদের সাথে আলোচনা করে আপনাদের সুবিধার্থে এই পোস্টটি সাজানোর চেষ্টা করেছি। কারো কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট বক্সে করতে পারেন। যথাযথ উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবো। এই পোস্টে কি কি জানতে পারবেন তার একটি তালিকা নিচে দেয়া হলো –
- ত এবং ৎ এর ব্যবহার
- স্ত এবং স্থ এর ব্যবহার
- সময় নির্দেশে কিছু ভুল প্রয়োগ
- এখনি এবং এখনই এর ব্যবহার
- হস্ চিহ্নের ব্যবহার
- সচরাচর ভুল হওয়া কিছু বানান বিভ্রান্তি
ত এবং ৎ এর ব্যবহার
তৎসম শব্দের শেষে যদি ‘ৎ’ থাকে তবে সেটা বহাল থাকবে।
যেমন-
বিদ্যুৎ, জগৎ, হঠাৎ ইত্যাদি।
কোনো প্রত্যয়ের শেষে যদি ‘ৎ’ থাকে তবে সাধিত শব্দের শেষেও ‘ৎ’ বসবে।
যেমন-
আত্মসাৎ, ধুলিস্যৎ, চলৎ, বৃহৎ, মহৎ, জগৎ, কদাচিৎ, কিঞ্চিৎ, অভিজিৎ, ইন্দ্রজিৎ, সত্যজিৎ, পিতৃবৎ, পথিকৃৎ, অর্থাৎ, ঈষৎ, অকস্মৎ, পশ্চাৎ, মৃৎ, শরৎ ইত্যাদি
আবার যেসব শব্দের শেষে ‘ৎ’ আছে এদের সাথে ‘এ’ বা ‘এর’ বিভক্তি যোগ করা হলে ‘ৎ’ এর বদলে ‘ত’ বসাতে হবে।
যেমন-
ভবিষ্যৎ + এ= ভবিষ্যতে
ভবিষ্যৎ +এর= ভবিষ্যতের
স্ত এবং স্থ এর ব্যবহার ( দূর্নীতিগস্ত নাকি দূর্নীতিগস্থ)
অভ্যস্ত শব্দ থেকে যদি ‘স্ত’ বাদ দিয়ে দেয়া হয় তবে বাকী থাকে ‘অভ্য’ যার কোনো অর্থ নাই।
যে সমস্ত শব্দের শেষে স্ত বাদ দিলে কোন অর্থবোধক শব্দ পাওয়া যায় না। সেখানে ‘স্ত’ বসাতে হয়।
যেমন-
অভ্যস্ত, গ্রস্ত, ন্যস্ত, পরাস্ত, ক্ষতিগ্রস্ত, বিন্যস্থ, আশ্বস্ত ইত্যাদি।
আবার যে সকল শব্দ থেকে ‘স্থ’ বাদ দিলেও শব্দটির অর্থ থেকেই যায় সেগুলোতে ‘স্থ’ বসাতে হবে।
যেমন-
কণ্ঠস্থ, গৃহস্থ, মুখস্থ, সমাধিস্থ,পদস্থ, নিকটস্থ, প্রকৃতস্থ, মনস্থ, ঢাকাস্থ, বক্ষস্থ ইত্যাদি।
ক্রিয়াবিশেষণের শেষে অধিকন্ত অর্থে ‘ও’ ব্যবহার করা উচিত।
যেমন-
শুদ্ধ বানান- অশুদ্ধ বানান
আজও- আজো
আবারও- আবারো
আরও- আরো
তেমনও- তেমনো
তারও- তারো
কারও- কারো
কালও- কালো
এমনও- এমনো
এমনও- এমনো
সময় নির্দেশে কিছু ভুল প্রয়োগ
পরবর্তীতে – পরবর্তী সময়ে, পরবর্তী কালে বা পরে লিখতে হবে।
তেমনি কিছু ভুল প্রয়োগ-
আগামীতে- ভবিষ্যতে, আগামী দিনে,
পূর্ববর্তীতে- পূর্ববর্তী সময়ে, আগে
চলাকালীন – চলাকালে, চলার সময়ে
থাকাকালীন – থাকাকালে, থাকার সময়ে।
আরো এবং আরও এর ব্যবহার
অধিকন্তু অর্থে ব্যবহত ‘ও’ প্রত্যয় শব্দের সঙ্গে কার- চিহ্ন রূপে যুক্ত না হয়ে পূর্ণ রূপে শব্দের পরে যুক্ত হবে। যেমন-
ইতোমধ্যে আমি অনেক বেশি খাবার খেয়ে ফেলেছি কিন্তু আরও (অধিক অর্থে) খাবার খেতে চাই।
এরকম- আবারও, কারও, তোমারও, আমারও ইত্যাদি।
এখনি এবং এখনই এর ব্যবহার
‘এখনি’ শব্দের ইংরেজি Anon, যার অর্থ শীঘ্রই।
আবার ‘এখনই’ শব্দের ইংরেজি Already যার বাংলা অর্থ ইতোমধ্যে।
ক) আমাকে এখনি (শীঘ্রই) বাড়ি যেতে হবে।
খ) এখন রাত সাড়ে বারোটা। তোমার এখনই ঘুমানো উচিত।
ব্যবহারে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও দুটি শব্দই সঠিক।
দুর্গা এবং পূজা বিভ্রান্তি
সহজ পদ্ধতি মনে রাখবেন- দুর্গা আগে না পূজা আগে? দুর্গা আসার পর পূজা হয়। তাহলে উ-কার আগে না ঊ-কার আগে? উ-কার আগে।
তাহলে যেটা আগে সেটা মনে রাখলেই এই বিভ্রান্তি এড়ানো সম্ভব।
ব্যথা না ব্যাথা, বানান বিভ্রান্তি
সঠিক বানান ব্যথা। মনে রাখার কৌশল-
ব্যথা দেখতে পাওয়া যায় না কারণ ব্যথা নিরাকার।সেই কারণে তার কোনো আকার নাই। আ-কার কিছুই লাগে না, আ-কার না দিলে ভীষণ লাগে।
হস্ চিহ্নের ব্যবহার
হস্-চিহ্ন যথাসম্ভব বর্জন করতে হবে। যেমন : কাত, মদ, চট, ফটফট, কলকল, ঝরঝর, তছনছ, জজ, টন, হুক, চেক, ডিশ, করলেন, বললেন, শখ, টাক, টক।
তবে যদি ভুল উচ্চারণের আশঙ্কা থাকে তাহলে হস্-চিহ্ন ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন : উহ্, যাহ্।
যদি অর্থের বিভ্রান্তির আশঙ্কা থাকে তাহলেও তুচ্ছ অনুজ্ঞায় হস্-চিহ্ন ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন : কর্, ধর্, মর্, বল্।
অলঙ্কার না অলংকার
অলংঙ্কার বর্জিত আর অলংকার প্রচলিত। সুতরাং অলংকার সঠিক।
কাঁদা এবং কাদা এর ব্যবহার
কাঁদা অর্থ কান্না। আর কাদা অর্থ কর্দম। সুতরাং প্রয়োজন বুঝে ব্যবহার করুন।
যেমন-
সাবিহা কাঁদছে।
তিথি কাদায় পড়ে গেল।
কুল এবং কূল এর ব্যবহার
কুল অর্থ বংশ, ফল বিশেষ।
যেমন-
কোন কুলের মেয়ে তুমি কিবা তোমার পরিচয়।
বাজারে অনেক জাতের কুল পাওয়া যাচ্ছে।
আবার কূল অর্থ তট, কিনারা।
যেমন-
দিপা ছেউটি নদীর কূলে বসে আছে।
কাঁচা এবং কাচা এর ব্যবহার
কাঁচা অর্থ অপক্ক। যেটা এখনও পাকে নাই।
যেমন-
মিজুমা আপু কাঁচা পেয়ারা পছন্দ করে।
আবার,
কাচা অর্থ ধোয়া বুঝায়।
যেমন-
বিনিতা কাপড় কাচে।
দাস এবং দাশ এর ব্যবহার
দাস অর্থ ভৃত্য বা চাকর
আবার দাশ অর্থ ধীবর বা জেলে
দাঁড়ি এবং দাড়ি
দাঁড়ি অর্থ পূর্ণচ্ছেদ। এটা বাক্যে ব্যবহার করা হয়।
অপর দিকে-
দাড়ি অর্থ শ্মশ্রু।
গুন এবং গুণ
গুন অর্থ নৌকার দাড়
আবার,
গুণ অর্থ বৈশিষ্ট, অঙ্ক বিশেষ
ভাবি এবং ভাবী
ভাবি অর্থ ভাইয়ের বউ
আবার,
ভাবী অর্থ ভাবী কাল, ভাবনা
আতেল এবং আঁতেল
আতেল অর্থ তেলহীন
আবার আঁতেল অর্থ বিদ্বান, পণ্ডিত। তবে বেশির ভাগ সময় আঁতেলকে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করা হয়।
এবার দেখি আকার নিয়ে কিছু মজার বিষয়:
আকার আছে-
অদ্যাপি
অদ্যাবধি
কিন্তু আকার নেই-
যদ্যপি
অত্যধিক
অত্যন্ত
অধ্যবসায়
অনটন
দূরদৃষ্টি
দূরবস্থা
লেখা নাকি লিখা
লেখার সাধুরূপ লিখা। চলিত ভাষা লিখতে গেলে হবে লেখা।
তার এবং তাঁর
এটি একটি সর্বনাম। এ ধরণে সর্বনামে অনেক সময় চন্দ্রবিন্দ্র দেখা যায়।
তার-এর সাথে চন্দ্রবিন্দু তখনই হবে যখন এটি কোনো সম্মানিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।
বাংলা বানান বিভ্রান্তি । সেলিম রেজার ধারাবাহিক বানান শিক্ষা। পর্ব – ০১
বানান বিভ্রান্তি নিয়ে লেখাটি আপাতত এখানেই শেষ করা হলো, তবে এই বিষয় নিয়ে আগামীতে বিস্তারিত আলোচনা করার ইচ্ছে রইল। আজ এই পর্যন্তই, সবাই ভালো থাকবেন আর আত্মপ্রকাশের সাথেই থাকবেন।
1 Comment
[…] […]