ধর্ষণ বৃত্তান্ত – আরিফ মিলন | আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত প্রবন্ধ
ধর্ষণ, ধর্ষক, ধর্ষিতা। সাম্প্রতিককালের বহুল ব্যবহ্নত এবং আলোচিত সমালোচিত তিনটি শব্দ। এই শব্দত্রয় বর্তমান সমাজে বিষফোঁড়া হয়ে বিষ বাষ্পের ন্যায় ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্নভাবে প্রচার হওয়ার পরে যেন এই ভয়াবহ সামাজিক অবক্ষয় আরও বিদ্যুৎবেগে প্রসার পাচ্ছে।
সকলের নিকট ধর্ষকের সমার্থক শব্দ পুরুষ আর ধর্ষিতার সমার্থক শব্দ নারী। অর্থ্যাৎ একমাত্র পুরুষ কর্তৃকই নারী ধর্ষিত হতে পারে। প্রশ্ন করা যায়, নারী কর্তৃক কি পুরুষ ধর্ষিত হতে পারে না? পুরুষ কি ইভটিজিংয়ের শিকার হয় না? অবশ্যই পারে এবং হচ্ছেও। এমনকি পুরুষ কর্তৃক পুরুষ কিংবা নারী কর্তৃক নারীও ধর্ষণের শিকার হতে পারে। যাকে বলাৎকার বলা হয়। এই সকল ঘটনায় পুরুষের আধিক্য এত বেশি যে, সংগাগুলো তার নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হেতু পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে দুএকজন নির্দোষ পুরুষের দোষী হওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করা যায় না।
ধর্ষণ এবং যৌন সংসর্গ দুভাবে হতে পারে। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ। সম্মতিহীন, অনিচ্ছাকৃত এবং জোরপূর্বক যৌন সংসর্গই প্রচলিত দৃষ্টিতে ধর্ষণ হিসেবে বিবেচিত। সামাজিক, পারিবারিক অবস্থান এবং মানসম্মান সম্পন্ন কিন্তু বিকৃত কুরুচিপূর্ণ এমন কিছু ব্যক্তিরা পরোক্ষ সুযোগ গ্রহণ করে থাকে। প্রকৃত অর্থে প্রতিটি ধর্ষণই পরোক্ষভাবে শুরু হয় এবং এই সকল ধর্ষণকারীদের উগ্রতা, লোলুপতা যখন তার সীমা অতিক্রম করে তখনই সে প্রত্যক্ষ সুযোগ গ্রহণে বেপরোয়া হয়ে উঠে। তার চরম মানসিক বিকৃতির ব্যাপকতার কাছে স্থান, কাল, পাত্র তখন খুব সামান্য বিষয় হয়ে দেখা দেয়।
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে মারাত্বক সামাজিক ব্যাধি ধর্ষণ। ধর্ষণ বিষয়ে নানা জনের নানান রকম অভিমত এবং মতামত রয়েছে। মতামতের এই মতান্তর অত্যন্ত প্রকট এবং আক্রমণাত্মক। ধর্ষণের প্রেক্ষাপট অনুসন্ধান করলে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো আলোকপাত করা যায়।
প্রথমত, এই শব্দ তিনটি ক্রমেই পণ্য হয়ে উঠছে। যারা এই শব্দগুলোকে পণ্য হিসেবে বেছে নিয়েছেন তারাই মূলত এই সমাজ অবক্ষয়ের মূল কারণ।
রিসিপশনে নারী, টেলিভিশনের সংবাদ পাঠে নারী, কল সেন্টারে নারী, বড় বড় বড় শপিং মলে নারী, কাস্টমার সার্ভিসে নারী। সর্বত্র নারীর এই অগ্রাধিকার নারীর অগ্রগতির জন্য কতটুকু সহায়ক? নাকি কর্পোরেট আমলের এক বিশাল ফাঁদ পাতা ব্যবসায়িক কৌশল? ভেবে দেখা উচিত।
“এমন কিছু হবে যা কেউ দেখেনি আগে”। হ্যা সত্যিই নিম্নবিত্ত একটা মেয়েকে লাগামহীন ঘোড়ারু হতে জীবনেও দেখিনি। পণ্যের বিপণনে তৈরিকৃত বিজ্ঞাপনে নারীর উপস্থিতির ধরণ ধারণ কতটুকু বিষয়ের সাথে সংগতিপূর্ণ, কোন বিজ্ঞাপন কোন সময়ে প্রচার উপযোগী ভেবে দেখা উচিত কিনা তা বিবেচ্য বিষয়।
এই যে পাবলিক পরীক্ষাগুলোর পরীক্ষার শুরু কিংবা ফলাফলের দিন। খবর দেখলে মনে হয় এদেশে যেন কোন ছেলেরা পরীক্ষাই দেয়নি আর দিলেও তা উল্লেখ করার মত নয়। সহজেই অনুমেয় সফলদের সফলতার উল্লাসকে প্রচার করা তো নয়, যেন ব্যবসায়িক কৌশলই মূখ্য। মেয়েদের যেসব ছবিকে যেভাবে প্রকাশ করা হয় তাতে বোঝা যায় সেখানে রয়েছে নিরব কিন্ত ছাই উস্কে প্রচ্ছন্ন আগুনে যৌনতার হাতছানি।
মুখে নারীর অগ্রগতি কিন্তু অন্তরে নারীর বুদ্ধিমত্তা নয় বরং সৌন্দর্যরূপকে পুজি করে হীন স্বার্থ চরিতার্থই মূল উদ্দেশ্য হয় তবে বলতে হয় নারী জানে না যে, সে দিনে দিনে পণ্য উঠেছে। এই অপকৌশলের আশপাশে বিচরণকারী সকলেই আজ বিপর্যস্ত, উন্মত্ত, উগ্র। ঠিক ঐ ক্রমশ পরিবেশ বিপর্যয়ের মতই।
দ্বিতীয়ত, ইন্টারনেট। ইউটিউবের কিছু কিছু শিরোনাম, “দেখুন বাংলা নাটকের অশ্লীলতা, সমাজকে কিভাবে নষ্ট করে দিচ্ছে”, “নষ্টামির একটা সীমা থাকা দরকার”, “কিভাবে শিশু ধর্ষণ হতে পারে দেখুন! আতকে উঠবেন! সচেতন হোন”। এমন আরও হাজার রকমের শিরোনাম। ভুঁইফোঁড় বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালের অবস্থা আরও বেশি শোচনীয়। তারা শিরোনামের শেষে এমনভাবে “ভিডিওসহ” কথাটি যুক্ত করেন যে, তারা বোঝাতে চায় এতে এক্কেবারে ধর্ষণেরই ভিডিও দেয়া আছে। এমনকি সংবাদের নামে যেসব এডাল্ট কন্টেন্ট দেয়া হয় তা রীতিমত ভয়ংকর। ছোট থেকে বড় সকল মিডিয়ার একই উদ্দেশ্য। ভিউয়ার বাড়ানো, টিআরপি বৃদ্ধি। সকল মিডিয়ার একই ধরণের ফরম্যাটে প্রচারের ধরণ ধারণ শুধু উনিশ আর বিশ। সচেতনতার আড়ালে সুড়সুড়ি জাগিয়ে সংবাদের কাটতিই যাদের মূল লক্ষ। তারা শুধু মানসিক পরিবর্তনের কথা বলে। না পারিবারিক, না ধর্মীয় শিক্ষা ও মূল্যবোধের কথা বলে। কর্পোরেটের এই যুগে তারা ভালভাবেই জানে এইখানে আসলে তাদের ব্যবসা লাটে উঠবে।
ইন্টারনেটের এই যুগে সবকিছুই হাতের মুঠোয়। প্রতিটি জিনিসেরই থাকে ভাল এবং মন্দ দিক। ইন্টারনেটও তার ব্যতিক্রম নয়। ভাল দিকগুলো গ্রহণ এবং খারাপদিকগুলো পরিহার করার জন্য আমরা কতটুকু প্রস্তুত ছিলাম বা আছি। বিশ্বায়নের এই যুগে এই বিষয়ে কোন আইন নাই, কোন সচেতনতা নাই বললেই চলে। আর এই সুযোগে আমরা হয়ে যাচ্ছি বেপরোয়া।
তৃতীয়ত, শিক্ষা ক্ষেত্র। যেই শিক্ষিকার হাতে বড় বড় নখ তিনি কিভাবে তার ছাত্রীকে বুঝাবেন ছোট নখের গুরুত্ব? যে শিক্ষক হাতে গলায় হরেক রকমের সূতা পৈতা দিয়ে ঘুরেন তিনি কিভাবে বুঝাবেন এর কুফল? প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীই তাদের এক বা একাধিক শিক্ষককে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। হোক তা মননে কিংবা ফ্যাশনে। কোন না কোন ভাবে শিক্ষকের প্রতিটি মন মানসিকতা, ড্রেস আপ, গেট আপ, আচার আচরণ, কথা বলার ধরণ ধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা অনুকরণ করে থাকে অবচেতনমনেই। শিক্ষকতা এবং চিকিৎসা এই দুটি এমন মহান পেশা যেখানে সবার চলাচল এবং আচরণ হওয়া উচিত সাধারণের ন্যায়। উৎকট এবং উগ্র হলে তার প্রভাব মন্দ বৈ ভাল আশা করা যায় না।
চতুর্থত, লজ্জা, সম্মান এবং শ্রদ্ধা। এখন আমরা সবাই একে অপরের সাথে বন্ধুভাবাপন্ন, খোলামেলা। বড় এবং ছোটদের মধ্যে এই বন্ধুত্বপূর্ণ এবং খোলামেলা সম্পর্কের অন্তরালে পারস্পরিক লজ্জাবোধ, সম্মান এবং শ্রদ্ধাবোধের জায়গা হতে বিচ্যুতি ঘটছে কিনা তা ভেবে দেখা দররকার। সত্যিকার অর্থে মা-মেয়ে, পিতা-পুত্র, ছাত্র-শিক্ষক এবং বড়-ছোট সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পাশাপাশি একটি ভয়ের জায়গাও থাকা দরকার।
পঞ্চমত, রিলেশন বা সম্পর্ক। যারা স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞ্যানে সম্পর্কের নামে প্রতিনিয়ত ধর্ষকের কাছে ধর্ষিত হচ্ছে কিংবা ধর্ষণ করছে তারা তাদের চারপাশকে কি ক্রমেই কলুষিত দূষিত এবং ধর্ষণের জন্য উপযোগী পরিবেশের ক্ষেত্রভূমি করে গড়ে তুলছে না? স্থান, কাল, পাত্র নয় উপরন্তু সর্বত্র তাদের নিজেদের এই বেপরোয়া চলাচল পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সঠিক মানসিক বিকাশের অন্তরায় নয় কি? সংসার জীবন শুরু করার আগেই দীর্ঘ সময় এক বা একাধিক জনের সাথে সম্পর্ক নামের সংসার করেও পরিসংখ্যানের খাতায় কেন এত এত নদীর তীর ভাঙার করুণ আর্তনাদ? আমাদের সমাজে কাছে আসার সাহসী গল্পের নামে কিশোর থেকে যুবকদেরকে যেভাবে যৌন উন্মাদ হতে উদ্দীপ্ত করা হয় সেখানে উপযুক্ত পরিবেশে উপযুক্ত শিক্ষা বৃথা আয়োজন মাত্র।
ষষ্ঠত, সংস্কৃতি। একটা দেশের সংস্কৃতি হলো তাই যা সেখানে বর্তমানে প্রচলিত। বাহিরের দেশের সংস্কৃতিতে যখন বাজার সয়লাব, গোগ্রাসে গিলছে আবাল বৃদ্ধ বণিতা। তখন মেধাশূন্য অনুকরণপ্রিয় দেশীয় সংস্কৃতির কান্ডারীদের নিজেকে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে আয়ের পথ সচল রাখতে ঐ অপসংস্কৃতিকে অনুসরণ ভিন্ন যেন অন্য কোন উপায় থাকে না। শুধু সস্তাদরের বিনোদনের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে তা নয়, সঠিক মানসিক বিকাশও হচ্ছে না।
সপ্তমত, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা। আমাদের মধ্যে আজ ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাব প্রকট। অনেকেই ধর্ষণরোধে মানুষের মানসিকতা পরিবর্তনের কথা বলে থাকেন। কিন্তু ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা ব্যতিত মানসিকতা পরিবর্তন কি আদৌ সম্ভব? সত্যিকার অর্থে ধর্মীয় অনুশাসন সংবলিত বার্তা পালন করার চাইতে মানসিকতা পরিবর্তনের নিমিত্তে আন্দোলনের নামে গলা ফাটানো সহজ। এতে করে অনেকের অনেক স্বার্থও হাসিল হওয়ার সুযোগ থাকে।
অষ্টমত, পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা। বংশ বা গোষ্ঠী বলতে যা বোঝায় তা বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। পরিবার হয়ত এখনও টিকে আছে। কিন্তু বংশ ভিন্ন পরিবারের বুনন কতটুকু মজবুত হয়। মানুষ শিখে তার পরিবার এবং তার চারপাশ তথা পরিবেশ থেকে। কিন্তু চারপাশের শিক্ষা যখন কাউকে আচ্ছন্ন করে তোলে তখন পরিবারের শিক্ষা তার কাছে গৌণ হয়ে যায়। পারিবারিক অনুশাসনের ভিত্তি যখন দূর্বল, নিজের সিদ্ধান্ত তখন অনেক সবল হয়ে উঠে। বড়’র চাইতে যখন কেউ বড় হয়ে উঠে তখন তার কাছে ভাল কিছু আশা করা নিস্ফল প্রত্যাশা।
নবমত, যৌন শিক্ষা। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে পর্ণোগ্রাফি বা নীল ছবি কিংবা বিভিন্ন ধরণের অ্যাডাল্ট কন্টেন্ট এখন অতিসহজলভ্য। হাত বাড়ালেই হাতের মুঠোয় সবকিছু। তথ্য প্রযুক্তির ভাল দিকগুলোর চাইতে খারাপদিকগুলোর প্রভাব অত্যধিক আগ্রাসী। হঠাৎ করে প্রসারিত তথ্য ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রকে ভালদিকে ব্যবহার করার সঠিক প্রচারণা, সচেতনতা এবং প্রশিক্ষণের ব্যাপারে উদাসীনতাই মূল্যবোধের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। বিভিন্নভাবে যৌনতার অপব্যবহার, অপচয় আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে শুধু নোংরা মানসিকতার দিকেই ধাবিত করছে তা নয়, উর্বর মেধাশক্তিকে অনুর্বর করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। সেইসাথে সামাজিক অবক্ষয় সমানতালে এগিয়ে চলছে। যৌন শিক্ষার অভাব এবং সঠিক ব্যক্তিত্ব তৈরি করতে না পারার ব্যর্থতাই এই সকল সংকট তৈরির প্রধান উপজীব্য।
দশমত, পোশাক। কারও কারও মতে ধর্ষণের জন্য পোশাক কোন কারণই নয়, নোংরা অশ্লীল মানসিকতাই মুখ্য। এজন্য তারা শিশু ধর্ষণের বিষয়টিকে শক্তিশালী উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন। পক্ষান্তরে কেউ কেউ শিশু ধর্ষণের বিষয়টিকে ব্যতিক্রম ভাবছেন এবং মেয়েদের পোশাক তথা চলন বলনকেই অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন।
প্রত্যেক মানুষের কাছ হতেই আমরা ভদ্রোচিত তথা শালীন কথাবার্তা এবং আচরণ প্রত্যাশা করি। অনুরুপভাবে, সবাই শালীন পোশাক পরিধান করবে এটাই সকলের প্রত্যাশা। এখন কথা হলো, এই শালীনতার মানদণ্ড কোথায় কেমন?
যেই পরিবার ইসলামের রীতিনীতি মেনে পর্দা করে চলেন তাদের কাছে বোরকা হিজাব পড়ে কিন্তু মুখ খুলে বাহিরে যাতায়াতকারী অন্য কেউ পছন্দনীয় নাও হতে পারে। মুখ খুলে হিজাব পড়ে যাতায়াতকারীদের কাছে শুধু সালোয়ারকামিজ পরিহিতা নারীরা সমর্থন হয়ত পাবে না। ঠিক যেমন অস্বাভাবিক লাগে তাদের কাছে ঐ সকল নারীদের যারা আটোসাটো পোশাকে নিজেকে সাজিয়ে সর্বাঙ্গ ফুটিয়ে তোলেন মোহনীয়ভাবে। যদি এমন হয়, এমন আটোসাটো কোন নারী লাল ঠোঁটে সাদা বেনসন সুইচের হালকা আমেজের স্বাদ নিচ্ছে লেক সার্কাস পার্কে। সেটাও বাঁকা চাহনীর কারণ হতে পারে কারো কারো কাছে। আমি যা করছি তার জন্য আত্বপক্ষ সমর্থন করে চলি নানান উপায়ে নানান যুক্তিতে। কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে নানান রকম মতান্তর। এখন প্রশ্ন করা যায়, কেন এখনো সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে পথে চলতে দেখা যায় না কাউকে। এর অন্যতম কারণ হতে পারে, এখনও অতটুকু লজ্জাবোধ টিকে আছে পৃথিবীর বুকে। আত্বমানসম্মানবোধ এক্কেবারে বিলীন হয়ে যায়নি।
কিন্তু পরোক্ষ যৌনতা তথা আই কনসেপ্ট সেক্সুয়াল এক্টিভিটিস এর অন্যতম কারণ হতে পারে অশালীন, অস্বাভাবিক পোশাক পরিধান এবং উগ্র সাজসজ্জাকরণ। আর এই পোশাক পরিচ্ছদ এবং সাজসজ্জার ধরণ ধারণের সাথে সমানভাবে সম্পর্কিত মানুষের চালচলন এবং আচার ব্যবহার। এখন দৃষ্টি সংযত রাখার কথা বলা হতে পারে। কিন্তু অশালীনতা যদি যৌনতাকে উস্কে দেয় তবে দৃষ্টি সংযত কতটুকু ফল বয়ে আনতে পারে? অবশ্যই মানুষ যেমন কান বন্ধ করে রাখতে পারে না, তেমনি চোখ বুজেও চলতে পারে না। আর যদি মানসিকতা পরিবর্তনের কথা বলা হয় তবে প্রত্যুত্তরে বলতে চাই, নিজের শালীনতাকে বিসর্জন দিয়ে অন্যকে কিভাবে মানসিকতা পরিবর্তনের কথা বলি। যেখানে মানসিক পরিবর্তন তাদের ঐ শালীন কিংবা অশালীন প্রকাশ দ্বারা প্রভাবিত। এটা নিশ্চিত বলা যায়, অশালীন যে কেউ চোখ দ্বারা ভক্ষণ হতে পারে কিন্তু তাকে কেউ নিজ গৃহে রক্ষণ করার চিন্তাও করতে পারে না। সর্বোপরি কোন ধর্মই অশালীনতাকে প্রশ্রয় দেয় না। যেমন উচ্ছৃঙ্খল আচরণ সমর্থনযোগ্য নয়। সম্পূর্ণ নগ্ন হওয়া যদি কারও কাছে লজ্জার মনে হয় তবে অশালীন পোশাক পরিধানের মাধ্যমে অর্ধনগ্ন হওয়া লজ্জারই অংশবিশেষ। আর যদি তাই হয়ে থাকে, তবে পোশাক ধর্ষণের একমাত্র কারণ নয় বটে কিন্তু পরোক্ষ ধর্ষণের জন্য গুরুত্ব বহন করে। আর আজকের পরোক্ষ ধর্ষণ কালকের প্রত্যক্ষ ধর্ষণের জন্য বড় ভূমিকা গ্রহণ করতেই পারে।
আমার বন্ধু তালিকায় একজন বন্ধু রয়েছেন। মেয়ে নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা ছাত্রী। স্যোসাল ওয়ার্কার। তাঁকে আমি প্রথম যেদিন দেখি, সেদিন তার পড়নে ছিল সাদা রঙের টাইট ফিটিং স্যূট এবং আটো সাটো গেন্জি টাইপের কিছু। পুরো ওয়েষ্টার্ন পোশাক বলতে যা বোঝায়। তার টাইমলাইনের ছবিগুলো রাম্প মডেল কিংবা ঠোট পালিশ, নেইল পালিশের কিংবা কোন ওয়েষ্টার্ন পোশাকের বিজ্ঞাপনের মডেলের চাইতে কোন অংশে কম নয়। প্রায় ছবিগুলো যৌনআবেদনে ভরপুর। এই পরিচটুকু দিতে চাইছি এই জন্য যে, তার ফেসবুক টাইমলাইনে বিভিন্ন সময়ে ইসলামের বিভিন্ন আয়াত, হাদীস, বক্তব্য, মতামত ঠাই পেয়ে থাকে। আমার কাছে মনে হয়েছে বিষয়টি সাংঘর্ষিক। ভূতের মুখে রাম নাম। তিনি তার ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনে সবসময় একটি কথাই বুঝাতে চান, ধর্ষণের জন্য পোশাক কোন কারণই নয়; নোংরা মানসিকতাই মূখ্য। আমার ধারণা, তিনি ইসলাম সমন্ধে যথেষ্ট জ্ঞ্যান রাখতে পারেন। কিন্তু তিনি মূল ইসলাম থেকে অনেক দূরে।শালীনতা এবং মানসিকতা একে অপরের পরিপূরক। শালীনতা ভিন্ন মানসিকতাকে উন্নত করা যাবে না। আর মানসিকতা উন্নত না হলে ব্যক্তিত্ব সুসংগঠিত হবে না। আর ব্যক্তিত্বের অভাবে চরিত্রের গঠন ভাল আশা করা যায় না। আর সুন্দর চরিত্রের অভাব হলে অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা সমুজ্জ্বল। সর্বোপরি বলা যেতে পারে, পোশাক ধর্ষণের জন্য প্রধান কারণ নয় কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে।
একাদশ, নারীর অগ্রগতিতে সরকারী উদ্যোগ। শিক্ষিত মা পেলে শিক্ষিত হবে জাতি, ত্বরান্বিত হবে উন্নয়নের গতি। এমনটাই প্রত্যাশা নিয়ে নারীদের উন্নয়নে অবৈতনিক শিক্ষা, উপবৃত্তি, কোটা সুবিধাসহ নানাধরণের সুবিধাসহ নানা মুখী প্রচার প্রচারণা চালানো হয়। যার সুফল বিভিন্নভাবে দিপ্তিমান। নারীর অগ্রগতি যতটুকু আশা জাগানিয়া, পুরুষের অনগ্রতি ততটাই হতাশাজনক। নারীদেরকে এগিয়ে নিতে গিয়ে পুরুষেরা পিছিয়ে যাচ্ছে কিনা, নানামুখী অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিনা খতিয়ে দেখা দরকার। একান্ত ব্যক্তিগত মতামত, পুরুষের তথা কিশোর, যুবকদের অবস্থা যেকোন সময়ের চাইতে করুণ। কেন জানি মনে হয় এদেরকে সুপথে ফিরিয়ে আনতে, সঠিক পথে পরিচালিত করতে ঐ নারীদের মত করেই আবার ব্যবস্থা নিতে হয় কিনা সন্দেহ রয়েছে।
পরিশিষ্ট, সঠিক পারিবারিক শিক্ষা এবং নিজ নিজ ধর্মীয় শিক্ষা, রীতিনীতি এবং তার অনুশাসন প্রতিফলিত না হয়, মূল্যবোধকে জাগিয়ে তোলা না যায় তবে ধর্ষণের দুঃসংবাদ প্রতিদিনই আসবে। প্রয়োজন সঠিক সময়ে সঠিক শিক্ষা, সঠিক প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা শীর্ষক নানা কার্যক্রম। ব্যবসায়ী কিংবা মিডিয়ার শুধু নিজের পকেট ভারী করার মানসিকতায় নারীকে পণ্য না বানিয়ে দেশ এবং সমাজের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ভাবনা ভাবা উচিত। মনে রাখা দরকার কামড়িয়ে খেলে বেশিদিন খাওয়া যায় না কিন্তু চুষে খেলে অনেকদিন খাওয়া যায়।
আরিফ মিলন রচিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছোটগল্প >> মাসুদ রানা ও তার দল
ধর্ষণ বৃত্তান্ত । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত প্রবন্ধ । লেখক পরিচিতি
লেখকঃ আরিফ মিলন
প্রবন্ধঃ ধর্ষণ বৃত্তান্ত
দেশের বাড়িঃ নাটোর
পড়াশোনাঃ বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং। (বর্তমানে একটি বেসরকারী কম্পানিতে চাকুরীরত)
লেখার মাধ্যমে সামাজিক অসংগতিগুলো তুলে নিয়ে আসাই আরিফ মিলনের মূল লক্ষ্য। তাঁর মতে-
“সঠিক সামাজিক পরিবর্তনের জন্য হাস্যরসাত্বক বিনোদন নির্ভর নয়, সঠিক বোধ এবং রস সম্পন্ন সাহিত্য সংস্কৃতির পরিচর্যা করা আবশ্যক”।
সে লক্ষ্যে তিনি অনবরত কাজ করে যাচ্ছেন।