আলোর পথে >> মাহামুদা মিনি । ভালোবাসার গল্প । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প |
মাহামুদা মিনি রচিত ‘আলেয়ার আলো’ রোমান্টিক ছোটগল্পটি ভালোবাসা দিবস-২০১৯ উপলক্ষ্যে আয়োজিত ‘আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প প্রতিযোগিতা – ০৩’ এ ষষ্ঠ স্থান অর্জন করে।
“শহরের একেবারে শেষদিকে পতিতালয়ের একটা দুতলা বাড়ির নিচতলার একটা ঘরে হালকা আলো দেখা যাচ্ছে। পুরো এলাকা অন্ধকারে ঢেকে আছে গত দুঘন্টা যাবত কারণ বিদ্যুৎ নেই। অন্ধকারে এলাকাটিকে আরও ভয়ানক লাগছে। যেন কোনো অশুভ ছায়া ঢেকে দিচ্ছে চারিদিক।
একটা মেয়ে আধো অন্ধকারে বসে ফোনের টর্চের আলোয় একটা সস্তা কলম দিয়ে দ্রুতগতিতে ডাইরিতে কিছু লিখে যাচ্ছে আর মাঝে মাঝে বামহাত দিয়ে চোখ মুছছে। মাঝে মাঝে দুচার ফোটা পানি টপটপ করে ডাইরির উপর পড়ে কালি লেপ্টে যাচ্ছে। তার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই বিন্দুমাত্র।
ডালিয়া?
ও ডালিয়া? কই আছিস তুই?
আলেয়া বেগম তার ভারী শরীর নিয়ে নড়তে পারে না ঠিকমতো। তবুও ডালিয়াকে খুঁজতে সে বিছানা থেকে নেমেছে। সন্ধ্যা হয়েছে অনেকক্ষণ হলো অথচ ডালিয়া এখনও তার কাছে আসেনি। কী যে হলো মেয়েটার!
ডালিয়া পতিতা পল্লীতে থাকে। আলেয়া বেগম ২৫ বছর আগে তাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে বড় করেছে। আলেয়া একজন পতিতা ছিল। তাই ডালিয়া একটু বড় হতেই তাকেও যোগ দিতে হয়েছে দেহ ব্যবসায়। আলেয়ার দুতলা একটা বাড়ি। ১৩ টা মেয়ে তার বাড়িতে থাকে। সবগুলো মেয়েই ডালিয়ার মতো। যাদের কেউ নেই পৃথিবীতে। সন্ধ্যা হতেই ঝাঁকে ঝাঁকে খদ্দেররা আসতে থাকে। তাই সন্ধ্যা হতেই আলেয়ার হাকডাক শোনা যায়। মেয়েরা তৈরি হয়েছে কিনা দেখতে হয় তাকে।
আলেয়া স্থুল দেহ নিয়ে রীতিমতো পা টেনে টেনে ডালিয়ার ঘরের দরজায় এসে বিরক্তমুখে দাঁড়ালেন। মেয়েটা কী যে এত সারাদিন লেখে ডাইরিতে! কোথায় সেজেগুজে বসে থাকবে তা না বসে বসে লেখালেখি!
সে বিরক্ত কণ্ঠে বললো, কী রে ডালি? সন্ধ্যা হলো। প্রস্তুত হবি কখন? খদ্দের আসলো বলে। আজ এক বড়লোক আসবে। তার জন্য তোদের সকলকে একটু বেশি গুছিয়ে থাকতে হবে। বলা তো যায় না কাকে তার পছন্দ হয়।
ডালি চমকে উঠে চোখ মুছে ডাইরিটা রেখে উঠে পড়লো। বললো, মা? আজ শরীরটা বড্ড খারাপ। আজ একজনের বেশি যেন এ ঘরে না আসে। পায়ে পড়ি তোমার। বয়স হচ্ছে আমার। আর ভালো লাগে না।
ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ ব্যবসার হিসাব কষে আলেয়া বললো, আচ্ছা তাই হবে। রেডি হয়ে নে। আজকাল কী যে মতিগতি হয় তোদের বুঝি না বাপু।
ডালি মনে ভীষণ বিতৃষ্ণা নিয়ে সাজতে বসলো। তখনি বিদ্যুৎ এসে পড়লো। আয়নার সামনে দাঁড়াতে তার ঘৃণাবোধ হয়। হাজার পুরুষের আঁচড় আর ছোঁয়াতে তার শরীরটা কলঙ্কিত। তার মনে হয় এ দাগ মুছে যাবে না কখনো। কাজল দেওয়া চোখদুটো তার ছলছল করে উঠলো আবার। এ নিকৃষ্ট জীবন সে চায় না। সে স্বপ্ন দেখে একটা সংসারের। যেখানে টাকার বিনিময়ে কেউ তাকে ছোঁবে না, ভালোবাসা দিয়ে সেখানে তাকে জয় করবে কেউ।
একটু পরেই খট করে দরজাটা খুলে গেল। ডালি তাকিয়ে আফজালকে দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। যাক! আজকের জন্য সে বেঁচে গেল।
আফজাল খুব সংকোচে বিছানায় এসে মুখ ভার করে বসে রইলো। আয়নার ভিতর দিয়ে ওকে আড়চোখে দেখলো ডালি।
মানুষটা অদ্ভুত! প্রথম যেদিন এসেছিলো সেদিন ঘরে ঢুকেই বলেছিলো, এমন রং মেখে জোকারের মতো সেজেছো কেন? নারীরা এমনিতেই সুন্দর। যাও, মুখ ধুয়ে এসে বসো।
ডালি অবাক হয়ে মুখ ধুয়ে এসে বসতেই মানুষটা একটা মায়াবী দৃষ্টিতে তাকে দেখেছিলো। এ দৃষ্টি খরিদ্দারের না, এ দৃষ্টি একজন সত্যিকারের মানুষের তা ডালি মুহূর্তেই বুঝে নিয়েছিলো। মানুষটা সারারাত তার হাত ধরে বসে তার জীবনের কাহিনী শুনেছিলো। নিজের জীবনের গল্প শুনিয়েছিলো। বহু বছর পর ডালি সেদিন কেঁদে হালকা হয়েছিলো।
আফজাল সাহেব দেখতে লম্বা, চওড়া। শান্ত স্বভাবের মানুষ। বয়স ৩৫/৩৬ মতো হবে। তার স্ত্রী সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে পাঁচবছর আগে মারা গিয়েছিলো। তারপর থেকে সে একাই থাকত। ব্যবসা করে। বেশ স্বচ্ছল। পরিবারে মা, বাবা, ভাই, বোন কেউ নেই। এক বন্ধু হঠাৎ তাকে এই পল্লীতে এনেছিলো। এই মানুষটা তাকে একবারও অন্য মনে ছুঁয়ে দেখেনি সেদিন। তারপরেও কখনো না।
তবে সে সপ্তাহে অন্তত একদিন করে ডালির কাছে আসত। ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখত ডালিকে। খুব আগ্রহ সহকারে জানতে চাইত ডালি কেমন আছে, মন ভালো আছে কিনা। ডালি অবাক হয়ে অনুভব করলো জীবনে এই প্রথম কোনো পুরুষ তাকে ভালোবাসছে। বিনা শর্তে ভালোবাসছে।
ডালি উঠে এসে তার পাশে বসতেই সে হঠাৎ বেশ জোরালো কণ্ঠে বললো, ডালি? আমি আজীবন তোমার পাশে থাকতে চাই। দিবে থাকতে?
হঠাৎ এমন অদ্ভুত প্রশ্নে ডালি ঘাবড়ে গিয়ে বললো, তা কীভাবে সম্ভব? আমি যে পতিতা! আর মা আমাকে এই পল্লী থেকে বেরোতে দিবে না। সমাজে আমাদের কোনো ঠাঁই নেই। আমাদের জন্ম, মৃত্যু সব এখানেই হয়। আর আপনার জীবনটা নষ্ট করার মতলব করেছেন নাকি?
আফজাল মৃদু হেসে বললো, না। তোমাকে এই পরিবেশে ঠিক মানায় না। আমি জানি তুমি প্রতিনিয়ত আঁতকে ওঠো আমার মতো পুরুষের নখের আঁচড়ে। তুমি মরে যাচ্ছো একটু একটু করে। ডালিদের জন্ম পুরুষের হিংস্র থাবায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে মরে যাওয়ার জন্য হয়নি। আমরা দুজনেই মরছি। তো চলো বাঁচি? তোমার মাকে বুঝানোর দায়িত্ব আমার।
ডালি চুপচাপ বসে রইলো। সে ভাবতে পারছে না সে সত্যিই নতুন জীবন পাবে। এ যেন কল্পনাতীত ব্যাপার। তবে তার মন বিদ্রুপ করে বলছে, পতিতার আবার সংসার হয় নাকি!
আফজাল আগেই আলেয়া বেগমের সাথে কথা বলে রেখেছিলো। তবে আলেয়া এত কাঁচা বুদ্ধির মহিলা না। তার কাছে ব্যবসার উপরে আর কিছু নেই। দুই লাখ টাকা দাম দিয়েছে সে ডালির। সেই ছোটবেলা থেকে সে ডালিকে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করেছে বলে কথা!
তবে সে নিজেও জানে। গত চৌদ্দ বছরে ডালি তাকে এমন কয়েক গুণ টাকা রোজগার করে দিয়েছে। তাছাড়া সে আজকাল লক্ষ্য করছে খদ্দেররা ডালির প্রতি তেমন আগ্রহী না। নতুন কয়েকটা মেয়ে তাদের পছন্দ। তাই ডালিকে বেচে দিতে তার আপত্তি নেই।
আফজাল শর্ত দিয়েছে ডালিকে বলা যাবে না যে তাকে টাকা দিয়ে বের করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিনে নেওয়া শব্দটা মনে আসতেই আফজালের ঘৃণাবোধ হয়। মানুষ কী পণ্য নাকি? যে কিনতে হয়! ছিঃ!
ডালি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পতিতা নাম ফেলে রেখে আফজালের হাত ধরে বেরিয়ে পড়লো। মানুষটাকে তার কেন এত ভালো লেগেছে বা বিশ্বাস করেছে তা সে নিজেও জানে না। তবে একটা খাঁটি মানুষ লোকটা তা ডালি স্পষ্ট অনুভব করতে পারে। কখনো ভালোবাসি বলেনি লোকটা অথচ কী ভীষণ ভালোবাসে তাকে!
রেজিস্ট্রি অফিসে বসে বিয়ের রেজিস্ট্রি করার সময় যখন ডালিকে জিজ্ঞেস করা হলো বয়স কত সে গম্ভীর হয়ে গেল। সে নিজেই জানে না তার জন্ম কোথায়, কখন হয়েছে। হঠাৎ তার মনটা ভয়ানক খারাপ হয়ে গেল। মনে হলো সে এক অনাকাঙ্খিত সন্তান ছিল কারও। যার জন্ম এবং জন্মতারিখ কোনোটারই ঠিক নেই। আফজাল ডালির মলিন মুখটা লক্ষ্য করে দ্রুত বলে দিল বয়স ২৬ বছর।
বিয়েটা শেষ করে ডালি পা রাখলো আফজালের সংসারে। কিন্তু নিজেকে বড্ড বেমানান লাগলো তার এই সংসারে। বাসায় ঢুকে তার মনে হলো তার দেহটা কলঙ্কিত। তাকে দ্রুত গোসল করতে হবে। মুছে ফেলতে হবে সব দাগ। অস্থির মনে সে গোসলখানায় ঢুকে পড়লো।
আফজালের এক বন্ধু তখন ওর বাসায় আসলো। সে ডালির ব্যাপারে সব জানে। সে এসেই বললো, তুই এটা কী করলি? বিয়ে করবি তা আমাদের বলতে পারতি! শেষে একটা পতিতাকে বিয়ে করলি? ছিঃ! ভাবতে পারছি না।
আফজাল তাকে পাশে বসিয়ে বললো, ও পতিতা ছিল। এখন তো নেই। আর ও তো ইচ্ছা করে পতিতাবৃত্তি করেনি! ওর জীবনের নির্মম বাস্তবতা ওকে বাধ্য করেছে। ওকে নিয়ে ঠিক সুখী হবো আমি তোরা দেখিস।
বন্ধু রেগে বললো, তোর ঘেন্না করবে না ওর হাজার পুরুষের ছুঁয়ে দেওয়া শরীর ছুয়ে দিতে? ঘেন্না করবে না ওকে নিয়ে সংসার করতে? এক সাথে ঘুমোতে?
আফজাল স্বভাবসূলভ হাসি হেসে বললো, না রে। বিন্দুমাত্র ঘেন্না হবে না। যারা ওকে ছুঁয়েছে তারা টাকার বিনিময়ে ওর দেহটা ছুঁয়েছে, ওর মনটা তো ছুঁতে পারেনি। আমি ওর মনটা স্পর্শ করতে চাই প্রতিদিন। নারীর দেহ না, মনটা ছুঁয়ে দিতে পারাই পুরুষের প্রকৃত সার্থকতা। ওর জীবনটা নষ্ট হচ্ছিলো ওই অন্ধকারে। ওকে ঠিক ওখানে মানায় না। এই সংসারে ঠিক মানাবে। প্লিজ আমাকে উল্টা বুঝাস না। ওকে আজ থেকে আমার স্ত্রী হিসেবে ভাবতে শেখ। একটা মানুষ হিসেবে ভাবতে শেখ। দুনিয়ার একটা মেয়েকে অন্তত আলোকিত জীবনের পথে হাঁটতে দিতে সাহায্য কর আমাকে। প্লিজ!
আর সবচেয়ে বড় কথা আমি ওকে ভীষণ ভালোবাসিরে বন্ধু।
বন্ধুটি এবার হয়ত বুঝতে পারলো তার ভুলটা। সে কিছু কথাবার্তা বলে চলে গেল। পাশেই গোসলখানার ভিতর দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনে থমকে গিয়েছিলো ডালি। সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলো কথাগুলো। মানুষটা এত ভালো কেন? পৃথিবীর সব পুরুষই তবে অন্ধকার রাতে হিংস্রতা দিয়ে পুরুষত্ব জাহির করতে চায় না, আফজালের মতো অনেকেই আছে যারা খুব গোপনে আগলে রাখতে চায় নারীকে। ভালোবাসায় ভরিয়ে তুলতে চায় জীবনটা।
তারপর সংসারটা চললো ভালোবাসায়। দুজন মানুষ নিজেদের একটা সুন্দর পৃথিবী তৈরি করে নিলো। যেখানে নেই মেঘের ঘনঘটা, নেই বিপর্যয়। বিশ্বাসের সাথে দুজনের হাত শক্তভাবে আঁকড়ে রাখলো তারা।
বিয়ের ঠিক দুবছর পর অনেক ডাক্তার দেখিয়েও আফজাল, ডালির সংসারে কোনো সন্তান আসেনি। ডাক্তার বলেছে সমস্যা ডালির। পতীতাপল্লীতে থাকতে তিনবার এবরশন করতে হয়েছে তাকে, তাছাড়া গত ১৪ বছরে অত্যাধিক শারীরিক সম্পর্ক, নির্যাতনের কারণে তার বাচ্চা ধারণ ক্ষমতা হারাতে হয়েছে। সারাদিন মনমরা হয়ে বসে থাকে সে। আফজাল ডালির উদাসীনতা দেখে মনে মনে ভাবলো ওকে ব্যস্ত রাখতে হবে। সে একদিন একটা সেলাই মেশিন কিনে এনে দিয়ে বললো এটা দিয়ে তুমি অবসর সময়ে পোশাক বানানো শিখবে। তারপর ছাদে একটা ফুলের বাগান করে দিলো যাতে ডালি অন্তত ব্যস্ত থেকে মনখারাপ ভুলে থাকে। তবে এত সব পেয়েও ডালির মন ভালো হয় না। অবশেষে আফজাল একটা অন্য রকম সিদ্ধান্ত নিলো। সে এই জীবনে ডালিকে আর কষ্ট পেতে দিতে পারবে না। ডালিকে সে প্রচণ্ড ভালোবাসে।
আলেয়া বেগম বিছানা থেকে উঠে বহুদিন পর ডালির ঘরটা খুলে ভিতরে ঢুকলো। ও চলে যাওয়ার পর আর কেউ থাকেনি এ ঘরে। ডালিকে সে আজকাল খুব মিস করে। মেয়েটা চলে যাওয়াতে তার কোথায় যেন শূন্যতা তৈরি হয়েছে। চোখদুটো অকারণে ছলছল করে ওঠে তার। বড্ড ভালোবাসতো মেয়েটা তাকে। কখনো গলা তুলে কথা বলেনি। ডালি তো তার মেয়ের মতোই ছিল। তার সন্তান থাকলে ঠিক ডালির মতোই তাকে মা বলে ডাকত। বুকের ভিতরটা শূণ্যতায় হাহাকার করে উঠলো তার। এখন আর কেউ তাকে মা বলে ডাকে না। কেউ না।
আলেয়া ভাবলো এক পতিতাকেও ভালোবাসা নিয়ে মা বলে যে মেয়ে ডাকতে পারে সে অন্তত খারাপ হতে পারে না। ও এখান থেকে চলে গিয়েই ভালো করেছে। ও পৃথিবীর জন্য উপযুক্ত। এখানকার জন্য না। দিনে একবার হলেও মেয়েটা তার খোঁজ নিতো। ঘরের এককোণে রাখা ডালির আলমারিটা চোখে পড়তেই সাবধানে খুলে ফেললেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ খুলতেই কয়েকটা ডাইরি এসে তার পায়ের উপর পড়লো। হাতে নিয়ে বুঝলেন সব ডালির ডাইরি। কী এত লিখত মেয়েটা তা সে জানে না। তবে আজ আগ্রহ হচ্ছে জানার। তাছাড়া হাতে সময়ও আছে আজ। মেয়েটাকে বড্ড বেশি মনে পড়াটাই হয়ত তাকে বাধ্য করলো পড়তে।
চুপচাপ ডাইরি তিনটা হাতে নিয়ে প্রথমটা খুলে পড়তে শুরু করলেন। প্রতিটি পৃষ্ঠা পড়তে গিয়ে বারবার শিউরে উঠলেন তিনি। দিন, তারিখ দিয়ে একেকটা খদ্দেরের অকথ্য নির্যাতনের বর্ণনা লিখেছে ডালি। এত পাশবিক নির্যাতন করে মেয়েগুলোকে?
ডাইরির এক জায়গাতে লেখা,
পতিতালয়ে প্রতি রাতে একেকটা মেয়ে অনিচ্ছায় একেকটা যুদ্ধের শিকার হয়। তাকে জয় করতে হয় যুদ্ধটা। আমরা যে দেহসর্বস্ব নারী। আমাদের অনিচ্ছা বলে কোনো কথা নেই, পুরুষের ইচ্ছেই সব। বাইরের জগতের উজ্জ্বল সূর্যটাও জানে না, এই অন্ধকার পল্লীর মেয়েগুলোর মনের গভীরে জমাট বাধা তীব্র অন্ধকারের কথা। রাতের আঁধারও জানে না আমাদের চোখের পানি এই আঁধারকে ঘন করে তুলতে থাকে প্রতি রাতে। আমাদের স্বপ্নগুলো প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হয় খদ্দেরের হিংস্র আঁচড়ে, আমরা আঁতকে উঠি সহস্রবার, আমরা অনুভূতিহীন হয়ে পড়ি অবিরত শারীরিক নির্যাতনে। রাত শেষে আমাদের নগ্ন দেহের উপর যখন খদ্দেররা ঘৃণার দৃষ্টি ফেলে টাকা ছুড়ে দিয়ে চলে যায় তখন আমাদের মনে হয় এই টাকাগুলো আমাদের অনুভূতিগুলো দাফন করার জন্য, স্বপ্নগুলোকে কবর দেওয়ার জন্য। তবুও পরদিন আবার আমরা ক্ষতবিক্ষত দেহটাকে রং মেখে সাজিয়ে গুছিয়ে সঁপে দিই আরেক খদ্দেরের কাছে। আমাদের জন্মই যে তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য। আমরা মরে যাই প্রতিনিয়ত। কেউ ভালোবাসা নিয়ে ছোঁয় না। মনের টানে ছোঁয় না, সবাই টাকার বিনিময়ে দেহের টানে ছোঁয়। মৃত দেহটা নিয়ে শেয়াল, শকুনের মতো টানাহেচড়া করে। অসংখ্যা ডালি প্রতিনিয়ত নিঃশব্দে মরে যায় রাতের আঁধারে, পৃথিবী খোঁজ রাখে না তাদের।
চমকে উঠলেন আলেয়া কথাগুলো পড়ে। ডাইরিটা রেখে তিনি তার ঘরে গিয়ে বেলকনিতে বসলেন। চেয়ারে দেহটা এলিয়ে দিয়ে তিনি ১২টা মেয়ের মুখ কল্পনা করলেন। তারপর সর্বশেষ ডালির মুখটা মনে পড়তেই তিনি শিউরে উঠলেন। এত নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করে চলেছে মেয়েগুলো? ছিঃ। জীবনে এই প্রথমবার নিজের প্রতি বড্ড ঘৃণা হলো তার। বড্ড ঘৃণা। ব্যাংকে তার অনেক টাকা জমেছে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন।
আফজাল দ্রুত রেডি হতে বললো ডালিকে। তবে কোথায় নিয়ে যাবে তা একবারও বললো না। প্রায় আধ ঘণ্টা পর সে ডালির হাত ধরে একটা হাসপাতালে ঢুকলো। ডালি ভাবলো হয়ত কোনো আত্মীয় অসুস্থ আফজালের। তবে তাকে অবাক করে দিয়ে আফজাল বেবি ইউনিটের দিকে নিয়ে গেল। এক ডাক্তারের সাথে কথা বলে একটা ফুটফুটে মেয়েকে এনে ডালির কোলে দিয়ে বললো, আজ থেকে তুমি ওর মা। ওর মা, বাবা কেউ বেঁচে নেই। তবে আজ থেকে ওর মা, বাবা সব আছে।
বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ডালি কেঁদে ফেললো। ছোট্ট বাচ্চাটার শরীর থেকে এখনও বাচ্চা বাচ্চা একটা ঘ্রাণ আসছে। ডালি চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে। ছোট্ট মেয়েটা তার বুকের ভিতর নড়ে উঠতেই ডালির মনে হলো আফজালের মতো পুরুষদের জন্যই বেঁচে থাকে কিছু ডালিয়া। আজ আরেকটা ডালিয়াকে বাঁচিয়ে দিলো সে। এই অনাথ বাচ্চাটাও হয়ত সমাজের নির্মমতায় একদিন ডালিয়ার মতো অন্ধকার জগতে জায়গা পেতো।
মাঝে মাঝে ডালি অবাক হয়। একটা মানুষ কতটা ভালো হলে একটা পতিতাকে স্ত্রীর সম্মান দিয়ে ভালোবাসায় আগলে রাখতে পারে তা সে ভেবে পায় না। বিয়ের পর একটা দিন ডালিকে কষ্ট পেতে দেয়নি মানুষটা। ডালি যে একটা মানুষ তা সংসারে এসেই বুঝেছে। তার ভালোলাগা, মন্দলাগারও দাম আছে, খুব দাম আছে কারও কাছে। এমন ভালোবাসার মানুষ পেয়ে সে রীতিমতো গর্বিত বোধ করে। এক জীবনে আর কী চাইবার আছে তার? এই মানুষটা তাকে অপূর্ণতা নিয়ে বাঁচতে দেবে না বলেই আজ তার কোলটা ভরিয়ে দিলো। স্বার্থক তার নারী জীবন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ভরা বুকে আফজালের হাত ধরে বাসার দিকে অগ্রসর হলো। আলোর পথ টানছে তাকে সামনে। ডালি ভাবছে তার মেয়েটার নাম রাখবে আলো। আলোর মতো ফুটফুটে মেয়েটা। বুকের দিকে মুখ গুজে চুপচাপ ঘুমোচ্ছে। ও এত নরম যে ওকে তুলোর মতো মনে হচ্ছে তার। একটা নারীর কোল জুড়ে একটা বাচ্চা থাকার অনুভূতিটা ডালি খুব গোপনে অনুভব করছে। এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশের মতো না। আফজাল মুগ্ধ চোখে এক নারীর চোখেমুখে মাতৃত্বের আনন্দ দেখছে। সেও আজ বড্ড তৃপ্ত। তার ভালোবাসার মানুষটার আরেকটা অপূর্ণতা সে পূর্ণতায় রূপ দিতে পেরেছে। অদ্ভুত এক ভালোবাসা অনুভব করলো আফজাল। পরম মমতায় সে ডালির একটা হাত আঁকড়ে ধরলো।
আলেয়া বেগম ১২টা মেয়েকে অন্ধকার গলির শেষ মাথায় এনে একটা বাসে তুলে দিয়ে গেল তাদের জিনিসপত্রসহ। মেয়েগুলোর কেউ বেঁচে নেই পৃথিবীতে। তাই ওরা তাকে ছাড়তে চাইছিলো না। অগত্যা আলেয়া তাদের সকলকে তার পুরোনো বাড়িটাতে সবকিছু ঠিকঠাক করে পাঠিয়ে দিলো। এখানকার বাড়িটা বিক্রি করে সপ্তাহখানেকের ভিতর সেও চলে যাবে মেয়েগুলোর কাছে। একটা এজেন্সির সাথে কথা বলেছেন তিনি। এজেন্সি থেকে মেয়েদের হাতের কাজ শেখাবে। মেয়েরা স্বচ্ছল হবে। সৎ পথে রোজগার করবে। নতুনভাবে বাঁচবে। সে গভীর দৃষ্টিতে লক্ষ্য করেছে মেয়েগুলোর মুখ খুশিতে চকচক করছে। এমন খুশি হয়ে তারা কখনও হাসেনি। এ যে মুক্তির খুশি। এই খুশি আলেয়ার মনেও প্রভাব ফেলছে।
এতদিন পর আলেয়া বড্ড শান্তিতে নিঃশ্বাস ফেললো। তার মনের ভিতর এতবছর যাবত তিলতিল করে জমা হওয়া অস্বস্তি আর পাপবোধ আজ তাকে মুক্তি দিলো। তার মনে হলো বাসটা দ্রুত গতিতে ছুটে যাচ্ছে মেয়েগুলোকে নিয়ে আলোর পথে। পিছন ফিরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলেয়া ভাবলেন এক জীবনে অনেক পাপ করেছেন, আর না। অন্ধকার পল্লীর জীবনটা ভুলে এবার তিনিও আলোর পথে পা রাখবেন।” (সমাপ্ত)
আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প প্রতিযোগিতা – ০১ এ ষষ্ঠ স্থান অর্জনকারী গল্প >> বাঁধন – অনুষ্কা সাহা ঋতু
আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প প্রতিযোগিতা – ০৩ এ সপ্তম স্থান অর্জনকারী গল্প >> অভিভাবক – ঈশিতা জুবায়ের
আলোর পথে । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প । লেখক পরিচিতি
লেখকঃ মাহমুদা মিনি
ছোটগল্পঃ আলোর পথে
গল্পের জনরাঃ রোমান্টিক, ভালোবাসার গল্প।
দেশের বাড়িঃ যশোর।
পড়াশোনাঃ B.A (২০১৯)।
পেশা: ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট
(লেখক ছবি দিতে ইচ্ছুক নন)
লেখকের কথাঃ পড়তে ভালোবাসি। বই আমার সেরা সঙ্গী। সময় পেলে একটু আধটু লেখারও চেষ্টা করি। নিজের অনুভূতিগুলো তুলে ধরতেই লেখালেখি করা। হৃদয়ের অব্যক্ত চাওয়াগুলোর পূর্ণতা দিতেই কাগজ, কলমের সাথে সখ্যতা আমার।
2 Comments
[…] আলোর পথে – মাহামুদা মিনি । ভালোবাসার… […]
[…] মাহমুদা মিনি রচিত ভালোবাসার গল্প >> আলোর পথে […]