নিখোঁজ আলোর শহর বুক রিভিউ | সাদিয়া সালসাবিলা | রিভিউয়ার – তানজিনা তানিয়া

সাদিয়া সালসাবিলা রচিত ‘নিখোঁজ আলোর শহর‘ বইটির রিভিউ নিয়ে, তানজিনা তানিয়া ‘নহলী গ্র্যান্ড রিভিউ প্রতিযোগিতা‘য় অংশ নিয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেন। তানজিনা তানিয়ার ‘নিখোঁজ আলোর শহর বুক রিভিউ‘টি নিয়েই আজকের আয়োজন।

বই: নিখোঁজ আলোর শহর
লেখিকা: সাদিয়া সালসাবিলা
পৃষ্ঠা: ১১২
মুদ্রিত মূল্য: ২৩০ টাকা
বর্তমান বিক্রয় মূল্যঃ ১৩০/- (৪৩% ছাড়) (মার্চ, ২০১৯)
অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: নহলী বুকস
রিভিউয়ারঃ তানজিনা তানিয়া

নিখোঁজ আলোর শহর বুক রিভিউ । সাদিয়া সালসাবিলা

রচনার ভাগসমূহ

আচ্ছা, গল্পেরা কি কেবল গল্পই হয়? গল্পের উৎস কোথায়? কোথায় গল্পের বাড়ি? গল্প কি লেখক লেখিকার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা নাকি গল্পেরা আমাদের আশেপাশেই ছড়িয়ে থাকে? আমাদের জীবনটাই তো গল্পের বিশাল বড় ভাণ্ডার। সবার জীবনেই গল্প আছে। একেকজনের গল্পের ধরণ একেকরকম। আমাদের জীবনটা গল্পের কিংবা গল্পগুলো জীবনের। “নিখোঁজ আলোর শহর” বইতে স্থান পাওয়া আটটি গল্পই আমাদের নিরন্তর প্রবাহমান জীবনের গতিপথ থেকে কুড়িয়ে নেওয়া।

বই থেকে বলছি : বইয়ের প্রথম গল্পটির নামই ‘নিখোঁজ আলোর শহর’। সব কুমারী মেয়ের মনেই তো স্বপ্ন থাকে কোনো এক রাজকুমারের ঘরের ঘরণী হতে। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি সবসময় অনুকূলে থাকে না। যখন নিজেদের স্বার্থের কাছে বিক্রি হয়ে গেল মেয়েটির আপন ভাই, বাবা মা সহ সকলেই, তখন মেয়েটির কথা কি ভাববে কেউ?

যে সংসারের সব সদস্যের জীবন ভালোভাবেই চলছিলো সেখানে অল্পবয়স্ক বাবু কী কাণ্ডটাই না করে বসলো! স্বভাবতই বোন , বাবা, ভাইয়া সবার কথা শুনতে হলো ছেলেটিকে। ছেলেটির এখন কী হবে? এই বয়সে এই কাণ্ডটা করা কি তার আদৌ ঠিক হয়েছে? বাকিটা বটবৃক্ষ গল্পটি পড়লেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।

দীপার ছেলে হঠাৎ করেই তার প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সুবোধ হয়ে উঠলো। বাবা মা ছেলেকে সময় দিতে পারে না৷ ছেলের ভিতর একটা একাকিত্ব ভাব তো থাকেই। কিন্তু গল্পের মূল জিনিস এটা না। গল্পটার সাথে পাশের ফ্ল্যাটে আসা নতুন পরিবারের কী সম্পর্ক? আড়াল গল্পটি যেন আমাদের ওয়ার্কিং দম্পত্বির সন্তানের প্রতি অবহেলার গল্প, শিশুটির অব্যক্ত ক্ষরণের গল্প।

সম্ভ্রান্ত মির্জা পরিবারে বউ হয়ে আসে খান পরিবারের মেয়ে মনোয়ারা খানম। পারফেক্ট গৃহবধূর মতো মনোয়ারা বেগম সামলে রেখেছেন পরিবারটা। তাকে সঙ্গ দেওয়া দেবর ননদেরাও সময়ের ডানায় ভর করে দূরে চলে গেল। গত হলো স্বামী। সন্তান কাছে নেই। শেষ বয়সে এই একা জীবনে তার শেষ পরিণতিটা কী? কেউ কথা রাখেনি গল্পটাই মনোয়ারা মির্জার।

আচ্ছা ভালোবাসায় কী দালালি চলে? এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে দালাল গল্পটিতে।

বামন হুজুর স্যারের ধারণা ছাত্রদের থেকে সে দেখতে ছোট বলেই তাকে কেউ মান্য করে না। ভিতরে ভিতরে তিনি মন্টা সহ তাকে বিরক্ত করা সকলের প্রতি ক্ষেপে উঠলেও তাদের গায়ে বেত চালাতে পারেন না। হুজুর স্যার তার অন্তিম সময়ে দেখলেন সেই মন্টাই তার ত্রাতা হিসাবে এগিয়ে এসেছে।

বৃদ্ধ বয়সে মহিলারা তাদের ছেলে আর ছেলে বউয়ের কাছে বোঝা হয়ে যায়। ছেলের বউয়ের সম্মান বুঝি আর থাকলো না শাশুড়ির কারণে! তাকে কী তবে বৃদ্ধাশ্রমেই যেতে হবে? গল্পেরও তো গল্প থাকে, তাই না? সেই গল্পটা একুশ বছর পর শেষ হয়েছিল। তাই গল্পটার নামও “একুশ বছর পর”।

স্বেচ্ছাসেবী নারী সংগঠনবাদী নেত্রী জোহরা রশীদেরা কি প্রকৃতপক্ষেই সকল নারীর অধিকার রক্ষা করতে পারে? না, বাকিটা আমি বলবো না, বলবে “সেবিকা”গল্পটি।

নিখোঁজ-আলোর-শহর-বই-সাদিয়া-সালসাবিলা-Nikhoj-Aalor-shohor-book-sadia-salsabila
নিখোঁজ আলোর শহর – সাদিয়া সালসাবিলা



নিখোঁজ আলোর শহর বুক রিভিউ । পাঠ প্রতিক্রিয়া

জীবনের হিসেব সবসময় অতি সহজে মিলে না৷ বাস্তবতার কাছে হেরে যেতে হয় অনেককে। কেউ কেউ অবশ্য জিতে যেতেও পারে। তবে জেনেশুনে লোভাতুর দৃষ্টির একজন মানুষকে বিয়ে করতে বাধ্য হওয়াটা কি একজন যুবতীর জন্য দুঃখজনক নয়? কিন্তু পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েরা তাদের শহরে এক ফালি আলো খুঁজে পেতে কতই না হাঁসফাঁস করে!

আমাদের বাস্তব সমাজচিত্রের প্রতিফলনই যেন ঘটেছে নিখোঁজ আলোর শহর গল্পটিতে। হুট করে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে প্রথমেই ভয়টা কিন্তু আমরা পরিবারের লোকদেরই পাই। ভুলটা বড় হয়ে গেলে প্রহারও কম সহ্য করতে হয় না। কিন্তু তারপর প্রটেকশন? ওই ঘুরেফিরে ভালো মন্দ সবটার দায়ই পরিবারের সেই প্রহার করা মানুষগুলোই নিয়ে নেয়। পরিবার হচ্ছে বটবৃক্ষ। যে বৃক্ষের ছায়াতলে আমাদের গোটা জীবন কেটে যায়। আমাদের পারস্পরিক জীবনবোধ থেকে উৎসরিত গল্পটির বর্ণনাভঙ্গি বেশ সাবলীল ছিল। আমার দারুণ লেগেছে গল্পটি৷

আড়াল গল্পটি পড়ার পরে আমার অনুভূতিটা আমি ঠিক বুঝাতে পারবো না। যে পরিবারের স্বামী স্ত্রী দুজনেই চাকুরিজীবী থাকে তাদের সম্পর্কের ফাঁকটা বোধহয় এরা নিজেরাও ধরতে পারে না। কিন্তু সেই ফাঁককে কেন্দ্র করে আড়ালের মতো গল্প গড়ে উঠতেই পারে। চমৎকার এই গল্পটি যে কোনো পাঠককে চরম তৃপ্তি দেবে।

কেউ কথা রাখেনি গল্পটি অপরিচিত কোনো গল্প নয় যেন। এমন অনেক অসহায় মনোয়ারাদের দিন রাত্রি যাপন হয়তো নিজ চোখে রোজ দেখছি। কিন্তু আমরা কয়জন তাদের গল্পটা জানি কিংবা ভিতরটা পড়তে পারি? কতজনের কথা রাখা না রাখার খবর রাখি? কয়জনকে কথা দিয়ে নিজের কথাটাই বা ঠিক রাখি? গল্পটা আমাকে একইসাথে কষ্ট ও তৃপ্তি দু’টিই দিয়েছে। দুঃখটা শেষ বয়সের অসহায় মূহূর্তের কথা ভেবে দুঃখ আর তৃপ্তিটা একটা ভালো গল্প পড়তে পারার তৃপ্তি। হৃদয় ভেঙ্গে দেয়ার মতো একটা গল্প।

পারিপার্শ্বিক অবস্থা অনুধাবন না করেই দালাল খেতাবটা কারোর নামের সাথে জুড়ে দেই আমরা। কাছের লোকদের জন্য কিন্তু আমাদের অনেকেরই এমন স্যাক্রিফাইসিং মন মানসিকতা থাকে। বইয়ের খুব পছন্দের গল্পগুলোর একটি হচ্ছে ‘দালাল’।

শুধু এখানেই সব অনুভূতির শেষ হয়ে যায়নি। বইয়ে প্রত্যেকটি গল্পই মানসম্মত এবং চমৎকার। এতক্ষণ বলা অনুভূতির সাথে আরও মিশে আছে হুজুর স্যার গল্প পড়ার মায়াময় অনুভূতি। হুজুর স্যারের অনুভূতি এবং মন্টার অনুভূতি পৃথকভাবে বর্ণনা করায় গল্পটা বেশ প্রাণ পেয়েছে।

তিন জেনারশন নিয়ে লেখা একুশ বছর পর গল্পটা গতানুগতিক আর সব গল্পকে ছাড়িয়ে গিয়েছে।

আর জোহরা রশীদের মতো মহিলারও অভাব নেই আমাদের সমাজে। নিজের পায়ে পাড়া পড়লে কোনো সেবিকাই আর তার নীতিতে অটল থাকতে পারে না।আমাদের সমাজের বাস্তবচিত্র এটা। শতভাগ নিঃস্বার্থ আসলে কতজন হতে পারে?

রকমারি স্বাদের আটটি গল্পের সাথে আমি দারুণ একটা সময় কাটিয়েছি বলতেই হবে। সবকিছু ছাপিয়ে বইটি অবশ্যই পাঠকপ্রিয়তা অর্জনে বাধাপ্রাপ্ত হবে বলে মনে হয় না।

ব্যক্তিগত রেটিং ৪.৭/৫।
.
বই সম্পর্কিত তথ্য:
পৃষ্ঠ :১১২
মুদ্রিত মূল্য : ২৩০ টাকা
বর্তমান বিক্রয় মূল্যঃ ১৩০/- (৪৩% ছাড়)
অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: নহলী বুকস 

আত্মপ্রকাশ সম্পাদক

http://attoprokash.com

আত্মপ্রকাশে অপ্রকাশিত গল্প এবং বুক রিভিউ এবং প্রবন্ধ প্রকাশ করতে যোগাযোগ করুন (ইমেইল-attoprokash.blog@gmail.com) অথবা ফেইসবুক পেইজ ইনবক্স। সর্বনিম্ন ১০০০ শব্দ হতে যেকোনো ঊর্ধ্ব সীমার ছোট গল্প গ্রহণযোগ্য। আপনার গল্প আত্মপ্রকাশ বিচারকদের দ্বারা নির্বাচিত হলে আপনাকে জানানো হবে এবং তা সরাসরি প্রকাশ করা হবে আত্মপ্রকাশে। আপডেট জানতে ফেইসবুক গ্রুপে সক্রিয় থাকুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *