বেলা শেষে >> মোঃ ফারুক । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প
মোঃ ফারুক রচিত ‘বেলা শেষে‘ সামাজিক ছোটগল্পটি আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প প্রতিযোগিতা – ০২ এ ষষ্ঠ স্থান অর্জন করে।
শফিক সাহেবকে উত্তর দক্ষিণ করে শুয়ে রাখা হয়েছে। সবাই অপেক্ষায় আছে। জীবনের শেষ নিশ্বাসটা নেওয়া হয়ে গেলেই সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে ফেলা হবে। শফিক সাহেবের বড় মেয়ে বাবার পাশে বসে কোরআন তেলয়াত করছেন। ছোট মেয়ে কে খবর দেওয়া হয়েছে। সেও বাড়ি থেকে রওনা দিয়েছে বাবাকে শেষ বিদায় দিতে। শফিক সাহেবের বড় ছেলে মেজো ছেলে ঢাকায় থাকে। তারা সরকারি বড় পদের কর্মকর্তা। ছোট ছেলে পরিবার নিয়ে লন্ডনে থাকে।
শফিক সাহেবের স্ত্রী সালেহা বেগম ছেলেদের কয়েকবার করে ফোন করে বলেছেন তাদের বাবার অসুস্থতার কথা। সাথে এটাও বলেছেন, তোমাদের বাবা জীবনের শেষ সময় পার করছেন। তোমরা এসে তোমাদের বাবা কে শেষ বারের জন্য দেখে যাও। বড় ছেলে আর মেজো ছেলে বলে দিয়েছে তারা এখন আসতে পারবেনা। কাজের অনেক চাপ। তাছাড়া বাবার কিচ্ছু হবেনা। শুধু শুধু ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ছোট ছেলে বলেছে এখন ভিসার জটিলতা চলছে। ইচ্ছে থাকলেও আসার কোন উপায় নেই।
রাত তিনটা! শফিক সাহেবের অবস্থা ধীরে ধীরে অবনতি হচ্ছে। একমাত্র স্ত্রী ছাড়া এখন আর পাশে কেউ নেই। সালেহা বেগম স্বামীর মুখে একটু একটু করে পানি তুলে দিচ্ছেন আর কালেমা পড়ছেন। সালেহা বেগমের হাত কাঁপছে। যার সাথে জীবনের এতটা পথ পাড়ি দিয়েছেন আজ চোখের সামনে তাকে চিরতরে বিদায় দিতে হচ্ছে। একটু পর পর নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখছে নিশ্বাস আছে কিনা। সালেহা বেগমের খুব ইচ্ছে হয় চলে যাওয়া মানুষটার সাথে দুদণ্ড কথা বলতে। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, আপনার কী খুব কষ্ট হচ্ছে!
জীবনের শেষ বেলায় যদি এই মানুষটার সাথে কিছু কথা বলা যেত, তবে কেমন হত! কথা গুলো হত ভীষণ আবেগী। এই যেমন সালেহা বেগম কান্না জড়িত কণ্ঠে বলত, আমাকে ছেড়ে যেতে আপনার একটুও কষ্ট হচ্ছেনা! আপনাকে ছাড়া থাকতেযে আমার ভীষণ কষ্ট হবে। জানেন! আমাদের ছেলেরা অনেক বড় চাকরি করে। তারা এখন অনেক ব্যস্ত। এতটা ব্যস্তযে বাবার মৃত্যু যন্ত্রণাও তাদের ছুঁতে পারেনা।
ভোর চারটা দশ মিনিট। সালেহা বেগম জোর গলায় কালেমা পড়তে লাগলেন। এখন আর মুখে পানি দিচ্ছেনা। এক সময় কালেমা পড়া বন্ধ করে দেন। শফিক সাহেবের জীবনের শেষ নিশ্বাসটা নেওয়া হয়ে গেছে। পৃথিবীর সব কিছু মূল্যেও একটা নিশ্বাস নেওয়া আর সম্ভব না। সালেহা বেগম নিথর হয়ে বসে আছেন। যেন কথা বলার সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। জগতের এই এক অদ্ভুত ব্যাপার, কখনো কখনো চিৎকার করে কাঁদতে চেয়েও কাঁদা যায়না। জগতের সব কান্না যেন গলায় এসে জমে থাকে।
সালেহা বেগম প্রতিদিনের মত স্বাভাবিক নিয়মে এক এক করে সবাই ডেকে তুললেন। তারপর শফিক সাহেবের মৃত্যুর খবর জানালেন। ভোর রাতে শফিক সাহেবের বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে যায়। সবাই কাঁদছে। শুধু সালেহা বেগমের চোখে কোন জ্বল নেই। তিনি ছেলেদের কাছে ফোন করে জানতে চাইলেন তারা আসতে পারবে কিনা। ছেলেরা উত্তর দিলেন, মৃত লাশ বেশিক্ষণ উপরে রাখা ঠিক হবেনা। আমরা রওনা হচ্ছি। আসতে দেরি হলে আমাদের জন্য যেন অপেক্ষা না করে। মৃত লাশ যত দ্রুত দাফন করবে তত মৃত লাশের আত্মা কষ্ট কম পাবে।
ছোট ছেলে লন্ডন থেকে বলে দিয়েছে, সে না আসা পর্যন্ত কোন সম্পত্তি যেন ভাগবাটোয়ারা না হয়। দুই তিন দিনের মধ্যে সে দেশে আসছে। শফিক সাহেবকে সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছে। পাশে আগরবাতি জ্বলছে। সালেহা বেগমের নাকের নলক হাতের চুড়ি খুলে নেওয়া হয়েছে। রঙিন কাপড় খুলে আলমারিতে অযত্নে পড়ে থাকা শাশুড়ির পুরনো সাদা শাড়ি পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাছের আত্মীয় দূরের আত্মীয় সবাই এসে ভীড় জমাচ্ছে। দু এক জন কান্না না আসলেও জোর করে আবেগের কান্না করার চেষ্টা করছে। কেউ হাউমাউ করে কেঁদে বলছে, শফিক সাহেবের মত ভালো মানুষ আর পাওয়া সম্ভব না।
শফিক সাহেবের গোসলের কাজ সম্পূর্ণ করে সাদা কাফনে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে চিরবিদায় দেওয়া হবে। সালেহা বেগম বার বার জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছেন, তার কোন ছেলে আসছে কিনা। কিন্তু প্রতিবারই হতাশ হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কোন শব্দ ফেলেই আবার দ্রুত উঁকি দিচ্ছেন, এই বুজি তার ছেলেরা এসে বাবা বাবা বলে চিৎকার করবেন। মা কে বুকে জড়িয়ে ধরে বলবেন, মা তুমি কোন চিন্তা করনা। বাবার মত আমরাও তোমাকে আদরযত্নে রাখবো।
সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। সবার মধ্যে কেমন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। গ্রামের মুরব্বিরা অপেক্ষায় আছেন শফিক সাহেবের ছেলেদের জন্য। সালেহা বেগম ঘর থেকে বের হয়ে বললেন, ছেলেরা আসতে অনেক দেরি হবে। তারা বলেছে তাদের বাবার দাফনের কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য। মুরব্বিরা কথা না বাড়িয়ে খাঁটিয়া নিয়ে রওয়া হলেন। পিছনে আবারও কান্নার রোল পড়ে যায়। শফিক সাহেবের দুই মেয়ে বাবা বাবা বলে চিৎকার করছেন। শুধু কাঁদছেনা সালেহা বেগম। তিনি নির্বাক চোখে প্রিয় মানুষের চলে যাওয়া দেখছেন। এই মানুষ আর কখনে ফিরবেনা, কোনদিনও না।
একজন মানুষের চিরবিদায় আমরা কান্নায় ভেঙে পড়ি। অথচ জগতের প্রতিটা প্রাণী এই পথের যাত্রী। শফিক সাহেবের মত আমাদেরও একদিন চিরবিদায় নিতে হবে। বিধাতার নিয়ম ভাঙার সাধ্য কারো নেই। যত একদিন যাচ্ছে, তত আমরা সেই পথের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
তিনদিন পর!!
সকালবেলা ছোট ছেলে বাড়িতে এসে পৌঁছেছে। বিকেলে গ্রামের মুরব্বি সহ তাদের চাচাদের ডাকা হয়। তিন ছেলের এক যুক্তি, আমাদের কারো সময় নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাবার সম্পত্তি একটা ফয়সালা হয়ে যাক। এখন সবাই এক সাথে আছে। দুই মেয়ের জামাইরাও এসেছেন। তাদেরও একমত। কবে আবার সবাই একসাথে হবে তার কোন ঠিক নেই। তাই এখনি সঠিক সময়। পিছন থেকে বড় মেয়ের জামাই তার বউ কে ফিসফিস করে বললেন, যেন চুপচাপ না থাকে। সঠিক প্রাপ্য যেন বুঝে নেয়। বড় মেয়ে সাথে সাথে বললেন, আপনারা মুরব্বিরা আছেন। আপনারা সব কিছু ভাগ করে দিয়ে যান।
ছোট মেয়ের জামাই তার বউ কে ইশারায় ধমক দিয়ে বললেন, তুমি চুপ করে আছো কেন! তুমিও কিছু বলো। একদম ছাড় দিবেনা। ছোট মেয়ে এতক্ষণ চুপ থালেও এবার কথা বলতে শুরু করলেন, ভাই বোন সবাই যেন সমান ভাগ পায়। বাবার সম্পত্তি সব বাবা নিজের পরিশ্রমে করেছেন। তাই এখানে সবার সমান অধিকার আছে। ছোট বোনের কথা শুনে শফিক সাহেবের বড় ছেলে রেগে যান। তিনি ছোট বোন কে ধমক দিয়ে বললেন, তোরা এত কথা বলছিস কেন! আমরা কী তোদের থেকে কম বুঝি। এবার বড় মেয়ে বলে উঠলেন, বাবা যখন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে ছিল কই তখন তো কেউ আসেননি। এখন সম্পত্তি ভাগাভাগির সময় ভাগ নেওয়ার জন্য সবাই এসেছেন। এক পর্যায় তর্কাতর্কি শুরু হয়ে যায়।
সালেহা বেগম অন্য রুমে বসে চুপচাপ সব শুনছেন। আর তার দুচোখ দিয়ে অবিরাম জ্বল গড়িয়ে পড়ছে। তিল তিল করে গড়া এই সংসারে আজ নিজেকে মূল্যহীন মনে হচ্ছে। এই সম্পৎ গড়ার জন্য শফিক সাহেব মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছেন। দিনের পর দিন ছুটেছেন এই সম্পৎএর পিছে। আজ সন্তানদের কাছে তার মূল্য না থাকলেও সম্পৎএর মূল্য অনেক বেশি।
সালেহা বেগম উঠে গিয়ে সবাইকে শান্ত হতে বললেন। তারপর সম্পত্তির সব দলীল এনে তাদের বড় চাচার হাতে দেন। দুই দিনের মধ্যে শফিক সাহেবের সব সম্পত্তি ছেলে মেয়েদের ভাগ করে দেওয়া হয়। শুধু ভাগ হয়নি শফিক সাহেবের অমূল্য সম্পৎ তার স্ত্রী সালেহা বেগম। ছেলেরা শহরে চলে গেলে তার কী হবে কেউ ভাবেনি।
শফিক সাহেব মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর!
শফিক সাহেবের দুই ছেলে শহরে চলে যান। ছোট ছেলেও উড়াল দেয় লন্ডনের পথে। বাড়িতে এখন আর লোক সমাগম নেই। যে যার মত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
কোন এক বিকেলে সালেহা বেগম স্বামী ব্যবহার করা জিনিশপত্র ঠিক করতে গিয়ে একটা চিঠি খুঁজে পান। তিনি চিঠি খুলে পড়তে শুরু করেন।
প্রিয় সালেহা!
আমি জানতাম আমার মৃত্যুর পর ছেলে মেয়েরা আমার কষ্টে অর্জিত সব সম্পত্তি ভাগ করে নিয়ে যাবে। তাদের কাছে তোমার আমার কোন মূল্য থাকবে না।
প্রিয় সালেহা!
দুঃখ পেওনা। আমার বাবার সম্পত্তির ভাগ আমার বাবার মৃত্যুর তিন দিনের মধ্যে আমি বুঝে পেয়েছি। আমি জানতাম আমার মৃত্যুর পর আমার সব সম্পত্তি ওরা ভাগ করে নিলেও তোমার দেখা শোনার ভার কেউ নিতে চাইবে না। তাই আমি তোমার নামে পনেরো লাখ টাকা ব্যাংকে রেখে দিয়েছি। আলমারির মধ্যে সব কাগজ পত্র রয়েছে। যদি তোমার ইচ্ছে হয় তাহলে ছেলেদের কাছে থেকো। আর যদি ইচ্ছে না হয়, তবে এই টাকা নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে চলে যেও। অযত্নে অবহেলায় ছেলেদের কাছে থাকার ছেয়ে তুমি হয়ত বৃদ্ধাশ্রমে অনেক ভালো থাকবে।
চিঠি পড়া শেষ করে সালেহা বেগম চিঠিটা বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়েন। সালেহা বেগম নীরবে কেঁদে যাচ্ছেন। আজ তাকে শান্তনা দেওয়ার মত কেউ নেই। নিজেকে বড্ড একা মনে হয়। আদরযত্নে গড়া প্রিয়জনরা থেকেও যেন কেউ নেই, কেউ নেই।
বেলা শেষে । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প । লেখক পরিচিত
লেখকঃ মোঃ ফারুক
ছোটগল্পঃ বেলা শেষে
গল্পের জনরাঃ সামাজিক ছোটগল্প
দেশের বাড়িঃ কুমিল্লা।
পড়াশোনা/চাকরিঃ প্রবাসী
লেখকের কথাঃ ছোট বেলা থেকে বই পড়তে ভালোবাসি। বাংলা সাহিত্যের জন্য মনের গভীরে একটা টান আছে। লেখালেখি করতে পছন্দ করি।
2 Comments
[…] […]
[…] মোঃ ফারুক রচিত আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প >> বেলা শেষে […]