সোমা ও মিনি >> সানজিদা প্রীতি । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প
সানজিদা প্রীতির লেখা ‘সোমা ও মিনি’ ছোটগল্পটি আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প প্রতিযোগিতা – ১ এ প্রথম স্থান অর্জন করে এবং সাদাত হোসাইনের ‘নিঃসঙ্গ নক্ষত্র‘ বইটি পুরষ্কার হিসেবে জিতে নেয়।
“ম্যাও ম্যাও” বাদামী রং এর বিড়ালটা ডেকেই যাচ্ছে। অন্যদিন হলে সোমা দৌড়ে গিয়ে বিড়ালটাকে দেখত। কিন্তু আজ সোমার মন খারাপ। ভীষণ মন খারাপ। কেন মন খারাপ সোমা জানে না। আসলে বুঝতে পারছে না কেন মনটা খারাপ। তার দাদীমার জন্য নাকি অন্য কিছুর জন্য মন খারাপ সেটাই ধরতে পারছে না সোমা। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে এই বিড়ালটা দেখার জন্য সোমা বারান্দায় যায়। বিড়ালটা হচ্ছে পাশের বাসায় থাকা একজন লোকের। লোকটার নাম রমিজ আলী। রমিজ আলীর বিড়ালটার গায়ের রং আর চোখ গুলো সোমাকে বেশি আকৃষ্ট করে। কিন্তু রাতে দেখা স্বপ্নটা তাকে বিছানা ছেড়ে উঠতেই যেন দিচ্ছে না। কাল রাতে সোমার দাদীমা এসেছিল তার স্বপ্নে এবং তিনি বলে গেছেন রমিজ আলী একজন খারাপ মানুষ। শুধু খারাপ মানুষ না অতি খারাপ মানুষ। তার দাদীমা নিষেধ করেছে এই লোকটার সাথে যেন সে না মিশে। এই লোকটা আজকে তার পোষা বিড়ালটাকে খারাপ ভাবে হত্যা করবে। এরপরেই সোমা দেখতে পেল রমিজ আলী সত্যি সত্যি তার সামনে মিনিকে হত্যা করছিল। মিনি সে কি চিৎকার দিয়ে দিয়ে ডাকছিল। রমিজ আলী যখন সোমার দিকে তাকালো তখন একটা অদ্ভুত হাসি দিয়ে তার কাছে আসতে লাগল। আর সে মুহূর্তে সোমার ঘুমটা ভেঙে যায়।
দশটা বেজে গেছে এখনও সোমা বিছানা ছেড়ে না উঠাতে তার মা, শায়লা বেগম রুমে আসেন। সোমাকে শুয়ে থাকতে দেখে তিনি সোমার পাশে গিয়ে বসেন। সোমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেন,
– কী হইছে মা? অন্যদিন তো আটটাই উঠে যাও আজকে এখনও উঠলে না যে?
সোমা শায়লা বেগমের কোলে মাথা রেখে বলতে লাগল,
-আচ্ছা মা আমরা স্বপ্নে যা দেখি তা কী সত্যি হয়?
শায়লা বেগম উত্তরে বলে,
-ধুর পাগলী মেয়ে আমার, স্বপ্ন কখনও সত্যি হয় নাকি?স্বপ্ন তো স্বপ্নই। তা আমার সোনা মেয়ে কী স্বপ্ন দেখেছে শুনি?
সোমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-মা, কালকে দাদীমাকে স্বপ্নে দেখেছি। দাদীমা বলেছে মিনি নাকি মারা যাবে। আমি আর মিনিকে দেখতে পাবো না মা?
ছয় বছর বয়সী সোমার কথা শুনে শায়লা বেগম মৃদু হেসে বললেন,
-পাবে না কেন? পাবে পাবে। আসলে তুমি দাদীমাকে খুব মিস করছ আর মিনিকেও খুব ভালোবাসোতো তাই হয়তো এমন স্বপ্ন দেখেছ। এখন দেখি লক্ষ্মী মেয়ের মত উঠে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও তো। আজকে তোমার পছন্দের ভুনা খিচুড়ি রান্না করেছি। চল চল ফ্রেশ হয়ে নাও।
বেশ কিছুদিন থেকে রমিজ আলী সোমাকে খুব আদর করেন। যখনই সোমার সাথে দেখা হয় তাকে একটা করে চকলেট ধরিয়ে দেন তিনি। রমিজ আলী একা মানুষ। তার সংসার, বউ,বাচ্চা কেউ নেই। একাই ভাড়া থাকেন পাঁচ কি ছয় বছর ধরে এই বাড়িতে। গত দশ বছর ধরেই রমিজ আলী একটা হাসপাতালে কাজ করছেন। হসপাতালের মর্গের লাশ গুলো দেখে রাখায় তার কাজ। চল্লিশ বছর বয়সী রমিজ আলী একজন ঠান্ডা মস্তিষ্কের লোক। তার পোষা বিড়ালের চোখের মতই তার চোখেও যেন অনেক কিছুই লুকিয়ে আছে। তার চোখের ভাষা সহজে বুঝার উপায় নেই। কিন্তু তার চেহারা দেখলে মনে হয় তার মত নিষ্পাপ, সহজ,সরল,ভালো মানুষ আর নেই। গত দশ বছর ধরে তিনি যা করে আসছেন তারপর তাকে ভালো আর নিষ্পাপ বলাটা সত্যি পাপ হবে। রমিজ আলী থ্যানাটোফিলিয়ায় ভীষণ ভাবে আক্রান্ত একজন মানুষ। তার মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ বিকৃত হয়ে গেছে। গত দশ বছরে মর্গে থাকা লাশের সাথে সে কি না করেছে! যখনই একটা করে নারীর লাশ এসে মর্গে জমা হয় তখনই রমিজ আলীর মুখে হাসির রেশ আরও বেড়ে যায়। এছাড়া সে সোমাদের এলাকায় যবে থেকে এসেছে, যত গুলো নারীর লাশ কবর দেওয়া হইছে, হোক সে শিশু বা বৃদ্ধ কেউ তার হাত থেকে রেহায় পায় নি। সে তার শারীরিক চাহিদা মিটিয়েছে এই লাশ গুলোর থেকে। সোমার দাদীমার লাশের সাথেও সে এমন জঘন্য কাজটি করেছে। সে প্রতিটা লাশের সাথেই এই কুরুচিপূর্ণ কাজটি করে থাকে। রাতের আধাঁরে লাশ গুলোকে কবর থেকে তুলে, তাদের সাথে খারাপ কাজটি করে লাশ গুলোর নগ্ন দেহ কবরের পাশে রেখে যায়। কাজটা সে এতোটাই সাবধানতার সাথে করে যে, এই পাঁচ বছরে কেউ এখনও বুঝতে পারেনি এমন কুৎসিত কাজটা কে করছে?
মৃত মানুষের পাশাপাশি তার এই কুরুচি কেন যেন এখন ছোট বাচ্চাদের দিকে ছুটে যাচ্ছে। তার লোভ দিন দিন আরও বেড়ে চলছে।
সোমাদের বাসা আর রমিজ আলীর বাসা মুখামুখি শুধু মাঝখানে একটা রাস্তা তাদের বাসা দুটিকে আলাদা করেছে। সোমা কিছুক্ষণ পর পর এসে বারান্দা দিয়ে মিনিকে দেখছে। বিড়ালটাকে রমিজ আলী বেঁধে রেখে গেছে। আজ বিড়ালটাকে দেখে সোমার কেন জানি অন্যদিনের থেকেও বেশি মায়া লাগছে। তার মনে হচ্ছে বিড়ালটা তাকে কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু মিনি কথা বলতে না পারায় তাকে বলতে পারছে না। সোমা মনে মনে ভেবে রেখেছে, আজ রমিজ চাচার সাথে দেখা হলে তাকে বলবে মিনিকে যেন এমন বেঁধে না রাখে। কিন্তু সেদিন আর রমিজ আলীর সাথে সোমার দেখা হলো না।
রাতে সোমা ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ মিনির আর্তনাদ করা চিৎকারে তার ঘুমটা ভেঙে যায়। সোমা তাড়াতাড়ি করে উঠে বারান্দায় গেল। সে রমিজ আলীর ঘরটার দিকে তাকিয়ে আছে। মিনিকে দেখার চেষ্টা করছে সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিনির চিৎকার বন্ধ হয়ে গেল। সোমা বারান্দা শিক গুলো ধরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিনিকে একবার দেখার জন্য। সোমার চোখ থেকে পানি তার গাল বেয়ে নিচে পড়ছে। কিছুক্ষণ পর সোমা দেখল রমিজ আলী হাতে কী যেন নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে আসছে। মৃদু আলোতে সোমা বুঝতে পারল না রমিজ আলীর হাতে ওইটা কি ছিল। রমিজ আলী এইদিক ওইদিক তাকিয়ে উত্তর দিকে হাঁটা শুরু করেছে। সোমা দোতালার বারান্দা থেকে শুধু তার হেঁটে যাওয়াটাই দেখছে। রমিজ আলী অন্ধকারে কোথায় জানি হারিয়ে গেছে। তাকে দেখতে না পেয়ে সোমা রুমে চলে আসে। সোমার প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। কেন কান্না পাচ্ছে তা সে জানে না। সোমা শুয়ে শুয়ে কান্না করছে শব্দ না করে।
পরের দিন সকালে যখন ঘুম ভাঙে সোমা দৌড়ে গিয়ে বারান্দায় যায় মিনিকে দেখতে। কিন্তু মিনিকে সে কোথাও দেখে না আর।
সেদিন বিকাল বেলায় সোমা বাকিদের সাথে মাঠে খেলছিল। রমিজ আলীকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে তার কাছে যায়।
– চাচা চাচা মিনি কোথায়? সকাল থেকে ও’কে যে কোথাও দেখতে পাইনি। মিনি কোথায় চাচা?
সোমার প্রশ্ন শুনে রমিজ আলী মুখে হাসি রেখা টেনে বলল,
– তোমার মিনি কয়দিনের জন্য একটা জায়গায় বেড়াতে গেছে। তুমি যাবে মিনিকে দেখতে?
সোমা বলল,
– কোথায় ঘুরতে গেছে? আর আমি কীভাবে যাব?
-তুমি চাইলে আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারি।
-কিন্তু আগে তো মাকে বলতে হবে। মা যদি রাজি হয় তারপরেই তো যেতে পারব।
– না না বাসায় বলা চলবে না। মিনি আমাকে বলেছে তোমাকে নিয়ে একা যাওয়ার জন্য। এখন তুমি যদি সবাইকে বলে দাও তাহলে তো মিনি রাগ করবে। মিনি রাগ করলে তোমার কী ভালো লাগবে বল? মিনি সেখানে তোমার জন্য অনেক গুলো চকলেট নিয়ে অপেক্ষা করছে। তুমি যদি কাউকে না জানিয়ে আমার সাথে একা যাও তাহলে তোমাকে সব চকলেট দিয়ে দিবে।
– সত্যি চাচা! ঠিক আছে আমি কাউকে বলব না। কিন্তু আমরা কখন যাব মিনির কাছে?
-কাল বিকালে যাব। তুমি বিকালে খেলতে আসার নাম করে ওই ঝোপটার পিছনে লুকিয়ে থাকবে। সেখান থেকে আমি তোমাকে নিয়ে যাব মিনির কাছে।
-আচ্ছা ঠিক আছে চাচা। আরেকটা কথা চাচা। কালকে মিনি এমন চিৎকার কেন করেছিল?
-ওই যে মিনি তার নতুন জায়গায় যেতে চায়নি তাকে জোর করে পাঠিয়েছি তো তাই চিৎকার করেছিল।
-ও আচ্ছা এখন বুঝেছি।
– হুম আর একটা কথা এই সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই যেন আমাদের মধ্যে সিক্রেট থাকে কেমন? এই নাও তোমার জন্য কিছু চকলেট এনেছি।
রমিজ আলী তিনটা চকলেট সোমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হাসতে লাগল। সোমা মাথা নেড়ে হাসি মুখে চকলেট গুলো নিয়ে নিল।
সোমা বাসায় কিছু না জানিয়ে রমিজ আলীর সাথে যাওয়ার জন্য ঝোপের পিছনে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর রমিজ আলী আসলো। সে সবদিক ভালো করে দেখে সোমার হাত ধরে হাঁটা শুরু করল। সোমাকে নিয়ে সে অনেক দূরে নির্জন জায়গায় চলে এলো। আকাশে হঠাৎ করে বিদুৎ চমকে উঠল। আকাশ কালো হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে এখনই বৃষ্টি নামবে। সোমার কেন জানি এখন খুব ভয় করছে। সে অনেকক্ষণ থেকেই রমিজ আলীকে জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছে আর কত দূর? প্রতিবারের উত্তরেই রমিজ আলী বলছে, “এইতো আর একটু।” রমিজ আলী আজ ভীষণ খুশি। অনেকদিন পর তার মনের আশাটুকু পূর্ণ হতে যাচ্ছে। সামনে বট গাছটাকে দেখতে পেয়ে তার খুশি যেন চরম মাত্রাই পৌঁছে গেছে। এইদিকে মানুষ খুব একটা আসে না । তাই তার কাজটা করতে বেশ সুবিধা হবে। রমিজ আলী সোমার হাতটা ছেড়ে তার গায়ে হাত বোলাতে লাগল। বিভিন্ন জায়গায় হাত দিতে লাগল রমিজ আলী। সোমার একদম ভালো লাগছে না এইসব। সে রামিজ আলীকে বলল,
-চাচা আমার এইসব ভালো লাগছে না। আমি বাসায় যাব। অন্যদিন এসে মিনিকে দেখব। আমায় বাসায় দিয়ে এসো।
সোমার কথা শুনে রমিজ আলী অট্টহাসি দিতে লাগল। রমিজ আলীর হাসি দেখে সোমার প্রচণ্ড ভয় লাগতে শুরু করল। রমিজ আলী তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। সোমার দিকে হাত বাড়াতেই সোমা রমিজ আলীর হাতে কামড় বসিয়ে বট গাছটার দিকে দৌড় দিল। ঠিক তখনই আকাশ ভেঙে ঝুম বৃষ্টি নামল। সোমা নিজেকে বট গাছটার পিছনে লুকিয়ে ফেলল। রমিজ আলীও দৌড়ে বট গাছটার কাছে আসল। সে হাসতে হাসতে সোমাকে বলতে লাগল বেড়িয়ে আসতে।
সোমা বসে কাঁদছে। সোমা কিছু বুঝার আগেই তার চুলের মুঠি ধরে রমিজ আলী তাকে বট গাছের পিছন দিক থেকে সামনে এনে ফেলে দিল।
রমিজ আলী সোমার কাছে আসতেই তার সারা শরীর ভয়ে কাঁপতে লাগল। সে তার চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছে না যা সে দেখছে তা কী সত্যি?
সোমার চেহারা শুধু বদলাচ্ছে। এতোদিন সে যত গুলো লাশের সাথে খারাপ কাজটা করেছে সবার চেহারা যেন একের পর এক আসতে লাগল। কখনও সোমার দাদীমা কখনও বা মর্গের কোনো লাশ এবং শেষ পর্যন্ত মিনির মত চেহারা হয়ে গেল সোমার। সোমার এমন রূপ বদলাতে দেখে রমিজ আলীর কাছে কেন জানি তাকে দেবী দূর্গা বলে মনে হচ্ছে। দেখতে দেখতে সোমার চোখ গুলো ভয়ংকর রকমের লাল হয়ে গেল। তার দাঁত আর নখ গুলো হিংস্র জানোয়ারের মত ধারালো আর বড় হয়ে গেল।
সোমা একাই বাসায় ফিরেছে সন্ধ্যায়। শায়লা বেগম যখন জিজ্ঞাসা করল, সে কোথায় ছিল বিকেল থেকে? সোমা শুধু উত্তরে জানায়, রমিজ চাচা বট গাছের ডালের সাথে গলায় ফাঁস দিয়েছে। এর থেকে বেশি কিছু বলার আগে সোমা জ্ঞান হারায়। সোমার ভীষণ জ্বর। শায়লা বেগম তার মাথায় জ্বলপট্টি দিচ্ছে। আর সোমার বাবা গেছেন বাকিদের সাথে রমিজ আলীর জানাযা পড়তে। গত কাল রমিজ আলীর দেহটা বট গাছের সাথে ফাঁস দেওয়া অবস্থায় পাওয়া গেছে। খুব নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়েছে তাকে। তার দেহটা যখন পাওয়া যায় তখন দেখতে পাওয়া যায় যে, তার একটা চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে। তার নগ্ন দেহে হাজার ও আঁচড় আর কামড়ের দাগ। কোনো কোনো জায়গায় মাংস তুলে নেওয়া হয়েছে কামড়ে। তাছাড়া তার বুকের মাঝখান থেকে চিঁড়ে রাখা হয়েছে। ভিতরে যা কিছু আছে সব বেরিয়ে চলে এসেছে। পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট অনুযায়ী পরে জানা যায় যে, তার গায়ে যেসব আঁচড়ের দাগ পাওয়া গেছে তা বিড়ালের নখের আঁচড়। আর কামড় গুলো মানুষের। এছাড়া আরও জানা যায় যে, রমিজ আলী নিজে গলায় ফাঁস দেয়নি, কয়েক জন মিলে তার গলা টিপে তাকে হত্যা করেছে, তারপর গাছের সাথে তার নগ্ন দেহটা ঝুলিয়ে দিয়েছে। রমিজ আলীর মৃত্যুটা সবার কাছে রহস্য থেকে গেল। সোমা ছাড়া আর কেউ জানল না সেদিন বিকেলে কি হয়েছিল।”
আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প প্রতিযোগিতা – ১ এ দ্বিতীয় স্থান অর্জনকারী ‘ডাকপিয়ন‘ সামাজিক ছোটগল্পটি পড়তে ক্লিক করুন >> ডাকপিয়ন । জুয়েল ইসলাম । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প
সোমা ও মিনি । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প । লেখক পরিচিতি
লেখকঃ সানজিদা প্রীতি
ছোটগল্পঃ সোমা ও মিনি
গল্পের জনরাঃ ভৌতিক
দেশের বাড়িঃ নোয়াখালী
পড়াশোনাঃ বোটানি বিভাগ, নোয়াখালী সরকারি কলেজ,(স্নাতকে অধ্যয়নরত আছি) ২০১৮।
সাহিত্যের জগতে এখনও নবীন। লিখালিখিটা এখন নেশায় পরিনত হয়েছে।ইচ্ছে আছে লিখালিখি নিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত যাওয়ার।
5 Comments
[…] সোমা ও মিনি । সানজিদা প্রীতি । আত্মপ্র… […]
[…] 0sharesসানজিদা প্রীতির লেখা ‘অপেক্ষা’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছোটগল্পটি আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প প্রতিযোগিতা – ০২ এ তৃতীয় স্থান অর্জন করে এবং আনোয়ার পাশা রচিত ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত‘ আলোচিত বইটি পুরস্কার হিসেবে জিতে নেয়। মুশফিক সাহেব হন্যে হয়ে বাজারের দিকে ছুটছেন। রেশনের যাবতীয় চাল,ডাল,আলু হাতের কাছে যা পাবেন অন্তত এক মাসের জন্য সব কিছুই কিনে নিয়ে আসবেন। তিনি সকাল বেলায় রেডিওতে খবরে শুনতে পেয়েছেন দেশে অবস্থা দিনকে দিন চরম খারাপ হচ্ছে। সারাদেশে নাকি কারফিউ জারি করা হয়েছে। মিলিটারীরা শহর,গ্রাম কিছুই বাদ দিচ্ছে না। যেখানেই মানুষ দেখছে সেখানেই পাখির মতো গুলি করে মানুষ মারছে তারা। তাদের এই গ্রামেও যে মিলিটারীরা আসবে না তার তো কোনো নিশ্চয়তা নাই। তাই তিনি ঠিক করেছেন আগামী এক মাস আর বাড়ি থেকে বের হবেন না। এই এক মাসে যা যা লাগবে সব কিছুই তিনি বাজার থেকে নিয়ে আসবেন। এইদিকে তিনি তার বড় ছেলে, রাসেলকে পাঠিয়েছেন তার বড় মেয়ে শানুকে নিয়ে আসার জন্য। শানু পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মুশফিক সাহেবদের পাশের গ্রামেই শানুর শ্বশুরবাড়ি। তারপরও তিনি চান তার মেয়ে তার কাছেই থাকুক এই সময়টাতে। তিনি চেষ্টা করছেন তার সম্পূর্ণ পরিবারটিকে আগলে রেখে সুরক্ষা দিতে। যায় হোক চাল,ডালের সাথে ভালো কিছুও নিতে হবে। বাড়িতে জামাই আসছে তাকে তো আর যেমন তেমন করে আপ্যায়ন করা যায় না। বাজার শেষ করে বাড়ি ফিরে শানুকে দেখতে পেয়ে মুশফিক সাহেব আবেগ জড়িত কণ্ঠে বললেন, “শানু মা আমার! তুই আসলি কখন?কতদিন পরে আমার মা’টাকে দেখলাম।জামাই আসে নাই?” শানু বসা থেকে উঠে মুশফিক সাহেবের পা ধরে সালাম করে বলল,”আব্বা কেমন আছেন? ইসরে ঘামে তো একদম সব কিছু ভিজে গেছে আপনার। এই রাবেয়া,কহিনুর আব্বার হাত থেকে বাজারগুলো নিয়ে যা তো। আপনি একা একা বাজারে গেলেন কেন? আমার জন্য না পাঠিয়ে রাসেলকে সাথে নিয়ে গেলেই তো পারতেন।” শানু নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে মুশফিক সাহেবের মুখের ঘাম মুছে দিতে দিতে আবার বলল, “এই বয়সে এতো কিছু করা ঠিক না আব্বা। আর আপনার নাকি শরীর খারাপ? এই শরীর খারাপ নিয়ে কেন গেলেন বাজারে?” মুশফিক সাহেব মৃদু হেসে বললেন,” বয়স হইছে না মা। এখন তো শরীর একটু আধটু খারাপ হবেই। তা জামাই আসে নাই?” শানু মাথার কাপড়টা টেনে নিয়ে বলল,” আসবেন তিনি। বলল কী কাজ আছে ওখানে যাবেন। দুপুরের দিকে এখানে আসবেন। আব্বা আপনি আগে চলেন তো ঘরে ওইসব কথা পড়েও বলা যাবে।আপনাকে একটু পাখা দিয়ে বাতাস করি।” মুশফিক সাহেব তার চার ছেলে-মেয়ের মধ্যে শানুকে সব থেকে বেশি ভালোবাসেন। মেয়ের যেন যত্নের কোনো কমতি না থাকে তাই তিনি তার স্ত্রী লায়লা বানুকে ডেকে আলাদা করে বলে দিয়েছেন। এতোদিন পরে বড় বোনকে পেয়ে ছোট ভাই-বোনগুলোর যেমন আনন্দের সীমা নেই তেমনই যেন তাদের কথার ও শেষ নেই। তাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন এতোদিন সব কথা তারা জমিয়ে রেখেছে শানু আসলে সব কিছুই বলে শেষ করবে বলে। সন্ধ্যা বেলায় চার ভাই-বোন মিলে গল্পের আসরে বসলো। গ্রামে কার কী হয়েছে,স্কুলে কী হয়েছে সব কিছুই বলে যাচ্ছে আর খিলখিল করে হাসছে তারা। কথা বলার এক পর্যায়ে রাবেয়া বলল,”জানিস আপা দেশে নাকি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।মিলিটারীরা নাকি মানুষ খুন করছে।” শানু রাবেয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,”তোকে কে বলেছে?কার কাছ থেকে শুনলি এইসব আজগুবি কথা?” রাসেল তখন বলল,”আপা আজগুবি না এইটা সত্যি কথা।আব্বা প্রতিদিন রেডিও শুনে আমরাও সে রেডিওতেই শুনতে পেয়েছি।এইজন্যই তো আব্বা তোকে এখানে নিয়ে এসেছে।” শানু কিছু বলতে যাবে তার আগে কহিনুর বলে উঠল, “আপা আজকেও সাতটার সময় রেডিও তে খবর দিবে তখন তুই শুনিস। জানিস আপা রেডিও তে মাঝে মাঝে একটা লোক কেমন করে যেন কথা বলে। শুনলে মনে হয় যেন তার খুব সর্দি হয়েছে। কথা বললেই সর্দি পড়ে যাবে।” এই কথা বলেই কহিনুর হিহি করে হাসতে শুরু করল। কহিনুরের এমন উচ্চ হাসির শব্দ শুনে লায়লা বানু রেগে গিয়ে পাশের ঘর থেকে বললেন,”এতো হাসি আসে তোদের কোথেকে?এই ভর সন্ধ্যায় এমন হাসি ভালো না। আল্লাহরে ডাক তাও কাজে দিবে। হাসি বন্ধ করবি তোরা?এমন যে হাসতেছিস তোরা, বিপদ একটা তো ঘরে টেনে নিয়ে আসতেছিস। যত হাসি তত কান্না ভুলে যাবি না। এই আমি বলে রাখলাম তোদের এই হাসি একটা বিপদকে ঘরে ডেকে নিয়ে আসতেছে।” মায়ের এমন কথা যেন তাদের হাসির জোয়ারকে আরও উসকে দিয়েছে। একজন হেসে আরেক জনের গায়ে পড়ছে তারা।শানু হাসতে হাসতে বলল,”কহিনুর তুই আগের মত খেচরই রয়ে গেলি।আর কিছু বলিস না মা না হয় এইবার ঘরে এসে দুই চারটা পিঠের উপর লাগিয়ে দিবে।” লায়লা বানু আবার চেঁচিয়ে বললেন,”রাবেয়া,কহিনুর রান্না ঘরের আয়।হাতে হাতে কাজ করলেও তো কাজ গুলো শেষ হয়ে যায়।” লায়লা বানুর কথা শুনে কহিনুর আর রাবেয়া দুজনে আড্ডা ছেড়ে ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও চলে গেলো। মুশফিক সাহেব এবং শানুর বর মোরশেদ বারান্দায় বসে কথা বলছেন। রাবেয়া দুজনের জন্য সন্ধ্যার চা-নাস্তা নিয়ে এলো। কথা বলার এক পর্যায়ে মোরশেদ বলল,”আব্বা শুনলাম আপনাদের গ্রামে রাজাকারদের একটা বাহিনী গঠন করা হইছে। এই সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন নাকি?” মুশফিক সাহেব চশমার ফ্রেম মুছতে মুছতে বলল,”ওইভাবে তেমন কিছুই জানি না। তবে বাজারে টুকটাক কিছু শুনছি। গ্রামের চেয়ারম্যানের ছেলে আর তার বন্ধু-বান্ধবরা মিলে একটা বাহিনী গঠন করছে শুনলাম। গ্রামের চৌকিদারটাও ওই দলে আছে। দলের প্রধান নাকি চেয়ারম্যান নিজেই। মানুষজন ধরে ধরে দাওয়াত দিচ্ছে তাদের দলে যোগ দেওয়ার জন্য।” এতক্ষণ রাবেয়া দুজনের কথা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিল।এইবার সে সাহস করে মোরশেদের দিকে জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,”দুলাভাই এই রাজাকারটা কী?” মোরশেদ হেসে উত্তর দিলো,”শালিকা তা তুমি বুঝবা না। তবে এইটুকু জেনে রাখ যে যারা এই দেশের মাটির সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে পাকিস্তানী মিলিটারীদের সাহায্য করছে।” রাবেয়া কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাবে তার আগে মুশফিক সাহেব বললেন,”থাক ওইসব নিয়ে আর কোনো কথা বলার দরকার নাই। কে কোথায় লুকিয়ে আবার এইসব শুনে কী প্যাঁচ লাগাবে তার ঠিক নাই। রাবেয়া যা তো রেডিওটা নিয়ে আয় ঘর থেকে।” রাবেয়া দৌড় দিয়ে গিয়ে রেডিওটা নিয়ে আসলো। সকলে বসে রেডিও’র খবর শুনছে।খবরের শেষে দেশাত্মবোধক গান চলতে শুরু করলো। রাতে ঘুমানোর জন্য শানুদের দেওয়া হয়েছে আলাদা রুম। শানু আর মোরশেদ পাশাপাশি শুয়ে আছে। শানু একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল,”আপনাকে একটা প্রশ্ন করব?” মোরশেদ উত্তরে বলল,”হুম কর।” শানু বলতে শুরু করল, “দেশে নাকি যুদ্ধ শুরু হইছে?কিসের যুদ্ধ? আপনিও তো আমারে কিছুই বললেন না এই নিয়ে।আজকে রাবেয়ারা না বললে তো আমি শুনতামই না।” মোরশেদ বলল,”হুম যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।দেশকে স্বাধীন করার যুদ্ধ। শত্রুদের হাত থেকে প্রতিটি বাঙালিকে রক্ষা করার যুদ্ধ। দেশের মাটিকে রক্ষা করার যুদ্ধ।” শানু আবারও জিজ্ঞাসা করল,”কার সাথে কে যুদ্ধ করছে?আমাদের এখানে তো সব কিছুই ঠিক আছে তাহলে কেন যুদ্ধ হচ্ছে?” মোরশেদ শানুর হাতটা নিজের হাতে টেনে নিয়ে বলল,”পূর্ব পাকিস্তানের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধ। বাঙালিদের সাথে মিলিটারীদের যুদ্ধ। আমাদের দেশটা অনেক বড় শানু। সেখানে আমরা শুধু একটা গ্রামে থাকি।আমাদের হয়তো কিছু হয়নি কিন্তু অনেক গ্রাম রয়েছে যেখানে মিলিটারীরা আগুন দিয়ে পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে।” দুজনের মধ্যে কিছুক্ষণ নিরবতা চলতে থাকলো। মোরশেদ নিরবতা ভেঙে বলল,”শুনো শানু আমাদের সন্তান হওয়ার সময় যদি আমি না থাকি তবে ভয় পেয়েও না। আমাদের যদি ছেলে সন্তান হয় তবে নাম রাখবে স্বাধীন আর যদি মেয়ে সন্তান হয় তবে নাম রাখবে মুক্তি।” মোরশেদের কথা শুনে শানু উঠে বসে জিজ্ঞাসা করল,”এইসব কী বাজে কথা বলছেন? আপনি থাকবেন না মানে কী?কোথায় যাবেন আপনি?আপনি কী আরেকটা বিয়ে করবেন?” মোরশেদ শানুর কথা শুনে হাসতে লাগল। হাসি থামিয়ে বলল,”আরেকটা বিয়ে করতে যাব কোন দুঃখ? দেখ শানু কথাটা তোমাকে কয়দিন ধরে বলব বলব বলে ভাবছি।এতদিন বলা হয়ে উঠেনি। আমার মনে হচ্ছে কথাটা এখন বলে দেওয়ায় ভালো। আমি যুদ্ধে যাব। দেশের জন্য লড়াই করবো। দেশকে স্বাধীন করব। তুমি একা থাকতে পারবে না?” শানু মোরশেদের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,”আপনার কোথাও যাওয়ার দরকার নাই।আপনি আমার সাথেই থাকবেন।আমি আপনাকে কোথাও যেতে দিব না।” মোরশেদ বড় করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,”শানু তা হয় না।আমাদের মুক্তির দল গঠন করা হয়ে গেছে।আমরা কালকেই ট্রেনিং এর জন্য বেড়িয়ে যাব। মনটাকে শক্ত কর। নিজেদের কথা না ভেবে দেশের কথা ভাব। এভাবে ঘরে বসে পঁচে মরার থেকেও যুদ্ধে গিয়ে দশটা মিলিটারীকে মারতে গিয়ে শহীদ হওয়াও অনেক ভালো। দেখ তুমি মনটাকে শক্ত কর। আম্মা-আব্বার কাছে এখানেই থাক। তুমি এখানে অন্তত থাকলে আমি যুদ্ধে গিয়েও তোমায় নিয়ে একটু দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকবো। অনেক রাত হইছে ঘুমিয়ে পড়। সকালে যা কথা হওয়ার হবে।” মোরশেদ চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। শানুও শুয়ে আছে কিন্তু তার চোখ থেকে যেন ঘুম উধাও হয়ে গিয়েছে।সারারাত সে না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিলো। পরেরদিন সকাল সকাল মোরশেদ বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার সময় শ্বশুরের হাতটা ধরে মোরশেদ বলল,”আব্বা শানুকে আপনার কাছে আমানত রেখে গেলাম।আমি জানি যদিও আপনারা ও’কে খুব যত্নেই রাখবেন তারপরও আবার বলছি ওরে একটু দেখে রাখবেন।” শানুর কান্না দেখে মোরশেদ তার কাছে গিয়ে বলল,” এই রুমালটা রাখ।নিজেকে শক্ত কর। এই সময় এমন কান্না কাটি করলে আমাদের সন্তানের জন্যই ক্ষতি হবে।আমার জন্য অপেক্ষায় থেকো।আমি ফিরে আসবো চিন্তা কর না।” মোরশেদ সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। শানু বাড়ির দরজা ধরে দাঁড়িয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। মোরশেদ যুদ্ধে যাওয়ার পর একবারের জন্যও বাড়ি আসেনি। সময়টাও বসে নেই। দেখতে দেখতে চার মাস কেটে গেলো। শানুর ও বাচ্চা হওয়ার সময়টা ঘনিয়ে এসেছে। সব কিছুই ঠিকঠাক ভাবে চলছিল কিন্তু এর মধ্যেই একদিন গ্রামে মিলিটারীরা এসে হাজির হলো। গ্রামের রাজাকার বাহিনী যোগ দিয়েছে তাদের সাথে। রাজাকারের দল মিলিটারীদের ক্যাম্প করার জন্য গ্রামের স্কুলটাকেই ঠিক করে দিল। মিলিটারীদের খুশি করার জন্য মানুষের বাড়ি থেকে হাঁস,মুরগী,গরু,ছাগল যা পাচ্ছে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারা। শুধু এখানেই শেষ না, তারা ঘর থেকে যুবতী মেয়েদের জোর করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে মিলিটারী ক্যাম্পে। যেখানে সেসব যুবতী মেয়েদের শরীর নিয়ে দিন রাত খেলে যাচ্ছে মিলিটারী জানোয়াররা। মিলিটারীদের এতোটাই কাছের মানুষ তারা হয়ে উঠেছে যে, মিলিটারীদের সাথে মিলে গ্রামের বড় বাজারটাই আগুন ধরিয়ে দিয়েছে রাজাকাররা। চেয়ারম্যান আর তার ছেলে মিলে গ্রাম থেকে যারা যুদ্ধে গিয়েছে তাদের পরিবারের একটা লিস্ট বানিয়ে ফেলেছে। মিলিটারীদের সাথে নিয়ে প্রতিটা পরিবারকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে তারা। মুশফিক সাহেব ছেলে-মেয়েদের বাঁচানোর জন্য বাড়ির মধ্যে করা গুপ্ত ঘরের মধ্যে শানু,রাবেয়া,কহিনুর ও রাসেলকে লুকিয়ে রাখলেন। আজ চেয়ারম্যান ও তার দল সহ মুশফিক সাহেবের বাড়িতে এসে উপস্থিত হলো। মিলিটারী ও রাজাকার বাহিনী সম্পূর্ণ বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও মুশফিক সাহেব আর তার স্ত্রীকে ছাড়া কাউকে পেল না। মিলিটারীর দল মুশফিক সাহেবকে জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছে তার মেয়ের জামাই এখন কোথায়? বাড়ির বাকি সদস্যরা কোথায়। জবাবে মুশফিক সাহেব শুধু একটা কথায় বলে যাচ্ছেন,”আমি জানি না।” এক পর্যায়ে চেয়ারম্যানের কথায় মিলিটারীর এক সৈন্য মুশফিক সাহেবের বুকে গুলি চালিয়ে দেয়। গুলির শব্দ শুনে ঘর থেকে লায়লা বানু দৌড়ে আসেন। তিনি কাছে আসতেই তাকেও গুলি করে মিলিটারীরা। পর পর দুইটি গুলির শব্দ শুনে রাসেল আর কহিনুর শানুদের কথা না শুনে বেড়িয়ে আসে। তারা দৌড়ে উঠনে আসতেই দেখে মুশফিক সাহেব এবং লায়লা বানু দুজনেই মাটিতে শুয়ে আছে। রাসেল উঠনে পড়ে থাকা একটা লাঠি নিয়ে মিলিটারীদের কাছে তেড়ে আসতেই মিলিটারীরা তাকেও গুলি করে মারল। নিজের চোখের সামনে মা-বাবা,ভাইকে মারতে দেখে কহিনুর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল,”আল্লাহ গজব তোদের উপরে পড়বে।তোরা আমার আম্মা-আব্বা,ভাইয়াকে কেন মারলি?আমি তোদের আজকে ছাড়ব না।” বলেই সে রান্না ঘর থেকে দা নিয়ে ছুটে আসলো। চেয়ারম্যান কর্ণেলের কানে কানে কী যেন বলল।তার পর কর্ণেল আরেক সৈন্যকে ইশারা করে বলল কহিনুরকে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যেতে। এইদিকে মিলিটারীর সৈন্যকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে কহিনুর তার হাতের দা টা তার দিকে ছুড়ে মারলো। সৈন্যটার গায়ে গিয়ে দা টা পড়তেই খুব খারাপ ভাবে তার হাতটা কেটে গেলো। সে চিৎকার দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। তখন বাকিদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে কহিনুরের চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে তাকে জিপে নিয়ে তুলল। মিলিটারীরা চলে যাওয়ার পর শানু আর রাবেয়া বেরিয়ে এসে বাবা,মা,ভাইয়ের লাশ ধরে কাঁধতে শুরু করল। এইদিকে কহিনুরকেও ধরে নিয়ে গেছে।তারা এখন কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। দুই বোন মিলে সেদিন রাতে তাদের বাবা-মা,ভাইকে মাটি দিল।বাবা-মা, ভাইকে এভাবে জানাযা ছাড়া কবর দিতে হবে তা কখনও তারা ভাবেনি। তারও বা কী করবে?তাদের পরিবারের মতো আরও অনেক পরিবারকেই মিলিটারীরা হত্যা করেছে। জানাযা পড়ার মতো গ্রামে আর এখন কেউ নেই। তাদের পাশের বাড়ির বুড়ি মা ছাড়া পরিবারের সকলকেই গুলি করে মেরেছে মিলিটারীরা। বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেছে কহিনুর আর বাড়ি ফিরে আসেনি। শানু আর রাবেয়া নিজেদের রক্ষা করে গেছে মিলিটারী আর রাজাকারদের হাত থেকে। এর মধ্যে একদিন শানুর প্রসব ব্যথা উঠেছে। রাবেয়া শানুর এই অবস্থা দেখে তাদের পাশের বাড়ির বুড়ি মাকে ডাকতে গিয়েছে। বুড়ি আসার ঘন্টা খানেক পরে শানুর সন্তান ভূমিষ্ট হলো। তার একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তান হলো। মোরশেদের ঠিক করা নামটাই মেয়ের নাম রাখলো শানু। “মুক্তি”। মেয়ের নাম রেখেছে সে মুক্তি। ক্যালেন্ডারে তারিখ তারিখটা দেখলো শানু। ষোল ডিসেম্বর। শানু তার ডায়েরিতে মুক্তির জন্ম তারিখ আর সালটা লিখে রাখলো। এই ডায়েরিতে শুধু মুক্তির জন্মের কথায় নয় শানু তার জীবনে ঘটে যাওয়া সমস্ত কিছুই লিখে রেখেছে। সেদিন বিকেলে গ্রামের মিলিটারীর দল গ্রাম থেকে চলে যাচ্ছে।গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে দেশ স্বাধীন হয়েছে। অনেকে মিলে আনন্দ মিছিল বেড় করেছে। শানুর আর রাবেয়ার খুশির অন্ত নেই। মুক্তি পৃথিবীতে আসতে তাদের জন্য স্বাধীনতা নিয়ে এসেছে। এইবার কহিনুর, মোরশেদ বাড়ি ফিরে আসবে সে আশায় দুই বোনের চোখ দিয়ে আনন্দের অশ্রু পড়তে লাগল। দিন,মাস, বছর কেটে যেতে লাগল কিন্তু কহিনুর আর মোরশেদ দুজনের কেউই আর বাড়ি ফিরলো না। শানু চোখের পানি ফেলে মোরশেদের জন্য অপেক্ষায় বসে আছে। তার বিশ্বাস একদিন ঠিক কহিনুর আর মোরশেদ ঠিকি ফিরে আসবে। ————-সমাপ্ত——————— আরো পড়ে নিতে পারেন, সানজিদা প্রীতি রচিত ছোটগল্প >> সোমা ও মিনি […]
[…] সানজিদা প্রীতি রচিত ছোটগল্প >> সোমা ও মিনি আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প […]
[…] সানজিদা প্রীতি রচিত ভৌতিক গল্প >> সোমা ও মিনি […]
[…] সানজিদা প্রীতি রচিত ছোটগল্প >> সোমা ও মিনি আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প […]