চাণক্যের নীতি । আলোচিত ও বাছাইকৃত বাণী, শ্লোক ও উক্তি সমাবেশ
চাণক্য; যিনি কৌটিল্য বা বিষ্ণগুপ্ত নামেও পরিচিত। তার জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০ অব্দে। তিনি ছিলেন প্রাচীন ভারতীয় একজন দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ ও রাজ-উপদেষ্টা এবং অর্থশাস্ত্র নামক রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ক বিখ্যাত গ্রন্থের রচয়িতা। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে তার পাণ্ডিত্যের জন্য তাকে ভারতের মেকিয়াভেলি বলা হয়। তার রচনা গুপ্ত সাম্রাজ্র্যের শাসনের শেষ দিকে অবলুপ্ত হয় এবং পুনরাবিষ্কৃত হয় ১৯১৫ সালে। তিনি প্রাচীন তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও রাষ্ট্রনীতির অধ্যাপক ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও তার পুত্র বিন্দুসারের রাজ-উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ২৮৩ অব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পরামর্শ ও কৌশলের বলেই রাজা চন্দ্রগুপ্ত তাঁর রাজ্য উদ্ধার করতে পেরেছিলেন এবং টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাজা চন্দ্রগুপ্তের পাশাপাশি চাণক্য তাঁর বন্ধু, স্বজন ও প্রজাদের নানা সমস্যার সমাধান দিতেন। আত্মপ্রকাশের আজকের আয়োজনে থাকছে চাণক্যের বাণী, মহামূল্যবান শ্লোক এবং তাঁর নীতির দর্শন।
চাণক্যের বাণী, উক্তি ও শ্লোক সমাবেশ
চাণক্য জীবন এবং সংগ্রামকে সহজ ভাবে দেখেছিলেন। তাইতো রাজ উপদেষ্টা হয়েও কুঁড়েঘরে জীবন যাপন করেছেন। চাণক্যের নীতি দ্বারা যেকোনো মানুষের চিন্তাধারা পরিবর্তন হতে পারে। চাণক্যের নীতিগুলো নিম্নে তিনভাগে ভাগে উপস্থাপন করা হলো।
রচনার ভাগসমূহ
জীবন দর্শন নিয়ে চাণক্যের উক্তি
চাণক্যের জীবন দর্শন যেকোনো মানুষের জীবন দর্শন বদলে দিতে সক্ষম। অল্প শব্দের বিনিময়ে তিনি জীবনের নিগূঢ় রহস্য উদঘাটন করেছেন সরল বাক্যের বিনিময়ে। চাণক্যের জীবন দর্শন ও বাছাইকৃত উক্তিগুলো নিম্নে সাজানো হয়েছে।
“যারা পরিশ্রমী, তাদের জন্যে কোনকিছুই জয় করা অসাধ্য কিছু নয়।”
“শিক্ষিত কোন ব্যক্তির জন্যে কোন দেশই বিদেশ নয়।”
“বিদ্যাবত্তা ও রাজপদ এ-দুটি কখনও সমান হয় না। রাজা কেবল নিজদেশেই সমাদৃত, বিদ্বান সর্বত্র সমাদৃত।”
“মিষ্টভাষীদের কোন শত্রু নেই।”
“সকল উদ্যোগ নির্ভর করে অর্থের ওপর।”
“তহবিল তসরুপ বা অর্থ আত্মসাতের চল্লিশটি পদ্ধতি আছে।”
“ বাল বৃদ্ধ যুবা যেই হোক না অতিথি,
গুরুজ্ঞান তার-ই সেবা গৃহস্থের রীতি ”
“মন খাঁটি হলে পবিত্র স্থানে গমন অর্থহীন ”
“বিষ থেকে সুধা, নোংরা স্থান থেকে সোনা, নিচ কারো থেকে জ্ঞান এবং নিচু পরিবার থেকে শুভলক্ষণা স্ত্রী – এসব গ্রহণ করা সঙ্গত ”
“মনের বাসনাকে দূরীভূত করা উচিত নয়। এই বাসনাগুলোকে গানের গুঞ্জনের মতো কাজে লাগানো উচিত। ”
“ অবহেলায় কর্মনাশ হয়, যথেচ্ছ ভোজনে কুলনাশ হয়, যাঞ্চায় সম্মান-নাশ হয়, দারিদ্র্যে বুদ্ধিনাশ হয়। ”
“যে রাজা শত্রুর গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা করতে পারে না এবং শুধু অভিযোগ করে যে তার পিঠে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে, তাকে সিংহাসনচ্যুত করা উচিত ”
“বিরাট পশুপালের মাঝেও শাবক তার মাকে খুঁজে পায়। অনুরূপ যে কাজ করে অর্থ সবসময় তাকেই অনুসরণ করে।”
“সুবেশভূষিত মূর্খকে দূর থেকেই দেখতে ভাল, যতক্ষণ সে কথা না বলে ততক্ষণই তার শোভা, কথা বললেই মূর্খতা প্রকাশ পায়।”
“যারা রূপযৌবনসম্পন্ন এবং উচ্চকুলজাত হয়েও বিদ্যাহীন, তাঁরা সুবাসহীন পলাশ ফুলের মত বেমানান।”
“দারিদ্র্য, রোগ, দুঃখ, বন্ধন এবং বিপদ- সব কিছুই মানুষের নিজেরই অপরাধরূপ বৃক্ষের ফল।”
“ভোগবাসনায় বুদ্ধি আচ্ছন্ন হয়।”
“মিত ভোজনেই স্বাস্থ্যলাভ হয়।”
“যশবানের বিনাশ নেই।”
“যে অলস, অলব্ধ-লাভ তার হয় না।”
“অহংকারের মত শত্রু নেই।”
“পাপীরা বিক্ষোভের ভয় করে না।”
“ধর্মের চেয়ে ব্যবহারই বড়।”
“কর্কশ কথা অগ্নিদাহের চেয়েও ভয়ঙ্কর।”
“খেয়ে যার হজম হয়, ব্যাধি তার দূরে রয়।”
“গুণবানকে আশ্রয় দিলে নির্গুণও গুণী হয়।”
“একটি দোষ বহু গুণকেও গ্রাস করে।”
“উপায়জ্ঞ মানুষের কাছে দুঃসাধ্য কাজও সহজসাধ্য।”
আরো পড়ে নিতে পারেন >>
চাণক্যের উপদেশ বাণী সমূহ
চাণক্যের উপদেশ না বলে চাণক্যের দেখানো পথ বলা শ্রেয়। জীবনের জটিল সমীকরণ সহজ হয়ে যায় তাঁর উপদেশ বাণীর কল্যাণে।
“হাতি থেকে একহাজার হাত দূরে, ঘোড়া থেকে একশ হাত দূরে, শৃঙ্গধারী প্রাণী থেকে দশহাত দূরে থাকবে। অনুরূপ দুর্জনের কাছ থেকেও যথাসম্ভব দূরে থাকবে।”
“অন্তঃসার শূন্যদের উপদেশ দিয়ে কিছু ফল হয় না, মলয়-পর্বতের সংসর্গে বাঁশ চন্দনে পরিণত হয় না।”
“আড়ালে কাজের বিঘ্ন ঘটায়, কিন্তু সামনে ভাল কথা বলে, যার উপরে মধু কিন্তু অন্তরে বিষ, তাকে পরিত্যাগ করা উচিত।”
“পাঁচ বছর বয়স অবধি পুত্রদের লালন করবে, দশ বছর অবধি তাদের চালনা করবে, ষোল বছরে পড়লে তাদের সঙ্গে বন্ধুর মত আচরণ করবে।”
অন্যান্য জ্ঞানী গুণীদের উপদেশসমূহ জেনে নিন>>
চাণক্যের শ্লোক
শ্লোক নিয়ে দ্বিধাদ্বন্ধ থাকলেও চাণক্যের পদ্য আকারে লেখা নীতি বাক্যগুলোকেই শ্লোক বলা হচ্ছে। অর্থাৎ শ্লোক দ্বারা আমরা চাণক্যের কাব্য প্রতিভার দেখা পাই। যাতে জীবনের পথ বাৎলে দেওয়া আছে।
“অতি পরিচয়ে দোষ আর ঢাকা থাকে না।”
“অধমেরা ধন চায়, মধ্যমেরা ধন ও মান চায়। উত্তমেরা শুধু মান চায়। মানই মহতের ধন।”
“অনেকে চারটি বেদ এবং ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করলেও আত্মাকে জানে না, হাতা যেমন রন্ধন-রস জানে না।”
“অবহেলায় কর্মনাশ হয়, যথেচ্ছ ভোজনে কুলনাশ হয়, যাচ্ঞায় সম্মান-নাশ হয়, দারিদ্র্যে বুদ্ধিনাশ হয়।”
“অভ্যাসহীন বিদ্যা, অজীর্ণে ভোজন, দরিদ্রের সভায় কালক্ষেপ এবং বৃদ্ধের তরুণী ভার্যা বিষতুল্য।”
“আকাশে উড়ন্ত পাখির গতিও জানা যায়, কিন্তু প্রচ্ছন্নপ্রকৃতি-কর্মীর গতিবিধি জানা সম্ভব নয়।”
“আদর দেওয়ার অনেক দোষ, শাসন করার অনেক গুণ, তাই পুত্র ও শিষ্যকে শাসন করাই দরকার, আদর দেওয়া নয়।”
“আপদের নিশ্চিত পথ হল ইন্দ্রিয়গুলির অসংযম, তাদের জয় করা হল সম্পদের পথ, যার যেটি ঈপ্সিত সে সেই পথেই যায়।”
“ইন্দ্রিয়ের যে অধীন তার চতুরঙ্গ সেনা থাকলেও সে বিনষ্ট হয়।”
“উৎসবে, বিপদে, দুর্ভিক্ষে, শত্রুর সঙ্গে সংগ্রামকালে, রাজদ্বারে এবং শ্মশানে যে সঙ্গে থাকে, সে-ই প্রকৃত বন্ধু।”
“ঋণ, অগ্নি ও ব্যাধির শেষ রাখতে নেই, কারণ তারা আবার বেড়ে যেতে পারে।”
“একটি কুবৃক্ষের কোটরের আগুন থেকে যেমন সমস্ত বন ভস্মীভূত হয়, তেমনি একটি কুপুত্রের দ্বারাও বংশ দগ্ধ হয়।”
“একটিমাত্র পুষ্পিত সুগন্ধ বৃক্ষে যেমন সমস্ত বন সুবাসিত হয়, তেমনি একটি সুপুত্রের দ্বারা সমস্ত কুল ধন্য হয়।”
“একশত মূর্খ পুত্রের চেয়ে একটি গুণী পুত্র বরং ভাল। একটি চন্দ্রই অন্ধকার দূর করে, সকল তারা মিলেও তা পারে না।”
“গুণহীন মানুষ যদি উচ্চ বংশেও জন্মায় তাতে কিছু আসে যায় না। নীচকুলে জন্মেও যদি কেউ শাস্ত্রজ্ঞ হয়, তবে দেবতারাও তাঁকে সম্মান করেন।”
“গুরু শিষ্যকে যদি একটি অক্ষরও শিক্ষা দেন, তবে পৃথিবীতে এমন কোনও জিনিস নেই, যা দিয়ে সেই শিষ্য গুরুর ঋণ শোধ করতে পারে।”
“গৃহে যার মা নেই, স্ত্রী যার দুর্মুখ তার বনে যাওয়াই ভাল, কারণ তার কাছে বন আর গৃহে কোনও তফাৎ নেই।”
“চন্দন তরুকে ছেদন করলেও সে সুগন্ধ ত্যাগ করে না, যন্ত্রে ইক্ষু নিপিষ্ট হলেও মধুরতা ত্যাগ করে না, যে সদ্বংশজাত অবস্থা বিপর্যয়েও সে চরিত্রগুণ ত্যাগ করে না।”
“তিনটি বিষয়ে সন্তোষ বিধেয়: নিজের পত্নীতে, ভোজনে এবং ধনে। কিন্তু অধ্যয়ন, জপ, আর দান এই তিন বিষয়ে যেন কোনও সন্তোষ না থাকে।”
“দুর্জনের সংসর্গ ত্যাগ করে সজ্জনের সঙ্গ করবে। অহোরাত্র পুণ্য করবে, সর্বদা নশ্বরতার কথা মনে রাখবে।”
“দুর্বলের বল রাজা, শিশুর বল কান্না, মূর্খের বল নীরবতা, চোরের মিথ্যাই বল।”
“দুষ্টা স্ত্রী, প্রবঞ্চক বন্ধু, দুর্মুখ ভৃত্য এবং সর্প-গৃহে বাস মৃত্যুর দ্বার, এ-বিষয়ে সংশয় নেই।”
“নানাভাবে শিক্ষা পেলেও দুর্জন সাধু হয় না, নিমগাছ যেমন আমূল জলসিক্ত করে কিংবা দুধে ভিজিয়ে রাখলেও কখনও মধুর হয় না।”
“পরস্ত্রীকে যে মায়ের মত দেখে, অন্যের জিনিসকে যে মূল্যহীন মনে করে এবং সকল জীবকে যে নিজের মত মনে করে, সে-ই যথার্থ জ্ঞানী।”
“পুত্র যদি হয় গুণবান, পিতামাতার কাছে তা স্বর্গ সমান।”
“পুত্রকে যারা পড়ান না, সেই পিতামাতা তার শত্রু। হাঁসদের মধ্যে বক যেমন শোভা পায় না, সভার মধ্যে সেই মূর্খও তেমনি শোভা পায় না।”
“বইয়ে থাকা বিদ্যা, পরের হাতে থাকা ধন একইরকম। প্রয়োজন কালে তা বিদ্যাই নয়, ধনই নয়।”
“বিদ্বান সকল গুণের আধার, অজ্ঞ সকল দোষের আকর। তাই হাজার মূর্খের চেয়ে একজন বিদ্বান অনেক কাম্য।”
“বিদ্যা ব্যতীত জীবন ব্যর্থ, কুকুরের লেজ যেমন ব্যর্থ, তা দিয়ে সে গুহ্য-অঙ্গও গোপন করতে পারে না, মশাও তাড়াতে পারে না।”
“বিদ্যাভূষিত হলেও দুর্জনকে ত্যাগ করবে, মণিভূষিত হলেও সাপ কি ভয়ঙ্কর নয়?”
“বিদ্যার চেয়ে বন্ধু নাই, ব্যাধির চেয়ে শত্রু নাই। সন্তানের চেয়ে স্নেহপাত্র নাই, দৈবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বল নাই।”
“বিনয়ই সকলের ভূষণ।”
“বিষ থেকেও অমৃত আহরণ করা চলে, মলাদি থেকেও স্বর্ণ আহরণ করা যায়, নীচজাতি থেকেও বিদ্যা আহরণ করা যায়, নীচকুল থেকেও স্ত্রীরত্ন গ্রহণ করা যায়।”
“যে গাভী দুধ দেয় না, গর্ভ ধারণও করে না, সে গাভী দিয়ে কী হবে! যে বিদ্বান ও ভক্তিমান নয়, সে পুত্র দিয়ে কী হবে!”
“রাতের ভূষণ চাঁদ, নারীর ভূষণ পতি, পৃথিবীর ভূষণ রাজা, কিন্তু বিদ্যা সবার ভূষণ।”
“শাস্ত্র অনন্ত, বিদ্যাও প্রচুর। সময় অল্প অথচ বিঘ্ন অনেক। তাই যা সারভূত তারই চর্চা করা উচিত। হাঁস যেমন জল-মিশ্রিত দুধ থেকে শুধু দুধটুকুই তুলে নেয়, তেমনি।”
“সত্যনিষ্ঠ লোকের অপ্রাপ্য কিছুই নাই।”
“সত্যবাক্য দুর্লভ, হিতকারী-পুত্র দুর্লভ, সমমনস্কা-পত্নী দুর্লভ, প্রিয়স্বজনও তেমনি দুর্লভ।”
“সাপ নিষ্ঠুর খলও নিষ্ঠুর, কিন্তু সাপের চেয়ে খল বেশি নিষ্ঠুর। সাপকে মন্ত্র বা ওষধি দিয়ে বশ করা যায়, কিন্তু খলকে কে বশ করতে পারে?”
চাণক্যের বাণী, শ্লোক, উক্তি বা নীতিবাক্য যেভাবেই বলা হোক, চাণক্যের মূল বিষয় বস্তু ছিল জগত সংসারে টিকে থাকতে জীবন ও সমাজের রহস্য জানা এবং তিনি তাঁর নীতি বাক্যের দ্বারা জীবন চলার কঠিন পথকে সহজ করেছেন। যা যুগে যুগে তাঁর অস্বিত্বকে ঠিকিয়ে রেখেছে।