নীরু >> মাহমুদা মিনি । ভৌতিক । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প
মাহামুদা মিনি রচিত ‘নীরু’ ভৌতিক ছোটগল্পটি ‘আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প প্রতিযোগিতা – ০৪’ এ প্রথম স্থান অর্জন করে।
“আকাশের বুকে চাঁদের সাথে মেঘের লুকোচুরি চলছে। কখনো চাঁদ হাসছে আবার কখনো মেঘ গ্রাস করে নিচ্ছে চাঁদকে। এই লুকোচুরি খেলায় সঙ্গ দিচ্ছে প্রায় জনমানবহীন এক পাহাড়ী এলাকা। মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকা মাঝারি আকারের পাহাড়ের চূড়া ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে হালকা বাতাস। এ বাতাস পাহাড়ে ধাক্কা লেগে অদ্ভুত একটা সুর তৈরি করছে পুরো পাহাড়ী এলাকা জুড়ে। অদ্ভুত নিঃসঙ্গতায় ডুবে যাচ্ছে বিস্তৃত এলাকা।
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল মীরার। অভ্যাসবশত পাশে হাত বাড়িয়ে নীরুকে ছোঁয়ার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু কয়েকবার খুঁজেও মেয়েটার স্পর্শ অনুভব করতে না পেরে চমকে উঠল। আরেকটু এগিয়ে হাত বাড়াতেই কবিরের মুখে হাত লাগল।
নীরু কোথায় গেল?
মীরা ভয়ে হুড়মুড় করে উঠে বসে কবিরকে ডাকল। কবির তখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ওর কোনো সাড়া না পেয়ে মীরা রুমের লাইট অন করতে গেল। তবে সেখানেও সে হতাশ হলো, কারেন্ট নেই। অগত্যা সে টেবিলের উপর মোবাইল খুঁজতে শুরু করলো।
এমন সময় সে ঘরের আরেক কোণে রাখা দোলনাটা দোলার শব্দ শুনতে পেল। একটা ক্যাচক্যাচ শব্দ হচ্ছে। মনে হলো দোলনাটা কেউ ঠেলছে। তার মানে নীরু এখন দোলনাতে আছে।
অন্ধকারে হাতড়ে-হাতড়ে মীরা দোলনাটা যেখানে রাখা সেখানে গিয়ে চেয়ার খুঁজে বসে পড়ল। দোলনাতে হাত দিতেই আচমকা কেউ একজন তার হাতটা ধরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো।
মীরার চিৎকারে কবিরের ঘুম ভাঙল। কবির দ্রুত উঠে টর্চ জ্বালিয়ে দেখল মীরা ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে অজ্ঞান হয়ে। মীরার চোখে পানির ছিটা দিতেই ওর জ্ঞান ফিরল তারপর আতঙ্কগ্রস্ত চোখে কবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-আমার নীরু কই?”
কবির স্বাভাবিকভাবেই বলল,
-নীরু তো বিছানায় ঘুমোচ্ছে। তাকিয়ে দেখো। তুমি চিৎকার করলে কেন? আর মেঝেতেই বা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছ কেন?”
মীরা কোনো কথা না বলে কবিরের হাত থেকে টর্চটা নিয়ে বিছানার উপর ফেলল। নীরু দলা পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ওর ছোট্ট হাত দুটো পেটের কাছে রাখা। নাকে চিকচিক করছে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে মেয়েটা।
মীরা নীরুর পাশে বসে অবিশ্বাসের সুরে বলল,
-কিছুতেই এটা হতে পারে না। একটু আগেই আমি ওকে বিছানাতে খুঁজে পাইনি। ও দোলনাতে ছিল। দোলনাটা দুলছিল।”
কবির হালকা হেসে বলল,
-তোমার শরীরটা দুর্বল মীরা। তোমার বিশ্রাম দরকার। তুমি মাঝরাতে ভুল ভেবেছো। নীরুর বয়স দেড়বছর। ও উচু বিছানা থেকে নেমে একা-একা অন্ধকারে দোলনাতে গিয়ে ঘুমোতে পারে না।”
মীরা চুপ করে গেল। তবে তার মনে একটা অদ্ভুত অশান্তি শুরু হলো। সে এমন ভুল করতে পারে না। কিছুতেই না।
নীরুর বয়স দেড়বছর। মীরা এবং কবিরের একমাত্র মেয়ে ও। কবির একজন ডাক্তার, বর্তমানে এই পাহাড়ি এলাকার হাসপাতালে চাকরি করছে এবং মীরা গৃহিনী। গতমাসে তারা পাহাড়ের উপরে এই সুন্দর বাড়িটা কিনেছে খুব কম দামে। মীরা মেয়েকে নিয়ে সারাদিন বাসায় একাই থাকে। বাসায় অতিরিক্ত লোক বলতে একজন দারোয়ান আছে। আর কেউ নেই।
মনে অদ্ভুত অস্বস্তি নিয়ে মীরা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোতে চেষ্টা করলো। তবে একটু পরপর সে দোলনা নড়ার শব্দ পেতে শুরু করলো এবং নীরুকে জড়িয়ে ধরে রাখল। একটা ভয় এসে জাপটে ধরতে চাইলো তাকে।
পরদিন দুপুরে,
কবির হাসপাতালে গিয়েছে। দারোয়ান বাজারে গিয়েছে সবজি কিনতে। মীরা নীরুকে গোসল করাতে বসেছে। হঠাৎ সে খেয়াল করলো নীরুর কাঁধে একটা কালো দাগ। বড় একটা কালো টিপের মতো। সে অবাক হলো কারণ গতকালও সে এই দাগটা দেখেনি, একদিনে হঠাৎ এমন দাগ হওয়া অসম্ভব বলে মনে হলো তার। পানি দিয়ে কয়েকবার ঘষে দেখল সে। তবে দাগটা উঠে যাওয়ার বদলে আরও জ্বলজ্বল করে উঠল।
বুকের ভিতর অজানা আতঙ্কে কাঁপতে শুরু করলো মীরার। কালো দাগটাকে তার অশুভ মনে হলো। এ যেন কোনো বিপদের ইঙ্গিত।
কোনোমতে গোসল করিয়ে নীরুকে খাইয়ে ঘুম পাড়াতে নিয়ে গেল মীরা। দুঃচিন্তায় সে ছটফট করছে। সে বুঝতে পারছে তার মেয়েকে ঘিরে অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটছে।
নীরু আজ খুব দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ল। মীরার চোখদুটোও বুজে এসেছে ঘুমে। হঠাৎ মীরা বুঝতে পারলো তার মুখের উপর টপটপ করে তরল কিছু পড়ছে। চোখ খুলে সে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে দেখল ফ্যান থেকে ফোঁটায়-ফোঁটায় রক্ত এসে তার চোখে-মুখে পড়ছে। সে আতঙ্কিত হয়ে ভাবছে রক্ত কীভাবে গেল ফ্যানের উপর। কে ফেলল?
ভয়ে উঠে বসতেই সামনের আয়নাতে মীরার চোখ পড়ল। নিজের রক্তাক্ত মুখটা দেখে সে ভয়ে চিৎকার করে উঠল। তখনই তার মনে পড়ল নীরুর কথা। নীরু কোথায়? বুকের ভিতর কেঁপে উঠল আবার। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দোলনার দিকে তাকাতেই বিস্ময়ে, ভয়ে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। বিস্ফারিত চোখে সে দেখল নীরু দোলনাতে শুয়ে। দোলনার সামনে রাখা চেয়ারে বসে আছে হুবহু তার মতো দেখতে একজন ক্ষতবিক্ষত মুখের মহিলা, যার নাক, মুখ থেকে অনবরত রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। রক্তে লাল হয়ে উঠেছে ঘরের মেঝে। মহিলা তার পঁচা-গলা, শুকনো হাত দিয়ে দোলনাটা আস্তে-আস্তে ঠেলছে। দোলনা থেকে একটা ক্যাচক্যাচ শব্দ তৈরি হচ্ছে। নীরু বুকের উপর হাতদুটো রেখে টানটান হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। ঘুমের মাঝে নীরুর চোখের পাতা মৃদু কেঁপে-কেঁপে উঠছে।
মীরা ঠিক কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সে আড়চোখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল এই ভর দুপুরবেলাতেও অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। আকাশে মেঘ জমেছে। ঝড়ো বাতাস বইছে। হঠাৎ করে যেন আবহাওয়াও বিরুপ আচরণ শুরু করেছে।
সে তার দৃষ্টি আবার ঐ মহিলার উপর ফেলল। সে বুঝতে পারছে গতকাল রাতে সে ঠিকই বুঝেছিল। এই মহিলাই নীরুকে তুলে নিয়ে দোলনাতে শুইয়েছিল। দোলনা এই দোলাচ্ছিল। তার ভাবনা ভুল ছিল না।
মহিলা যে জীবিত না সেটা বুঝতে পেরে মীরার বুকে কাঁপুনি শুরু হলো। একটা আত্মার তাদের ঘরে। ও যদি নীরুর কোনো ক্ষতি করে!
মীরা মেয়ের চিন্তায় ভয়-ডর ভুলে রক্তাক্ত মুখটা মুছে বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে পা রাখলো। মুহূর্তের ভিতর ঐ আত্মাটা ওর শুকনো হাতদুটো বাড়িয়ে নীরুকে কোলে তুলে নিলো। তারপর মীরার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি ফেলে ঘরের দরজার দিকে পা বাড়ালো। মীরা ভয়ে-ভয়ে ওর পেছন-পেছন হাঁটতে শুরু করলো। সে এইটুকু অন্তত বুঝতে পেরেছে যে আত্মাটা নীরুর ক্ষতি করবে না। যদি ক্ষতি করতে চাইত তবে এতসময় দেরি করত না।
আত্মাটা সোজা পথে হেঁটে এসে বাড়ির ডানদিকের পরিত্যক্ত পুকুরপাড়ের দিকে গেল। অনেক বছর আগে সেখানে একটা ফুলের বাগান ছিল সেটা বুঝা যায়। মীরা একদিন এসে দেখেছিল জায়গাটা। ভয়ংকর, গা ছমছমে অনুভূতি এসেছিল সেদিন তার মনে। আজও তেমন অনুভূতি হলো তার।
আত্মাটা ঘুমন্ত নীরুকে কোলে নিয়ে বাগানের উত্তর কোণে আমগাছের ডালে ঝুলন্ত একটা পরিত্যক্ত, মরিচা পড়া দোলনাতে বসল। দোলনাতে বসতেই নীরুর চোখদুটো খুলে গেল। সে আত্মাটার মুখের দিকে একটা ভয়ের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো। তারপর স্বাভাবিকভাবেই হাসতে শুরু করলো।
সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েকে হাসতে দেখে মীরার মনে পুরোনো ভয়টা ফিরে আসলো। সে ভাবছে নীরু যদি ঐ আত্মাকে তার মা ভেবে নেয়! দুঃচিন্তায় ঝড়ো বাতাসের মাঝে সে পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
নীরু তখন আনন্দে হাত, পা ছুঁড়ছে আত্মাটার কোলে। প্রচণ্ড বাতাসে চারদিকে গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ছে। নির্জন পাহাড়ের বুকে কোলাহল শুরু হয়েছে। নাম না জানা অসংখ্য পাখির আর্তনাদে ভরে উঠছে চারদিক। ঘন জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে জীবজন্তুর ভয়ার্ত ডাক। প্রচণ্ড ঝড়ের সাথে শুরু হয়েছে মুষলধারে বৃষ্টি।
নীরু ভিজে যাচ্ছে সেদিকে আত্মাটার কোনো খেয়াল নেই। মীরা ছুটে গেল দোলনাটার কাছে। হাত বাড়িয়ে মেয়েকে কেড়ে নিতে গেল সে। আত্মাটা ভয়ানক চোখে মীরার দিকে তাকালো। সে কিছুতেই নীরুকে ছাড়বে না এমন ভাব নিয়ে ক্ষিপ্তভাবে মীরাকে ধাক্কা দিলো। মীরা আছড়ে পড়লো কাদা-মাটির ভিতরে।
কাদা-পানির ভিতর থেকে মীরা আবার উঠে দাঁড়ালো। তার মাতৃ হৃদয় হাহাকার করে উঠল। নীরু বৃষ্টিতে এতসময় ভিজলে অসুস্থ হয়ে পড়বে এই চিন্তা মুহূর্তেই তার সব ভয় দূর করে দিলো।
সে কঠিন স্বরে বলল,
-আমার মেয়েকে দিয়ে দাও। ও অসুস্থ হয়ে পড়বে। তুমি কেন ওর ক্ষতি করতে চাইছো? তুমি আমাকে মেরে ফেলো, ছেড়ে দাও আমার মেয়েকে। দয়া করো।”
আত্মাটা একবার মীরার বিদ্ধস্ত মুখের দিকে আরেকবার নীরুর মুখের দিকে তাকালো, তারপর গম্ভীর হয়ে বসে রইলো।
মীরা কাদা-পানির ভিতর বসে কাঁদতে শুরু করলো। তার বুকটা ভেঙে আসতে চাইছে। সে স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে নীরু না থাকলে সেও বাঁচতে পারবে না। মরে যাবে সে।
বাতাসের একটানা শো-শো আওয়াজ ছাঁপিয়ে হঠাৎ একটা চিকন স্বরের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল মীরা। সে চোখ তুলে দেখল আত্মাটা তার নিজের রূপে ফিরেছে। পঁচা-গলা, বীভৎস একটা শরীর নিয়ে সে নীরুকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। ওর চোখ থেকে পানির বদলে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তবে বৃষ্টির পানি মুহূর্তেই তা ধুঁয়ে দিচ্ছে।
আত্মাটা হঠাৎ দোলনা থেকে নেমে নীরুকে মীরার কোলের ভেতর এনে দিয়ে দিলো, তারপর ভাঙা গলায় বলল,
-আমার নাম ছিল সেঁজুতি। আমি মারা গিয়েছিলাম দশবছর আগে। ঠিক এমন একটা দিনে। আমার স্বামী মারা গিয়েছিল আমার মেয়ের জন্মের পরেই। আমার মেয়ের নামও নীরা ছিল, আমি ওকে নীরু বলে ডাকতাম। একদিন হঠাৎ মাঝরাতে পাহাড়ি ঢল শুরু হলো। এই পাহাড়ী এলাকার একটা বাড়ি সেদিন পাহাড়ী ধসে চাপা পড়ে গেল আমাকে আর নীরুকে নিয়ে। আমি আটকা পড়ে মারা গেলাম তখনই। নীরু তখন পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছিল। জানি না ওর কী হয়েছিল। তারপর থেকে নীরুকে খুঁজে চলেছি। ওকে আর পাইনি আমি। ওর দেহটাও পাইনি। হয়তো কেউ ওর দেহটা উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছিল। তোমরা যখন এই বাড়িতে এসে উঠলে, ওকে নীরু বলে ডাকতে শুরু করলে তখন আমি এখানে এসেছিলাম। আমার নীরুকে খুঁজতে। ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম তোমাকে, তোমার নীরুকে পেয়ে আমার নীরুর কথা মনে করছিলাম।”
মীরা কিছু বলতে গিয়েও থমকে গেল। একটা আত্মা তার অনুভূতিকে নাড়িয়ে দিলো অজান্তেই। বহু কষ্টে সে বলল,
-ধন্যবাদ তোমাকে। তুমি তোমার মেয়েকে একদিন ঠিক খুঁজে পাবে।”
আত্মাটা ভয়ানকভাবে হেসে ফেলল তারপর কাঁদতে শুরু করলো। দোলনার পাশে পড়ে থাকা নোংরা একটা পুতুল তুলে নিয়ে সে পুতুলটাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে-কাঁদতে বিড়বিড় করে বলল,
-এই তো আমার নীরুর পুতুল। নীরু এটাকে কখনো দূরে রাখত না। এখন থেকে নীরুকে খুঁজবে এই পুতুলটাই। এইবার আমার ছুটি হবে।”
মীরা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে সেঁজুতিকে দেখল, তারপর নীরুকে বুকের সাথে জাপটে ধরে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। হঠাৎ পেছন থেকে সেঁজুতি চিৎকার করে উঠে বলল,
– দাঁড়াও মীরা। বাড়ির দিকে ভুলেও পা বাড়িও না। তোমাদের বাড়িটাও আজ পাহাড়ি ধসে চাপা পড়ে যাবে। এই পাহাড়ের সব বাড়িই একেক করে চাপা পড়ে যাবে। গত কয়েকদিনের একটানা বৃষ্টিতে পাহাড়ী ধসের সময় এগিয়ে এসেছে। তোমার স্বামী এখনই ফিরবে। ও ফিরলে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ো। অন্য কোথাও চলে যাও। আর এদিকে এসো না।”
মীরা কাঁদতে-কাঁদতে সেঁজুতির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।সে ভাবলো, মাতৃ রূপ সব জগতেই বুঝি একই রকম হয়!
এমন সময় কবিরের চিৎকার শোনা গেল। মীরা ছুটে গেল নীরুকে নিয়ে সেদিকে। সেঁজুতির আত্মা পুতুলটাকে জাপটে ধরে বসে রইলো দোলনার উপর। পুতুলটা থেকে কী এখনও নীরুর শরীরের গন্ধ পাচ্ছে সে?
কবির মীরাদের এই অবস্থায় দেখে খুব ভয় পেয়ে গেল। মীরা বলল,
-আমাদের হাতে একদম সময় নেই। পাহাড়ী ধসে আমাদের বাড়িটা আজ চাপা পড়বে। হয়তো এক্ষুণি। দেরি না করে চলো বেরিয়ে পড়ি। পরে তোমাকে সব বুঝিয়ে বলব। তোমার হাসপাতালে যাই চলো।”
বাড়ির দারোয়ান ফিরে এসে বলল, সে তার মতো করে বাড়িতে ফিরে যাবে আজ। কয়েকমাইল উত্তরেই তার বাড়ি।
তারপর কবির যে গাড়িতে করে বাড়িতে এসেছিল সেই গাড়িতেই উঠে পড়ল ওরা। ড্রাইভার দক্ষ হাতে স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাচ্ছে। বহু বছর সে এই পথে গাড়ি চালিয়ে আসছে তবে আজকের মতো দূর্যোগ সে আর দেখেনি। পাহাড়ী রাস্তায় একেকটা মোড়ে এসে গাড়ি ঘোরাতে গিয়ে সে ভেতরে-ভেতরে কেঁপে উঠছে।
প্রচণ্ড ঝড়ে গাছের ডালপালা ভেঙে রাস্তার উপর এসে পড়েছে। তার মাঝের পথ করে নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে ড্রাইভার। নীরু মুখে আঙ্গুল গুজে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে মায়ের কোলে। মীরা নীরুর ঘাড়টা দেখল ভালো করে। সেই কালো দাগটা আর নেই। মনে-মনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে পাশের সিটের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল। পাশের সিটে পড়ে আছে সেঁজুতির কোলে দেখা নীরুর সেই পুতুলটার মতো দেখতে হুবহু একই রকম নতুন একটা পুতুল। মীরা পুতুলটার দিকে হাত বাড়ানোর আগেই নীরু চোখ খুলে পুতুলটা টেনে নিলো নিজের কাছে। ভয়ে কেঁপে উঠল মীরা…
পাহাড়টা থেকে সমতল ভূমিতে পৌঁছাতেই মীরা পেছন দিকে তাকালো গাড়ির জানালা দিয়ে। সে দেখলো পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে একটা মহিলা। লম্বা চুলগুলো বাতাসে দুলছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে পতপত করে উড়ছে সাদা শাড়ির লম্বা আঁচল। মীরা বিড়বিড় করে বলল, বিদায় সেঁজুতি…
ঠিক তখনই ভারী বর্ষণে মাটি ধসে এসে চাপা পড়ে গেল মীরাদের বাড়িটা। বাড়ির সামনের পরিত্যাক্ত বাগানে জীর্ণ দোলনাটা অবিরত দুলছে অদৃশ্য সেঁজুতিকে নিয়ে। আজ থেকে সে অদৃশ্য। এখন তার সব শক্তি নিয়ে দ্রুতগতিতে সভ্য সমাজের দিকে ছুটে চলছে নীরুর পুতুলটা। একটুকরো ক্রূর হাসি ফুটল সেঁজুতির ঠোঁটে।”
মাহমুদা মিনি রচিত ভালোবাসার গল্প >> আলোর পথে
নীরু । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প । লেখক পরিচিতি
লেখকঃ মাহমুদা মিনি
ছোটগল্পঃ নীরু
গল্পের জনরাঃ ভৌতিক গল্প।
দেশের বাড়িঃ যশোর।
পড়াশোনাঃ B.A (২০১৯)।
পেশা: ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট
(লেখক ছবি দিতে ইচ্ছুক নন)
লেখকের কথাঃ পড়তে ভালোবাসি। বই আমার সেরা সঙ্গী। সময় পেলে একটু আধটু লেখারও চেষ্টা করি। নিজের অনুভূতিগুলো তুলে ধরতেই লেখালেখি করা। হৃদয়ের অব্যক্ত চাওয়াগুলোর পূর্ণতা দিতেই কাগজ, কলমের সাথে সখ্যতা আমার।