সাত ভাইয়ের এক বোন – তুরস্কের রুপকথার গল্প । আত্মপ্রকাশ

 সাত ভাইয়ের এক বোন – তুরস্কের রুপকথার গল্প । আত্মপ্রকাশ

সাত-ভাইয়ের-এক-বোন-রুপকথার-গল্প

এক ছিল শিকারি।
দুর্দান্ত সাহস তার। অসীম মনোবল। খুব বুদ্ধিমান। বাবা তার মারা গিয়েছিলেন ছোটবেলায়। তারপর একা একাই সেই শিকারি বড় হয়ে ওঠে। বনে বনে ঘুরে বেড়ায়। বাঘ সিংহ শিকার করে, নীল-নয়না হরিণ ধরে আনে।
সেই শিকারির নাম ছড়িয়ে পড়ল গ্রাম থেকে গ্রামে। একদিন রাজার কানেও গেল তার কথা। রাজা তাকে ডেকে পাঠালেন রাজপ্রাসাদে। বললেন, “তোমাকে আমার খুব দরকার শিকারি। তুমি আমাকে হরিণ ধরে এনে দেবে। সেই হরিণেরা খেলা করবে আমার বাগানে। আমি বাস করতে চাই হাতির দাঁতের তৈরি রাজপ্রাসাদে। তুমি এনে দেবে সেই হাতির দাঁত। রাজার কথা মানেই আদেশ। শিকারি আর কী বলতে পারে।
বন থেকে সে হরিণ ধরে আনে। হাতি শিকার করে হাতির দাঁত নিয়ে আসে। দিনে দিনে সুন্দর হতে থাকে রাজার প্রাসাদ।
রাজা একদিন বললেন, “তুমি দারুণ কাজের ছেলে। তোমাকে দিয়েই হবে। আমার জন্যে তোমাকে অন্য একটা কাজ করে দিতে হবে।

শিকারির শুরু হল হৃদকম্প। রাজা খুব লোভী। মানুষের এত লোভ ভালো নয়।
রাজা বললেন, ‘সোজা উত্তরে আছে এক পাহাড়। সেই পাহাড়ে থাকে সাত ভাই আর এক বোন। সেই বোন দেখতে যেমন রূপবতী কাজেও তেমন গুনবতী। আমি তাকে বিয়ে করতে চাই। হাতির দাঁতের রাজপ্রাসাদে তাকে নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকতে চাই।’
রাজার আদেশ, না করার কোনো সুযোগ নেই। শিকারি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। পথই এখন তার ঘর। যাত্রা করল উত্তরে। যেতে যেতে, যেতে যেতে এল সে এক নদীর ধারে। এসে দেখে, নদীর পাড়ে বসে রয়েছে একটা মানুষ। সে নদীর পানি পান করছে। পান করছে তো করছেই। পিয়াস যেন তার আর মেটে না। মাঝে মাঝেই সে আর্তনাদ করে উঠছে, ‘আরো…আরো পানি দরকার আমার। শিকারি গিয়ে বলল, “ওহে তুমি এমন করছ কেন? লোকটা অবাক চোখে তাকাল, ‘পিপাসায় বুক ফেটে যাচ্ছে আমার। আরো পানি দরকার। আরো পানি চাই।”
শিকারি বলল, “ভাই, তোমার যদি কোনো অসুবিধা না থাকে তবে তুমি আমার সঙ্গী হও, চল আমার সঙ্গে। দুজনে চলল। যেতে যেতে, যেতে যেতে আরেকটি আজব লোকের সঙ্গে তাদের দেখা হল। লোকটি বসে রয়েছে জ্বলন্ত আগুনের সামনে। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আর লোকটি হা-হুতাশ করছে—বাবারে, মারে, গেলাম, গেলাম। ঠাণ্ডায় জমে গেলাম। ওফ—কী ভয়ানক ঠাণ্ডা !
শিকারি এই লোকটিকেও সঙ্গী বানিয়ে নিল। এর পরেই আরেকটি আজব লোকের সঙ্গে দেখা। লোকটি খাচ্ছে আর খাচ্ছে, খাচ্ছে আর খাচ্ছে। তবু তার খিদে যেন মিটছে না। শিকারি তাকেও সঙ্গে নিল।
হঠাৎ করে পথে পড়ল আরেক অদ্ভুত লোক। সে মাটিতে কান পেতে রয়েছে। শিকারি তাকে বলল, ‘তুমি এভাবে কান পেতে রয়েছ কেন ? লোকটি হেসে উঠল, ‘আরে ভাই, মাটিতে কান পেতে আমি সব শুনতে পাই। কোথায় কী ঘটবে সব আমি বলে দিতে পারি।
‘তুমিও আমাদের দলে যোগ দাও, লোকটি সানন্দে রাজি হল। পাঁচজনের দলটি এবারে সোজা চলল উত্তরে।

সাত-ভাইয়ের-এক-বোন-রুপকথার-গল্প-bangla-fairytale-story ২
লোকটি কান পেতে কথা শুনছে

পথের মধ্যে দেখা হল আরেক আজব লোকের সঙ্গে। লোকটি লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। আর বড় বড় পাথর ছুড়ে মারে। ওরা তাকেও সঙ্গে নিল। সবশেষে দেখা হল মহাশক্তিশালী এক লোকের সঙ্গে যে এক হুংকার দিয়ে পৃথিবী কাঁপিয়ে তুলতে পারে।
সবাইকে নিয়ে এবার দলের সদস্য হল সাতজন। সাতজনে সাতটি গুণে গুণান্বিত। ওরা চলল উত্তরে।

দিনের পর দিন যায়।
উত্তরের পাহাড়ে এসে খবর মিলল সাত ভাইয়ের। সাত ভাইয়ের এক বোন। সাত ভাই দূর থেকেই দেখতে পেয়েছে আগন্তুক সাতজনকে।
কী ব্যাপার? কেন ওরা এল ? কোত্থেকে এল? শিকারি বলল, “আমরা রাজার দূত। রাজা তোমাদের বোনকে বিয়ে করতে চান। আমরা সেই বোনকে নিয়ে যেতে এসেছি।
সাত ভাই চিন্তায় পড়ল। ফিরে গেল বাড়িতে। পরদিন সকালে দেখা হবে। সাত ভাই তখন বুদ্ধি বের করতে বসল। কী করা যায়? কিভাবে শায়েস্তা করা যায় সাতজনকে ?
শিকারি তখন সেই বন্ধুকে, যে মাটিতে কান পেতে সব শোনে, তাকে বলল, “দেখ তো তুমি—সাত ভাই কী নিয়ে সলাপরামর্শ করছে? কী নিয়ে কথাবার্তা বলছে ?
লোকটা মাটিতে কান রাখল। শুনল, ওরা বলছে যে, সাত হাঁড়ি ভাত দেবে খেতে। ওরা যদি খেতে পারে তবে বোনকে দেবে সঙ্গে।
শিকারি ভাবল, এ আর তেমন কঠিন কাজ কি! সারাক্ষণ যার খিদে লেগে থাকে তার পক্ষে সাত হাঁড়ি খাওয়া তেমন কোনো ব্যাপারই নয়। সাত বন্ধু পরদিন সকালে দেখা করতে গেল সাত ভাইয়ের সঙ্গে। বড় বড় হাঁড়িতে করে খানা নিয়ে এল সাত ভাই। অতিথিদের বলল, ‘এসব খেয়ে শেষ করতে হবে কিন্তু। নইলে আমরা বোন দেব না তোমাদের কাছে।
ছয়জন অন্যসময় যতটুকু খায় সেটুকুই খেল। শুধু পেটুক লোকটা একাই হাঁড়ি কুড়ি চেঁছেপুছে খেয়ে সাফ করে দিল। সাত ভাই তো অবাক! এবার অন্য বুদ্ধি বের করতে হয়। ওরা বড় বড় সাত কলসি ভরে পানি নিয়ে এল।
বলল, ভাই, ‘শিগগির পানি খেয়ে শেষ কর। শেষ কিন্তু করতেই হবে। তারপর বোনকে তোমাদের হাতে তুলে দেয়ার পালা।
নদীর পানি খেয়েও যার পেট ভরে না সে তো এক চুমুকেই পানি খেয়ে শেষ করে দিল। তারপর সে চেঁচাতে লাগল, আরো পানি দাও, আরো পানি দাও।



indow.adsbygoogle || []).push({});

তখন সাত ভাই আবারও পরামর্শ করতে বসল। কিভাবে ভিনদেশিদের বিপদে ফেলা যায় ? সব ধরনের কাজই তো ওরা অনায়াসে করে ফেলে। সাত ভাই ওদের বলল, আমাদের বাড়ির পেছনের বনে এক ভয়ানক আগুন লেগেছে। তোমরা ঐ আগুন নিভিয়ে দাও আমাদের।
এবারে সেই আজব লোকটা গেল, যার খালি শীত লাগে। সে আগুনের মধ্যে বসেই বলতে লাগল, আরো উত্তাপ দাও আমাকে, আরো উত্তাপ। আমি যে শীতে মরে গেলাম।
সে একাই নিভিয়ে দিল সেই আগুন। সাত ভাইয়ের চোখ উঠল কপালে। কী আশ্চর্য !
এমনটি তারা সারাজীবনে দেখেনি। তখন তারা নতুন বুদ্ধি বের করল। বলল, ‘এবার তোমাদের জন্য রয়েছে শেষ পরীক্ষা। ঐ যে পাহাড়ের খাদ—ঐ খাদের ঐ পাশে রয়েছে টলটলে এক ঝরণা। তোমাদের মধ্যে একজন গিয়ে ঝরণার পানি আনবে। আমার বোনও যাবে পানি আনতে। যে আগে আসবে সে জিতবে। আমাদের বোন তখন তোমাদের হবে।
তখন হি হি করে হেসে উঠল লম্ফবিশারদ। এটা আবার কোনো কাজ হল ? সে লাফাতে লাফাতে চলল ঝরণার দিকে। পানি নিয়ে যখন সে ফিরছে পথে দেখা বোনটির সঙ্গে। বোনটিকে দেখেই সে বলল, ‘দেখলে তো পানি নিয়ে এসেছি। আমরা তো জিতেই গেছি। তুমি আর পানি নিয়ে কী করবে? তারচেয়ে বরং এসো আমরা দুজন বসে গল্প করি। মেয়েটি তাতে রাজি হল।।
মেয়েটি মনে মনে তাই চাইছিল। দুজনে গল্প জুড়ে দিল। মেয়েটির গল্প বলার ধরনটা ছিল এমন যে মন ভরে যায়।
গল্প করতে করতে এক সময় লক্ষ্যবিশারদ ঘুমিয়ে পড়ল। যেই না সে ঘুমিয়ে পড়েছে অমনি বোনটি পানি নিয়ে রওনা দিল বাড়ির দিকে।
এদিকে শিকারি ভাবছে, কী ব্যাপার ! লম্ফবিশারদ এখনও আসছে না কেন? শিকারি বলল, ওহে, কান পেতে সব শুনতে পাও তুমি–দেখ তো ব্যাপারটি কী ? মাটিতে কান-পাতা লোকটি এবার কান পেতে শুনল—কেউ একজন হেঁটে আসছে। তবে যে আসছে সে পুরুষমানুষ নয় মোটেই। তাহলে তো সাত ভাইয়ের এক বোনটিই পানি নিয়ে ফিরে আসছে। লোকটি বলল, “এবারে বুঝি আমরা হেরেই গেলাম”।
তৎক্ষণাৎ উঠে দাড়াল শক্তিশালী সেই লোকটা যে অনায়াসে পৃথিবীটা কাঁপাতে পারে। সে মাটি কঁপাতে লাগাল প্রচণ্ড জোরে। থরথর করে মাটি কাঁপতে লাগল।



এতে লম্ফবিদের ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম থেকে জাগতেই লম্ফবিদ অবাক। সব্বেনাশ ! সব্বোনাশ !
ঘুম থেকে জেগে উঠেই লম্ফবিদ ছুট লাগাল। ছুট ছুট ছুট। কোথায় গেল মেয়েটি ? পথের মধ্যেই মেয়েটিকে পেল সে। পানির পাত্র তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এক ছুটে সে এসে হাজির হল সাত ভাইয়ের কাছে।
সাত ভাই তখন আর কী করবে!
বোনটিকে তুলে দিল তাদের হাতে। শিকারি বন্ধুদের নিয়ে ফিরে এল রাজপ্রাসাদে।
রাজা তো মহাখুশি। আনন্দ তার ধরে না। বেজে উঠল ঢাক-ঢোল। সাজ সাজ রব পড়ে গেল। এবারে বিয়ের বাদ্যি বাজতে লাগল।
বোনটি তখন রাজাকে বলল, ‘মহান রাজা, এই রাজপ্রাসাদ কে বানিয়েছে ?” রাজা বললেন, ‘শিকারি। ‘আমাকে উত্তরের পাহাড় থেকে কে এনেছে ?” ‘কেন? শিকারি ?
তবে রাজা আপনি আমাকে কেন বিয়ে করতে চাচ্ছেন? বিয়ে তো হবে শিকারির সঙ্গে আমার।
রাজা ভাবলেন, তাইতো ! তিনি তো শুধু হুকুমদারি করেছেন। কিন্তু কাজ তাে করেছে শিকারি।।
রাজা তাই কন্যার কথা সব মেনে নিলেন। শিকারি বিয়ে করল সেই কনেকে। | তারপর ছয় বন্ধুকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে দিন কাটাতে লাগল তারা।

সাত ভাইয়ের এক বোন‘ রুপকথার গল্পটি আমিরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘তুরস্কের রুপকথা’ গল্প বই হতে সংগ্রহ করা হয়েছে।

1 Comment

Leave a Reply to রুপকথা কি? রুপকথার গল্প এবং অজ্ঞাত ইতিহাস । রুপকথার বিবর্তন | আত্মপ্রকাশ Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *