ঈশিতা জুবায়ের রচিত ‘অভিভাবক’ রোমান্টিক ছোটগল্পটি ভালোবাসা দিবস-২০১৯ উপলক্ষ্যে আয়োজিত ‘আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প প্রতিযোগিতা – ০৩’ এ সপ্তম স্থান অর্জন করে।
“চিত্রটা একটা রান্নাঘরের। একটা ডিম মাটিতে পড়ে ভেঙে পুরো পিচ্ছিল হয়ে আছে। ভাজার জন্য ফাটানো হচ্ছিলো বোধহয় অসাবধানতায় হাত ফসকে গেছে। আটার গুড়োতে চারপাশ পুরো সয়লাব। ঝুড়ির পেয়াজ-মরিচ সব এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা। তেল কৌটোর মুখ খুলে উপুড় হয়ে রয়েছে। গ্যাস বার্নারটাতেও কিছুতেই ম্যাচের কাঠিটা ধরানো যাচ্ছে না। আসলে অনভ্যস্ত হলে যা হয় আর কী! এদিকে আবার ঘড়ির কাটা জানিয়ে দিচ্ছে সময় লাফিয়ে-লাফিয়ে চলে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। হাতে আর একদম সময় নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই সৌরভ কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়বে। ছেলেটাকে তো আর খালি পেটে বিদায় দেয়া যায় না। সারাদিন তো বাহিরের খোলা স্ট্রিট ফুডগুলো খেতে হয়, বাড়ি থেকে যে কোনো খাবার তৈরি করে দেয়া হবে সেটাও তো আর এখন সম্ভব না। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ পোড়া গন্ধ নাকে এসে লাগে। ইশশ! তাওয়া অতিরিক্ত গরম হয়েছে নাকি! রুটি ঝলসে ছাই! বাহিরের ঘর থেকে দুমদাম করে জুতো ঝাড়ার শব্দ আসছে। সৌরভ বোধহয় তৈরি হয়ে গেছে। একগাদা এটো থালাবাসনের স্তুপ ঠেলে বেসিনটাতে হাত ধুতে গিয়ে ঝনঝন শব্দে সব ছড়িয়ে পড়লো। কিন্তু এখন আর এসব কিছুই গ্রাহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না আসফাক সাহেবের। তড়িঘড়ি করে যেটুকু খাবার তৈরি হয়েছে সেটুকুই হাতে করে ডাইনিংয়ের দিকে লম্বা লম্বা পা চালান তিনি। সৌরভ বেড়িয়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, ছেলেকে উদ্দেশ্যে করে বলে ওঠেন,
–নাস্তা তৈরি করা হয়েছে। খেয়ে তারপর যেন বেরোনো হয়।
–সম্ভব না বাবা। আজকে এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।
–আহামরি এমন কিছু দেরিও হয়নি। সারাদিন তো রাস্তার ধারের ছাইপাঁশ খাওয়া হয়। সকাল-সকাল একটু খেয়ে বেরোলে তো ক্ষতি হচ্ছে না কোনো।
অগত্যা বাধ্য হয়ে খাবার টেবিলে বসতে হয় সৌরভকে। রুটির থালাটা তার দিকে ঠেলে দেন আসফাক সাহেব। কোণা ভেঙে একটুখানি মুখে দিতেই মুখ বিকৃত হয়ে যায় সৌরভের। জিনিসটা যে অত্যন্ত বিস্বাদ হয়েছে সেটা তার মুখ দেখেই আন্দাজ করে নেয়া যায়। কোনোমতে অর্ধেকটা খেয়েই উঠে পড়ে খিদে নেই বলে বেড়িয়ে যায় সৌরভ। টেবিলের উপর এখনো আধ খাওয়া রুটিটা পড়ে আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেদিকে তাকিয়ে ভাবেন আসফাক সাহেব, বাবা থেকে মা হয়ে ওঠা অনেক শক্ত কাজ বটে তবে অসম্ভব কিছুই নয়। তাহলে তিনি কেনো পারছেন না এই দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করতে? তার স্ত্রী গত হবার পর বেশ কয়েকটা মাস পেরিয়ে গেছে। এখন বাড়িতে প্রাণী বলতে সে আর সৌরভ দুজনেই। সারাটা দিনই দুজনে বাহিরে কাটান। বাড়ি ফেরেন সেই সন্ধ্যে বেলা। তাই তাদের মধ্যে একেবারেই কোনো কথা হয় না বলা চলে। ছোটবেলা থেকেই ছেলেটার সাথে খুব একটা সখ্যতা গড়ে ওঠেনি তার। সৌরভের অবচেতনে তার বাবা আর মা এই দুজন মানুষের দুটো আলাদা মূর্তি গড়া আছে। মা মানেই হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল, বন্ধুবৎসল আর বাবা মানেই রাসভারী, গুরুগম্ভীর, অমিশুক। আসলে বাবা সম্পর্কে সৌরভের এই ধারণার জন্য ওকে খুব একটা দোষ দেয়া যায় না। সৌরভের জন্য উনার অনুভূতি ঠিক কতটা গভীর সেটা কখনই তিনি ওকে বুঝতে দেননি। তাই ছেলেটা কেবল তার খোলসাবৃত বাহ্যিক বাবাকেই চেনে, খোলসের ভেতরের বাবাকে নয়।
.
বাসের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে আছে সৌরভ। কানে হেডফোনে এফএম রেডিও টিউন করা। রেডিও জকি তার সুমধুর কণ্ঠে শ্রোতাদের খুদে বার্তাগুলো পড়ে যাচ্ছে, শুনতে বেশ ভালোই লাগছে। একজন শ্রোতা তার মায়ের জন্যে ভালোবাসার অভিব্যক্তি মিশিয়ে কবিতা লিখে পাঠিয়েছেন, সেটাই আবৃতি করা হচ্ছে। মা, এই শব্দটা শোনার পর নিজের অজান্তেই দু’চোখ বেয়ে অশ্রুর ঝর্ণা নেমে আসে সৌরভের। এই মা নামক অমূল্য রত্নটাকে তো অল্প কিছুদিন আগেই অকালে হারিয়ে ফেলেছে সে। আচমকা তাকে ফাঁকি দিয়ে চিরকালের মতো না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি। অথচ এমনটা তো হবার কথা ছিল না। কতটুকু সময়ই বা তিনি এই ছোট্ট পৃথিবীটা দেখেছেন? আর কয়েকটা দিন তাকে আমাদের মাঝে রাখলে কী খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেত সৃষ্টিকর্তার? অনেকেরই তো এখনও মা জীবিত আছেন। কেউ হয়তো বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন, তবুও তো বেঁচে আছেন। কতোই না ভাগ্যবান তাদের সন্তানরা। সবাই হয়তো সকালে বেরোনোর আগে তার মুখটা দেখে বেরোয় এই ভেবে যে এবার সারাটা দিনই শুভ কাটবে আবার দিনের শেষে ঘরে ফিরে সেই মুখটা দেখা মাত্রই সকল ক্লান্তি মোচন হয়ে যাবে। শুধু তার ভাগ্যটাই কেনো এমন হলো? সৃষ্টিকর্তাকে এই একটা প্রশ্ন সে প্রতিনিয়তই করে কিন্তু তিনি কি কখনো তার প্রশ্নের উত্তর দেবেন? হঠাৎ আচমকা ঝাকুনিতে ভাবনায় ছেদ পড়ে তার। টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় সে। বাসের ব্রেক কষা হয়েছে আর কখন যে হ্যান্ডেল থেকে তার হাত ঢিলে হয়ে গেছে খেয়ালই ছিলো না। ততক্ষণে লোকজন বিরক্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে তার দিকে। হেল্পারটা সমানে চেঁচিয়ে চলেছে, “নামেন নামেন। স্টপেজ এসে গেছে আপনার।” ছঁড়ে যাওয়া কনুইতে হাত বোলাতে বোলাতে নিজেকে সামলে নেয় সৌরভ। বাস থেকে নেমে আলগোছে চোখটা মুছে হাঁটা দেয় কলেজের উদ্দেশ্যে। হেডফোনে তখন জেমসের কণ্ঠে বেঁজে চলেছে….রাতের তাঁরা আমায় কি তুই বলতে পারিস, কোথায় আছে কেমন আছে মা…..
–আমি একটা দরখাস্ত করেছিলাম স্যার। ঐ ব্যাপারটা যদি একটু বিবেচনা করতেন।
–জ্বী। আপনার দরখাস্ত অনুযায়ী এ মাসের বেতনটা আপনাকে অগ্রিম দেয়া হবে।
ক্ষীণ একটা হাসির রেখা ফুটে ওঠে আসফাক সাহেবের মুখে,
–অনেক ধন্যবাদ স্যার। ইয়ে মানে, আরেকটা আর্জি ছিলো। আজ যদি আমাকে ছুটি দিতেন তবে খুব ভালো হয়।
–অবাক করলেন আসফাক সাহেব! আপনার কর্ম জীবনে আপনি শেষ কবে ছুটি নিয়েছেন আমার মনে নেই। আর সেই আপনি কিনা আজ নিজ মুখে ছুটি চাইছেন! তা আপনার ছুটির কারণটা কি জানতে পারি?
মুখ কাচুমাচু করে লজ্জিত ভঙ্গিতে জবাব দেন তিনি,
–আজ আমার ছেলেটার জন্মদিন।
সৌরভের কি আজ দিনটাই খারাপ নাকি! আজই পরীক্ষার জন্য টাকা জমা দেবার শেষ দিন অথচ এতো জরুরি কথাটা সে বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলো। প্রথম যেদিন নোটিশ দেখেছিলো সেদিন অবশ্য বাবাকে জানানো হয়েছিলো একবার। কিন্তু তিনি কি সে কথা মনে রেখেছেন? অবশ্য মনে না থাকারই কথা কারণ হাজারটা ঝক্কি ঝামেলা সামলাতে হয় উনাকে। তাছাড়া তার নিজেরই তো মনে নেই আর এতো কিছুর মাঝে ভুলে যাওয়াটাই বাবার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক নয় কি? অবশ্য বাবার অফিসে গিয়ে তো তাকে স্বরণ করিয়ে দেয়া যেতে পারে কিন্তু সৌরভ যাবে কি না এ নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায়। আজ তার জীবনের একটা বিশেষ দিন। প্রতিবছর এই দিনটা মা খুব আনন্দ ভরে পালন করতেন। নিজ হাতে মুখে তুলে পায়েস খাইয়ে আশীর্বাদ করতেন। মা-ছেলেতে মিলে গোটা দিনটাই একসঙ্গে উৎযাপন করা হতো। আর এখন তো মা দূর আকাশের নক্ষত্র হয়ে জ্বলজ্বল করছে। সৌরভ হাজার চেষ্টা করলেও আর তার নাগাল পাবে না। আচ্ছা, বাবার কি মনে আছে আজকের দিনটার কথা?
হঠাৎ একটা মৃদু বাকবিতণ্ডা শুনে আপাতত নিজের কথা ভুলে সেদিকে ছুটে যায় সৌরভ। একটা ছেলে পরীক্ষার টাকা জমা দেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে সময় চাইছে। ছেলেটি প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছে তাদের বোঝাতে সে অতি শীঘ্রই টাকাটা পরিশোধ করে দেবে কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা মানতে নারাজ। হাল ছেড়ে দিয়ে ছেলেটি হতাশ হয়ে বসে পড়ে। সৌরভ শুনতে পায় ছেলেটি কাঁদছে আর বলছে, “বাবা, তুমি এতদিন বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়ে সব সময় আমাদের আগলে রেখেছিলে। যার মাথায় এই ছায়া নেই একমাত্র সেই জানে জীবনের আসল অর্থটা কতো কঠিন।”
.
সৌরভ যেদিন পৃথিবীতে এসেছিলো সেদিনের কথা ভাবেন আসফাক সাহেব। সেদিনটা ছিলো তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। হাসপাতালের বেডে যখন ওর মায়ের পাশে ওকে শুইয়ে রাখা হয়েছিলো তখন মনে হচ্ছিলো যেন একটা দেবশিশু স্বর্গের পথ ভুলে মর্তে নেমে এসেছে। ভয়ে ভয়ে কোলে তুলে নিয়েছিলেন ওকে। কি জানি, ছোট্ট তুলোর মতো শরীরে যদি কোথাও ব্যথা লেগে যায়। আর তাকে অবাক করে দিয়ে কোলে নেয়া মাত্রই ফিক করে হেসে উঠেছিলো সৌরভ যেন মেঘ সরিয়ে সূর্যটা উঁকি দিচ্ছে আকাশে। ছেলের মুখের হাসিটা দেখে তার মনে হয়েছিলো সেই মুহূর্তে তার চেয়ে সুখি হয়তো পৃথিবীতে আর কেউ নেই।
“সাব, আইয়া পড়ছি। অহন আপনে নামেন।” রিকশাওয়ালার ডাকে বর্তমানে ফিরে আসেন তিনি। রিকশা থেকে নেমেই হন্তদন্ত হয়ে সৌরভ কে খোঁজার জন্য ছুটে যান। ঐ তো সৌরভ, আনমনে একটা জটলার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে গিয়ে বলে ওঠেন,
–যাক, সময় মতো পৌঁছাতে পেরেছি তাহলে। এই খামটায় পুরো টাকাটা আছে। জমা দিয়ে আয় জলদি। আরে, এখনো হাবলার মতো হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? জলদি যা। পরীক্ষায় বসার ইচ্ছে নেই নাকি? গাধা ছেলে কোথাকার।
.
ওরা এখন বাড়ির দিকে যাচ্ছে। আসফাক সাহেব হালুয়াই এর দোকান থেকে পায়েস কিনেছেন। চোখে মুখে এক গাদা কৌতূহল নিয়ে বাবাকে প্রশ্ন করে সৌরভ,
–আজ অফিস করলে না কেন বাবা? শরীর খারাপ করেছে?
গম্ভীর মুখে জবাব দেন আসফাক সাহেব,
–না, আমি ঠিক আছি। আজ ছুটি নিয়ে নিয়েছি।
–ছুটি নিলে কেন? এমনি নাকি কোন কারণে?
সৌরভ তার এই প্রশ্নের কোনো উত্তর পায় না তবে আজ বাবার নীরবতার ভাষা সে ঠিকই উপলব্ধি করে নিয়েছে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে হাজারবার ক্ষমা চেয়ে শুকরিয়া আদায় করে নেয়, তিনি কিন্তু অতটা অবিবেচকও নন। অত শত ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে রাস্তায় একটা হোচট খায় সে আর সেই সাথে আসফাক সাহেব ছেলেকে প্রচণ্ড একটা ধমক দিয়ে বসেন। বাবাকে অবাক করে দিয়ে হেসে ওঠে সৌরভ। আসফাক সাহেবের আবার মনে হয় এ মুহূর্তে তার চেয়ে সুখি এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই।
ঠিক সেই সময় শত শত ক্রোশ দূরের এক নক্ষত্রের মুখে ফুটে ওঠে সুক্ষ্ণ হাসির রেখা, বুক চিরে বেরিয়ে আসে একরাশ স্বস্তির নিঃশ্বাস। মনে মনে প্রার্থনা করে, “ভালো থাকুক ওরা। এই ভালোবাসার বলয়ে আজীবন ঘিরে থাকুক ওদের চারপাশ।” আপনজনদের পৃথিবীতে দৃশ্যমান থাকার ক্ষমতা হয়তো সৃষ্টিকর্তা তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন তবে দূর থেকে এই ভালোবাসায় শামিল হতে ক্ষতি কী!
(সমাপ্ত)…
আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প প্রতিযোগিতা – ০৩ এ প্রথম স্থান অর্জনকারী গল্প >> হৃদমাঝারে – তানভীর তূর্য
লেখকের কথাঃ প্রচুর বই পড়তে ভালোবাসি, এককথায় যাকে বই পোকা বলা চলে। মূলত বইয়ের প্রতি এই ভালোবাসা থেকেই লেখিকা হবার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সেই সাথে ছবি আঁকার কিঞ্চিৎ দক্ষতা রাখি।।
আত্মপ্রকাশে অপ্রকাশিত গল্প এবং বুক রিভিউ এবং প্রবন্ধ প্রকাশ করতে যোগাযোগ করুন (ইমেইল-attoprokash.blog@gmail.com) অথবা ফেইসবুক পেইজ ইনবক্স। সর্বনিম্ন ১০০০ শব্দ হতে যেকোনো ঊর্ধ্ব সীমার ছোট গল্প গ্রহণযোগ্য। আপনার গল্প আত্মপ্রকাশ বিচারকদের দ্বারা নির্বাচিত হলে আপনাকে জানানো হবে এবং তা সরাসরি প্রকাশ করা হবে আত্মপ্রকাশে। আপডেট জানতে ফেইসবুক গ্রুপে সক্রিয় থাকুন।
1 Comment
[…] অভিভাবক – ঈশিতা জুবায়ের । ভালোবাসার … […]