লাল জামা । আসিফ আহমেদ । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প

আসিফ আহমেদের ‘লাল জামা‘ সামাজিক ছোটগল্পটি ‘আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প প্রতিযোগিতা- ১’ এ পঞ্চম স্থান অর্জন করে।

“হোটেল থেকে কাজ শেষ করে ফিরলো রহিম। সাথে রাতের জন্য সামান্য কিছু খাবার। ছোট বোন নিশিকে নিয়ে খেতে বসেছে ঠিক তখনই নিশি বললো,
‘বাই , কাইল তো পয়লা বৈশাখ আমারে একখান নুতুন জামা কিন্না দিবা না ?
নিশির কথা কানে যেতেই শুকনো ভাতের দলা আটকে গেলো রহিমের গলায়। ভাইয়ের এমন অবস্থা দেখেই নিশি তাড়াতাড়ি পানি এগিয়ে দিলো। রহিম পানি পান করে নিশির দিকে তাকালো। দেখলো নিশি উত্তরের জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। রহিম দম নিয়ে বললো,
‘কি জামা কিনমু ক’ ?
রহিমের মুখে এমন কথা শুনে নিশির চোখ-মুখে আনন্দের শীতল বাতাস বয়ে গেলো। আর সাথে সাথেই মুচকি হেসে বললো,
‘কাইল দেহামু নে তোমারে’।
‘আইচ্ছা কাইল দেহাস। তুই এহন ঘুম যা রাইত মেলা অইছে।’
রহিমের কথা শুনেই নিশি চুপচাপ চটের বস্তাটার উপর শুয়ে পড়লো। আর রহিম চিন্তায় পরে গেলো কী করবে এখন ? ছেঁড়া হাফ প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে আজকের আয় করা সব টাকা বের করলো। তারপর রাস্তার পাশের সোডিয়াম লাইটের নিচে বসে গুণতে শুরু করলো,
দুই,পাঁচ,তেরো,বিশ- সব মিলিয়ে বিয়াল্লিশ টাকা ওর কাছে। হতাশ হয় রহিম।
ছয় বছরের ছোট্ট বোনটা তার কখনোই কোন কিছুর আবদার করে নি। আজ একটা জামা কিনে চেয়েছে সেটাও কি দিতে পারবে না?
রহিম ছোট্ট বোনটার দিকে তাকিয়ে দেখে সে ঘুমের দেশে চলে গেছে। উপায় না পেয়ে ও ছুটে যায় পথের দিকে। যে ভাবেই হোক কিছু টাকা জোগাড় যে করতেই হবে। বোনটার একটামাত্র আবদার যে করেই হোক পূরণ করতে হবে।

রহিম দেখে এখনো কয়েক টা হোটেল খোলা আছে।
ঢুকে যায় একটা হোটেলে। তারপর হোটেলের ম্যানেজার কে বলে,
‘স্যার আমারে একখান কাম দিবেন আইজ রাইতের জন্যি?’
‘ঐ মিয়া তুই ভিতরে কি করে ঢুকলি! যা বের হ।’
রহিমকে দেখেই রাগি কণ্ঠে হোটেল ম্যানেজার বললো।
‘একখান কাম দেন না আমারে’?
‘কোন কাম নাই যা ভাগ।’ বলেই তাড়িয়ে দেয় ম্যানেজার।
দিশেহারা রহিম কি করবে ভেবে পায় না। তার যে এখন অনেক টাকার প্রয়োজন। এখানে ওখানে ঘুরেঘুরে অবশেষে একটা হোটেলে পানি টানার কাজ পায় । তবুও এতেই খুব খুশি! অন্তত কিছু টাকা তো পাবে এই আশায়। ছোট্ট বোনটার জন্য একটা জামা যে কিনতেই হবে।
খুশি মনে কাজ করে ও। ছোট্ট ছেলেটার চোখে নিদ্রা আসে না। শেষ রাত পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে কাজ করে। তারপর থালাবাসন পরিষ্কার করে কাজ শেষ হলে হোটেল ম্যানেজার ওর হাতে ২০ টাকার একটা নোট তুলে দেয়।

রহিম হয়তো প্রাপ্তির থেকে একটু বেশিই আশা করেছিল। তবে বেশি কথা বললে যে বাকিটাও আর পাবে না এটা ওর অজানা নয়। টাকাটা নিয়েই দৌড় লাগায় ও। রেল লাইনের কাছে গিয়ে দেখে ছোট্ট বোনটা এখনো সেভাবেই ঘুমাচ্ছে। আস্তে করে বোনটার পাশে শুয়ে পড়ে। প্রচণ্ড ঘুমে চোখটা বুজে আসে ওর । এক সময় আস্তে আস্তে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায় ।

‘বাই, ও বাই উঠ তাড়াতাড়ি’।
নিশির চেঁচামেচিতে ধরফড় করে উঠে বসে রহিম।
‘কি হইছে তোর এই সাত সহালে’?
‘বাই আমারে নুতুন জামা কিন্না দিবা না’?
‘ হ দিমু তো। তয় এহন তো সহাল, দোহান খুলতে মেলা দেরি আছে। তোর কাম নাই আইজ’?
‘খালাম্মা কইছে আইজ বাসায় থাকবো না তাই কামে যাওন লাগবো না’।
‘আইচ্ছা তুই থাক আমি আইতাছি’।
‘ কই যাস বাই’?
‘ কইলাম না আইতাছি’। বলেই দৌড়ে চলে যায় রহিম।
রাস্তার পাশের চাপ কল থেকে হাতমুখ ধুয়ে কাজের খোঁজে চলে যায়। আজ পথে এই সাত সকালে এত্ত মানুষ দেখে খুব ভালো লাগে ওর। সবাই নতুন জামা পড়া। মুখে রঙ দিয়ে কি যেন লেখা। মাথায় ও টুপির মতো কি যেন! রহিম দেখে ওর বয়সি একটা ছেলে খুব সুন্দর একটা পাঞ্জাবি পড়ে ঘুরছে। রহিম ভাবে,
‘ইশ্! এই জামাখান যদি কিনবার পারতাম!
ভাবতেই বুকের ভিতর ধক্ করে ওঠে ওর।
ছোট্ট বোনটা তার জামার আবদার করেছে।

রহিম নিজের ইচ্ছা টাকে পিচঢালা রাস্তায় পিষে দিয়ে কাজ খুঁজতে চলে যায়। তবে ভাগ্যে আজ হয়তো কাজ নাই। কোথাও কাজ মেলে না ওর।

সকাল ১১ টা। হতাশ হয়ে বোনের কাছে ফেরে ও । ফিরতেই দেখে বোনটা তার পথের পাণে চেয়েই আছে।
ভাইকে দেখেই একদৌড়ে কাছে চলে আসে নিশি।
‘বাই, আমার জামা কিইন্না দিবা না’?
‘হ দিমু চল’।
নিশি ভাইয়ের আঙুল টা শক্ত করে ধরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়। আর পথ দিয়ে যাওয়া ওর বয়সি ছোট্ট ছোট্ট মেয়েদের দিকে তাকিয়ে ভাবে,
‘ইশ্ আমারও যদি ওগোর মতো একখান জামা থাকতো!

আজ পহেলা বৈশাখ। প্রায় সব দোকানই বন্ধ।
তবে ফুটপাতের কয়েকটা দোকান খোলা আছে। রহিম নিশিকে নিয়ে সেদিকেই ছোটে। তারপর একটা দোকানের সামনে এসে বলে,
‘কুন জামাডা নিবি দেখ’?
নিশি জামার দিকে তাকায়। মনে ধরে না কোনটাই।
অপর দোকানে যায়। একটা জামা দেখে হঠাৎই চিৎকার করে ওঠে নিশি।
‘বাই, ঐ লাল জামাটা আমার মেলা বালা লাগছে’।
রহিম তাকিয়ে দেখে মাথার উপরে একটা সুন্দর কারুকাজ করা লাল ফ্রক।
‘বাই আমারে এইহান কিন্না দিবা’?
রহিম দোকানদারকে বলে,
‘চাচা ঐ লাল জামাডার দাম কত’?
‘কুনডা ‘?
‘ ঐ যে উপুরের ডা’।[ হাতের ইশারায় দেখায় নিশি]
দোকানদার জামাটা নিচে নামায়।
‘হ এইডা’।
‘এইডা খুব ভালা জামা। নিবা নাকি ‘?
‘ হ চাচা মিমু। তয় দাম কত’? জানতে চায় রহিম।
‘এইডা একদাম তিন’শো রাখা যাইবো’।

তিন’শ টেহা! বুকটা ধক্ করে ওঠে রহিমের।
“এহন এত টেহা কই পামু” ! মনে মনে ভাবে রহিম।
অনেকক্ষণ ভেবে নিশিকে বলে,
‘বইন, তুই এই দোহানডার পাশে বয় আমি আর কিছু টেহা লইয়া আইতাছি’।
‘আইচ্ছা বাই যাও’।
রহিম একদৌড়ে সেখান থেকে চলে যায়। এতটাকা কই পাবে ভেবে পায় না।

তবে কি ভিক্ষা করবো? কেমন যেন লাগে ওর।
না খেয়ে থাকলেও কোনো দিন হাত পাতেনি রহিম।
তবে বোনটার এই একটা আবদার কি সে রাখতে পারবে না?
‘নাহ্ , বোনডার জন্য আমার আইজ হাত পাতাই লাগবো’। নিজের কথা না ভেবে অবশেষে হাত পাতে রহিম। তবে মুখে কিছু বলতে পারে না হয়তো লজ্জা অথবা আত্মসম্মানের জন্য।
কারো দয়া হলে দিচ্ছে তবে বেশির ভাগই দিচ্ছে না।

দুপুর গড়িয়ে গেছে। হাত পাতা আর সহ্য হয় না ওর। ওদিকে বোনটাকে সেই সকালে বসিয়ে রেখে আসছে।
দৌড়ে বোনের কাছে চলে যায় সে। গিয়ে দেখে ছোট্ট বোনটা তার হাটুর উপর মাথা রেখে অধীর আগ্রহে তার পথ পাণেই চেয়ে আছে।
রহিম নিশির হাতটা ধরে দোকানটার সামনে আসে।
‘ চাচা ঐ জামাডা নামান তো’।
‘জামা কি নিবা’? দোকানদার বলে।
‘ হ চাচা নিমু’।
দোকানদার জামা টা নামায়।
‘চাচা, দাম কত’?
‘একদাম তিন’শো টেহা’।
‘কিছু কমান যায় না চাচা’?
‘কত দিবা তুমি কও’।

রহিম ছেঁড়া হাফ প্যান্টের পকেট থেকে একমুঠো খুচরা টাকা বের করে। তারপর রাস্তায় রেখে গুণতে শুরু করে,
দশ, পনেরো,তেইশ,চল্লিশ, সত্তর, এক’শো
এভাবে একশত তেরো টাকা হয়। রহিম খুশি মনে দোকানদারকে বলে,
‘চাচা একশো টেহা দিবা এই জামাডা’?
‘এত কম দামে দেওন যাইবো না। বেশি অইলে কও’।
রহিম কত বলবে ভেবে পায় না।
‘চাচা এক’শো দশ টেহা দেবেন ? এর বেশি আমি আর পারুম না’।
‘ধুর মিয়া! এত কম দাম অয় নাকি! আরও কও।’
ধমক দিয়ে কথা টা বলে দোকানদার।
‘আমার কাছে মোট এক’শো তেরো টেহাই আছে’।
‘ভাগ বেটা। টেহা নাই জামা কিনতে আইছে ফকিন্নি কোথাকার’।
‘চাচা দেন না জামাডা। আমার বইনডার মেলা পচন্দ অয়ছে জামাডা’।
‘যা এহান থেইক্কা। টেহা নাই আবার জামা কিনা লাগবো ক্যে’?
‘চাচা আফনে এই টেহাডা রাহেন। আমি পরে বাকি ডা শোধ করে দেবো নে, তাও জামাডা দেন’।
‘ভাগ বলতেচি এহান থেইক্কা’। বলেই দোকানদার তাড়া করে রহিমকে। উপায় না পেয়ে ছোট্ট বোনটার হাত ধরে দৌড় দেয় রহিম ।

‘বাই, আমারে ঐ জামাডা কিইন্না দিবা না’? দৌড়াতে দৌড়াতেই বলে নিশি।
‘হ বইন দিমু তো। তুই একদম মন খারাপ করিস নে আমি তোরে জামাডা কিন্নাই দিমু’।

ছোট্ট নিশি ভাইটার কথায় স্বস্তি পায়।
ভাবে,
‘বাই টা ঠিক তারে ঐ লাল টুকটুকে জামাটা কিন্না দিবো’।

তবে ছোট্ট রহিম জানে বাস্তবতা কতটা নির্মম ।
তার বোনটার ছোট্ট একটা আবদার “লাল জামাটি” হয়তো আর কখনোই কেনা হবে না।
অনেক চেষ্টা করেও রহিম পারলো না বোনটার ছোট্ট ইচ্ছাটি পূরণ করতে।
ছোট্ট নিশিটার ছোট্ট ইচ্ছাটি অপূর্ণই থেকে গেল।

আহত রহিম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশপানে তাকিয়ে ভাবে,
‘এই বার না পারলাম, পরের বার বোনডারে ঐ জামাডা ঠিক কিন্না দেবো’।”

আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প প্রতিযোগিতা – ১ এ ষষ্ঠ স্থান অর্জনকারী “বাঁধন” গল্পটি পড়তে ক্লিক করুন >> বাঁধন । অনুষ্কা সাহা ঋতু । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প

লাল জামা । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প । লেখক পরিচিতি

লেখকঃ আসিফ আহমেদ
ছোটগল্পঃ লাল জামা
গল্পের জনরাঃ সামাজিক
দেশের বাড়িঃ পাবনা
পড়াশোনাঃ ডিপ্লোমা ইন ইন্জিনিয়ারিং, মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্ট ৩য় সেমিস্টার, ২০১৮।

asif-ahmed-আসিফ-আহমেদ-attoprokash-writter
লেখক- আসিফ আহমেদ

সাহিত্যের নেশায় আসক্ত। গল্প লিখতে ভালোবাসি। আমার জগত বলতেই বই।

আত্মপ্রকাশ সম্পাদক

http://attoprokash.com

আত্মপ্রকাশে অপ্রকাশিত গল্প এবং বুক রিভিউ এবং প্রবন্ধ প্রকাশ করতে যোগাযোগ করুন (ইমেইল-attoprokash.blog@gmail.com) অথবা ফেইসবুক পেইজ ইনবক্স। সর্বনিম্ন ১০০০ শব্দ হতে যেকোনো ঊর্ধ্ব সীমার ছোট গল্প গ্রহণযোগ্য। আপনার গল্প আত্মপ্রকাশ বিচারকদের দ্বারা নির্বাচিত হলে আপনাকে জানানো হবে এবং তা সরাসরি প্রকাশ করা হবে আত্মপ্রকাশে। আপডেট জানতে ফেইসবুক গ্রুপে সক্রিয় থাকুন।

3 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *