নিষিদ্ধ লোবান বুক রিভিউ । সৈয়দ শামসুল হক । মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর রচিত ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাসটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। বইটি প্রথম প্রকাশ হয় ১৯৮১ সালে। আত্মপ্রকাশের আজকের আয়োজন নিষিদ্ধ লোবান বুক রিভিউ।

উপন্যাসঃ নিষিদ্ধ লোবান
লেখকঃ সৈয়দ শামসুল হক
প্রকাশকালঃ প্রথম প্রকাশ ১৯৮১
প্রকাশকঃ অনন্যা প্রকাশনী
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৭১

নিষিদ্ধ লোবান বই রিভিউ । উপন্যাসের পটভূমি

রচনার ভাগসমূহ

বিলকিসের গন্তব্য জলেশ্বরী,তাঁর যাত্রাপথের শুরু ছিল ঢাকা, নবগ্রামে ট্রেন এসে ফেরত চলে গেল তোরশাতে। জলেশ্বরীর দুরুত্ব এখনো পাঁচ মাইল, কোথাও কোন যান নেই। হাতে গোনা কিছু মানুষ দেখা যাচ্ছে,যান থাকলেও জলেশ্বরী তে যাওয়ার মনোভাব কারোর নেই। পরিবেশটাই কেমন নিরবতায় সায় দিচ্ছে।

পায়ে হেটে হলে ও বিলকিস কে জলেশ্বরী যেতেই হবে,তাঁর মন উদ্বিগ্ন হয়ে আছে তার মা, বোন ও ভায়ের জন্য। সেই ২৫ শে মার্চ রাত থেকে তাঁর স্বামী আলতাফের কোন খোঁঁজ নেই। কখনো খোঁঁজ পাবে সে আশা সে করে না। নাড়ির টান কিনা না করতে পারে, পাঁচ মাইল কেন হাজার মাইল ও পায়ের হাটার মতো দুঃসাহসও পেয়ে যাওয়া একটা মুহুর্তের ব্যপার মাত্র। সে পায়ে হেটেই জলেশ্বরীর দিকে ছুটে চললো।

স্টেশনে নামার পর থেকেই সে লক্ষ্য করেছে, ১৭-১৮ বছরের একটা ছেলে তাকে অনুসরন করছে। হাটার মধ্যেই মনে হচ্ছিলো কেউ তার পিছু নিয়েছে,পেছনে তাকিয়ে সেই ছেলেটাকেই আবিষ্কার করলো বিলকিস যাকে সে ইষ্টিশানে দেখেছিলো।ছেলেটা একটু সামনের দিকে এগিয়ে চুপ করে দাড়িয়ে রইল।বিলকিস কিছু প্রশ্ন করলে সে চুপ করে থাকে, পরক্ষনে বলে উঠে আপনি জলেশ্বরীতে যাবেন না।বিলকিস তাঁর সিদ্ধান্তে অটল, তাকে যেতেই হবে।তবে ছেলেটার সরলতা আর মিনতি তাকে স্পর্শ করে যায়।

সময়ের বাঁকে বাঁকে জীবনের প্রতিটি মোড়েই মানুষের জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়,হতে পারে সেটা নতুন কোন ঘটনার জন্য,হতে পারে কোন পরিচিত মানুষের সান্নিধ্য লাভের জন্য অথবা হতে পারে অপরিচিত কোন মানুষের সাথে পরিচিত হয়ে।সময়ে সময়ে এই সম্পর্ক গুলো রক্তের সম্পর্ক কেও হার মানায়।

হ্যাঁ বিলকিসের সাথে এই ছেলেটার পরিচয় এমনই একটা সম্পর্কের সুচনা করে। পথ চলার শেষ সময়টুকু পর্যন্ত বিলকিসের সহযোগী হয় এই ছেলেটাই, প্রদীপ ওরফে সিরাজ। সিরাজ বিলকিস কে তার বড় বোনের আসনেই আসিন করে।

তারা দুজনেই জলেশ্বরীর দিকে পা বাড়ায়,সন্ধ্যের দিকে তারা পদার্পন করে জলেশ্বরীতে, কিন্তু বাড়িতে মা, বোন, ভাই কাউকেই না দেখে বিলকিস চিন্তিত হয়ে পড়ে। সিরাজ গ্রামে খোঁঁজ নিয়ে জানতে পারে বিলকিসের মা বোন নদীর ওপারে চলে গেছে আর তারা নিরপাদেই আছে। কিন্তু তার ভাইকে হত্যা করেছে পাকিস্তানি সৈন্যরা।ভায়ের মৃত্যর খবর সিরাজ বিলকিস কে দেয় না। কিন্তু বিলকিস পরক্ষনে ঠিকি জানতে পারে তার ভায়ের মৃত্যুর খবর। আরো জানতে পারে তার ভাই সহ আরো অনেক কে হত্যা করে বাজারের মাঠে ফেলে রেখেছে পাকিস্তানিরা। লাশ ছোয়ার প্রতিও কড়া নিষেধাক্কা জারি করা হয়েছে।

কথায় আছে অধিক শোকে মানুষ পাথর হয়ে যায়,এই সময়টাতে ভোতা হয়ে যায় ইন্দ্রীয় এর কার্য ক্ষমতা। ভায়ের মৃত্যু সংবাদ তার কাছে নতুন মনে হয় নি, মনে হয়েছে শোনা কথাই সে দ্বিতীবার শুনেছে। দৃঢ় হয়েছে তার মনোবল, তাঁর মাথায় নতুন চেতনা জেগে উঠেছে, সে দাফন করবে তার ভায়ের লাশ।পাক-বাহিনী কিভাবে তাকে প্রতিরোধ করে সেটাই সে দেখতে চায়। আর তার সাথে সঙ্গ দিয়েছিল সিরাজ। কে এই সিরাজ? কি তার সম্পর্ক বিলকিসের সাথে? নাকি সে শুধুই দায়িক্ত পালন করেছে? দায়িত্ব হলেও কিসের দায়িত্ব সেটা?  তার নাম কেন প্রদীপ থেকে সিরাজ হলো? বিলকিস কি আদৌ তার ভায়ের লাশ দাফন করতে পেরেছিল? এই সকল প্রশ্নের সমাধানের জন্য আপনি পড়তে পারেন সৈয়দ শামসুল হক এর নিষিদ্ধ লোবান।

নিষিদ্ধ-লোবান-বুক-রিভিউ-সৈয়দ-শামসুল-হক-nishiddho-loban-book-review-bangla-syed-shamsul-haq
নিষিদ্ধ লোবান বুক রিভিউ

নিষিদ্ধ লোবান বুক রিভিউ। উপন্যাসের প্রেক্ষাপট

সৈয়দ শামসুল হক এর “নিষিদ্ধ লোবান” বইটি ৭১’ এর মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা। লেখক সৈয়দ শামসুল হক, এখানে তুলে ধরেছেন পাক-বাহিনী আর তাদের সহযোগীদের(দেশীয় শত্রু) তান্ডবের কিছু নমুনা। বিলকিস আর সিরাজই উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র। তাছাড়া রয়েছে আলেফ মোক্তার, ইষ্টটিশান মাষ্টার,  ইনজিন ড্রাইভার, পাকবাহিনীর মেজর, আর্দালি আর কিছু বিহারী।তবে বিলকিস আর সিরাজই মুখ্য চরিত্র। গুটি কয়েক চরিত্র এর মধ্য দিয়েই লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন লাখো মানুষের আর্তনাদ।তুলে ধরেছেন পাকিস্তানিদের নির্মমতা,নিষ্ঠুরতা আর কিভাবে বিহারীরা বাঙালীদের সাথে আচরন করেছে।

নিষিদ্ধ লোবান উপন্যাস হতে পাওয়া সৈয়দ শামসুল হকের কিছু উক্তি

সৈয়দ শামসুল হক কিছু উক্তি উপস্থাপন করেছেন উপন্যাসটিতে, যেগুলো ঐ সময়ের সাথে তো যায়ই আবার চিরন্তন সত্য হিসেবে নিলেও ভুল হবেনা। নিষিদ্ধ লোবান বুক রিভিউ লেখার সময় উক্তিগুলোকে একত্র করা হয়েছে।

“কখনো কখনো সমস্ত মানুষের মুখ এক হয়ে যায়”।

“বিষয়টা এমন যে যখন একজন ব্যক্তি আত্মকেন্দ্রিকটা ভুলে গিয়ে অনেকের মাঝে নিজেকে খুজে নিতে পারে অন্যের ভালো মানে নিজের ভালো মনে করতে পারে তখনি কেবল এমন টা হতে পারে”।

“পালাবার সবচেয়ে ভালো জায়গা শত্রুর ঘাটির ভেতরে”।

“কেউ ভেঙে পড়ে না,শোক কখনো এত বড় নয় যে মানুষ মাথা তুলে দাড়াতে পারে না”।

“সোনা পুড়লে কিন্তু আরো খাঁটি হয়। মানুষ কে বিপদ দিয়ে বিচার করলে অনেকটা এমরকমই হবে। মানুষের মন কে আরো দৃঢ় আরো শক্তিশালী করার জন্যই বিপদ গুলো হানা দেয় তাদের মনের দুয়ারে। আর মানুষ জন্মের আগ থেকেই বিপদের সাথে যুদ্ধ করে করেই পৃথিবীর আলো দেখে। তাই শোক কখনো সাহসের ঊর্ধ্বে না”।

“চাঁদ কখনো আলো দেয়,কখনো মেঘের আড়ালে কৃপণ হয়ে যায়”।

উক্তিটি লেখক খুব স্বাভাবিক অর্থেই ব্যবহার করেছন। আকাশ মানেই চাঁদ আছে আর সাথে মেঘের ও অভাব নেই। তাই মাঝে মাঝে চাঁদ  অনীচ্ছাতে হলেও কৃপণ হয়। বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য লেখকদের উক্তিগুলো থেকে তাঁর উক্তিগুলো বেশ পাকাপোক্ত এবং হৃদয়চ্ছেদী।


নিষিদ্ধ লোবান বুক রিভিউ । উপন্যাস নিয়ে নিজস্ব কিছু কথা

লেখক তার উপন্যাসটিতে একটা নির্দ্দিষ্ট জায়গা আর কিছু চরিত্র নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু ফুটিয়ে তুলেছেন পুরো যুদ্ধের ভয়াবহতা। যুদ্ধের সময় সাধারন মানুষের ভাবনা, স্বজনদের হারিয়েও সাহসি হয়ে ওঠা, নতুন উদ্যম নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করা। তাছাড়া পাক-বাহিনীর বাঙালির প্রতি আচরন টাও উপন্যাসে বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়।

পাকিস্তানিরা বাঙালিদের কে কুকুরের সাথে তুলনা করেছে, তাদের কে হত্যা করে ফেলে রেখেছে যাতে শেয়াল বা শকুন  খেয়ে যায়। এমন কাজ মানবিকতার মধ্যে পরে না। তখনকার সময়ে যারা বিহারী ছিল তাদের কার্যক্রম আরো নিষ্ঠুর। সাধারন মানুষের বাড়ি ঘর লুঠ করেছে তারা,পাকিস্তানিদের কে বাড়ি চিনিয়ে দিয়েছে, এক কথায় তারা পাকিস্তানিদের দোসর ছিলো।

বিহারীদের বিষাক্ত কার্যকলাপের একটা জ্যান্ত উদাহরন:আলেফ মোক্তার কে জুতোর মালা গলায় দিয়ে মাজায় দড়ি বেধে সারা গ্রাম ঘোরানো। একটা অন্ধ নিরীহ বাঙালিকে, শুধু বাঙালি বলে, এই অন্ধ লোকটাকে অসহনীয় নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে তাও আবার বিহারীদের থেকে যারা এদেশে থেকেছে,  এই দেশের অন্ন জল খেয়েছে।

আবার,বাঙালিদের প্রতি পাকবাহিনীর চিন্তা চেতনার দিক গুলোও মেনে নেয়ার মতো না।তারা বাঙালিদের কে কুকুর ভাবে তারা ভাবে বাঙালির রক্ত শুদ্ধ না, তারা প্রকৃত মুসলমান না। বিলকিসের প্রতি মেজরের উক্তি ছিল এরকম –

“আমি তোমায় সন্তান দিতে পারবো, উত্তম বীজ উত্তম ফসল। তোমার সন্তান খাঁটি মুসলমান হবে। আমরা সেই সন্তান তোমাদের দেব, তোমাকে দেব, তোমার বোনকে দেব, তোমার মাকে দেব, যারা হিন্দু নয়, অবাধ্য নয়,আন্দোলন করে না,জাতির এই খেদমত আমরা করতে এসেছি”।

উক্তিটার মাধ্যমে পাকবাহিনীর নিকৃষ্ট ব্যবহারের চিত্রই ফুটে ওঠে। তারা একই সাথে ধর্ষণ করেছে মা মেয়েকে।এর থেকে নিকৃষ্ট আর কি হতে পারে। আর এটা নাকি ছিল নাকি তাদের খেদমত, বড়ই হাস্যকর।

উপন্যাসে বিলকিস কে আমরা একজন সাহসী নারী হিসেবেই লক্ষ্য করি। নিজের আদরের ভায়ের মৃত্যু সংবাদ তাকে দমিয়ে দেয় নি আরো সাহসী ও দৃঢ় করেছে। ইচ্ছা জাগিয়েছে পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে যেয়ে ফেলে রাখা লাশ গুলোকে দাফন করার। জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত সে তার সাহস হারায় নি, সাহস ও বুদ্ধিমত্তার দ্বারা সে নিজের সম্মান তো রক্ষা করেছে। উপরন্তু একজন পাক-বাহিনীর মেজর কে মৃত্যু দন্ড শাস্তি দিতে পেরেছে। তার সাহসী কার্যকলাপ সত্যি প্রশংসার দাবি রাখে।

অপর দিকে পুরো উপন্যাসে বিলকিস কে সাহায্য করেছে  সিরাজ ওরফে প্রদীপ, যে কিনা বিলকিসের রক্তের সম্পর্কের কেউ না। তবুও সে যা করেছে বিলকিসের জন্য, রক্তের সম্পর্কের কেউ ও এমন টা করে না। একটু গভীরভাবে ভাবলে মুলত সে দেশের জন্য কাজ করেছে। আর সবার মতো সে ইন্ডিয়া চলে যায়নি। নিজের বাবা, মা, ভাই ও বোন কে হারিয়ে সে চেয়েছে দেশে থেকে দেশের জন্য কাজ করতে। যুদ্ধের সময় ধর্ম বৈষম্য টা খুব প্রকট ছিল। হিন্দুরাই সব চেয়ে বেশি জীবনের ভয়ে থাকতো। তাই প্রদীপকে ও সিরাজ হতে হয়েছে। এটা সে চায় না, সে আবার প্রদীপ হতে চায় আর সেটা বাংলাদেশে থেকেই।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জানা, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে অবশ্য করনীয়, তাই যতটুকু না জানলেই নয় ওতটুকুই শুধু আমরা জানি। একটু বিস্তারিত ভাবে জানার সুযোগ হয়ে ওঠে না আর হয়ে উঠলেও সব সময় ইচ্ছা থাকে না। আমরা বুলি আওড়ানোর মতোই ভাসা ভাসা ভাবে পড়ে থাকি যুদ্ধের ইতিহাস। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত ছিল বলেও অনেকে যুদ্ধ সম্পর্কে কিছুটা জানে। নিজের উদ্যোগে যুদ্ধের ইতিহাস পড়ে এমন মানুষ কমই পাওয়া যাবে। যারা উপন্যাস পড়তে ভালবাসেন তাদের জন্য নিষিদ্ধ লোবান বইটি দুটি কাজ করবে, প্রথমত সে পড়ার মাধ্যমে বিনোদন পাচ্ছে দ্বিতীয়ত যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কেও জানতে পারছে।

রোজিনা খাতুন

https://www.facebook.com/groups/attoprokash/

সাহিত্য অনুরাগী রোজিনা খাতুন, সর্বদাই সাহিত্যে ডুবে থাকতে পছন্দ করেন। রোজী পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগে অধ্যয়নের পাশাপাশি লিখালিখি করে থাকেন। সাহিত্য সমালোচনা তার বিশেষ একটি দিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *