কাক পরী – রুপকথার গল্প । পাখি শিকারি ও কাকের গল্প । আত্মপ্রকাশ
একজন লোকের কাজ ছিল জাল ফেলে পাখি ধরা, সেই পাখি বাজারে বিক্রি করা। তার ছিল একটি ছেলে। লোকটি যখন মারা যায় তখন ছেলের জন্যে তার জালটা ছাড়া আর কিছুই সে রেখে যেতে পারেনি।
ছেলেটি বাবার কাছে পাখি-ধরা শিখেছিল। রোজকার মতো সেদিনও সে জাল নিয়ে পাখি ধরতে বেরিয়েছে। যেতে যেতে, একসময় শেষ পর্যন্ত খুব ঘন বনে পৌছে গেল সে। তারপর সেখানে একটা সুবিধামতো গাছ বেছে নিয়ে তার একটা ডালে জাল বিছিয়ে নিচে নেমে অপেক্ষা করতে থাকল।
বেশিক্ষণ দেরি করতে হল না, হঠাৎ সে দেখল একটা কাক সেই জালে আটকে গেছে, কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারছে না। ছেলেটি গাছে উঠল কাকটাকে ধরতে, এমন সময় অবাক কাণ্ড, কাকটা মানুষের ভাষায় অত্যন্ত কাতর গলায় বলে উঠল, ‘ছেড়ে দাও আমাকে, দয়া কর !
ছেলেটি বলল, “বাঃ, ছেড়ে দেব কেন? পাখি ধরার জন্যেই তো আমি জাল ফেলেছি!’
কাক আবার তেমনি কাতর গলায় তাকে ছেড়ে দিতে অনুরােধ করল। ছেলেটি বলল, ‘বারে, পাখি ধরার জন্যে যে জাল পেতেছে, তার জালে ধরাপড়া পাখিকে সে ছেড়ে দেয় কখননা, এমনই বোকা সে?
কাক বলল, ‘ছেড়ে দিলে বোকামির কাজ হবে না গো, বরং বুদ্ধিমানের কাজই হবে, কারণ আমাকে ছেড়ে দেবার পর তুমি যে পাখি ধরবে, সুলতানের কাছে সেটাকে খুব ভালো দামে বিক্রিও করতে পারবে।
এ কথায় ছেলেটি কাককে ছেড়ে দিল। তারপর আবার জালটা বিছিয়ে দিয়ে নেমে এল। বেশিক্ষণ দেরি করতে হল না, কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা পাখি এসে সেই জালে ধরা পড়ল। কী প্রকাণ্ড, আর কী চমৎকার পাখিটা, অপরূপ তার রঙ ! পাখিটা নিয়ে সে তক্ষুনি সুলতানের কাছে গেল। | পাখি দেখে তো সুলতান অবাক—পাখি এত সুন্দরও হয়! সঙ্গে সঙ্গে তিনি পাখিটা নিলেন, আর কোনোরকম দরাদরি না করেই ছেলেটিকে অজস্র টাকা দিয়ে দিলেন,—এত টাকা সে সারাজীবনেও আয় করতে পারত না। সুলতানের হুকুমে পাখিটাকে একটা সোনার খাঁচায় রাখা হল, আর ব্যবস্থা হল, যাতে পাখিটা কোনো সময়েই তার চোখের আড়াল না হয়।
এদিকে উজির তো হিংসেতেই মরে যায়—কোথাকার একটা সামান্য ছেলে, পাখি ধরে খায়, তাকেই কিনা সুলতান এতগুলো টাকা দিলেন ! তিনি ঠিক করলেন, যেমন করেই হোক ছোকরাটাকে জব্দ করবেন।
সুলতানের সঙ্গে দেখা করলেন তিনি। প্রথমেই পাখিটার খুব প্রশংসা করলেন। তারপর বললেন, কিন্তু হুজুর, এমন চমৎকার পাখিকে কি সামান্য সোনার খাঁচায় রাখলে মানায়? এর উপযুক্ত জায়গা হচ্ছে হাতির দাঁতের একটা বাড়ি।
কথাটা সুলতানের মনে ধরল। বলে উঠলেন, ঠিক কথা, ঠিক কথা উজির ! কিন্তু তার জন্যে যে প্রচুর হাতির দাঁতের দরকার, এত দাত আমি কোথা থেকে পাব?’
‘কেন জাহাপনা—পাখি যে দিয়েছে, পাখির থাকার জায়গার ব্যবস্থাও তো তাকেই করতে হবে।
সুলতান ভাবলেন, তাইতো। তিনি ডেকে পাঠালেন ছেলেটিকে। বললেন, এই পাখির উপযুক্ত একটা হাতির দাঁতের বাড়ি তৈরি করে দিতে হবে তোমাকে, এবং তা তৈরি করতে যত হাতির দাঁত দরকার হবে সব তোমাকে জোগাড় করে দিতে হবে। চল্লিশ দিন সময় দেওয়া হল। ছেলেটি বলল, “কিন্তু হুজুর—।
উজির ছিলেন সেখানে, তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, “চুপ, একটা কথাও নয়—এ হচ্ছে সুলতানের হুকুম ! জান তো, সুলতানের হুকুম মতো কাজ না করলে কী শাস্তি হয় ? বিপদে পড়ল ছেলেটি। সে ভালো করেই জানে, সুলতানের হুকুম পালন করতে পারলে তার মুণ্ডু কাটা যাবে। খুব মন খারাপ করে সে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এল। কী করবে, কোথায় যাবে—কিছুই সে ভেবে পেল না। হঠাৎ একটা আওয়াজ তার কানে এল। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল, সেই ছোট কাকটা তার কাছে উড়ে আসছে। কাকটা এসে তার কাঁধে বসল। বসে বলল, এমন মনমরা হয়ে দাড়িয়ে আছ কেন, সুলতান কি পাখিটার ভালো দাম দেননি?
পাখিওলা বলল, “হ্যা, সুলতান খুব ভালোই দাম দিয়েছেন, অত টাকা আমি আশাও করতে পারিনি। কিন্তু এখন আমার মহা বিপদ, সুলতানের হুকুম, ঐ পাখির উপযুক্ত একটা হাতির দাঁতের প্রাসাদ তৈরি করে দিতে হবে, তা-ও চল্লিশ দিনের মধ্যে। এ কেমন করে সম্ভব হবে বল?’
শুনে কাক বলল, “আরে ও কিছুই না, এর জন্যে ভেব না। আমি যা যা বলছি ঠিক সেই মতো কাজ কর, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। সুলতানকে বল চল্লিশ পিপে আঙুরের রস চাই, তারপর সেই রস নিয়ে তুমি বনের ভিতরে অনেক দূরে চলে যাবে। সেখানে চল্লিশটা খাল দেখতে পাবে, সেই এক-একটা খালে এক-এক পিপে রস ঢেলে দেবে। বনের হাতিরা যখন পানি খেতে এসে সেই রস দেখতে পাবে তখন আর তারা পানি খেতে যাবে না, খুব আয়েস করে সেই রস খাবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই যখন তারা নেশায় ঢুলে পড়বে, তোমার তখন কাজ হবে শুধু সেইসব হাতির দাত খুলে নেওয়া।
কাক যেমন যেমন বলেছিল ঠিক সেই মতোই কাজ হল, একরাশ হাতির দাঁত নিয়ে সে সুলতানের প্রাসাদে গেল।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
একসঙ্গে এত হাতির দাত সুলতান জীবনে দেখেননি। খুব খুশি হয়ে তিনি পাখিওলাকে আরো অজস্র টাকাকড়ি দিলেন। হিংসুটে উজির ভাবলেন, ‘হায় হায়, কোথায় পাখিওলার গর্দান যাবে আর তার হাড় জুড়োবে, তার বদলে কিনা ছোকরাটা আরো ভূরি ভূরি টাকা নিয়ে চলে গেল। রাগে কাপতে লাগলেন তিনি। তখন তার মাথায় আবার একটা মতলব খেলে গেল। সুলতানের কাছে গিয়ে তিনি বললেন, “হুজুর, আপনার এই পাখির কোনো তুলনা নেই, এমন পাখি কেউ কোনোদিন দেখেনি। কিন্তু হুজুর, এর উপর যদি এই পাখি গান গাইতে পারত তাহলে কি আরো চমৎকার হত না হুজুর ?”
কথাটা সুলতানের বিশেষ মনের মতো হল। বললেন, ‘বলেছ তো ঠিকই উজির, কিন্তু তা কেমন করে হবে ? ও যে গান জানে না।
উজির বললেন, ‘হুজুর, ও তো বুনো পাখি নয়, শেখালে নিশ্চয় শিখতে পারবে, এবং সে ব্যবস্থাও নিশ্চয় পাখিওলাই করতে পারবে। তখন সুলতানের আদেশে পাখিওলা তাঁর সামনে হাজির হল।
শুনে পাখিওলা বলল, কিন্তু হুজুর, এ তো আমার ধরা পাখি, এ কেমন করে গান গাইবে? আর, যদি পারত তাহলে কি গাইত-না হুজুর ?”
উজির বললেন, ‘ও সব কথা হুজুর শুনবেন না। যাও, চল্লিশ দিন সময় দিলাম, তার মধ্যে যেন সুলতান ওর গান শুনতে পান। না হলে কী শাস্তি হবে তা নিশ্চয় তুমি জান।
প্রায় কাঁদতে কাঁদতে পাখিওলা প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এল। এমন সময় ডানার ঝটপটানি শুনে সে তাকিয়ে দেখল, সেই কাক উড়ে আসছে। তার কাঁধে বসে বসে সে তার এই বিপদের কারণ জিজ্ঞাসা করল।
সব শুনে এবারও কাক বলে উঠল, ‘ও, এই ব্যাপার? এর জন্যে একটুও ঘাবড়িও না , যেমনটি বলব ঠিক তেমনিভাবে কাজ কর। শোনো মন দিয়ে, সুলতানের কাছে গিয়ে একটা প্রকাণ্ড জাহাজ চেয়ে নাও, সেই জাহাজে থাকবে চল্লিশ জন দাসী, একটা বাগিচা আর একটা স্নানের ঘর। সেই জাহাজ নিয়ে তুমি অনেক, অনেক দূরে চলে যাবে। এক জায়গায় একটা দ্বীপ তুমি দেখতে পাবে—সেই দ্বীপে থাকে পরীরানি, তারই দ্বীপ সেটা। প্রকাণ্ড জাহাজ দেখেপরীরানি আর অন্যান্য পরীরাও জাহাজে উঠতে চাইবেন, কিন্তু তুমি অন্য কাউকে নয়, কেবলমাত্র পরীরানিকেই সেই জাহাজে উঠতে দেবে।
তারপর যখন পরীরানি স্নানের ঘরে গিয়ে স্নান করবেন আর দাসীরা তার সেবা করবে, তখনই হবে তোমার সুযোগ, জাহাজ নিয়ে ওখান থেকে চলে আসবে।
ঠিক কাকের কথামতোই কাজ হল। পরীরানির যখন খেয়াল হল জাহাজ দ্বীপ ছেড়ে চলে যাচ্ছে তখন আর তার পক্ষে দ্বীপে ফেরার কোনো উপায় রইল না। ভয়েই অস্থির হলেন তিনি।
পাখিওলা তখন এসে তাকে বলল, ‘কোনো ভয় নেই, সে তাকে তাদের সুলতানের কাছে নিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ কাজে।
জাহাজ পৌছলে পাখিওলা পরীরানিকে নিয়ে সুলতানের প্রাসাদে গেল। পাখিওলার সঙ্গে পরীরানি প্রাসাদে প্রবেশ করলে মনে হল যেন স্বর্গের দরজা খুলে গেছে। এমন অপূর্ব গলায় পাখিটা গেয়ে উঠল যা কোনো মানুষ কোনোদিন শোনেনি। ততক্ষণে পরীরানিরও ভয় ঘুচে গেছে, খুশিতে মন ভরে উঠেছে। আর সুলতান তো ভেবেই পাচ্ছেন না কোনটা বেশি ভালো,—পাখির গান, না পরীরানির রূপ !পরীরানিকে বিয়ে করার জন্যে তিনি অত্যন্ত উৎসুক হয়ে উঠলেন। তাতে পরীরানিরও আপত্তি না থাকায় পরদিনই বিয়ে হয়ে গেল।
সুলতানের মন যেমন খুশিতে ভরে উঠল, উজিরের মন তেমনি হিংসেয় ভরে উঠল। কিছুতেই তিনি ভেবে পাচ্ছেন না কেমন করে পাখিওলাকে জব্দ করবেন।
এদিকে হয়েছে কী, সুলতানের বউ পরীরানি হঠাৎ অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়লেন। রাজ্যের সেরা চিকিৎসকরা দেখে গেল, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। শেষ পর্যন্ত তারা বললেন, ‘হুজুর উনি পরিরানি, ওঁর ওষুধ আনতে হবে ওঁর দেশ থেকে, তবে উনি সেরে উঠবেন।
উজির দেখলেন, এই আর-একটা সুযোগ। তিনি সুলতানকে বললেন, ‘হুজুর, পরীরানিকে পাখিওলাই তো এনেছে, তার দ্বীপ তার চেনা, সে-ই গিয়ে ওষুধ নিয়ে আসুক, খেয়ে রানিমা ভালো হয়ে উঠবেন।
আবার পাখিওলা সেই প্রকাণ্ড জাহাজ ভাসিয়ে চলে গেল পরীরানির দ্বীপে। তীরে উঠে সে এগিয়ে চলল নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত পার হয়ে। প্রাসাদের কাছে যেতে সে দেখল, একটা সিংহ প্রাসাদের দরজা পাহারা দিচ্ছে—সিংহটা প্রকাণ্ড! আর এক পা-ও সে এগোতে ভরসা পেল না, তার সারা শরীর কাঁপছে। অথচ তাকে তো ওষুধ নিয়ে ফিরতেই হবে, রানিমা না-হলে বাঁচবেন না, আর তাহলেই তার মুণ্ডু কাটা যাবে !
ভেবে পেল না সে কী করবে, তার খুব মন খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎ কাকটাকে তার চোখে পড়ল, উড়তে উড়তে তার কাছে এগিয়ে আসছে। পাখিওলার কাঁধে বসে সে সব শুনল। বলল, “আরে এই ব্যাপার? এ আর এমন কী? এই একটা পালক দিচ্ছি, এটা নিয়ে তুমি প্রাসাদের তোরণের কাছে যাও। সিংহ কাছে এলে এটা তার গায়ে ছুঁইয়ে দেবে, আর সিংহ কিছু বলবে না।
হলও তাই। সে প্রাসাদে প্রবেশ করা মাত্র পরিরা সবাই এসে জিজ্ঞাসা করল, পরীরানি কেমন আছে, আর যখন তারা তার কাছে পরীরানির অসুখের কথা শুনল দৌড়ে গিয়ে একটা ওষুধ এনে তার হাতে দিল। বলল পরীরানির শরীরে ছোঁয়ালেই সঙ্গে সঙ্গে পরীরানি ভালো হয়ে উঠবেন। ওষুধ নিয়ে পাখিওলা রাজ্যে ফিরল, কাকও ফিরল সেইসঙ্গে।
পাখিওলা যখন ওষুধ নিয়ে প্রাসাদে রানিমার ঘরে গেল, তখন রানিমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। পালঙ্কের পাশে গিয়ে সে ওষুধটা তার মুখে, গায়ে ছুঁইয়ে দিল।
সঙ্গে সঙ্গে রানি চোখ মেলে তাকালেন, আর তাঁর দৃষ্টি কাকটার ওপরে গিয়ে পড়ল। তক্ষুনি তিনি বলে উঠলেন, ‘ওরে হতভাগী, কুঁড়ের হদ্দ কোথাকার!”
কাক পাখিওলার কাঁধে দাড়িয়ে ছিল, পরীরানির এ-কথায় সে সেখানেই তুড়ুক-তুড়ুক করে নাচতে শুরু করল।
পরীরানি আবার বললেন, ‘ওরে আমি জানি তুই-ই এই ভালোমানুষ পাখিওলাকে এতবার এত বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিস, আর এখন আমারও প্রাণ রক্ষা করলি। বলতে বলতে রানি সোজা হয়ে উঠে বসলেন, তার চোখ ঝলমল করে উঠল।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
সুলতান বললেন, কিন্তু এসব তুমি কী বলছ কিছুই তো বুঝতে পারছি না! রানি বললেন, ‘ও ছিল আমার অতি প্রিয় দাসী। কিন্তু ও ছিল বেজায় কুঁড়ে, আর কেবলই কাজে ফাকি দিত। তাই আমার শাপেই ও কাক হয়ে গিয়েছিল। এখন আমি ওর সব অপরাধ ক্ষমা করলাম,—যে এত ভালো কাজ করেছে তাকে কি ক্ষমা না করে পারা যায়!
সঙ্গে সঙ্গে—কোথায় গেল কাক? তার জায়গায় দেখা গেল এক অতি সুন্দরী পরী। তাকে দেখেই পাখিওলার খুব পছন্দ হয়ে গেল, আর পরীদেরও তখন তাকে তেমনি ভালো লাগল।
তখন আর কী, সুলতানের আর রানির মত হওয়ায় আর বিয়ে হতেও দেরি হল না।
সব শুনে সুলতান পাখিওলাকে উজিরের আসনে বসালেন, আর শয়তান উজিরকে দূর দেশে নির্বাসিত করলেন। তারপর থেকে আর কেউ কোনোদিন উজিরকে রাজধানীর ত্রিসীমানাতেও দেখতে পায়নি।
‘কাক পরী’ রুপকথার গল্পটি আমিরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘তুরস্কের রুপকথা’ গল্পবই হতে সংগ্রহ করা হয়েছে।
1 Comment
[…] […]