সারেং বৌ বুক রিভিউ । শহীদুল্লা কায়সারের সারা জাগানো উপন্যাস
সারেং বৌ লেখক শহীদুল্লা কায়সার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ১৯২৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাজাকার ও আলবদরের সহায়তায় পাকবাহিনী তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে হত্যা করে। সারেং বৌ উপন্যাসটি তিনি জেলে বসেই রচনা করেছেন। আত্মপ্রকাশের আজকের আয়োজন সারেং বৌ বুক রিভিউ।
উপন্যাসঃ সারেং বৌ
লেখকঃ শহীদুল্লা কায়সার
প্রকাশকালঃ প্রথম প্রকাশ ১৯৬২
প্রকাশকঃ নওরোজ সাহিত্য সম্ভার
সাহিত্য পুরস্কারঃ আদমজী সাহিত্য পুরস্কার
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১৪৯
সারেং বৌ বুক রিভিউ । উপন্যাসের পটভুমি
রচনার ভাগসমূহ
সমুদ্রেরর নিকটবর্তী কয়াল নদীর তীরে বামনছাড়ি গ্রাম। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। জলরাশি যেন গ্রামটির চারিদিকে বিছিয়ে রেখেছে কোমলতার চাদর। বেশ কয়েকঘর লোকের বাস এই গ্রামে। হালচাষ ও নাবিকের কাজই জীবিকা উপার্জনের প্রধান উৎস এই গ্রামের মানুষের। আর এই গ্রামের সারেং বাড়ির বউ নবিতুন। বারো বছর বয়সে মজল সারেং এর ছেলে কদম সারেং এর সাথে বিয়ে হয় নবিতুনের, সে এখন এক সন্তানের জননী ও তেইশ বছরের এক নারী। (যারা নাবিকের কাজ করে তারা সারেং হিসেবে পরিচিত, মজল সারেং এর ছেলে কদম সারেং ও একজন নাবিক)
জাহাজের কাজে বিভিন্ন দেশের বন্দরে বন্দরে ঘুরে বেড়ানোই নাবিকের কাজ। বিদেশে থাকারই আর একটা মাধ্যম হচ্ছে জাহাজে কাজ করা। সমুদ্র নাবিকদের দ্বিতীয় বাড়ি বললেও ভুল হয় না।
তিন বছর হয়ে গেল কদম সারেং এর বাড়ি ফেরার নাম নেই। যে টাকা রেখে গিয়েছিল খরচের জন্য ফুরিয়ে গেছে অনেক আগেই। পরের ধান ভেনে দিয়ে একটু চাল পায় নবিতুন। সেই চাল রান্না করেই দুই মা মেয়ের দিন চলে যায়। চাল কল আসায় সকলে কলেই চাল ভাঙানো শুরু করে, নবিতুনের শেষ ভরসা টুকুও মিলিয়ে যেতে থাকে।তাছাড়াও লুন্দর শেখের বদ নজরে পড়েছে নবিতুন। গুজো বুড়ি সগির মাকে তার পিছনে লাগিয়ে দিয়েছে সে।গুজোবুড়ি নানা রকম জিনিসের লোভ দেখায় নবিতুনকে। পাড়ার লোকে বিভিন্ন রকম বাজে কথা বলে কদম কে নিয়ে।সে আর কখনো ফিরবে না এমনটাই বলে সগির মা। কিন্তু নবিতুন কদম সারেং এর বিশ্বাসি বউ, সে প্রতিক্ষায় থাকে তার স্বামির ফিরে আসার। সে মনে প্রানে বিশ্বাস করে তার কদম এমন না যে শ্বেতি মেমদের জাদুতে আটকে থাকবে। কদম সারেং তো কেবল নবিতুনের রুপের জালে আটকা পড়েছিল সেই এগারো বছর আগেই।দৃঢ়ভাবে সে বিশ্বাস করে তার সারেং বৌ কে।
তার এই দুর্দশার সময়ে চৌধুরী বাড়িতে ঝিয়ের কাজ পায় নবিতুন। সারা দিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পরে নবিতুন পায় কিছু খাবার। সেটাই,দু বেলা আধ পেটা খেয়ে দিন গুজরান দেয় মা মেয়ে। এদিকে ছোট চৌধুরীও খারাপ নজরে দেখে সারেং বউ কে। তার সৌন্দর্যে যেন ঝলসে যায় সব পুরুষের হৃদয়।যখন নবিতুন কাজে ব্যস্ত থাকে ছোট চৌধুরি যেন চোখের নেশায় লেহন করে নবিতুনের শরীরের কোমলতা।
যখন সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয় লুন্দর শেখের, তখন সে অন্য পথ বেছে নেয়। চৌধুরী বাড়ি থেকে ফেরার পথে ধানের ক্ষেত ও পাট ক্ষেত পাড়ি দিতে হয় নবিতুনকে। সে দিন কাজ সের ফিরে আসতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গিয়েছিল। সেই পাট খেতের কাছে এসেই সারেং বৌকে সম্মুক্ষীন হতে হয় অনাকাঙ্খিত বিপদের। লুন্দর শেখ ঝাপিয়ে পড়ে নবিতুনের ওপর, খুলে দেয় তার শাড়ি। আদৌ কি সারেং বৌ পেরেছিল তার সম্মান রক্ষা করতে? যদি পারেই তাহলে কিভাবে রক্ষা করেছিল?
জাহাজে গোপনে গোপনে অনেক অবৈধ কাজ হয়ে থাকে। বিভিন্ন ধরনের নিষদ্ধ জিনিসের লেনেদন হয় জল পথে। কদম সারেং এসব থেকে আলাদা, সে অবৈধ কাজে নিজেকে জড়াতে নারাজ। জাহাজের বড় পদের একজন নাবিক তাকে ছোট একটা প্যাকেট রাখতে দেয় আর এই প্যাকেটের জন্যই তাকে তিন বছর হাজতে কাটাতে হয়। মুক্তি পেয়ে সে আবার রুতুন্দা জাহাজে নাবিকের কাজ শরু করে। বউ মেয়ের জন্য মন কেমন করলেও খালি হাতে সে বাড়িতে ফিরতে পারে না। জাহাজে কাজ করে সে চিঠি আর টাকা পাঠায় বউ এর কাছে। কিন্তু সারেং বউ কি সেই টাকা চিঠি পায়? যদি পায় তাহলে তাকে কেন অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতে হয়?
এক সময় ফিরে আসে সারেং, বউ এর জন্য নিয়ে আসে শাড়ি, চুড়ি আরো কত কি। নবিতুনের সুখ দেখে গা জ্বলে পাড়ার মানুষের। যারা নবিতুনকে নিজের করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে তারাই কদম সারেং এর কান ভাঙায় নবিতুনকে নিয়ে। নবিতুন ও নিরব থাকে, স্বামিকে কিছুই বলে না কি ঘটে গেছে এই ক বছরে। কদম সারেং এর সন্দেহ দানা বেধে ওঠে, ভুল বোঝে নবিতুনকে। সে কোন সংযোগই খুজে পায় না,কোথায় গেল তার পাঠানো চিঠি, টাকা।নবিতুন কেন তাকে চিঠি লিখে নি। কোন প্রশ্নের উত্তর পায় না ,ভেতরে বেতরে গুমরে মরে সে। তার অন্তঃসত্ত্বা বউকে প্রহার করে সে, পরে যায় নবিতুন, মরা ছেলে পসব করে সে।
হঠাৎ করে মেঘ উঠে আসে, গরম বাতাসের সাথে, সমুদ্র থেকে উঠে আসে বানের জল, ভেসে যায় সব কিছু। কামিজ বুড়ো, যে সাথ দিত লুন্দর শেখের বলতে থাকে সবই পাপের ফল। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে গ্রামের বুকে, গ্রামের মানুষ কি রক্ষা পায় সে বানের জল থেকে? নতুন দিনের সুর্যের সোনালি আভা কি ছুতে পারে নবিতুন আর কদম কে? নবিতুন আর কদম সারেং কিভাবে রক্ষা পায় গড়কি নামের বান থেকে? সারেং বৌ কিভাবে বাঁচিয়ে তোলে তার মৃত্যু পথযাত্রী স্বামি কে? জানতে চাইলে এখনি পড়ে নিতে পারেন শহীদুল্লাহ কায়সার এর সারেং বৌ উপন্যাসটি।
আরো পড়ে নিতে পারেন >> দ্য কাইট রানার বুক রিভিউ । খালেদ হোসাইনির অনবদ্য উপন্যাস।
সারেং বৌ উপন্যাস প্রেক্ষাপট
সারেং বৌ উপন্যাসটিতে ফুটে উঠেছে নদীর তীরের মানুষের জীবন যাত্রা। তাদের জীবিকা উপার্জনের উৎস। সমুদ্রকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে গ্রাম, সেই গ্রামের মানুষের রক্ষকই সমুদ্র, সমুদ্রই তাদের জীবিকা সরবরাহ করে থাকে। লেখক শহীদুল্লা কায়সার নবিতুন এবং তার স্বামী কদম সারেং কে প্রধান চরিত্র হিসেবে ফোকাস করেছেন।কদম সারেং একজন নাবিক, ডাঙায় যেমন আছে তার ভালবাসার বউ ও মেয়ে, জল ও তেমনি তার ভালবাসার আরো এক জায়গা। ডাঙায় থাকলে গভীর মমতায় জল তাকে টানে, আবার জলে থাকলে তার প্রিয়তমার কোমল ছোয়া ইশারা করে তাকে।
এই জীবিকার তাগিদেই সেই ঘর ছাড়া। তিন বছর সে জেল খেটেছে বিনা দোষেই। অন্যদিকে নিরুদ্দেশ স্বামীর জন্য প্রতিক্ষায় আছে নবিতুন। এ জন্য তাকে হাজারো গঞ্জনা সহ্য করতে হচ্ছে। কত পুরুষ তাকে দেখে লালায়িত হচ্ছে, তাকেও জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য পরের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতে হচ্ছে। সব কিছুই জীবিকার তাগিদের ইশারাই করে। উপন্যাসের সবটুকু চিন্তার জায়গাতে সবাইকে অর্থ উপার্জনের সাথেই সম্পৃক্ত দেখা গেছে।এছাড়া নাবিকদের জীবনের হতাশার জায়গাটাও লেখক দেখিয়েছেন নিখুঁতভাবে। বছরের পর বছর তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন দেশের বন্দরে। বাড়ির নেশা তাদের কে ক্ষনে ক্ষনে তৃষ্ণার্ত করে দিচ্ছে, অনেকে হারাচ্ছে বিবেক, কেউ আবার অনেক কষ্টে বিজয়ী হচ্ছে। আর হ্যাঁ উপন্যাসের শেষে লেখক শহীদুল্লা কায়সার দেখিয়েছেন কিভাবে রক্ষক হয়েই, সমুদ্র গ্রামের মানুষ কে ভক্ষন করছে।
সারেং বৌ বুক রিভিউ । উপন্যাস নিয়ে ব্যক্তিগত মতামত
শহিদুল্লাহ কায়সার তার সারেং বৌ উপন্যাসে খুব সাধারনভাবে সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রা অসাধারন ভাবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি একজন অসহায় নারী কে তুলে ধরেছেন অসামান্যা হিসেবে। যে কিনা বিপদে থমকে যায় নি,সাহস ও বুদ্ধি দিয়ে তার সকল বিপদ জয় করেছে। লেখক নিখুতভাবে গল্পের প্রধান চরিত্রের চিত্রায়ন করেছেন। স্বামির দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে, যখন সে উপোশ থেকেছে, দু মুঠো খাবারের জন্য বাড়ি বাড়ি কাজ খুজতে হয়েছে, তখন তাকে অনেকে সাহায্য করতে চেয়েছে বিনিময় হিসেবে চেয়েছে সম্মান। কিন্তু সে কখনো এতটুকু টলে যায়নি। সর্বদা নিজের সম্মান রক্ষা করে গেছে। সে একজন বিশ্বাসি বউ, একজন সম্মানি মা।
আমরা সেই সময়টার কথা তুলে ধরতে পারি, যখন লুন্দর শেখ হাজার লোভ দেখিয়ে নবিতুন কে তার বাগে আনতে পারল না। তখনই সে সারেং বউকে জোর করতে গেল। পাট খেতের মধ্যে অর্ধউলঙ্গ একটা নারী, কতটা ধৈর্য আর সাহস থাকলে বলিষ্ঠ একজন পুরুষের নিকটা থেকে নিজের সম্মান বাচিয়ে ফিরে আসতে পারে ঘরে? এটা সত্যি ভাবার বিষয়। নবিতুন কিন্তু এ কাজটাই করেছে। বিপদেও সে সাহস হারায় নি। তাঁর এমন কাজ সত্যি প্রশংসনীয়।তাকে বিপ্লবি বললে এত টুকুও কম হয় না। জীবন যুদ্ধে সে জয়ী। জীবনের বিপ্লবে সে জয় করেছে সকল বাধাকে।
সমাজে বাস করতে গেলে আমরা বিভিন্ন ধরনের মানুষ কে প্রতক্ষ্য করে থাকি। শহিদুল্লাহ কায়সারের সারেং বৌ উপন্যাসটিতেও বিভিন্ন চরিত্রের বিভিন্ন গুনের মানুষ দেখতে পাই। এদের মধ্যে লুন্দর শেখ, কামিজ বুড়ো, সগির মা, ছোট চৌধুরি, উল্লেখ্য যোগ্য। লুন্দর শেখ আর ছোট চৌধুরী সমাজের উচু শ্রেনীর লোক, তারা টাকা দিয়ে এক মুহুর্তে হাজার নারীর সম্মান নিয়ে খেলা করতে পারে। কামিজ বুড়ো ও সগির মা দুজনই তোষামুদে শ্রেনীর মানুষ।তারা বড় লোকদের পিছু ছুটে আর তাদের অনৈতিক কাজে সাহায্য করে একটু সুবিধা নেয়। এটা স্বাভাবিক যে সমাজে বিভিন্ন আচরনের, বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ থাকে।
যেহেতু সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই উপন্যাসটি লেখা তাই সমাজের মানুষের দুঃখ দুর্দশা ও জীবন প্রবাহই চিত্রিত হয়েছে উপন্যাসটিতে। আর এই বিষয় গুলো সমালোচনার জন্য ইতিবাচকই হয়ে থাকে তবে বানের জলে ভেসে গেল গ্রামের সবাই শুধু মাত্র কদম সারেং আর নবিতুনই বেচে রইল, আমার দৃষ্টিকোন থেকে বিষয়টা একটু নাটকীয় হয়ে গেল। এমনটা হতেই পারতো ওরা দুজন ছাড়াও আরো কিছু মানুষ বেঁচে গেল। কিন্তু না, তা হয়নি,মুলত লেখক চেয়েছেন নবিতুন ও কদমকেই চিহ্নিত করতে। ওদের দুজনের ভালবাসা বিশ্বাসকে তিনি সকল কিছুর ঊর্ধ্বে দেখিয়েছেন। এটার প্রমান আমরা তখনই পাই, বানের পরের দৃশ্যে যখন নবিতুন ও কদমের পুনরায় দেখা হয়, লেখক ওই সময়টাকে ওদের দুজনকে আদম হাওয়ার পৃথিবীতে মিলিত হওয়ার সাথে তুলনা করেছেন।
সব মিলিয়ে শহিদুল্লাহ কায়সারের সারেং বৌ উপন্যাসটি সত্যিই অসাধারন।উপন্যাসটি পড়ে পাঠকগণ পরিচিত হতে পারবে নাবিকদের জীবনের সাথে।কেমন তাদের পথ চলা, কেমন তাদের জীবনের গতি। জল ও ডাঙা তাদের কাছে কেমন ভুমিকা রাখে। তাছাড়াও নবিতুনের বিশ্বাস ও ধৈর্যের প্রশংসা করা ছাড়াও কিভাবে সকল পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেয়া, আকস্মিক আসা বিপদের মোকাবেলা করে নিজেকে রক্ষা করা, এই বিষয় গুলোর শিক্ষা পাঠক সারেং বৌ উপন্যাস পড়েই জানতে পারবে। যা একজন নারী তো বটেই, একজন পুরুষের জন্যও সমান দরকারি। তাই উপন্যাসটি পড়ার জন্য সকল পাঠকেরর কাছে নিবেদন রইল।
বইটি বর্তমানে বিভিন্ন অনলাইন স্টোরে পাওয়া যাচ্ছে, খুব সহজেই সুলভ মূল্যে সংগ্রহ করে নিতে পারেন শহীদুল্লা কায়সারের সারেং বৌ উপন্যাসটি।