বাবা নিয়ে যত কথন । সাপ্তাহিক অনুভূতি । আত্মপ্রকাশ

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে, আত্মপ্রকাশ ফেইসবুক গ্রুপে আয়োজন করা হয়, সাপ্তাহিক অনুভূতি- বাবা। সেখানে গ্রুপের সদস্যগণ বাবাকে নিয়ে প্রকাশ করেন, নিজ নিজ অনুভূতি, না বলা যত কথা। অনুভূতিতে যাবার আগে বাবাকে নিয়ে একটা ছোট্ট গল্প বলে নেই।

“একটি বিমান আকাশে মেঘের মধ্যে দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ বিমানটি নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলল। সকল যাত্রী ভয়ে চিৎকার করতে লাগল। কিন্তু সে সময় একটি ছোটো মেয়ে তার খেলনা দিয়ে খেলছিল। তার মধ্যে কোন ভীতি কাজ করছিল না!
এক ঘণ্টা পর বিমানটি এয়ারপোর্টে নিরাপদে অবতরণ করল। একটা লোক, ছোটো মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করল- “তুমি খেলছিলে কিভাবে? যখন আমরা সবাই ভয়ে অস্থির ছিলাম?
ছোটো মেয়েটি হাসল আর বলল- “আমার বাবা এই বিমানের পাইলট ছিলেন।
আমি জানতাম তিনি আমাকে নিরাপদে মাটিতে নামাবেন। কারণ বাবা আমাকে বলেছেন, আমি সাথে থাকলে তোমার কোন ভয় নেই।”

বাবাকে নিয়ে সন্তানের অনুভূতিগুলো সবসময়ই মনের গহীনে চাপা পড়ে থাকে। বাবার ত্যাগ, তিতিক্ষা, স্নেহ, রাগ, ভালোবাসা সন্তান আগলে বুকের এক কোণে। কখনো মুখ ফুটে বলা হয়ে উঠে না, বাবা ভালোবাসি। বাবাদের আমরা বাবা, আব্বু, ডেডি যে নামেই ডাকি না কেন! সব বাবাই তাঁর সন্তানের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করেন। তাঁদের বাহ্যিক রুপ ভিন্ন হলেও অন্তঃস্থ রুপ একই চিহ্ন বহন করে; বাবা।

বাবাকে নিয়ে না বলা অনুভূতিগুলো প্রকাশের জন্যই আত্মপ্রকাশ আয়োজন করেছিল, সাপ্তাহিক অনুভূতি- বাবা। যেখানে লেখক, পাঠক সবাই তাঁদের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। সেখান থেকেই নির্বাচিত কিছু অনুভূতি পাঠকদের সামনে প্রকাশ করা হয়েছে।

আমার বাবা, আমার আদর্শ । জিনাতুননেছা জিনাত

রচনার ভাগসমূহ

২৮/৯/১৯

ছোট বেলায় বাবা মা আর নয় ভাই বোনের একটা বিশাল পরিবার ছিল আমাদের ৷ ছয় বোন তিন ভাইয়ের মধ্যে আমি আট নম্বর, বোনদের মধ্যে ছোট ৷

আমার বাবা অতি মেধাবী কিন্তু অতি সাধারণ একজন ভালো মানুষ ছিলেন ৷ জীবনে কোনো পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় হননি ৷ লেখাপড়ার ক্ষেত্রে সবসময় প্রথম হয়েছেন, সেরাদের সেরা! বিভিন্ন সময়ে তাঁর ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি হয়েছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও একবার শিক্ষকতার সুযোগ হয়েছিল, সেই চাকরি তিনি করেননি, তাঁর অজুহাত ছিল – এতগুলো ছেলে-মেয়ে রেখে দূরে গেলে ওদের কে দেখবে?

মনের পিছুটান আর প্রিয় স্যারের অনুরোধে স্থানীয় একটা বেসরকারী হাই স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন বাবা ৷ সেখানেই পেশা জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন ৷

ছোট বেলায় এসব কথা জানার পর আমি ভাবতাম -বাবা কী খুব বোকা, না কি বুদ্ধিমান! হিসেব মিলতো না ৷ তবে এতটুকু বুঝতাম, যে বাবা তার সন্তানদের থেকে দূরে না থাকার জন্য নিজেকে নিয়ে, নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে এতটুকু ভাবলো না, সে বাবার স্থান নি:সন্দেহে ভালো বাবাদের শীর্ষে ৷

বাবার পেশা প্রসঙ্গে এত কথা লিখতে হলো এজন্য যে, তাঁর সততা, পেশার
প্রতি আন্তরিকতা এসব ঠিক রাখতে গিয়ে আমাদের পরিবারে খুব একটা
সচ্ছলতা ছিল না কখনোই ৷ সারাক্ষণ অভাব অভিযোগ ছিল না
ঠিকই কিন্তু এর পরোক্ষ প্রভাব পড়ত সবার লেখাপড়ার উপর ৷

স্কুল জীবনের পড়াশুনা সবাই বাবার স্কুলে করেছি, কলেজ পর্যায়ে গিয়ে সবার পড়াশুনার ব্যয়ভার বহন করা বাবার জন্য ভীষণ কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল ৷ আমরা ভাই-বোনেরা অতি মেধাবী না হলেও মেধাবী ছিলাম ৷ তাই বেশ কষ্ট করে হলেও সবাই পড়াশুনা শেষ করেছে ৷ বাবা আমাদেরকে অনেক শক্ত ভাবে মানুষ করেছেন ৷ সব সময় বলতেন – ‘সব কাজই মন দিয়ে করবে, আমি যেন বলতে পারি আমার ছেলে মেয়েরা সব কাজ পারে ‘ ৷ আট বছর বয়সে এতিম হয়ে যাওয়া একজন মানুষ কিভাবে শিক্ষা-দীক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছিল – বাবার সেই সব বাস্তবতা আমাদের কাছে আদর্শ ৷

ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয় নামাজ কালাম ছাড়াও সত্য বলা, বিপদে মানুষকে সহযোগিতা করা, অন্যের দু:খে ব্যথিত হওয়া প্রভৃতি নৈতিক শিক্ষাগুলো বাবার কাছ থেকেই পেয়েছি ৷ তিনি খুবই ধর্মভীরু ছিলেন, তবে গোঁড়া নন ৷ আধুনিক মন মানসিকতার ছিলেন এবং সেই বিষয়গুলো আমাদের মাঝেও সঞ্চারিত করেছেন ৷ বাড়ির সামনে নারকেল গাছ ঘেরা একটা বিশাল জায়গা ছিল আমাদের ৷ সেটা দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল গনি মিয়াকে ৷ কয়েক বছর পর আমরা জানতে পারলাম,গনি মিয়া কিভাবে যেন জায়গাটা জাল দলিল করে নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছে ৷ বাবা খুব দু:খ পেলেন কিন্তু ভেঙে পড়লেন না! আমাদেরকে ডেকে বললেন – দিয়ে ধন, বুঝে মন, কেড়ে নিতে কতক্ষণ? তোমরা চিন্তা করো না, পরকালে ঐটুকুই আমাদের থাকবে ৷

অনার্স লাইফে হলে সিট পেলাম, জীবনে প্রথমবার বাড়ি ছেড়ে দূরে থাকা ৷ মন্নুজান হলের নতুন বিল্ডিং, ফার্নিচার ও তৈরী হয়নি ৷ হল সুপার বললেন – আপাতত তোমরা দু’হাত চওড়া একটা খাট নিয়ে এসে উঠে যাও ৷ বাবা বাজার থেকে খাট কিনে আনলেন কিন্তু চারপাশে পালঙ্কের মত স্ট্যান্ড দেওয়া ৷ সবাই অবাক! এটা আবার কী? বাবা বেশ সিরিয়াস ভঙিতে বললেন – আমার মেয়েটা কখনও মশারি টানাতে চায় না, তাই আমি এভাবে রেডি করে এনেছি ৷ মেয়েদের হলে স্বভাবতই পুরুষের প্রবেশ নিষেধ, সুপারের প্রবল আপত্তি দু’হাতে ঠেলে সেদিন বাবা আমার হলে ঢুকে ওই স্ট্যান্ডে মশারি টানিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন ৷

অনার্স প্রথম বর্ষে আমার চিকেন পক্স হলো ৷ শরীরে তিল ধারণের জায়গা বাকি নেই ৷ সারাদিন সংসারের কাজের শেষে মা খুব একটা সেবা করার সুযোগ পেতেন না ৷ বাবা তখন আমার হাতে-পায়ে প্রতিটি দানার উপর পরম যত্নে মাখন লাগিয়ে দিতেন ৷ পরীক্ষার সময়গুলোতে রাত জেগে পড়াশুনা করতাম, না ঘুমানো পর্যন্ত বারান্দায় পায়চারী করতেন ৷ কতদিন হলে দেখা করতে এসেছেন, আসার সময় মা হয়ত হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন বাড়ির মুরগির ডিম, সেটাই পাঞ্জাবির পকেটে করে নিয়ে এসেছেন, এভাবে কতদিন …

ঈদের আগে আমাকে বললেন – এবার আমার জন্য কিছু কিনতে হবে না ৷ কয়েকদিন পর আবার বললেন – তুমি তো দেখছি সবার জন্য অনেক কিছু কিনেছ, তাহলে আমাকে শুধু একটা স্যান্ডেল কিনে দিতে পারো, তবে পাঁচশ টাকার বেশি দাম যেন না হয় ৷ আমি খুশি হয়ে বাজার থেকে আরামদায়ক একটা স্যান্ডেল বাইশ’শ টাকা দিয়ে নিয়ে এলাম ৷ সেটা পায়ে দিয়ে করিডোরের এমাথা ওমাথা হেঁটে হেঁটে বলছিলেন – এত টাকা দিয়ে কেন আনতে গেলে? কিন্তু চোখ দুটো তাঁর আনন্দে জ্বল জ্বল করছিল, আমারও আনন্দে চোখে পানি এসেছিল সেদিন!

বাবা-নিয়ে-অনুভুতি-আত্মপ্রকাশ-বাবা-আমার-বাবা-জিনাতুননেছা-জিনাত
জিনাতুননেছা জিনাত এবং তার বাবা

শুধু কী তারাই আমাদের মনের কথা বুঝবে, আমরাও কী একটু বুঝতে পারি না?!

বাবা চিরকালই অত্যন্ত সাধারণ জীবন যাপন করেছেন ৷ আমরাও সেভাবে অভ্যস্ত হয়ে গেছি ৷ তাঁদেরকে ছেড়ে অনেক দূরে এসে সংসার করছি, তবু ভালোমন্দ সব কাজে তাঁদের কথাই প্রথমে মনে পড়েছে সবসময় ৷ পরীক্ষার সময় ফোন করে দো’আ চেয়েছি, এতেই নিশ্চিন্ত নির্ভরতা পেয়েছি বা দূরে কোথাও যাবার আগে শুধু বলেছি যাচ্ছি, ব্যস! মনে হয়েছে নিরাপদে পৌঁছে যাব ৷

“জীবনে অনেক কিছু পেয়েছি ,নিজের জন্য আর কিছু চাই না, শুধু মৃত্যুর আগে জেনে যেতে চাই আমার মেয়েটা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছে ” – আমার ক্যান্সার হয়েছে জানার পর এটাই ছিল আমার জন্য বাবার শেষ চাওয়া ৷

আজ প্রায় পাঁচ বছর হতে চললো তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন ৷ জীবনের বাস্তবতায় ভালো থাকার ভান করে ঘুরে বেড়াই ,কিন্তু বাবা-মা’হীন একটা পৃথিবীতে সত্যি কী ভালো থাকা যায়? কাজ শেষে যখন নিজের মুখোমুখি হই, আর ভান করতে পারি না ৷ বুকের ভেতর দগদগে ক্ষতগুলো কেবলই জ্বলতে থাকে ৷

আদর করে আর কেউ বলে না – জিনু, মা! আজ কী তোমার শরীরটা ভালো আছে?

বাবা – হাসনাত সৌরভ

‘‘একদিন শব্দছক করতে করতে জেনে গেলাম–
“বাবা” আসলে একটা একশব্দের ধাঁধা,
যে আমাকে মাঝে রেখে সবদিক থেকেই সমানভাবে ঘিরে আছে…
আর আমি শুধুই এদিকওদিক ঘুরে কাছে যেতে চাইছি…’’

ছোটবেলায়, বছরের প্রথম দিনে আমার একটা করে নতুন ডায়েরি হত। ঠিক যেমন জন্মদিন বা ঈদে নতুন জামা হয়, তেমনি। তবে তাকে আমি ডায়েরি বলতাম না, বলতাম লেখার খাতা। সেই প্রথম দিন, বাবা আমার হাতে ওই খাতাটা দিয়ে বলতো, আমি যেন রোজকার টুকরো টুকরো ঘটনা সেখানে লিখে রাখি। আমিও বাবার কথা মতো, লিখতাম। আকাশে মেঘ করলে, ঘুম থেকে দেরীতে উঠে বকা খেলে, এক একদিন পড়তে বসতে ইচ্ছে না করলে…অথবা জুতোর বাক্সে গুটিপোকা পুষলে, সেইসব ঘটনা লিখে রাখতাম। যাই দেখতাম, তাই লিখতাম। তবে একটা ব্যাপারে বেশ খুশি থাকতাম যে, বাড়ির কেউ জোর করে আমার সেই লেখার খাতা পড়তে আসতো না। ফলে যে কথা কাউকে কখনো বলা হত না, মানে যাকে আমরা “সিক্রেট” বলি, সেসব কথা আমার খাতাটা জানত। আর যেহেতু কাগজ কথা বলতে পারে না… সেহেতু , যতক্ষণ না তাকে কেউ পড়ছে ততক্ষণ খাতায় লেখা শব্দরা নীরব, তাই ওই একটা জায়গাতে ছিল আমার চরম স্বাধীনতা। তাছাড়া আমার হঠাৎ হঠাৎ মন কেমন, আমার চুপ করে বসে থাকা বিকেলবেলা, আমার যাবতীয় দুষ্টুমির প্রতিও ছিল খাতাটার প্রশ্রয়।

অবশ্য কোথাও বেড়াতে গেলে সেই খাতা আমি সঙ্গে নিয়ে যেতাম না। পাছে হারিয়ে যায়! বা কেউ যদি সিক্রেট পড়ে ফ্যালে! আমি তো কখনোই কাউকে বুঝতে দিতে চাইতাম না, আমার মন কখন খারাপ হয়, কখন আমি কোয়ার্টারের জানলা দিয়ে ইউক্যালিপটাস গাছে বসে থাকা পাখি দেখি! আমি আসলে চাইতাম না, কেউ আমার ভিতরের আমিটাকে চিনুক বা জানুক। আমার মনে হত, ওইটুকু জায়গা শুধু আমার একার। আর কেউ সেখানে আসবে না। তাই পুজোর ছুটি, গরমের ছুটিতে নানার বাড়ি বা দাদার বাড়ি বেড়াতে গেলে সে খাতা আমি শহরেই রেখে যেতাম। তবে খাতা যেত না তো কী! মন তো যেত। ঘুরেও আসতো। অর্থাৎ, ছুটির দিনযাপন মনে মনে বয়ে আনতাম নিজের ঘরে, তারপর সেই খাতাতেই লিখতে বসতাম…

নানার বাড়ির দোতলা পাকা বাড়িটার উঠোন পেরিয়ে ছিল মাটির একটা বাড়ি। মায়ের কাছে শুনেছি, পাকা বাড়ি হওয়ার আগে নাকি সেই মাটির বাড়িটাই ছিল মায়েদের একমাত্র মাথা গোঁজবার ঠাঁই । তো সেই বাড়িটা ছিল আমার খুব প্রিয়। খড়ের চালায় কত যে চড়ুই পাখি বাসা বেঁধে থাকত, তার ঠিক নেই। সারাটাদিন তাদের কিচিরমিচির ডাক। ঘরের ভিতরে যে পশ্চিম দিকের জানলা ছিল, সেখান থেকে উঁকি দিলেই দেখা যেত একটা পুকুর। পুকুরের ধারে ধারে জমত শ্যাওলা। দু একটা পদ্ম ভেসে থাকতো জলে। পুকুরের পাশে খেজুর গাছ, তাল গাছ, আরো অচেনা কত গাছ। হাসগুলো দল বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকতো পুকুর পাড়ে। বেলার রোদ এসে যেন খেলা করে যেত তাদের ভিজে ডানায়। আমি সেসব দেখতাম। আর মনে মনে ভাবতাম এইসব ছবির মত দৃশ্য আমাকে শহরে ফিরে লিখতে হবে। বাবা সব লিখতে বলেছে বলে নয়, আমি এই ছবিগুলোর মধ্যে ভাল থাকি, তাই লিখতে হবে।

ওদিকে দাদার বাড়ি, সে আমার বাবার বড় হয়ে উঠবার জায়গা। তাই বাবার মুখেই বাবার ছোটবেলাকার গল্প শুনতাম বেশি। আর যখন সুযোগ পেতাম যাওয়ার, তখন খুব কাছ থেকে ছুঁয়ে আসতাম বাবার ছোটবেলা। রেখে আসতাম নিজের ছোটবেলার স্মৃতিও। সেখানে বাড়িটা রাস্তা লাগোয়া। দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে শুয়ে দেখতাম, দরজার ফাঁক দিয়ে আলো এসে ঘরের ভিতরের দেওয়ালে পড়ছে। আর রাস্তায় যারা হেঁটে বা সাইকেলে চলে যাচ্ছে, অথবা আইসক্রিমওয়ালা যখন তার গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে চলে যাচ্ছে পাড়ার ভিতর, তখন সেই ছায়া এসে পড়ছে আলোর উপর। ঘরের গোটা দেওয়াল জুড়ে মানুষের যাতায়াতের ছবি….সেসব একমনে দেখতাম। বিকেলবেলায় পাশের বাড়ির সঙ্গে চলতো আমাদের ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা। সন্ধে নামার পর মা-চাচিরা গরম তেলেভাজা, মুড়ি আর চা নিয়ে ছাদের একপাশে বসে সুখ-দুঃখের গল্প করতো। আর আমি, অন্যদের সঙ্গে চাঁদের একটুকরো আলোয় বসে বসে কত খেলাই না খেলতাম…তারা গুনতাম..দেখতে দেখতে রাত নেমে আসতো গুটিগুটি পায়ে। তারপর ছুটি থেকে ফিরে এসে এই দিনগুলোই লিখে রাখতাম আমার খাতায়। ছুটি ফুরোবার একবুক মনখারাপ আর লেখার ভিতর স্মৃতি এঁকে দেবার আনন্দ, দুটোই বেশ গাঢ় হয়ে উঠত কাগজে।

বড় হবার পর অবশ্য নিয়ম করে রোজকার কথা খাতায় লিখতে বসা হয় না। তাছাড়া বছরের শুরুতে বাবা নতুন ডায়েরি আর হাতে তুলে দেয় না বলে, তাগিদটাও নেই। মনটাও তো নানান দিকে, নানান কাজে ছড়িয়ে থাকে বলে এক জায়গায় তাকে আটকাতে পারি না সবসময়। স্মৃতি ভেসে এলে কেবল ফেসবুকের পাতায় লিখি। তারপর যেভাবে জমাট বাঁধা মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে গেলে চারপাশে একটা শান্তির হাওয়া বয়, তেমনি মনে পড়া গুলো লিখবার পর, বেশ আরাম হয়। মনে হয়, মন কেমনের বোঝা কমলো বুঝি কিছুটা। এই মুহূর্তে তাই মনে হচ্ছে। মায়ের বাড়ি, বাবার বাড়ি আর আমার ছোটবেলার স্মৃতির সরণি দিয়ে ঘুরেফিরে এসে, বেশ ভাল লাগছে।
মনে হচ্ছে, অনেকদিন পর যেন সেই পুরোনো লেখার খাতাটার পাতাগুলো হঠাৎ দমকা হাওয়ায় আবার উল্টেপাল্টে গেল…

অনুভুতি – বাবা । অনুষ্কা সাহা ঋতু

বাবার ছোট্টপরীটা কবে এতবড় হয়ে গেল?
কোল থেকে নামাতেই যাকে ছিলো এতো ভয়,
সেই পরীই আজ বড্ড ভারী মনে হয়।

হঠাৎই মনটা ভারী হয়ে এসেছে,গলা ধরে যাচ্ছে,বড় বড় জলকণা চোখের সীমানা পার করে নেমে আসছে। খুব বেশি অভিমান হয়,রাগ হয়। আচ্ছা,মেয়ে মানেই কী বাবার কাঁধে বোঝা?

স্মৃতি পাতা উল্টে দেখলাম একটু।
দুই কি তিন বছর বয়স বোধহয় তখন। ছোট্ট অভিমানে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছিলাম। বাবা মা’কে ডেকে বলে কি,”একটা গ্লাস নিয়ে আসো তো,জল পড়ে ভেসে যাচ্ছে।”সাথে সাথে আমার কান্না বন্ধ।বলা বাহুল্য, এরপর থেকে আমি কান্না করার আগে সাবধান হয়ে থাকতাম।

মায়ের হাতে প্রচুর মার খেয়েছি। শরীর বিভিন্ন স্থান ফুলে ফুলে থাকত। সন্ধ্যা থেকে বাবার কলিংবেলের অপেক্ষায় বসে থাকতাম। বাবা আসলে অসহায়ের মতো ঘুরঘুর করতাম বাবার সামনে।

২০১৬তে একটা ছোট দূর্ঘটনায় হাঁটুর রগ মচকে যায়, বাবার চোখের উদ্বিগ্নতা স্পষ্ট দেখেছি। মনে হচ্ছিলো ব্যথাটা ওনার লেগেছে।

এগুলো বাবাদের বৈশিষ্ট্য হয়। ভালোবাসি বললেও ভালোবাসবে, না বললেও ভালোবাসবে। হাজারটা আত্মত্যাগ জড়িয়ে থাকে বাবা শব্দটার মধ্যে।

একরাশ অভিমান বুকে নিয়ে বসে আছি। বাবার মাথায় এখন মেয়ের বিয়ের চিন্তা। অথচ একমাত্র ভরসার জায়গাটায় সবসময় বাবাই ছিলেন। অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে বড় হলেও, কোথাও যেন একটা অদৃশ্য স্বাধীনতার আস্বাদ পেয়েছি। বহুবার ভুল করেছি,মার খেয়েছি,কিন্তু ক্ষমাও পেয়েছি। বাবার লক্ষ্মী ছিলাম,হয়ত আজও আছি। তবে অভিমান জন্মায়, যখন বিয়ের কথা বলে।আমি তো বাবার ছেলে হতে চেয়েছি সবসময়।

এখন কষ্ট হয়,আগের স্মৃতিদের কখনও ফিরে পাব না। তবুও হাজার বাঁধনে আটকে রাখলেও বাবা ছাড়া আমি অসহায়। আমার এই কুড়ি বছরের জীবনে একটা দাপ্তরিক কাজও আমি নিজ হাতে করিনি। প্রতিটা জরুরি কাগজপত্র ঠিকঠাক করা থেকে জমা দেওয়া পর্যন্ত বাবাকেই দৌড়োতে হয়েছে। অভ্যাসটা এতো মারাত্মক যে,সামান্য একটা কাজ একা করতে গিয়েও হিমশিম খেয়েছি,অথচ সবটা বাবা বুঝিয়েই দিয়েছিলেন।

মা-বাবাকে নিয়ে কোনো অনুভূতি কাব্যিক ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, গেলেও আমি পারি না। এই অনুভূতিগুলো একদম স্বচ্ছ।
অভিমান,অভিযোগ,অপারগতা, অপদার্থতা আর অদৃশ্য ভালোবাসায় ভর্তি অনুভূতিগুলো। খুব ইচ্ছে,একদিন সামনে গিয়েই বলব,”হাজার অভিমান, অভিযোগ থাকা সত্বেও ভালোবাসি বাবা তোমাকে।”

অগোছালো অনুভূতিগুলো গোছানোর জন্যও হয়ত বাবাকেই দরকার। বদঅভ্যাস হয়ে গেছে তো,একা একা এক কদমও চলতে পারি না। দূরে যেতেই তাই ভয় হয়,বাবা ছাড়া আমায় গোছাবে কে?

হুমায়ূন আহমেদ স্যার বলেছিলেন, “পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে কিন্ত একটাও খারাপ বাবা নেই।”
ঠিক তাই, বাবারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হন। সবাইকে ভালো রাখার জন্য বাবাদের আপ্রাণ অভিনয় চালিয়ে যেতে হয়। সবার জন্য সবকিছুই করা হয় কিন্ত নিজের জন্য তেমন কিছুই করা হয়ে ওঠে না….

অনুভুতি- বাবা । তানভীর তূর্য

হয়তো পরিবারের সবার জন্য জামাকাপড় কেনা হচ্ছে কিন্ত নিজের জন্য একটা শার্ট কেনা হয় না। বলবে, থাক কিছুদিন পরে কিনবো। কেনা আর হয় না। ব্যাবহারের মোবাইল ফোনটির হয়তো তিন চারটা বাটন নষ্ট সেটাও বদলানো হয় না কিন্ত ছেলেমেয়েদের হাতে দামি সেট তুলে দিতে পারলেই খুশি। আর বাবাদের পায়ের জুতা স্যান্ডেল তো ইতিহাসের স্বাক্ষী। ক্ষয়ে ক্ষয়ে সয়ে সয়ে। নতুন আর কেনা হয় না। বলবে, চলছে তো চলুক না কোনো অসুবিধা তো হচ্ছে না…
.
যাদের পুরানো মোবাইল সবসময় নতুন থাকে শুধু এই জন্যে যাতে সন্তান নতুন আই ফোনটা কিনতে
পারে। যাদের বুকের ব্যাথা থাকা সত্ত্বেও ডাক্তার
দেখানো হয়না সন্তানের ভার্সিটির ফিস দিতে গিয়ে।
ভালো মন্দ না খেয়ে একটু একটু করে টাকা জমান
মেয়ের বিয়ের জন্য…
.
বাবারা সূর্য হন। নিজেদের সবসময় জ্বেলে রেখে, জ্বালিয়ে রেখে শত অন্ধকার থেকে আমাদের আগলে রাখেন।
বাবারা আকাশ হন। যে আকাশের নিচে আমরা একটু একটু করে বড় হই, যে আকাশ আমাদের কাছে ভরসার একমাত্র জায়গা, যে আকাশকে দেখে আমরা লড়াই করতে শিখি।
.
তবু্ও বাবাদের আমরা ভুল বুঝি, আড়ালে বকা দেই, এড়িয়ে চলি। সব সহ্য করে বাবারা অভিনয়টা চালিয়ে যায়। এই হলো আমাদের অভিনেতা বাবা। বাবাদের কোনো চাহিদা নেই, নেই কোনো স্বার্থ। এতো রক্তের সাথে রক্তের টান। স্বার্থের অনেক উর্ধ্বে…

অনুভূতি – বাবা । শামছুন নাহার কচি (ইচ্ছে নীল)

বাবাকে নিয়ে কি লিখবো আর কি লিখবো না সেটাই ভেবে পাচ্ছি না।অতো ভালো লিখতে পারি না। তবুও বাবাকে নিয়ে কিছু লিখার চেষ্টা।
আমার বাবা পেশায় একজন স্বাস্থ্য কর্মী।বাবাই আমার আদর্শ।
ছোটবেলায় যখন সন্ধ্যা হলে পড়তে বসতাম তখন বাবা বলতো জোড়ে জোড়ে পড়, আমি আশপাশেই আছি, কেথাও ভুল হলে ঠিক করে দিবো। জোড়ে পড়লে সহজে ঘুম আসবে না আর পড়াও তাড়াতাড়ি মুখস্থ হবে।আমাদের গ্রামে তখন কারেন্ট ছিলো না।তাই গরম কালে যতক্ষণ পড়তাম বাবা ঠিক ততক্ষণ পাশে বসে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতো, আর বলতো পড়রে মা পড়, অনেক বড় হতে হবে তো।মানুষের মতো মানুষ হতে হবে।তখন বুঝতাম না তাই বলতাম মানুষ তো এমনি আছি পড়ে আবার মানুষ হয় কেমনে।বাবা মুচকি হেসে বলতো বড় হলে বুঝবি।পরীক্ষার সময় আমার চাইতে আমার বাবার টেনশন হতো বেশী, সেটা এখনও হয়। স্কুলে পরীক্ষা দিয়ে এসে আবার বাবার কাছেও পরীক্ষা দিতে হতো, কতটা পেড়েছি সেটা বাবা এভাবেই পরখ করতেন। কখনো ভুল করলে বাবা যদি মারতেন তাহলে মারার পর নিজেই জড়িয়ে ধরে কান্না করতেন আর বলতেন কেনো এমন করছ, তোদের মারলে যে আমিই বেশী কষ্ট পাই।
যতক্ষণ পড়তাম রাতে বাবা ঠিক ততক্ষণ এই আমার পাশে বসে থাকতেন।কখনো আমার আগে ঘুমাতে যেতো না।এমনকি এসএসসি, এইচএসএসি পরীক্ষার সময়ও বাবা না যতক্ষণ জেগে থেকেছি ঠিক ততক্ষণ আমার পাশে বসে থাকতেন, কখনো টিভি দেখতেন আবার কখনো বা নিজের রোম আর আমার রোমে পায়চারী করতেন।যদি বলতাম ঘুমিয়ে পড়ো গিয়ে তুমি, তখন বলতো তোর পড়া শেষ কর তারপর একসাথে ঘুমাবো।আমি কখনো পরীক্ষা দিয়ে আসার পর বইয়ের সাথে উত্তর মিলিয়ে দেখিনি, এই কাজটা বাবাই করতো সবসময়, পরীক্ষা দিয়ে আসার পর বই আর প্রশ্ন নিয়ে লেগে যেতেন উত্তর মিলানোর কাজে।স্কুল থেকে ফেরার পথে বৃষ্টি হলে বাবাকে দেখতাম একটা ছাতা মাথায় ধরে আরেকটা ছাতা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসছেন আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফেরার সময় দেখতাম বাবা মাঝ রাস্তায় আমার অপেক্ষায় আকুল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে আসতেই পরীক্ষা কেমন হলো? কমন আসছিলো তো? সব ঠিকঠাক দিয়েছিস তো? অনার্স প্রায় শেষের দিকে এখনও আমার বাবা এই কাজটা করেন।কখনো বাবা বাসায় না থাকলে আমার ফেরার একটা নির্দিষ্ট সময় বুঝে মায়ের ফোনে কল দিয়ে খবর নিবে পরীক্ষা কেমন হলো। সব দিতে পারছি কীনা, কত পাবো? অথচ নিজেই কিছক্ষণ পর এসে সব জানতে পারবে এমনিতেই, কিন্ত এই যে টেনশন।
বাবাকে ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি বাহির থেকে বাড়ি ফেরার পর আমাদের ভাই -বোনদের সামনে দেখতে না পেলেই মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করবে আমরা কে কোথায় আছি?আমরা ভাই বোনেরাও বাড়ি ফিরে ববাকে দেখতে না পেলেই মা কে জিজ্ঞেস করি আব্বা কই, এখনও আসে নি।আমার বাবা সবসময় কিছু কথা বলতেন ( উপদেশ)
#কঠিন পরিস্থিতিতেও সত্য কথা বলবে
#কখনো কাওকে ছোট করে কথা বলবে না
#যে যত খারাপ ব্যবহার এই করুক না কেনো সবসময় তুমি তার সাথে উত্তম ব্যবহার করবে
#রাগের সময় চুপ থাকবা।
বাবাকে নিয়ে লিখার অনেক কিছুই আছে। এটুকুতেই সমাপ্ত।

অনুভুতি – বাবা । নীলিমা জাহান নীলা

জন্মের পর থেকেই শুনে আসছি আমার আব্বা নাকি বিদেশ থাকেন, আব্বাকে তেমন একটা কাছে পাওয়া হয়নি কখনো, মায়ের মুখে শুনেছি যখন আমি মায়ের পেটে এক মাসের, তখন নাকি আব্বা আমাদের রেখে বিদেশ চলে যান, যাতে আমাদের সংসারটা ভালোভাবে চলে এরকম কিছুই ছিল তার মনে।

আমরা বাসায় ছিলাম দাদা দাদির সাথে, আমার বড় বোন আর আমি মাত্র তিন বছরের ছোট বড়ো, আব্বা দুই বছর পরে পরে আসতেন দুই মাসের ছুটিতে ঠিক তখনই আব্বাকে কাছে পেতাম, আমরা কি খেতে পছন্দ করি এটা আমাদের জিজ্ঞেস করতেন, আব্বা বাজার থেকে ঠিক সেই জিনিসগুলো নিয়ে আসতেন, আব্বা যে কয়দিন বাসায় থাকতেন আমাদের পছন্দের খাবারগুলোই রান্না হতো বেশি।

আব্বা অনেক মিস করতেন আমাদের আর আমরাও, আব্বার কাছ থেকে যদি কখনো কোনো মানুষ আসতেন বাংলাদেশ, সে এভাবে বলতেন ভাই আমার সামানগুলো যখন বাসায় পৌঁছে দিতে যাবেন, আমার মেয়ে দুটোকে একটু কোলে নেবেন, এ কথাটা শুনছি যখন আমরা একটু বড় হয়েছি তখন, কিন্তু তখনো বুঝতাম না আব্বা এ কথাটা কেন বলতেন এখন ঠিক বুঝতে পারি।

যখন ছোট ছিলাম তখন আব্বাকে কাছে পাইনি, এখন বড় হয়েছি এখন আব্বা বাড়িতে আর আমরা দূরে আছি, এই জিনিসটা ভাবলেই কান্না পায়,
নিজের অজান্তেই চোখে জল চলে আসে,
কতটা কষ্ট হয় প্রকাশ করার মতো না।

ছোটবেলার একটা কথা আমার সব সময় মনে হয় তখন আমার বয়স সাত কি আট বছর হবে, আমার চাচা যখন বিয়ে করলেন, চাচার বিয়ের অনুষ্ঠানে চাচার শ্বশুর বাড়িতে যখন আমরা চাচিকে আনতে যাই, চাচাকে তখন পুরো একটা আস্তো মুরগির রোস্ট খেতে দেয়, আমাদের এলাকায় এটাকে সাক্ষরখানা বলে,

আমরা দুইবোন বাড়িতে এসে আব্বাকে বলি আব্বা আমরা তো ছেলে না, আমরা তো বিয়ের দিন সাক্ষরখানা খাইতে পারবো না, তাইলে কি আমরা কখনো সাক্ষরখানা খাবো না? আজকে তো চাচাজান সাক্ষরখানা খাইছে আমরা তো খাই নাই।

একথাটা আব্বা শোনামাত্রই সিরিয়াস ভাবে নিয়েছিলেন আম্মাকে বলেছিলেন এখনই আমার মেয়েদের সাক্ষরখানা বানিয়ে দাও, আমার মেয়েরা আমার সামনে বইসা যাতে খায়, আমার মেয়েরা খাবে আর আমি দেখবো, আর আম্মা তাই করলেন।

এবার ছুটিতে যখন বাসায় গিয়েছিলাম তখন আমার বড় বোন আর আমি এই কথা নিয়ে অনেক হাসাহাসি করেছি, এখনো আমাদের বাড়িতে আমার চাচাতো ভাই বোনেরা সবসময় আমাদের দেখে হিংসা করে, বলে ওদের আব্বা আম্মা ওদের অনেক বেশি ভালোবাসে।

আমাদের কোন চাওয়াই আব্বা-আম্মা কখনোই অপূর্ন রাখেন নাই আম্মা তো সবসময় পাশে থাকতেন, আব্বা যতটুকু আমাদের সময় দিতেন ততটুকু সবসময় আমাদের সব আবদার গুলো পূরণ করার চেষ্টা করতেন এবং সবসময় সেটাই করেছেন।

সবশেষে শুধু এটুকুই বলবো আব্বাকে কখনো জড়িয়ে ধরে বলা হয়নি আব্বা আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি, এবার বলবো ইনশাআল্লাহ, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ পৃথিবীর সমস্ত বাবাদের ভালো রাখুন সুস্থ রাখুন, আমীন।

অনুভূতি – বাবা । ওয়ারিশা সিনথিয়া

কিছু ভালোবাসা ভাষায় কখনো প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু অনেক বেশি অনুভব করা যায়। আব্বুর সাথে আমার সম্পর্কটা অনেকটাই তেমনই।

একটা ঘটনা মনে পড়লো… আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি। কোচিং-এ সবসময় আমি একাই যেতাম। একদিন আব্বু বাসায় ছিল..বললো, “আমি দিয়ে আসি”.. আমার বাসা থেকে ১৫- ২০ মিনিট লাগে হেঁটে যেতে। তো আব্বুর সাথে রিকশাতে যাচ্ছি আর আব্বু বলছে ” আমি তো কাছেই ভাবছি.. এতো দূরে কেন? আমি হাসতে হাসতে বললাম, তুমি তো বাবার চোখে দেখছো তাই তোমার কাছে দূরে মনে হচ্ছে। তোমার নিজের চোখে দেখো কাছে মনে হবে। তখন আমার মনে হচ্ছিল এটা কোনো ঢং না,মেয়ের প্রতি বাবার প্রচন্ড ভালোবাসা আর ইমোশন।মানুষটা আমার মতোই রাগী।আমিও দেখতে আব্বুর মতো। তার ধৈর্য্য ও অধ্যাবসায় অনেক অনেক বেশি।

আব্বুর হাত ধরে প্রথম বইমেলায় যাওয়া।প্রথম বাসে উঠা, সব কিছুরই শুরু বাবার সাথে।বাবা যদি না প্রথম বাসে উঠা না শিখাতো তাহলে তো আমার বাসে করে কলেজ আসা-যাওয়ার অভিজ্ঞতাই হতো না। এমন আরো কতো অভিজ্ঞতা আছে বলে শেষ করা যাবে না।

যতই মুখে বলি,” তুমি তো আমি বাদে বাকি দুই মেয়েকে বেশি আদর করো”..কিন্তু দিন শেষে আমি আর আব্বু দুইজনেই জানি, আমি বড় মেয়ে, আমার প্রতি বাবার আশাটা বেশি,আমার সাথে কমিউনিকেশনটাও বেশি,একটু মনোমালিন্যতাও হয়,আবার আমার জন্য আব্বুর খরচটাও বেশি হয়। ” এতো ঘুরতে যেতে হবে কেন, বাইরে খাওয়া কমাও,আবার বলবে, তুই বিয়ে করবি না??শোন প্রেম-ট্রেম করিস না, নামাজ পড়। কাজের কাজ তো করবা না সারাদিন ফোনের মধ্যে ডুইবা থাকো।”দিনশেষে সকল স্বাধীনতা কিন্তু আমার বাবা আমাকে দিয়ে রাখছে। গন্ডির ভিতর আগলে রেখে কিভাবে মেয়েকে পুরো দুনিয়া দেখতে দিতে হয়,তা আমার বাবা জানে।। দুই দুইবার অপারেশন হওয়া সত্বেও নিজের ঝুঁকি নিয়ে আমার সাথে পরীক্ষার হলে গিয়েছে। এটাই হয়তো বাবা। প্রতিটা দিন মানুষটা সাথে থাকুক ভালো থাকুক। আমার বাবা লাখে একটা।

ভালো থাকুক এপারের ওপারের সকল বাবারা…

অনুভূতিঃ বাবা । আফরা নাওয়ার রাফু

স্কুল ছুটির ঘন্টা পরে গেছে। ক্লাসের সবাই তাড়াহুড়ো করে বের হতে ব্যস্ত।কিন্তু নিতু ঠায় বসেই আছে। ছুটির ঘন্টা যেন তার কান পর্যন্ত পৌঁছায় ই নি। তার ঘোর কাটলো বান্ধবী তানহার নাড়া খেয়ে।
তানহাঃ- কিরে নিতু বসে আসছি কেন স্কুল ছুটির ঘন্টা পরে গেছে বাসায় যাবি না?
নিতু ;- হুম চল।
ঃ- তোর কি হয়েছে বলতো?? কেমন যেন চিন্তায় ডুবে আছিস।
;- না কিছু হয় নি চল।
এই বলেই দুজনে এক সাথে বাসায় ফিরলো নিতু আর তানহা।
নিতুর আজ মন ভালো নেই। কোন এক গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। বাসায় ফিরে খাওয়া দাওয়া করতেও ইচ্ছে করছেনা আজ ওর। শেষ ক্লাসে ম্যামের বলা কথা গুলো খুব ভাবাচ্ছে নিতুকে। আজ শেষ ক্লাসে ম্যাম ঘোষনা করেছেন সামনের সপ্তাহে পেরেন্স ডে উপলক্ষে তাদের স্কুলে একটি ইভেন্টের আয়োজন করা হবে।সেখানে তাদের ক্লাসের কয়েকজন কে বাবা- মা কে নিয়ে বক্তব্য রাখতে হবে। যে কজনকে বাঁচাই করা হয়েছে তার মধ্যে নিতুও আছে। ম্যাম বলেছেন তাদের অনুভূতি গুলো আগে একটা কাগজে লিখে ভালো করে প্রেকটিস করে নিতে। মাকে নিয়ে অনায়াসে লিখতে পারবে নিতু। কিন্ত বাবা! বাবাকে নিয়ে কি লিখবে!
নিতু ওর বাবাকে কখনও কাছে পায়নি। বাবার মুখটাও মনে নেই ওর। ওর জন্মের কিছু মাস পরেই ওর বাবা মা আলাদা হয়ে যান। সেই থেকে ওর বাবা – মা সবই ওর মা। নিতুর মা শিক্ষিকা। চাকরি সূত্রে মেয়েকে নিয়ে একাই থাকেন। বাবা না থাকলেও সে অভাব বোধ তেমন হয় নি নিতুর। তবে মাঝে মাঝে বান্ধবীদের মুখে বাবাদের গল্প শুনে একটু মন খারাপ হতো তার। তখন মাকে কাছে পেলে সব ভুলে যেত ও।
বিকেলে মা স্কুল থেকে ফিরতেই মাকে জড়িয়ে ধরে নিতু। মাও তাকে। মেয়ের মুখ দেখে মা বুঝে যান তার মন খারাপ।
মাঃ- কি হয়েছে মা? আমার নিতুর মন খারাপ কেন?
নিতু;- না মা কিছু হয় নি। তোমার আসতে লেট হচ্ছিল তাই তোমাকে মিস করছিলাম।
নিতু জানে বাবাকে নিয়ে কথা বলা প্রশ্ন করা মায়ের পছন্দ না। তাই মাকে মন খারাপের বিষয় বলে বিরক্তিতে ফেলতে চায়নি ও।
রাতে লিখতে বসে হাজারো প্রশ্ন এলো নিতুর মাথায় বাবাকে নিয়ে কি লিখবে ও! ওরতো বাবার মুখটাও মনে নেই। আচ্ছা, বাবা কি কখনও আমায় কোলে নিয়েছে? আমি কি কখনও বাবার হাত ধরে ঘুরতে গিয়েছি? বাবা থাকলে কি আমাকেও বান্ধবীদের বাবাদের মতো স্কুলে নিয়ে যেতো? এমন হাজারো প্রশ্ন…
পরদিন সকালে গিয়ে তানহা কে জিঙ্গেস করছে নিতুঃ- কিরে তোর লিখা শেষ?
তানহা;- হুম প্রায় শেষ।
নিতুঃ- আচ্ছা বাবাকে নিয়ে কি লিখলি?
তানহা ;- ঐ যে ম্যাম সে দিন বললেল না বাবা – মা কে নিয়ে আমাদের অনুভূতি তাই লিখেছি বাবার সাথে আমি কি করে সময় কাটাই, মজা করি, ঘুরতে যাই বাবার সাথে আমার কিছু সুন্দর স্মৃতি এই সবই আর কি। তা তুই কি লিখলি?
নিতু ঃ- এখনো শেষ করি নি পরে বলবো।
তানহার কথায় নিতুর চিন্তা আরোও বেরে গেছে।
বাবাকে নিয়ে কি আমার কোন সুন্দর স্মৃতি আছে! আমার কেন বাবাকে নিয়ে তেমন অনুভূতি নেই!!
রাতে লিখতে বসে নিতু ভাবছে আজ রাতে মার কাছে বাবা সম্পর্কে জানতে চাইবো। তা না হলে যে লিখতেই পারছি না। যাই জেনে আসি….
নিতু ঃ- মা, বাবাকে নিয়ে আমার কোন স্মৃতি আছে? জানো না, আমাদের স্কুলে পেরেন্স ডে উপলক্ষে বাবা- মা কে নিয়ে বক্তব্য রাখতে বলা হয়েছে কিন্তু আমি তো বাবাকে নিয়ে লিখতেই পারছি না। মা আমাকে একটু বাবার অনুভূতি দাও না…………!
মেয়ের কথা শুনে মুখ থেকে কোন কথাই বের হচ্ছে না মায়ের। হা করে তাকিয়ে আছেন মেয়ের দিকে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরছে ওনার।
মায়ের অবস্থা দেখে নিতুর ও ভীষণ কান্না পাচ্ছে।
মাকে জরিয়ে ধরে সরি মা। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই নি।আমি লিখবো না। প্লিজ তুমি কেঁদো না।
আমার বাবার অনুভূতি চাই না।

আফরা নাওয়ার রাফু
২৯.০৯.২০১৯
কল্পনামিশ্রিত

অনুভূতিঃ বাবা । সৈয়দ তানভী

আমি আমার বাবাকে বলে আব্বা ডাকি।
যে যেই শব্দ ব্যবহার করেই ডাকুক না কেন, অনুভূতির জায়গা থেকে তা হয়ত সবার কাছেই এক।
পৃথিবীর এমন কোন শব্দের বা বাক্যের আবিষ্কার হয়নি, যা বাবার নামক শব্দের অনুভূতিটুকুকে সম্পূর্ণ রুপে প্রকাশ করতে পারে।

আমার বাবা যেমন রাগী, ঠিক তেমনি কোমল মনের অধিকারী। আমার বাবা রসিক মানুষ, আবার তার মাঝে একটা গাম্ভীর্যতাও কাজ করে। আমার বাবা খুব সাহসী ও শক্তিশালী একজন। সেই সাথে উনি প্রচুর দয়ালু।

আমি শুনেছি, আব্বার যখন ১ বছর বয়স তখন তার বাবা মারা যায়। সে তার মামা কাছেই বড় হয়। আব্বার মামা আব্বাকে এতটা আগলে রাখেন পৃথিবীর কোন মানুষ ত দূরের কথা কোন পোকামাকড়ও তাকে সহজে টোকা দিতে পারতো না। তাই আমাদেরও দাদা অভাব কখনো হয়নি। এবং দাদা আব্বাকে সবসময় এই পরিমাণের টাকা দিতেন, পৃথিবীর অভাব তার কাছেই আসতো না। সেই কারনে আমার আব্বা কিছুটা বেপরোয়া।

দুই দাদার (আব্বার আব্বা ও আব্বার মামার) প্রচুর পরিমানে সহায় সম্পত্তি থাকার ফলে, আব্বা কখনোই ভাবেন নি জীবনে তার কিছু করতে হবে। তার জীবনটা ঘুরেফিরে হেলায় কেটেছে অনেকটা। তাই আমার আব্বার কোন কর্ম জীবন নেই। টুরিস্ট বলা যেতে পারে। কারন নিজের টাকা খরচ করে এখানে সেখানে বেড়াতেই খুব পছন্দ করেন।

আমার আব্বা রাগের জন্য, আব্বাকে প্রচুর ভয় পেতাম। কিন্তু আব্বাই আমাকে খেলাধুলাতে প্রচুর সুযোগ করে দিত। নিজে আমাকে মাঠে নিয়ে আমার থেকে ৫/৬ বছরের বড় ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলায় লাগিয়ে দিতেন। আব্বা দাবা প্রচুর ভাল খেলেন। আমাকে নিয়ে প্রচুর দাবা খেলেছেন, দাবায় ভুল হলে মাইরও খাইতাম আব্বার হাতে। আমি তাস খেলাও শিখেছি আব্বার কাছ থেকে।

আমার আব্বা ভোজন রসিক মানুষ। চা ও সিগারেট তার প্রিয় জিনিস। কোন ক্রমে আব্বা যদি এই লেখা টা পড়ে, যদি দেখে তার প্রিয় বন্ধু চা ও সিগারেট নাম উল্লেখ করি নাই, ধইরা দিতে পারে মাইর। তবে আমি কখনো শোনি নাই, আব্বার চা সিগারেট ছাড়া অন্য কোন বাজে নেশা আছে বা ছিলো।

জীবনে আমার চাহিদা গুলো সব দাদা ও চাচা পূরণ করলেও, প্রায়েই দেখতাম আব্বা আমার জন্য জুতা কাপড়, নানান কিছু নিয়ে আসতো। আমাকে কি পড়লে ভাল লাগবে সেই দিকেই তার নজর। আমার বয়স তখন ১০/১২ হঠাৎ আব্বা আমায় বললো, তানভী তকে ফরমালে বেশ ভালো লাগবে। বলে দোকানে নিয়ে গিয়ে কাপড় কিনে, শার্ট প্যান্ট বানিয়ে দিলো। এমন অসংখ্য ঘঠনা আছে।
জীবনে না চাওয়া সত্ত্বেও, আব্বার ভাল লাগা গুলো পূরণ করেছে আমার মাধ্যমে।

দুষ্টুমির জন্য মাইর কম খেলেও পড়া শোনার, জন্য আব্বার হাতে মার প্রচুর খেয়েছি। এখন অবশ্য সেই সুযোগ হয় না। তবে আব্বার হাতে মাইরটা প্রচুর মিস করি।

আমার আব্বাকে দেখতাম বাসায় কেউ আসলে তাকে না খাইয়ে যেতে দিতেন না। মানুষকে খাওয়ার জন্য তার একটা বাড়তি সুনাম আছে। বাড়ি পাশ দিয়ে কেউ গেলেও, বা পরিচিত কেউ ময়মনসিংহ আসলেও, তাকে আব্বার খাওয়ানো লাগবেই। আগে অবশ্য বেশ রাগ করতাম তার এই স্বভাবের জন্য। কেন শুধু শুধু বাসায় ওদের এনে খাওয়াতে হয়.?? এখনি নিজেরই অনেক ভাল লাগে কাউকে খাওয়াতে পারলে।

আব্বার আরেকটা খারাপ কাজ আছে যা এখন নিজের ভাল লাগায় পরিণতি হয়েছে। সেটা হলো অন্যকে সাহায্যে করা। গ্রামের অনেক মানুষকে আব্বা ময়মনসিংহ এনে চিকিৎসা করিয়ে দিয়েছেন, বা ময়মনসিংহে কোন সাহায্যের জন্য নিয়ে এসেছেন এমন নজির হিসেব ছাড়া। এখন আব্বার দেখানো পথেই আমিও হাটার চেষ্টা করি। আব্বাও এখন অসুস্থ কেউ, বা ময়মনসিংহে কেউ কোন কাজ আসলে, আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়। বলে তানভী ময়মনসিংহ আছে ওর কাছে যাবি। যা সাহায্যে লাগবে সে করবে।

আমার আব্বা খুব সাহসী একজন। যারা আব্বাকে চিনেন তাদের মোটামুটি সকলের জানা। কারো বাড়িতে আগুন লেগেছে, কোন দূর্ঘঠনায় কবলিত মৃত ব্যাক্তির বিকৃত শরীর ধৌত করানোর কাজ, যা ভয়ে অন্য কেউ করতে সাহস পায় না, আব্বাকে সেখানে ডাকবেই, আর আব্বাও আগ্রহ নিয়ে সেখানে হাজির। আব্বার বন্ধু ও পরিচিত অনেকেই বলে আব্বার নাকি অনেক সাহস ও শক্তি ছিলো, এখনো আছে।

ছোট বেলা আমার বয়স ৭/৮ চাচার পুকুর থেকে কিছু লোক মাছ মারছিলো। তো ওদের নিষেধ করলে, ওরা তেড়ে আসে। আমার চাচাতো ভাই ও তার বন্ধুদের সাথে আমি গিয়ে ওদের দেই মাইর। আর মাইর দিয়ে তাদের সাথে দৌড়ে চলে আসছি। আব্বা শোনে আমাকে মাইর দিলো। আব্বার কথা মাইর দিছিস ভাল কথা, কিন্তু তুই দৌড় কেন দিলি.!!

আব্বা নামাজী ও ধার্মিক একজন মানুষ। হজ করে এসে আমায় বলে তুই যদি এখন নামাজ না পড়িস, মানুষ বলবে হাজীর পোলা পাজী হয়। আর নামাজ ৫ ওয়াক্ত না পড়লে আমায় আব্বা ডাকবি না। সে যখন চিল্লায় বা জামাতে যায়, আমি তাকে দেখতে গেলে আমাকে দিয়ে কমপক্ষে তিন দিন আল্লাহর রাস্তায় লাগাবেই।

বছর খানিক আগে একটা প্রজেক্টে ১০ দিন কাজ করা বাবদ ১১০০০ টাকা পাই। নিজের জীবনের প্রথম কামাই ঠিক করলাম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারে পরিবারের সবাইকে কিছু না কিছু দিবো। সেই বন্টণে আব্বার ভাগে ১০০০ টাকা পড়লো। সেই টাকা আব্বার হাতে তুলে দিতেই আব্বা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলো। যাকে কখনো কাঁদতে দেখি নাই সে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে আর বলছে আমার টাকার দরকার নাই বাপ-ধন তুই থাকলেই চলবে।

মাস খানিক আগে আমাকে বলতেছে, তর যদি দেশের বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করতে হয়, তবে আমার তো ক্যাশ টাকা নেই। কিন্তু সম্পত্তি আছে, তর যেই জমি ইচ্ছা বিক্রি করবি। আমি সাইন করে দিবো। কখনো বলিস না বাবার টাকা নেই বলে ভাল কোন দেশে গিয়ে পড়াশোনার সুযোগ পাইনি। কথাটা শুনেই চোখে পানি চলে আসলো।

আব্বার সাথে এমন অসংখ্য ঘঠনা আছে যা বললে,খাতা কালি শেষ হয়ে যাবে। তবু হয়তো বাপ ছেলের কথা শেষ হবে না। আমার জীবনের ইচ্ছা গুলোর একটা আমার আব্বাকে আমি যেন আমার দাদা(আব্বার মামার) মত আগলে রাখতে পারি। আব্বার জীবনের সকল অপূর্ণ চাওয়া পাওয়া গুলো, নিজে আব্বাকে দিয়ে পূরণ করতে পারি। আল্লাহ যেন আমাকে সেই তৌফিক দেন।

আমার আব্বা । দোলা ইসলাম

আমার আব্বা মাদ্রাসার একজন আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। একজন আদর্শ মানুষ ছিলেন। আমাদের গ্রামে যখন কারও কোন দরকার পড়তো আগে আমার আব্বার কাছে আসত তার একটাই কারন আব্বা একজন শিক্ষক, নিশ্চয় ভালো কিছু সমাধান দিবেন। আব্বার জন্য কি লিখবো আমি ভালো করে বুঝতেই পারছিনা, আমি এতোটা লিখতেও পারিনা, কিন্তু সবার লেখা দেখে আমারও ইচ্ছে যে কিছু লিখি কিন্তু কতটুকু কি লিখবো জানিনা, কারন আব্বাকে লেখার মতো তেমন আমি কিছু অর্জন করিনি, তার তেমন সঙ্গ পাইনি,কারন আমার আব্বা আমি যখন ছোট তখনই গত হয়েছেন,তাই আব্বার বিষয়ে হয়ত তেমন কিছু জানা হয়নি আমার অর্জন করতে পারিনি আব্বার স্নেহ ভালোবাসা। কিন্তু যতটুকু মনে আছে আব্বা আমাকে খুব ভালোবাসতো। আমার যখন ৩-৪ বছর তখন শিক্ষকতা ছেড়ে দেন। তো এসব আমার অনেক অজানা কারন এসব জানিও না ঠিক। কিন্তু আব্বা যখন চাকরি ছাড়ার পরও নিজের পেশাকে টিউশন, কোচিং এসব সেরে বাড়ি আসতো, এসে আগে আমাকে ডাকতো, মা দুলি “” আমি নাকি অল্প কথায় কান্না করতাম তাই আব্বা এমন করে ডাকতো মাঝেমধ্যে আমার “দুলালি মা ” বলতো। যখন যে কাজ থেকেই আব্বা আসতো আগে আমাক ডাকতো আর আমিও যেখানেই থাকি আব্বা ডাকলে বা কেউ বললে ছুটে আসতাম। আমার আব্বা ডাকছে আমাক। বেশি কিছু মনে নেই আব্বা সম্পর্কে, কারন ছোট বেলাতেই আব্বাকে হারাই। যখন আমার বয়স ৮ আর বড় ভাই ১০ এবং ছোট ভাই ৪ বছর বয়স তখনই আব্বা আমাদের এতিম করে যায়। তাই বেশি আব্বার থেকে আদর স্নেহ শাসন কিছুই পাইনি। যতটুকু পেয়েছি তার অর্ধেকই মনে নেই। আমি যখন ছোট আমার মনে আছে আব্বা আমাকে বলতো আমার মেয়ে অনেক বড় হবে, চাকরি করবে, সবি বলতো যাতে পড়াশোনা ভালো করে করি। আরও বলতো আমার মেয়ের আবার বিয়েও হবে শশুড়বাড়ি যাবে। হয়তো বেশিদিন থাকবেনা তাই এসব বলতো। আব্বা যখন বাজার থেকে আসতো রাতে তখন আমরা ঘুমিয়েই পরতাম। আমাদের ঘর ছিলো তখন টিন দেওয়া, অনেক গরম পরতো, তখনও কারেন্ট ছিলোনা এলাকায়। আব্বা বাজার থেকে এসেই ঘুম অবস্থায় আমাক বারান্দায় তার সাথে রাখতো। নাহলে গরমে যে আমার কষ্ট হবে। আমার আব্বা যখনি খেতে বসতো তার পাত থেকে আমাক খাইয়ে দিতো বেশি, ভাই এর থেকে একটু বেশি আদর করতো আমাক কারন আমি যে একমাত্র মেয়ে তার। বড় ভাই কত বলতো আব্বা তোকে বেশি ভালোবাসে। কিন্তু আজ আব্বা নেই, আব্বা যখন মারা যায় ২০০৩ সালে ১৫ এপ্রিল তখন আমি ৮ বছরের, কি এমন টা পেয়েছি তার স্নেহ ভালবাসা? কিন্তু এতেই আমার আব্বা বিদায় নিলেন আমাদের থেকে। ছোট ছোট ছেলে মেয়ে রেখে চলে গেলেন। হয়ত আমাদের কপালে আব্বার স্নেহ ভালবাসা নেই। আব্বা যেদিন মারা যায় সেদিন আমি পাগল হয়ে গেছিলাম, আমাক কেউ সরাতে পারেনি তার থেকে। আব্বা যখন অসুস্থ ছিলেন আমি সবসময় আব্বার কাছে কাছে থাকতাম, আব্বা যদি আমাক কিছু বলে যে মা আমার এটা লাগবে। স্কুল থেকে এসেই তার কাছে বসে পরতাম। আব্বা মারা যাওয়ার আগে আমার বড়আব্বুকে বলেছিল ভাই আমার মেয়েটাকে দেখিস, আমি তখনও বুঝতে পারতাম না যে আমার আব্বা আমার থেকে চলে যাবে। আব্বা তখনও ছেলেদের চিন্তা করতোনা কারন ওরা ছেলে মানুষ বড় হলে ঠিক চলতে পারবে। কিন্তু আমাক নিয়ে যেনো তার আশা, চিন্তার শেষ ছিলোনা। আব্বা যেদিন মারা যায় সকাল থেকে আমাক দেখে দেখে কান্না করেছিল বুঝতে পারতাম, আমাক ডাক দিয়ে কাছে বসিয়ে রাখতো, বেশি কিছু বলতে পারতোনা কিন্তু তার চোখের কোনে পানি অনর্গল পরতেই আছে। আর আমি ততবার আব্বার চোখের পানি গুলো পরম যত্নে মুছে দিচ্ছিলাম।জানতাম কি আব্বা আমাক ছেড়ে আজি যাবেন। আমার আব্বাকে কেনো আল্লাহ আর রাখলো না! কেনো আমাদের এতো ছোট বেলায় এতিম করে দিলো আল্লাহ! আমরা কি খুব বড় হয়েছিলাম তখন! কই অনেকেরই আব্বা এখনও বেচে আছেন আমার আব্বা থাকলে কি হতো! আব্বা যে একটা ছায়া মাথার উপরে ছিলেন যখন বুঝেছি তখন আর তাকেই পেলাম না।আজও যখন বাড়ি ফিরি, আমাক দেখে সবাই বলে মা যার কলিজা ছিলি সেই নেই, বাড়ি ঢুকলে দেখি মা আছেন আব্বা নেই, যদি আব্বা থাকতো কতই না খুশি হতো আমাক পেয়ে। যখন আমার মেয়ে দুষ্টমি করে তখন সবাই বলে আজকে তোর নানু থাকলে দেখতিস বুড়ি তোকে কই রাখতো, কত খুশি হতো আজ, তখন মনে হয় আমার আর আমার মেয়ের কপালেই কেনো এসব! নানুর আদর পেলোনা আমার মেয়ে।যখন দেখি আশে পাশের অনেকেরই বাবা আসে মেয়েকে দেখতে তাদের কতই না আনন্দ হয় কিন্তু আমার আব্বা নেই, আমার কেউ আসেনা খোজ নিতে আব্বা বলতে মানুষটা আমাক ছেড়ে অনেক আগেই চলে গেছেন। আব্বার কথা বেশি মনে নেই যতটুকু স্মৃতিতে ততটুকুতেই আফসোস আমার আমার আব্বা নেই।

কবিতাঃ বাবা । অতনু ভক্ত

সেদিন আমি ছোট ছিলাম, যুবক ছিলেন বাবা ,
সেদিন টি আসবে ফিরে যায় কি তা ভাবা ?
বাবার কাছেই হাঁটতে শিখি, শিখি সবকিছু।
সারাটি দিন কাটতো আমার জড়িয়ে তার গলা ।
বাবার হাতেই হাতে খড়ি, প্রথম লেখা পড়া, বাবার চোখেই দেখা আমার প্রথম বিশ্বটাকে।
আজকে বাবার চুল পেকেছে ,
তবু বুঝি বাবা থাকলেই লাগে ভুবন ভরা ।
বাবা এখন চশমা পড়েন পার করেছেন পঞ্চাশ –
আজো তাকে আগের মতোই ভালোবাসি অনেক।

অতনু-ভক্ত-বাবা-সাপ্তাহিক-অনুভূতি-আত্মপ্রকাশ
অতনু ভক্ত বাবা

#অতনু ভক্ত
(২৭/০৯/২০১৯)

অনুভূতিঃ বাবা । এস এ নুঈম খান

দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ মানুষটি হলো ‘বাবা’। খারাপ বলেই তো কখনও বলা হয়ে ওঠে না ‘ভালোবাসি, বাবা’, ‘আই লাভ ইউ’।

জগতে অনেক বহুরূপী দেখেছি। কিন্তু, বাবার মতো বহুরূপী দেখিনি আমি। বাহিরের বহুরূপী আচরণে যিনি ভিতরটাকে লুকিয়ে রাখেন।

তাই আমি বলব, আমার বাবা দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ বাবা, একজন বড় মাপের মিথ্যুক। যিনি সমানে মিথ্যা বলে যান।

কিন্তু, হঠাৎই যখন বটগাছটার সুদৃঢ় বলয়ের থেকে শীতল ছায়ার স্নিগ্ধতা অনুভব করি তখন বুক ভারী হয়ে যায়, গলাটা ধরে আসে।

আব্বার মৃত্যুর পর । আমিনুল ইসলাম সেলিম

আব্বার মৃত্যুর পর আমি খুব শীতার্ত হয়ে পড়লাম। শীতবস্ত্রের যোগান না থাকায় ঠাণ্ডায় থরথর কাঁপতে লাগলাম। এতো শীত আগে কখনো লাগেনি আমার। প্রতি ঈদের নামাজশেষে আব্বার কবরের কাছে যাই, সুরা-কেরাত পড়ি, কালেমা-দরূদ পড়ি, তার সাথে কথা বলতে চাই, জানতে চাই- আব্বা চলে গেলে মানুষের এতো শীত লাগে কেনো! আব্বার ঘুম ভাঙে না। কবরের মানুষ এতো ঘুমায় কেনো?

রাত্রে ঘুমের মধ্যে আব্বার শুভাগমন ঘটে। আব্বাকে দেখি। আমি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। তাকে খুব বিমর্ষ মনে হয়। ঝড়কবলিত নরম গাছ মনে হয় তাকে। কিন্তু তার চোখ অন্যরকম। ‘আব্বা, আপনার চোখ এতো লাল কেনো?’ জিজ্ঞেস করি। আব্বা হু হু করে কেঁদে ফেলেন। চোখে পানি নাই। রক্ত।
আব্বা বলেন, ‘তোমার খুব শীত লাগে, না বাজান?’
আমি বলি, ‘জ্বি আব্বা।’
আব্বা আবার কাঁদতে থাকেন। রক্তকান্না। আর বলেন, ‘প্রিয়তম সন্তানের জন্য, পিতার চোখের রোগ কখনো সারে না।’ বলে তিনি হাওয়া।

ঘুম ভেঙে গেলে দেখি পৃথিবীর শীতঋতু নিয়েছে বিদায়। রক্তজবার মতো লাল হয়ে ফুটে আছে চুমুর মানচিত্র এক– আমার চিবুকে।

সাপ্তাহিক অনুভূতি বাবা । আত্মপ্রকাশ

আমরা বিশ্বাস করি, অনুভূতি প্রকাশে লেখক স্বত্ত্বার প্রয়োজন নেই, ভালোবাসাটুকুই যথেষ্ট। আপনার বাবা সম্পর্কিত অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেন, আত্মপ্রকাশ ফেইসবুক গ্রুপে
#সাপ্তাহিক_অনুভূতি
#বাবা

(নিজস্ব অনুভূতি)

– অনুভূতি লেখকের নাম

এই ফরমেটেই গ্রুপে পোষ্ট করলে, এবং তা মানসম্মত হলে, নিয়ে আসা হবে আত্মপ্রকাশ ব্লগে। অনুভূতিগুলো ছোট ছোট হওয়াতে, সবগুলো একসাথে প্রকাশ করা হয়েছে। মানসম্মত এবং ১০০০ শব্দ সমমান বা অধিক অনুভূতিগুলো একক পোষ্টে প্রকাশ করা হবে। চলুন পড়ে নেয়া যাক, গ্রুপের অন্যান্যদের বাবা সম্পর্কিত অনুভূতিগুলো।

ভালো থাকুক সব বাবা। আমরা যেন তাঁদের ভালোবাসার প্রতিদান দিতে পারি, সৃষ্টিকর্তা যেন আমাদের সে তৌফিক দান করেন।

 

 

মোঃ ওয়ালীউল্লাহ অলি

http://enlightentricks.com

সমসাময়িক একজন মানুষ। রক্তে মিশে থাকা লেখালেখি থেকেই ব্লগিং এর অনুপ্রেরণা। লিখতে ভালোবাসি। প্রচুর লিখতে হবে, বাঁচতে হলে লিখতে হবে। এই ব্রত মাথায় নিয়েই লিখে চলেছি। বাংলার পাশাপাশি ইংলিশেও ব্লগিং করছি Enlighten Tricks ওয়েবসাইটে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *