সত্যজিৎ রায়ের উক্তি । জীবন, গল্প, সিনেমা । অনবদ্য সংমিশ্রণ

সত্যজিৎ রায়; তিনি একজন ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা, সঙ্গীত পরিচালক, শিল্প নির্দেশক, চিত্রনাট্যকার এবং লেখক। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে অন্যতম একজন হিসেবে গণ্য করা হয়। তার জন্ম ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২রা মে কলকাতা শহরের শিল্প ও সাহিত্য সমাজে খ্যাতনামা রায় পরিবারে। তার পূর্বপুরুষের ভিটা ছিল বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া গ্রামে। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। কর্মজীবন বাণিজ্যিক চিত্রকর হিসেবে শুরু হওয়ার পর ইতালীয় চলচ্চিত্র বাইসাইকেল চোর দেখার পর নির্মাতা হিসেবে তার পথচলা শুরু হয়। তার প্রথম চলচ্চিত্র “পথের পাঁচালী” নির্মিত হয় ১৯৫৫ সালে। সেই ছবি ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে এবং পরবর্তী বছর ১৯৫৬ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে “শ্রেষ্ঠ মানব দলিল” পুরস্কার লাভ করে। তার সমগ্র কর্মজীবনের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯২ সালে অর্জন করেন “অস্কার”। ২০০৪ সালে বিবিসির তৈরীকৃত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় তিনি ১৩তম স্থান লাভ করেছিলেন। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল হৃদযন্ত্রের জটিলতার কারণে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। গুণী সত্যজিৎ রায়ের উক্তি ও বাণী নিয়েই আত্মপ্রকাশের এই আয়োজন।

সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত উক্তি ও বাণীসমূহ

সত্যজিৎ রায়ের উক্তি ও বাণীগুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করে নিম্নে উপস্থাপন করা হলো।

রচনার ভাগসমূহ

সত্যজিৎ রায়ের জীবনবোধ উক্তি

সত্যজিৎ রায়ের চমৎকার জীবনবোধ তাঁর প্রত্যেকটি লেখা এবং সিনেমায় প্রকটভাবেই প্রকাশ পায়। জীবনের নিষ্ঠুর এবং সুন্দরভাবে উপস্থাপন তাঁর মত আর কেউ করতে পারে কিনা তা নিয়ে দ্বিমত নেই। জীবনবোধ নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের কিছু উক্তি নিম্নে উল্লেখ করে হল।

“সবচেয়ে মূল্যবান ও একমাত্র সমাধানগুলো লোকেরা নিজেরাই খুঁজে বের করতে পারে।”

 

“নিজের মতো করে কাজ করার সুযোগ সবসময়ই পাওয়া যায়।”

 

“ডোমিনাস ওমনিয়াম ম্যাজিস্টার, এর অর্থ হল ঈশ্বর সবকিছুর অধিপতি।”

“আমি অনুভব করি যে, নায়কের ছাঁচে থাকা মানুষের তুলনায় রাস্তায় থাকা একটি সাধারণ মানুষকে বিষয় হিসেবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। তাঁদের আংশিক অন্ধকার, অস্পষ্ট শব্দগুলোই আমি ধরতে চাই, আবিষ্কার করতে চাই।”

চলচ্চিত্র, সিনেমা নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের উক্তি

সত্যজিৎ রায় একমাত্র বাঙ্গালী পরিচালক, যিনি চলচ্চিত্র পরিচালনার জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। চলচ্চিত্র ও সিনেমা নিয়ে তাঁর দারুণ কাজগুলো আমাদের সবসময় অনুপ্রাণিত করে এবং জীবনকে সহজভাবে বুঝতে ও ভাবতে শেখায়। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা ও চলচ্চিত্র সম্পর্কিত বেশ কিছু জনপ্রিয় উক্তি ও বাণী নিম্নে উপস্থাপন করা হল।

“যখন আমি মৌলিক কোনো গল্প লিখি তখন আমি এমন ব্যক্তিদের ব্যাপারে লিখি যাদের আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি এবং এমন পরিস্থিতির কথা লিখি যার সঙ্গে আমি পরিচিত। আমি ১৯ শতকের কোনো গল্প লিখি না।”

 

“চলচ্চিত্রের দৃশ্যরচনার অভ্যাসকে আমি শখে পরিণত করেছি। আমি খুঁজে বের করতাম কোন গল্পটি চলচ্চিত্রের জন্য প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। এরপর আমি নিজস্ব ঢঙে গল্পটি লিখতাম, এরপর আসল গল্পের সঙ্গে করতাম তুলনা।”

 

“সবার শেষ কথা— বলতে গেলে সবচেয়ে জরুরি কথা হলো— আপনার প্রয়োজন একটি শুভ সমাপ্তি। যাহোক, এই শুভ সমাপ্তির আগে যদি বিষাদময় পরিস্থিতি এবং চমক সৃষ্টি করতে পারেন তাহলে বিষয়টা আরো ভালো কাজ করে।”

 

“আমি অনুভব করি যে নায়কের ছাঁচে থাকা মানুষের তুলনায় রাস্তায় থাকা একটি সাধারণ মানুষকে বিষয় হিসেবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। তাঁদের আধা অন্ধকার, অস্পষ্ট শব্দগুলোই আমি ধরতে চাই, আবিষ্কার করতে চাই।”

 

“যখন আপনার কাহিনীতে নতুন কোনো চরিত্রের আবির্ভাব ঘটে, তখন অবশ্যই তার চেহারা ও কাপড়ের বর্ণনা বিস্তারিতভাবে দেবেন। যদি সেটা না দেন তাহলে পাঠক নিজের মতো করে ভেবে নেবে, যেটা আপনি পরে যে বর্ণনা দেবেন সেটার সঙ্গে না-ও মিলতে পারে। তাই…”

“পরিচালকই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ভালোভাবে জানেন যে চলচ্চিত্রটি কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে।”

 

“সিনেমায় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসূচক গুণগুলোই মানুষের মনের অন্তরঙ্গ বিষয় ধরতে ও যোগাযোগ ঘটাতে সক্ষম।”

 

“আসলে, (চলচ্চিত্রে) সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো শুভ একটা সমাপ্তি। যা-ই হোক, আপনি শুভ একটা সমাপ্তির আগে ট্র্যাজিক কোন অবস্থা এবং কিছু কান্নার সিকোয়েন্সও রাখতে পারেন, এটা ভালো কাজ দিতে পারে।”

 

“আবহসঙ্গীতের ধারণা দিনে দিনে বেশ পরিবর্তিত হচ্ছে। এখন (পরিচালকেরা) যতটা পারা যায় কমই ব্যবহার করার চেষ্টা করেন।”

 

“আমার চিত্রগ্রাহক এবং আমি একটা মেথড নিয়ে চিন্তা করছিলাম এবং আমার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র থেকে এটা সবসময়ই করতাম। মেথডটা হলো, ইনডোরের শ্যুটিং দিনের আলোয় করা এবং লাইটটাকে সরাসরি না ফেলে বাউন্স করে ফেলা। আমরা দুইজনে এক ব্যাপারে ঐক্যমত্যে এসেছিলাম যে ক্যারেক্টারেরর ছায়া খুবই বিরক্তিকর একটা জিনিস।”

 

“আমি এখনো পর্যন্ত ১৭ কি আঠারোটার মতো চলচিচত্র বানিয়েছি যার মধ্যে মাত্র দু’টো মৌলিক চিত্রনাট্য, আর বাকি সবই ছোট গল্প কিংবা উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে লেখা। আমার মনে হয়, ছায়া অবলম্বনে চিত্রনাট্য লিখার জন্যে বড় দৈর্ঘে্যর ছোটগল্পই উপযুক্ত।”

“যখন আমি কোন লোকেশনে শ্যুটিং করি, নিজে নিজেই ওই লোকেশন থেকে কিছু না কিছু উদ্ভাবন করার চেষ্টা করি। হয়তো আপনি মূল জিনিসটা পরিবর্তন করতে পারবেন না কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কোন পরিবর্তন (যা চলচ্চিত্রটিকে আরো ভালো করতে পারে) চাইলে করতেই পারেন। আমি সাধারণত এটা করে থাকি। আর যা-ই হোক, একটু হিসেবী তো হতেই হবে।”

 

“বিশেষত, (একটা চলচ্চিত্র নির্মানের) শেষ সময়ে এসে আমি প্রায়ই খেয়াল করি আমি বেশ তাড়াহুড়ো করছি। এটা খুবই বিপদজনক যখন দেখবেন আপনি সম্পানদার টেবিলে বসে তাড়াহুড়ো করছেন। আমার শুরুর দিককার সময়ের অধিকাংশ চলচ্চিত্রেই বড় রকমের ভুল রয়ে গিয়েছিলো এই তাড়াহুড়োর কারনে।”

 

“চলচ্চিত্রের অন্যতম দক্ষতা হলো মানুষের মন বোঝার এবং তার সাথে যোগাযোগ করার ক্ষমতা এর রয়েছে।”

 

“বলিউডের চলচ্চিত্র এখন যেমন, আগে তেমনটা ছিলো না। আগে এটা স্থানীয় একটা ইন্ডাস্ট্রি ছিলো যেখানে বস্তুনিষ্ঠ ও বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্র নির্মিত হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে এটা পাল্টে গিয়েছে।”

সত্যজিৎ রায়ের মত সিনেমা ব্যক্তিত্ব ও গল্পকারের জন্য যুগের পর যুগ অপেক্ষা করতে হয়। সাধনা এবং পরিবেশই পারে এমন গুণী মানুষের জন্ম দিতে। সত্যজিৎ রায়ের উক্তি ও বাণীগুলো আমাদের চলার পথকে সুগম করবে সেই প্রত্যাশা রইলো।

মোঃ ওয়ালীউল্লাহ অলি

http://enlightentricks.com

সমসাময়িক একজন মানুষ। রক্তে মিশে থাকা লেখালেখি থেকেই ব্লগিং এর অনুপ্রেরণা। লিখতে ভালোবাসি। প্রচুর লিখতে হবে, বাঁচতে হলে লিখতে হবে। এই ব্রত মাথায় নিয়েই লিখে চলেছি। বাংলার পাশাপাশি ইংলিশেও ব্লগিং করছি Enlighten Tricks ওয়েবসাইটে।

1 Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *