মুহাম্মদ জাফর ইকবালের শৈশব বিজরিত কিছু স্মৃতি । দুরন্ত ছোটবেলা
সাহিত্য, যা আলোকিত করে মানবের মন, সেই জগৎ কে নতুন নতুন চিন্তাধারা দিয়ে শুশোভিত করছে এমনই একটি নাম মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। শুধু ঔপন্যাসিকই নন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখক হিসেবে তিনি অধিক পরিচিত। তাছাড়া তিনি পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখেন এবং শিশু সাহিত্যিক হিসেবেও খ্যাত। তিনি ১৯৫২ সালের ২৩ ডিসেম্বর সিলেটে জন্মগ্রহন করেন।তার বাবা একজন সরকারি চাকরিজীবি ছিলেন। তাই সেই সুবাদে তার ছেলেবেলা কাটে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রকৃতির বুকে বিচরন করে করে। “আধ ডজন স্কুল” শিরোনামে মুহাম্মদ জাফর ইকবালের শৈশব স্বৃতিচারনমুলক একটি বই প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালে । সেখানে জাফর ইকবালের অনেক স্মৃতিকথা উঠে আসে, যা মানুষকে হাসিয়েছে, স্মৃতিতে ভাসিয়েছে।
মুহাম্মদ জাফর ইকবালের শৈশব এবং সাহিত্যে অনুপ্রেরনা
রচনার ভাগসমূহ
সাহিত্যের প্রতি অনুরাগের দুইটি কারন না বললেই নয়, পরিবার এবং প্রকৃতি ভ্রমন। যেহেতু মুহাম্মদ জাফর ইকবালের বাবা সরকারি চাকরি করতেন, সেই সুত্রে তাকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বদলি হতে হতো। প্রত্যন্ত অঞ্চল গুলোও বাদ থাকতে না। চট্টগ্রাম, রাঙামাটি,পঞ্চগড়,বান্দরবনসহ অনেক জায়গা লেখক ছোট বেলাতেই পরিচিত হয়েছেন। অবলোকন করেছেন প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। বিশেষ করে বান্দরবন যেখানে প্রকৃতি তার সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে অকৃপন হাতে সেখান থেকেও লেখক সৌন্দর্যের নির্যাস গ্রহন করেছেন। এসকল কিছু দীর্ঘস্থায়ি প্রভাব বিস্তার করে লেখকের হৃদয়ে।
লেখক এমন একটা পরিবারে বেড়ে ওঠেন যা সাহিত্য চর্চার জন্য অনুকুল পরিবেশ সরবরাহ করেছে। তার বাবাও সাহিত্য চর্চা করতেন এবং তার সকল সন্তানদের কে সাহিত্য চর্চার প্রতি অনুপ্রাণিত করতেন। ছোট বেলাতেই তাদের সবাইকে কবিতা আবৃত্তি শেখাতেন এবং ডাইরি লিখতে দিতেন। যদিও বা জাফর ইকবাল ডাইরি লেখার কিছুই বুঝতেন না তবে বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ এবং বড় বোন সুফিয়া হায়দারের( ডাইরি লিখা দেখে মাঝে মাঝে কপি করতেন। এক্ষেত্র, পরিবার বিশেষ করে বাবা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমদ, লেখকের ছোটবেলায় সাহিত্যে বিচরনের অনুপ্রেরনার প্রধান প্রবেশপথ বলা যায়।
মুহাম্মদ জাফর ইকবালের ছোটবেলার স্মরণীয় কিছু স্মৃতি । সাহসী বোকা
লেখক তার শৈশব স্মৃতিচারণ মুলক বই “আধ ডজন স্কুল”এ লিখেছেন –
“ছোট থাকতে আমি একটু বোকা গোছের ছিলাম।আমাকে যারা চিনেন তারা এখনো মাথা নেড়ে বলবেন তুমি এখনো সেরকম চতুর হয়ে ওঠোনি। তিনি এও বলেন – দুই একটা বিষয় নয় সকল বিষয়েই আমি হাবা গোবা ছিলাম।”
যেমন ধরুন সিলেটে থাককালিন সময়ে আমার (লেখকের) বড় মামা আমাদের বাড়িতেই থাকতেন। বাড়িতে একটা কুয়ো ছিল, মামা কুয়োর রেলিং এর উপর উঠে শুয়ে শুয়ে বই পড়তেন,আমি খুব কৌতুহলী হয়ে যেতাম, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম।
এরপর থেকেই আমি কুয়ার আশে পাশে ঘুর ঘুর করতাম।একদিন যখন দেখলাম আমার আশে পাশে কেউ নেই,খুব সাহস করে হাঁচড়ে পাঁচড়ে কুয়ার রেলিংটার মাঝে উঠে গেলাম। গভীর কুয়ার নিচে কালো পানি দেখে ভয়ে আমার পেটের ভেতর পাক দিয়ে উঠছে, একটু অসাবধান হলেই নিচে পড়ে অন্ধকারে হারিয়ে যাবো। তবুও আমি সাহস করে কুয়ার রেলিং এ বাঁকা হয়ে শুয়ে পড়লাম। এখনো আমার অক্ষর পরিচয় হয়নি তাই পড়ার জন্য বড় মামার মতো একটা বই আনা হয়নি।
স্কুল ফাকিবাজ লেখক হঠাৎ শুনলেন গরমের ছুটি হবে। সেই সময় আবার ছুটি হলে ছাত্ররা ফুলের মালা গেথে ছুটির দিন স্যারের গলায় পড়িয়ে দিতেন। লেখক এতো জানতেন না, তিনি স্কুলে নতুন ছিলেন বিধায় শুনলেন আগের দিন। সারা গ্রামে ফুল খোঁজেও তিনি কুটোটিও পেলেন না। স্কুলের সময় হয়ে আসছে, তিনি কাঁদতে বসে গেছেন, তখন লেখকের বাবা বললেন-
“সবাই ফুলের মালা নিয়ে গেছে তাতে কি! তুমি বিস্কুটোর মালা নিয়ে যাও।”
তারপর লেখক বিস্কুটের মালা নিয়েই স্কুলে গিয়েছিলেন। স্যার ক্লাসে আসলেন, নাম ডাকলেন তারপর শুরু হলো মালা দেয়ার প্রতিযোগিতা। সবাই হুড়মুড় করে ঝাপিয়ে পড়লেন স্যারের উপর। লেখক তো লজ্জায় ব্যাগ থেকে বিস্কুটের মালা বেরই করতে পারছেন না, কিভাবে সবার সামনে নিয়ে যাবেন তিনি। মালাটা তিনি ছুড়ে দিয়েছিলেন স্যারের মাথা বরাবর। মালা দেয়ার শেষে যখন সবাই যে যার মতো বেঞ্চে বসলো, স্যার বিস্কুটের মালা আবিষ্কার করলেন। একটা বিস্কুট ছিড়ে খেয়ে বললেন ফাস্ট ক্লাস বিস্কুট, কে দিয়েছে বিস্কুটের মালা? কিন্তুু সেই বিস্কুটের মালার ধারক লজ্জায় লুকিয়ে ফেলেছেন নিজেকে। বিস্কুটের মালার আরো নানা রকম প্রশংসা করেছিল স্যার।
গন ঐক্য বলে যে কথা টা আছে, তা শৈশবে, স্কুল জীবন থেকেই শিখেছিলেন । বিখ্যাত মানুষ গুলোর দিকে লক্ষ্য করলেই মনে হয়, তারা খুব হারে স্কুল ফাকি দেয়ার ওস্তাদ ছিলেন। জাফর ইকবালও তার বিপরীত ছিলেন না। স্কুল ফাঁকি দেয়ার জন্য নানা রকম অজুহাত দেখাতেন। তিনি দেরি করে ঘুম থেকে উঠতেন পেটে ব্যথা মাথা ব্যথা অজুহাতে, বাড়ির মানুষ বুঝে গিয়ে সকালে ডেকে ঘুম থেকে উঠিয়ে স্কুলে পাঠাতেন তাকে। বর্ষার এক সকালে তিনি স্কুলে গিয়েছেন, সারা স্কুল বাড়িময় শুধু পানি কিন্তু ক্লাস রুমে পানি নেই। লেখকের বন্ধুরা সবাই মিলে ঠিক করলেন, কচু পাতায় করে পানি এনে বেঞ্চ ভেজানোর জন্য। যথরীতি কাজ শুরু হয়ে গেল, লেখক ও হাত লাগালেন। দেখতে দেখতে ক্লাস রুম পানিতে ভরে উঠলে, মাস্টার সাহেব এসে ক্লাসের অবস্থা দেখে ছুটি দিয়ে দিলেন।
বাবার বদলি উপলক্ষে তাদের যেতে হচ্ছে দিনাজপুরের জগদ্দলে। ট্রেন, স্টিমারে চড়ার পর তাদের যেতে হলো মোষের গাড়িতে করে। যেতে যেতে মোষের গাড়ি কেমন ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে আর দুলে, এমন যে দোলনায় চরা হচ্ছে। লেখকের তো খুবই মজা হচ্ছে, তিনি স্থিরই করে ফেললেন বড় হয়ে তিনি একটা মোষের গাড়ি কিনবেন যেটা তার নিজের হবে। তিনি মোষের গাড়ি চালিয়ে দেশময় ঘুরে ঘুরে প্রকৃতি দেখবেন। এমন সময় বিপরীত পাশ থেকে একটা ট্রাক আসলো মহিষ গুলা ভয়ে দৌড়ানো শুরু করলো। মাঠ, খেত পার হয়ে নদীতে পড়লো মোষের গাড়ি। নদী থেকে থেকে মোষের গাড়ি তোলা কি এত সহজ, লেখককে তার ভাবনা পরিবর্তন করতে হলো। তিনি ভাবলেন- নাহ! এর চেয়ে একটা সাইকেল কেনা অনেক ভালো।
পড়ে নিতে পারেন >> মুহাম্মদ জাফর ইকবালের জীবনী । অজানা কিছু মজার ঘটনা
মুহাম্মদ জাফর ইকবালের ছোটবেলায় করা না জানা কিছু বোকামি
আবার ধরুন, মুহাম্মদ জাফর ইকবালের শৈশব সময়ে, তার বড় ভাই বোনদের সাথে পড়তে বসতেন। তাদের পড়া লেখকের কাছে জটিল মনে হতো, কিভাবে তারা অক্ষর পড়ে! তাদের বাড়ির কাজের খাতা ঘাটাঘাটি করতেন যদিও তিনি কিছু বুঝতেন না। একদিন খাতার মধ্যে তিনি দুইটা হাতির মাথা আবিষ্কার করে ফেললেন কিন্তু হাতির মাথায় তার ভাই বোন চোখ আঁকতে ভুলে গিয়েছিল। তাই তিনি ঝটপট চোখ এঁকে ফেললেন, এইবার শুনুন আসল কথা ওই মাথা দুটো আসলে ইকারের উপরের অংশটা।
লেখক খুবই শান্ত স্বভাবের ছিলেন আর সব কিছুকেই তিনি খুব জটিল ভাবতেন। একবার হলো কি তাদের কুয়ার পানি খুব গন্ধ হয়ে গেল, কি হবে এখন? তাঁর মামা ও আরো কয়েকজন মিলে বালতি দিয়ে সব পানি ছেঁচে ফেলে, কুয়াতে নামলেন,কুয়ার ভেতরে বিভিন্ন জিনিস পাওয়া গেল। মামা সব কিছু উঠালেন আর একটা পঁচা মাছ পাওয়া গেল যা পানি গন্ধ হওয়ার জন্য দায়ী ছিল।পুরো ব্যপারটা লেখকের জন্য বিস্ময়কর ছিল। তাঁর বড় ভাই বোন স্কুল থেকে এলে লেখক গর্বের সাথে বলতে লাগলেন- বল দেখি বড় মামা আজকে কুয়োতে নেমেছিল কিনা? তারা বলল, হ্যাঁ নেমেছিল। লেখক আবার বললেন- বল দেখি মামা এই জিনিস গুলো কুয়ো থেকে উঠিয়েছে কিনা? তারা উত্তর করলো হ্যাঁ উঠিয়েছে। ব্যাপারটা তাঁর কাছে খুব অদ্ভত লেগেছিল, এত বড় একটা ব্যপার অথচ তাঁর ভাই বোন সহজ ভাবেই নিচ্ছে।
ছোটবেলায় মুহাম্মদ জাফর ইকবালের যা কিছু প্রথম
প্রথম শিক্ষক
মুহাম্মদ জাফর ইকবালের মতে, তার প্রথম শিক্ষক ছিলেন তাদের বাড়ির কাজের ছেলে রফিক। কিভাবে মাকড়শার পেট থেকে সুতা বের করা যায়, তা রফিকই লেখককে শিখিয়েছিলেন। আবার ছোট বয়সেই সাহিত্যের সমালোচক হতেও রফিকই শিখিয়েছিলেন। লেখকের বাবা তার সকল ভাই বোন কে রবীন্দ্রনাথের কবিতা শেখাতেন, লেখককে শিখিয়েছিলেন “প্রশ্ন”কবিতাটি। রফিক বলতো বাজারে যে একজন কবিতা বিক্রেতা আছে, তার কবিতা রবীন্দ্রনাথের কবিতার চেয়েও ভালো, শুনলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। সে একদিন লেখককে নিয়ে যান কবিতা শোনাতে,কবিতা শুনে লেখক বলেন- রবীন্দ্রনাথের কবিতাই ভালো।
প্রথম স্কুল
লেখকের প্রথম স্কুল ছিল “কিশোরী মোহন পাঠশালা“। স্কুলে প্রথম দিকের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন- তিনি তার বড় বোন শেফা (শেফু) এর সঙ্গে তিনি স্কুলে যেতেন। অন্য ছেলেদের মতো তিনি খেলাধুলো করতেন না। স্কুলে প্রথম দিকের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন- তিনি চুপচাপ বসে থাকতেন ক্লাসে, একদিন দেখলেন স্কুলের সবচেয়ে বড় ছেলেটা, সবচেয়ে ছোট ছেলেটার নাক চেপে ধরে রেখেছে। তাঁর তো ভয়ে কেঁদে ফেলার জোগাঢ়। ছোট লেখকের মতে- নাঁক দিয়ে নিশ্বাস নিতে হয়, নাঁক চেপে রাখলে নিশ্চিত ছেলেটা মারা যাবে, পুলিশ আসবে ইত্যাদি। কিন্তু অনেকক্ষন পরে ও যখন ছেলেটা মারা গেল না তখন লেখক স্বস্তি পেলেন।
কৈশোরেই পক্কতা: প্রথম অপমানবোধ
লেখকের প্রথম অপমান বোধ উপলব্ধি করতে শেখা পাঁচ বছর বয়সে। তাও আবার এই কিশোরী মোহন পাঠশালা থেকে। পড়ার বিষয় টা তার কাছে সরল সমীকরন মনে হতো। স্যার আসতেন, লিকতে অথবা পড়তে বলতেন।
একদিন স্যার রীতিমত ক্লাসে এলেন, দুইটা অংক করতে বললেন। লেখক না পারলে তাঁর বোন তাকে বলে দিতেন। সবাই খাতা জমা দিলে তিনিও তার বোনের পিছু পিছু জমা দিলেন।স্যার প্রথম খাতাটা দেখলেন ফাস্ট বয়ের, অংক ঠিক হলো, তখন ফাস্ট বয়ের উপর খাতা দেখার ভার পড়লো। যাদের অংক দুটোই ঠিক হলো তারা খাতা ফেরত পেল, যাদের হলো না তাদের বেতের মার খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হলো। বোন খাতা ফেরত পেয়েছে কিন্তু লেখক পাননি,তাঁর দুটো অংকই ভুল। তিনি তো ভয়ে জড়সড় হয়ে আছেন, বোন তো আরো। শেফু তাকে শিখিয়ে দিলেন- যেয়ে বলবি, স্যার মাফ করে দেন আর কোন দিন ভুল হবে না। সবাই এক এক করে মার খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বসলো, এবার লেখকের পালা, তিনি তো ভয়েই অস্থি্ কেঁদে কেঁদে একশে। বোন তাকে যেয়ে ক্ষমা চাইতে বলছে, তিনি গেলেন এবং হাত পেতে বেতের দিকে চেয়ে রইলেন। বেতটা শপ করে এসে তার হাতে আঘাত করলো তিনি হাত সরালেন না, ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড অপমান বোধ করছিলেন। কান্না থামাতে পারছিলেন না। বার বার কেঁদে উঠছিলেন এই ছোট্ট বয়সেই তাঁর মধ্যে প্রথম অপমান বোধ জাগ্রত হয়েছিল। তখন থেকে তিনি অংক ঠিক করার অঙ্গিকার করেন এবং যে অংক ভুল হয়েছে সেটা দিয়েই শুরু করেন। ওই অংক টা তিনি বার বার করেন কিন্তু রেসাল্ট একই আসে। তাঁর বাবা অংক দেখে বলেন- ঠিকি তো আছে অংক। কোনো কারণ ছাড়াই লেখককে মার খেতে হয়েছিল। হতেই পারে জীবনের বড়সড় পরিবর্তনের জন্য লেখকের জীবনের একটা মিরাকল ছিল।
প্রিয় শিক্ষক
ক্লাস টু তে পড়ে লেখক, এখন পর্যন্ত তার প্রিয় শিক্ষকই হয়ে উঠল না। তবে কিভাবে প্রিয় শিক্ষক পেলেন শুনুন, সেই গল্পটাই। বান্দরবনের স্কুলের ড্রয়িং টিচার একজন বয়স্কা মহিলা, জাতিতে মগ। দেখতে উনি এতটাই সুশ্রী যে লেখকের মোটেও পছন্দ হয়না, তার গলায় আবার গলগন্ড রোগ আছে। তাকে দেখে যেকোন ছাত্র বুঝে যাবে, যে তিনি অঙ্কন এর অ ও পারেন না। ক্লাসে এসেই তিনি বাচ্চাদের বেগুন আঁকতে বললেন, না পারলেও সবাই আঁকতে চেষ্টা শুরু করে দিলো। কারোর হচ্ছে লাউ, কারোর কল্ কারোর বা ডিমের সাইজ। প্রথমে একজন স্লেট নিয়ে গেল, তার আঁকানো বেগুন দেখতে ঠিক কলার মতো হয়েছিল, মেম তো দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল,তাকে দুশো নম্বর দিয়ে দিলো। সবার মধ্যে তো হইচই পড়ে গেল বেগুন একে দুশো নম্বর! একে একে সবাই স্লেট নিয়ে গেল মেম এর কাছে এবং আড়াইশ,তিনশ, চারশ করে নম্বর পেল সবাই। লেখক ছোট বেলা থেকে ভালই ছিলেন আঁকায়, তার আকা বেগুনটা দেখতে ঠিক বেগুনের মতোই হলো। লেখক নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলো, মেম কে দেখানোর পরে তিনি তো অপলক তাকিয়েই ছিলেন। আর লেখক কে মার্ক দিয়েছিলেন বারো’শ। তখন সেই কুৎসিত মেম কে লেখকের কাছে অপরুপ মনে হয়েছিল।
বান্দরবনে মুহাম্মদ জাফর ইকবালের শৈশব স্মৃতি
বান্দারবনের স্কুলে লেখকের সহপাঠীরা ছিল মগ, ওরা বয়সে অনেকটাই বড় ছিল। পড়াশোনা হতো বাংলাতেই, এ নিয়ে মগ দের কোনো মাথা ব্যথা ছিলনা। আমার ও আপাতত এটা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। কারন এখন লিখছি লেখকের সাপের ঝোলের সাথে পরিচিত হওয়া নিয়ে, তাই ভাষাটা আপাতত আলাদাই থাক।
টিফিন টাইমে সবাই মাঠে ছুটোছুটি করছে, এমন সময় একটা সাপ দেখে বাঙালি ছাত্ররা চিৎকার করা শুরু করলো, প্রচলিত নিয়ম সাপ দেখে চিৎকার করকে হয়, আর মগরা কি করলো? তারা দলে দলে সাপ খুজতে লাগলে, একটু পরেই রাশি রাশি সাপ নিয়ে চলে আসলো। আটি আটি বেধে বাড়ি নিয়ে যেতে লাগলো, একজন কে লেখক জিজ্ঞেস করেছিল- কি করবে সাপ দিয়ে? সে বলেছিল- রান্না করে খাবে। সাপের ঝোল নাকি খুবই টেস্টি।
বান্দরবনের সবচেয়ে উত্তেজনাকর ঘটনা ছিল ফুটবল। ফুলবল খেলা শুরু হলে সবাই একদম দুমড়ে মুষড়ে পড়তো খেলা দেখার জন্য। তিনটা দল ছিল খেলার জন্য- স্কুলের দল, বাজার দল আর অফিসারদের দল। বিভাগ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কোন দলের লোক কোন টাইপের। তারপরও বলি, স্কুল দল বলতে স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে গঠিত দল, বাজার দল বলতে বাজারের দোকানদার কর্মচারি দের নিয়ে গঠিত দল আর শহরের অফিসারদের নিয়ে গঠিত দল হচ্ছে অফিসারদের দল।
খেলার মৌসুম চলে, রীতিমত খেলা হচ্ছে স্কুলের দলের সাথে বাজারের দল। বাজারের দলটা একটু শক্তিশালীই বটে। লেখক অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে খেলা দেখছে, একটা অন্যরকম উত্তেজনাকর পরিবেশ। বাজার দলের খেলোয়ার বল নিয়ে এগিয়ে আসছে গোল পোস্টের দিকে, লেখক খেয়াল করলেন গোলকিপার কে খুব অবসন্ন দেখাচ্ছে বল ছুটে আসছে দেখে গোলকিপার আরও দিশেহারা হয়ে গেলো। বল ছুটে আসলে, গোলকিপার বলের উল্টো দিকে লাফিয়ে কি একটা শুন্যতাকে ধরতে গেলেন। লেখক তো অবাক, বলের বিপরীত দিকে কেন লাফালেন গোলকিপার। পাড়ার একটা ছেলে, যে কিনা পাড়ার সকল খবর রাখে সে বলল, ফুটবল খেলার সময় তো চশমা পড়া যায় না খুলে রেখে আসতে হয়, গোলকিপার চশমা ছাড়া ভালো দেখতে পায় না। চশমা ছাড়া সবকিছু তিনটা করে দেখে, মাঝখানের টা হলো আসল কিন্তু খেলার উত্তেজনায় তিনি ভুলে গেছেন কোনটার দিকে লাফাতে হবে। তাই উল্টো দিকে লাফাচ্ছে। এই ছিল ফুটবল রহস্য।
ছেলেবেলায় স্কুলে যেতে মজা পায় এমন ছেলে মেয়ে খুজে পাওয়াই মুসকিল। স্কুলে যাবো না বায়না ধরেই থাকে আর অসুখ বাধিয়ে স্কুলে না যাওয়া সেই অসুখটাও যে সুখের তাও না। তাই কি করলে অসুখ ও পোহাতে হবে না আর স্কুলেও যেতে হবে না এমন কিছুই ভাবতেন লেখক। হঠাৎ তাঁর বাবা বললেন গাঁয়ে তেল মেখে রসুন বগলে নিয়ে রোদের মধ্যে হাটলেই জ্বর চলে আসবে, তারপর ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করলে জ্বর নেমে যাবে। যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়ে গেল। পরের দিনই পরীক্ষা করার দুম পড়ে গেল, লেখকের বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ গায়ে তেল মেখে বগলে রসুন রেখে রোদে হাটতে শুরু করলেন। সবাই মজা করে দেখছিল কিভাবে জ্বর ওঠে, স্কুলের ঘন্টাও বেজে গেল কিন্তু কারোর স্কুলে যাওয়া হলো না।
আমার বললে ভুল হবে না, অনেকেই আছেন যারা ভালবাসেন, শ্রদ্ধা করেন মুহাম্মদ জাফর ইকবাল স্যারকে তার সাহিত্য কর্মের জন্য। তিনি এখনো পর্যন্ত সাহিত্যকে বিনোদন, জ্ঞান এবং আশার আলো হিসেবে ছড়িয়ে দিচ্ছেন সমাজের বুকে। মানুষকে শেখাচ্ছেন তারই(মানুষ) রুপি অন্য কারোর মন কে ব্যবচ্ছেদ করে ভেতর টা জানতে। মুহাম্মদ জাফর ইকবালের শৈশব নিয়ে করা এই আর্টিকেলে সংক্ষিপ্ত রুপে তুলে ধরা হয়েছে তার বিভিন্ন জায়গায় কাটানো ছোট ছোট কিছু ঘটনা। যদিও সেগুলো মোটেই ছোট নয়। আসা করছি পাঠক গন ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতেই দেখবেন। এই আর্টিকেল লিখার সময় সহায়তা নেয়া হয়েছে উইকিপিডিয়া, লেখকের স্মৃতিচারণমূলক বই “আধ ডজন স্কুল” এবং বিভিন্ন বাংলা ব্লগ থেকে।
1 Comment
[…] […]