অনীশ বুক রিভিও । মিসির আলী সিরিজ । হুমায়ূন আহমেদ
অনীশ উপন্যাসটি হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলী সিরিজের একটি। মিসির আলী চরিত্রটি গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সাইকোলজিক্যাল ফ্যাক্ট এবং যুক্তির মধ্য দিয়ে। যেখানে যুক্তি নেই, সেখানে মিসির আলীর অস্তিত্ব নেই। তিনি অন্ধকারকে আলোর দিশা দিবেন যুক্তির মাধ্যমেই। এমনি কিছু সাইকোলজিক্যাল টার্ম এবং কন্ডিশন নিয়েই গড়ে উঠেছে অনীশ উপন্যাসটি এবং শেষে অবধারিত ভাবেই যুক্তির জট খুলেছেন মিসির আলী। অনীশ উপন্যাস বইটি সব মিলিয়ে ৬০ পৃষ্ঠা এবং ২-৩ ঘন্টা অনবদ্য সময় কাটানোর জন্য যথেষ্ট। আত্মপ্রকাশের আজকের আয়োজন অনীশ বুক রিভিউ।
উপন্যাসঃ অনীশ
লেখকঃ হুমায়ূন আহমেদ
প্রকাশনা সংস্থাঃ অনুপম প্রকাশনী
প্রকাশকালঃ ১৯৯২ (বিচিত্রা ঈদসংখ্যা)
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৬০
প্রচ্ছদঃ ধ্রুব এষ
মুদ্রনঃ ঢাকা প্রিন্টার্স
গ্রন্থে মুদ্রিত মূল্যঃ ১০০ টাকা (বিভিন্ন অনলাইন বুক স্টোর থেকে ছাড়ে কিনতে পারেন)।
অনীশ উপন্যাসের পটভূমি । মিসির আলী সিরিজ । হুমায়ূন আহমেদ
রচনার ভাগসমূহ
অনীশ উপন্যাসটির শুরুতেই দেখা যায় মিসির আলী একটি সরকারী হাসপাতালের ৪০৯ নাম্বার কেবিনে রয়েছেন। তাঁর কি রোগ হয়েছে ডাক্তাররা ধরতে পারছেন না। শুরুতে লিভারের সমস্যা বলা হলেও প্রচন্ড মাথা ব্যাথায় স্ক্যান করানোর পর কিছু পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে কিডনীর সিস্ট জনিত সমস্যা নিয়ে একই হাসপাতালে এসে উঠেছেন সময়ের জনপ্রিয় নায়িকা রুপা চৌধুরী। যিনি ৪০৯ নাম্বারকে তাঁর জন্য লাকি কেভিন মনে করছেন। তাঁর মনে একটি বধ্য ধারণা রয়েছে, ১৩ তাঁর জন্য লাকি নাম্বার। ৪০৯ এর সংখ্যাগুলো যোগ করলে ১৩ হয়, তাই এই কেভিনটি তাঁর চাই।
যুক্তিনির্ভর মিসির আলী রুম ছেড়ে দিতে রাজি আছেন কিন্তু এই অন্ধকার আচ্ছন্ন যুক্তি তিনি তিনি মেনে নিতে পারেন না। এমনি অবস্থান উপন্যাসে কাহিনী এগিয়ে যায়। রুপা চৌধুরী ক্রমে মুগ্ধ হতে থাকেন মিসির আলীর যুক্তি এবং ম্যানারের কাছে। যার আসল নাম বুড়ি, পিতা নাম দিয়েছিলেন তিতলী, যা ছয় মাস বয়সে পিতার মৃত্যুর পর মা পাল্টে রাখেন রুপা।
রুপা তাঁর নিঃসঙ্গতা এবং মানসিক নানা বিভ্রান্তির কথা মিসির আলীকে জানাতে চান এবং অপারেশনের পূরবে মিসির আলীকে তাঁর লেখা ডাইরীটি দিয়ে যান। শর্ত থাকে, যদি তিনি অপারেশন থেকে বেঁচে ফিরে আসেন, তবেই মিসির আলী সেই ডাইরীটি পড়বেন নয়ত নষ্ট করে দিবেন।
মিসির আলী রুপার ডাইরিটি অর্ধেক পড়েই রুপার মানসিক্ অবস্থার কথা বুঝতে পারেন এবং যুক্তির মাধ্যমে একটি যথাযথ সমাধান দেয়ার চেষ্টা করেন।
অনীশ বুক রিভিও । উপন্যাসের প্রেক্ষাপট
অনীশ উপন্যাস বুক রিভিউ এর শুরুতেই বলা হয়েছে পুরো উপন্যাসটি সাইকোলজিক্যাল টার্মের উপর রচিত। যেখানে রুপা ভয়াবহ মানসিক সমস্যায় ভুগে এবং রুপার মানসিক সমস্যায় ভুগার পেছনে তাঁর মায়ের ভয়াবহ ভূমিকাই এই উপন্যাসে মুখ্য বলে মনে হয়েছে। রুপার পিতার মৃত্যুর পর তাঁর মায়ের বিরুপ আচরণ এই উপন্যাসের প্লটটিকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছে। রুপার মা তাঁর পিতার যাবতীয় সম্পর্ককে ছিন্ন করে বেঁছে নিয়েছিলেন এক নিঃসঙ্গ জীবন। যেখানে রুপা এবং তাঁর মা একে অন্যকে সম্বল করে থাকতে হয়েছে। বলা যায় রুপার মা রুপাকে নিঃসঙ্গ থাকতে বাধ্য করেন এবং নিজেও নিঃসঙ্গ জীবন কাটান। রুপার মা স্বামী হিসেবে রুপার জন্য যে ছেলেটিকে ঠিক করেন সেও রুপার নিঃসঙ্গতা দূর করে ব্যর্থ হয়। তাদের একটি সন্তান হয় এবং সেই সন্তান নিয়েই নানা অশান্তি উঠে আসে। বিরুপ পরিবেশের মধ্যেই রুপাকে খাপখাইয়ে চলতে হয়েছে এবং মায়ের বিকৃত মানসিকতার ভয়াবহতা একসময় রুপা নিজের মধ্যেও ধারণ করতে শুরু করে। নিঃসঙ্গতা এবং মানসিক বিকৃতির ভয়াবহতা হুমায়ূন আহমদ তাঁর চিরাচরিত সাবলীল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন এবং মিসির চরিত্রে মাধ্যমে যুক্তি খন্ডিয়ে অন্তত সহজভাবে তার সমাধান দিয়েছেন। যা যেকোনো পাঠককেই একটানে বইটি শেষ করতে বাধ্য করবে।
অনীশ উপন্যাসের ভালো লাগা কিছু উক্তি । অনীশ বুক রিভিউ । হুমায়ূন আহমেদ
অনীশ উপন্যাসটি পড়ার সময় বেশ কিছু উক্তি বা লেখার অংশ ভালো লেগেছে। তাঁর কিছু উল্লেখ করছি।
“পৃথিবীতে অনেক মেয়ে আছে যাদের জন্মই হয়েছে অভিভূত হবার জন্য”।
“কিছু কিছু পুরুষ আছে যারা রুপবতী তরুনীদের অগ্রায্য করে এক ধরনের আনন্দ পায়। সচরাচর এরা নিঃসঙ্গ ধরনের পুরুষ হয়, এবং নারীসঙ্গের জন্য তীব্র বাসনা বুকে ধরে রাখে”।
“জ্বর মাপার যন্ত্র আছে থার্মোমিটার। ব্যথা মাপার যন্ত্র এখনও বের হল না কেন? মানুষের ব্যথাবোধের মূল কেন্দ্র মস্তিষ্কে পৌছে দেয়। যে ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল ব্যথার পরিমাপক সেই সিগন্যাল মাপা কি অসম্ভব?”
হুমায়ূন আহুমেদের জনপ্রিয় উক্তি গুলো একত্রে >> কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের উক্তি মেলা । কিছু বাস্তবিক চরিত্রের উন্মেষ
অনীশ নিয়ে হুমায়ূন আহমদের কিছু কথা
অনীশ প্রথম ছাপা হয়েছিল ঈদসংখ্যা বিচিত্রায় (১৯৯২)। গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় কিছু পরিবর্তন করেছি। অনীশের নায়িকা রুপা’র স্বামী সম্পর্কে মিসির আলীর ধারণার কথা মূল বইয়ে বলা হয়েছে, যা আগে বলিনি। মিসির আলীর যুক্তিনির্ভর এই ধারণা হয়তো অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য মনে হবে না। আমার কথা হচ্ছে ‘যুক্তি’ গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে মাথা ঘামায় না, সে চলে তাঁর সরল পথে। জালালউদ্দিন রুমির চার লাইনের একটি কবিতা ব্যবহার করেছি। মূল বইয়ের সঙ্গে এই কবিতার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। জালালউদ্দিন রুমির এই স্তবকটি আমার খুব প্রিয়। পাঠক-পাঠিকাদের কাছে প্রিয় স্তবকটি উপহার দেবার লোভ সামলাতে পারলাম না।
“I am so small I can barely be seen.
How can this great love be inside me?
Look at your eyes. They are small
But they see enormous things.”
অনীশ বুক রিভিউ । নিজস্ব কিছু কথা
হুমায়ূন আহমেদ আমার বরাবরই পছন্দের লেখক। সমাজ বাস্তবতাকে ব্যঙ্গার্থক রসবোধ দিয়ে এত সহজভাবে উপস্থাপন খুব কম লেখকই করতে পেরেছেন। আর মিসির আলী সিরিজের যুক্তিভিত্তিক কথা, সাইকোলজিক্যাল ফ্যাক্ট, এবং সরল সমীকরণ বরাবরই ভালো লেগেছে। অনীশ উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে খুব দ্রুত শেষ হয়ে গেছে। হুমায়ূন আহমেদের কোনো বইয়ের ৬০ পৃষ্ঠাকে একটানে পড়ে ফেলতে ২ ঘন্টার বেশি সময় লাগে না। কিন্তু এটা সত্য যতক্ষনই পড়েছি একাগ্রচিত্তে পড়েছি এবং বেশ মজা পেয়েছি। পাঠক সময় পেলে অনীশ উপন্যাসটি পড়ে নিতে পারেন।