গল্পশেষে >> আশরাফ মামুন । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প
১
প্রিয়ন্তির দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে বহু বছর পর পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যটি দেখছি। আমার পাশে প্রিয়ন্তি ঘুমিয়ে আছে। কত নিশ্পাপ তার চেহারা! প্রিয় মানুষটার ঘুমন্ত চেহারাটি ভিষণ মায়াভরা হয়। প্রিয়ন্তির চেহারার সে মায়া আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। একটা সময় ছিলো রোজ ভোরে উঠে প্রিয়ন্তির পাশে বসে থাকতাম। তার চেহারার দিকে তাকিয়ে ভাবতাম , এটা কি স্বপ্ন নাকি বাস্তবে প্রিয়ন্তি আমার পাশে? সত্যি বলতে কি ! ভাবার পিছনে কারণ ছিলো , বছর পাঁচ এক আগেও প্রিয়ন্তিকে কল্পনা করা যেতো না । আমি একটা দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে বাহিরে তাকায় , ভোরের আলো ফুটছে । প্রিয়ন্তি তখনো ঘুমিয়ে । আচ্ছা প্রিয়ন্তি কি কখনো আমার রোজ ভোরে উঠা এই পাগলামো খেয়াল করেছিল? নিজের কাছে প্রশ্নটি করে নিজেকে বোকা মনে হয় আজকাল। মাঝে মাঝে নিজের কাছে এমন অনেক প্রশ্ন করি এখন।
প্রিয়ন্তি আনমোড়া দিলো , শীত পড়ছে রুমটিতে। জোড়সড় হয়ে শুয়ে আছে প্রিয়ন্তি । আমি লেপটা এগিয়ে প্রিয়ন্তির শরীরে জড়িয়ে দেই। প্রিয়ন্তির চুলগুলো তার চোখের উপরে এসে পড়ে। একটা মেয়ের চেহারায় এত মায়াভরা হয় কিভাবে! ভেবে পাই না আমি। প্রিয়ন্তির চোখের উপর ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো আমি আলতো ভাবে সরিয়ে দেই , কপালে চুমু এঁকে উঠে দাড়ায়। ততক্ষণ বাহিরে ভোরের আলো ফুটে গেছে ।
আজ বিশেষ একটি দিন । সময় অনেক গড়িয়েছে । এতদিন পর প্রিয়ন্তি কি মনে রেখেছে সেই কথা?
প্রিয়ন্তির সাথে প্রথম পরিচয়টা হয় ক্লাস সিক্সে। ছোটছোট চুলে ফ্রক পড়ে আসতো মেয়েটি। আমি অবশ্য বড় ছিলাম কয় ! হাফ হাতা শার্টে কোমড়ের উপর অবদি প্যান্ট পড়াতো মা। তখনকার ছবি দেখে আনমনে আজো হাসি আমি। আমি যখন সেবার স্কুলে গেলাম তখন পিটি শুরু হয়েছে । কোন রকম সুযোগ বুঝে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। প্রিয়ন্তি পারল না , স্কুল সমাবেশ যখন শেষ তখন প্রিয়ন্তির আগমন । চেহারা কাচুমুচু করে গেইটে দাঁড়িয়ে ছিলো মেয়েটি। সমাবেশে যোগ না দেয়ায় ম্যাডাম যখন বকছিল তখন প্রিয়ন্তির চোখে জল ! অদ্ভুত লাগে এখনো। সম্পূর্ন অপরিচিত একটি মেয়ের চোখে জল দেখে সারাটা ক্লাস মন খারাপ ছিলো আমার ।
ক্লাসে বাকপটু ছেলেটা প্রিয়ন্তিকে দেখলেই চুপ হয়ে যেতাম। প্রথম দেখার দিন ছুটির পরের কথা আমার আজো মনে পরে , প্রিয়ন্তি যখন বিকেলে বাড়ি ফিরছিলো আমি তখন তার পিছুপিছু হাটতে লাগলাম। প্রিয়ন্তি প্রথমে কিছু বলেনি পরে যখন লক্ষ করল তখন অবাক হয়ে তাকালো।
_ এই ছেলে তোমার বাসা এইদিকে? _ চোখ নাচিয়ে জানতে চাইল প্রিয়ন্তি । আমি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম । মুখে থেকে কথা বের হচ্ছে না। আমার দিকে তাকিয়ে প্রিয়ন্তি তখন উত্তরের অপেক্ষায়। আমি তখন কিছু না বলে , পিছন ফিরে হাটতে লাগলাম। অনেকটা দৌড়ানোর মতো। প্রিয়ন্তি তখন পিছন থেকে ডেকেই যাচ্ছে
– এই ছেলে এই …
স্মৃতিগুলো বড্ড বেশি স্পষ্ট । ভাবতে গেলে আনমনে হাসি চলে আসে।
ঢিং ঢং ঢিং !!
দেয়াল ঘড়ির এলার্মে বেজে উঠল। সকাল ৭ টা বাজছে। আমি রান্না ঘরে দাঁড়িয়ে । আচ্ছা, প্রিয়ন্তি কি আমার হাতে চা দেখলে অবাক হবে? আজ দিনটিতে প্রিয়ন্তিকে চমকে দিতে চাই আমি।
রুমের দরজা লাগিয়ে রেখে গিয়েছিলাম আমি। চা হাতে নিয়ে দরোজা খুলতেই দেখলাম প্রিয়ন্তি উঠে বসেছে। তার হাতে ফোন , কি দেখে হাসিছিল যেন! আমাকে দেখে ফোন একপাশে রেখে অবাক হয়ে তাকালো। তার অবাকের কারণ আমি জানি। আজ অনেকদিন পর তার সকালটা শুরু হচ্ছে আমার হাতের চা দিয়ে। হাসলাম আমি , আমাকে দেখে প্রিয়ন্তির ঠোঁটেও হাসির রেখা ফুটল। প্রিয়ন্তির ঠোট বড় একটা তিল। সেই তিলটি তার হাসির সৌন্দয্য হাজার গুণে বাড়িয়ে দেয়।
আমি সামনে গিয়ে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দেই দিকে । প্রিয়ন্তি হেসে নেয় । বাহুতে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দেই আমি। প্রিয়ন্তির চেহারায় তখনো হাসির রেখাটা রয়ে যায়।
– আজ অফিসে নেই? _ প্রিয়ন্তি জিজ্ঞেস করে । উত্তরে হাসি আমি। অফিস আজ ছুটি । বিশেষ দিনটির কথা মনে করিয়ে দেবো কিনা ভাবলাম একবার। পরক্ষণেই সে চিন্তা বাদ দিতে হলো। অনেক দিন প্রিয়ন্তিকে সারপ্রাইজ দেয়া হয় না!
– কি রে কোথায় হারিয়ে গেলে? আমার চোখের সামনে হাত নাড়িয়ে জানতে চায় প্রিয়ন্তি।
– তোমাকে কেউ বলেছিল ঘুম থেকে উঠার পর তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটি। !!
– তুমি কি তোমার বউয়ের সাথে ফ্লার্ট করবে অভ্র? ভ্রুর কুচকে জানতে চায় প্রিয়ন্তি, পরক্ষনে হেসে দেয়।
– বুড়ো হয়ে গেলেও আমি ফ্লার্টিং করব তোমার সাথে; প্রিয়ন্তির পাশে বসতে বসতে বলি আমি।
প্রিয়ন্তি চায়ের কাপে চুমুক দেয় , আমি তাকিয়ে থাকি। আচ্ছা , এ মেয়ের মধ্যে এমন কি মায়া আছে, যা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।
প্রিয়ন্তির সাথে বিয়ে হয়েছে আজ তিন বছর হতে চলল। বিয়ের পর প্রিয়ন্তি আর আমি দুজনকে তুমি করে বলি। এটা প্রিয়ন্তির ইচ্ছে । অথচ আমরা “তুই” করে বলতাম।
– প্রিয়ন্তি?
– হুম
– তোমার আলমারীতে একটা ড্রেস রাখা আছে। ফ্রেস হয়ে নাও। নাস্তা সেরে রেডি হবে। আজ সারাদিন ঘুরব আমরা।
– তোমার কি হযেছে অভ্র?
– কি হবে?
– এইতো সকাল সকাল উঠলে , চা বানিয়েছ। ঘুরার প্ল্যান, এসব কেন?
– এমনিতেই, হেসে বলি আমি। যা বলেছি করো। প্রিয়ন্তি আর কিছু না বলে দাঁড়িয়ে থাকে । আমি উঠে দাঁড়ালাম। প্রিয়ন্তি নিশ্চয়ই কার্ভাড খুলে, সেখানে থাকা গিফট গুলো দেখে অবাক হবে!
আকাশে মেঘ ডাকছে । বোধহয় বৃষ্টি নামবে! স্কুলে থাকতে খুব ভিজতাম আমরা। প্রিয়ন্তির সাথে তখন অল্পস্বল্প কথা হতো। একবার ঝুম বৃষ্টি , ছাতা না নেয়ায় স্কুলে যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে ছিলাম গাছের নিচে। মাঝ পথে প্রিয়ন্তি স্কুলের পথে যেতেই আমাকে দেখে থামল । সত্যি বলতে , প্রিয়ন্তিকে দেখলেই আমি একটি জড়তায় আটকে যেতাম । প্রিয়ন্তি পাশে এসে দাঁড়াল
– দাঁড়িয়ে আছ কেন?
– আমি তোতলাতে তোতলাতে বললাম, বৃষ্টি ।
আমার তোতলানো দেখেই বোধহয় হাসল প্রিয়ন্তি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। নিজের উপরই রাগ হচ্ছিল খুব। সে কি বাঘ না ভালুক যাকে দেখে তোতলাতে হবে !
– ভেতরে এসো, ছাতি দেখিয়ে বলে প্রিয়ন্তি। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ব্যাগ হাতে টান দেয় সে। আমি কাচুমুচু মুখ করে একই ছাতিতে ঠায় নেই। সেদিন যাওয়ার পথে আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছিল প্রিয়ন্তি। আমি আড় চোখে তাকিয়ে ছিলাম ।
– অভ্র?
উপরের রুম থেকে প্রিয়ন্তি ডাক দেয় । আমি নাস্তা টেবিলে সাজিয়ে উপরে উঠি। ডাইনিং রুম থেকে তখন খিচুরীর ঘ্রাণ আসছে । খিচুরী খুব পছন্দ প্রিয়ন্তির ।
রুমে ঢুকেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম প্রিয়ন্তির দিকে । পড়নে নীল শাড়ি, কপালে নীল টিপ। চোখে কাজল দেয়া। নিজেই নিজের ছবি তুলছিল । তুলে মোবাইলটা কি সব লিখল। আমি দরোজায় কড়া নাড়তেই চমকে তাকালো। হাসলাম আমি, প্রিয়ন্তিও হাসছে।
– ভয় পাইয়ে দাও তুমি !
– আমি কি করলাম?
– কড়া নাড়তে হয়!
– তুমি ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিলে।
প্রিয়ন্তি চুপ হয়ে যায়। আয়নায় নিজেকে দেখে। আমি প্রিয়ন্তির দিকে তাকিয়ে ভাবি, স্রষ্টার সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টিটি আমার পাশে দাঁড়িয়ে ।
– কি দেখছ তুমি?
– তোমার কপালের টিপ।
– উফফ বলো না, এটা বাঁকা হয়েছে। আমি যেমনটা দেখছি ঠিকই আছে । আহ্লাদি কন্ঠে বলে প্রিয়ন্তি। আমি হাসি , প্রত্যেকবার প্রিয়ন্তি কপালের টিপ ঠিক জায়গাতেই বসায়। আমি তাকে রাগাতেই বলি ঠিক জায়গাতে নেই টিপ । বলার পর প্রিয়ন্তির আহ্লাদি কন্ঠে , “ঠিক করে দাও” শুনতে আমি রোজ এমন মিথ্যে বলতে রাজি।
প্রিয়ন্তি কাছে এসে দাঁড়ায় । হাতে নতুন নীল টিপ।
– নাও , ঠিক করে লাগিয়ে দাও
আমি প্রিয়ন্তির হাত থেকে টিপ নিয়ে লাগিয়ে দেয়। প্রিয়ন্তির কাজল দেয়া চোখ দুটোই নিজেকে দেখার চেষ্টা করি। প্রিয়ন্তি হেসে বলে,
– কি দেখছ?
-তোমাকে। চোখ অন্য দিকে সরিয়ে বলি আমি। প্রিয়ন্তি নিজেকে আমার থেকে সরিয়ে নিয়ে হাসে। ঢং, বলেই ড্রেসিং টেবিলের দিকে ফিরে প্রিয়ন্তি। আমি পকেট থেকে প্রিয়ন্তির পছন্দের ফুলের মালাটি বের করে খোপায় লাগিয়ে দেয়।
আয়নায় প্রিয়ন্তির অবাক হওয়া চেহারা দেখে বুকের ভিতরে কোথাও যেন হুহু করে উঠল।
তখন প্রিয়ন্তি খুব ভাল বন্ধু হয়ে উঠেছে। আমার বন্ধুর জগত বলতেই প্রিয়ন্তি। স্কুলের বিশাল অনুষ্ঠান। সে অনুষ্ঠানে প্রিয়ন্তির নাচার কথা। প্রিয়ন্তি ভাল নাচতে জানতো। সত্যি বলতে, প্রিয়ন্তি প্রোগ্রামে নাচবে শুনে ভেতর থেকে আমি উচ্ছ্বসিত ছিলাম । আমার সব উচ্ছ্বাস পানসে হয়ে গেলো, প্রিয়ন্তি কালো মেঘের মতো হয়ে থাকা মুখটি দেখে।
– কি রে বসে আছিস যে ! অবাক হয়ে বললাম আমি।
– উফ কথা বলিস না তো অভ্র। আমি কিছুই করব না
– করবিনা মানে কি? তুই নাঁচছিস না আজ?
– উহু
তখন সবে এইটে উঠেছি। প্রিয়ন্তির প্রতি গভীর টান অনুভব করতাম। তার ঝগড়া হলে মন খারাপ হতো। স্কুলে না এলে অস্থিরতায় কাটাতাম দিনটি। সেদিন প্রিয়ন্তির চোখে জল দেখে খারাপ লাগল খুব। কিছু না বলে উঠে এসে খোঁজ নিলাম। প্রিয়ন্তির নাচের কস্টিউমে বেলী ফুলের মালা খোঁপায় থাকবে। প্রিয়ন্তি যে ফুল এনেছিল তা চুরি হয়ে গেছে। তাই তার মন খারাপ । আনমনে হাসলাম আমি। এই ছোট ব্যাপার নিয়ে কেউ কাঁদে! প্রিয়ন্তিকে বললাম না কিছুই আর। শো শুরু হতে তখন ঘন্ট দেড় এক বাকি। ততক্ষণে ফুলের মালা আনা যাবে।
কাট ফাটা রোদে ঘেমে আমি চুপসে গেছি। কপাল ভাল দিচ্ছিল না সেদিন। বহু খুঁজে যখন মালা পেয়েছি ততক্ষণে ঘন্টা পার হয়ে গেছে । মাঝ পথে নষ্ট যাওয়া গাড়ি ছেড়ে হেটেই আসতে হলো। সত্যি বলতে কি হেটে নয় , দৌড়ে এসেছিলাম।
যখন মালা হাতে রুমে ঢুকেছি তখন অন্যরা অনুষ্ঠানের নাচের প্রস্তুতি নিচ্ছে । রিহার্সাল রুমে এক কোণে বসে ছিলো পাগলীটি । আমি সামনে দাড়িয়ে হাঁপাতে লাগলাম । চেহারা আর শরীর থেকে ঘাম বেয়ে পড়ছে । প্রিয়ন্তি অবাক হয়ে আমার হাতের বেলী ফুলের মালা গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। প্রিয়ন্তির সেদিনের হাসিটা আমি ভিতরে একটা জায়গা তৈরী করে নিলো। যে জায়গায় আমি ছোট্ট একটি রাজ্য সাজালাম । যে রাজ্যের পুরোটা জুড়ে প্রিয়ন্তি !
– আজ তোমার কি হয়েছে বলবে অভ্র?
– কিছু না প্রিয়ন্তি । আজ তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে ।
– হয়েছে এইবার থাম।
– নিচে এসো প্রিয়ন্তি, হেসে বললাম আমি । প্রিয়ন্তি আমার সাথে হাটা ধরে।
কখন করলে এসব! ডাইনিং এ খিচুরী দেখে অবাক হয়ে হেসে বলে প্রিয়ন্তি। আমি তার অবাক হওয়ার দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকি।
– তুমি যখন উপরে সাজছিলে।
– থ্যাংক ইউ, বলে আমার বুকে মাথা রাখে প্রিয়ন্তি। দুহাতে নিজের বাহুতে প্রিয়ন্তিকে নেয়ার আগে থেমে যায় কেনো যেন!
– খেতে বসো তাড়াতাড়ি বের হবে।
– কোথায় যাচ্ছি আমরা? খাবার মুখে দিয়ে প্রিয়ন্তির প্রশ্ন শুনে আমি শুধু হাসলাম।
সত্যি বলতে কি বের হয়ে প্রিয়ন্তিকে নিয়ে যে জায়গটায় যাচ্ছি তা অনেক পুরনো । আমাদের পুরোনো স্মৃতি, কিছু স্বপ্নকথার গল্পের প্রিয় স্থান ।
২।
প্রিয়ন্তির চেহারায় একটা অদৃশ্য মায়ায় ছেয়ে যায়। আমি তাকিয়ে থাকি , বাতাসে তার চুল উড়ছে। চুল উড়ার দৃশ্য আমাকে আচ্ছন্ন করতে লাগল । আমি হা হয়ে তাকিয়ে থাকি। আকাশে মেঘ জমছে , আমি খুব করে চাই বৃষ্টি হোক। আজ বিশেষ একটি দিন। বৃষ্টি নিশ্চয় প্রিয়ন্তির খুশির মাত্রাটা বাড়িয়ে দিবে !
– কি দেখছ তুমি? আমার দিকে তাকিয়ে বলে প্রিয়ন্তি। আমি সংবৃত ফিরে পেয়ে হাসলাম।
– তোমর চুল গুলো অনেক সুন্দর প্রিয়ন্তি। প্রিয়ন্তির থেকে চেহারা অন্যদিকে সরিয়ে বললাম আমি। প্রিয়ন্তি আমার দিকে তাকালো।
– অভ্র !
– বলো শুনছি।
– আমাকে খুব ভালোবাস?
আমি প্রিয়ন্তির দিকে তাকালাম। প্রিয়ন্তি তখন অন্যদিকে তাকিয়ে। সত্যি বলতে , প্রিয়ন্তিকে আমি ভালোবাসি । অসম্ভব ভালোবাসি।
“ভালোবাসি” ব্যাপারটা বুঝতে শিখেছি ক্লাস নাইনে উঠে । একেবার শেষের দিকে প্রিয়ন্তিকে ছাড়া আমার কিছুই ভাল লাগত না। স্কুলে এসেই আমি আড়ালে প্রিয়ন্তিকে খুঁজতাম। সমাবেশে যখন দাঁড়াতাম আমি তখন চোখ থাকত মেয়েদের সারির নারিকেল গাছটির দিকে । ঐদিকটাই দাঁড়াত প্রিয়ন্তি। চুলে বেনী করে আসতো সে। চেহারায় সর্বক্ষনিক হাসি লেগেই থাকত । আমার গল্পকথার রাজ্যে প্রিয়ন্তির সে হাসি কতশত স্বপ্নের বীজ বুনত !
আকাশে তখন মেঘের গর্জন । প্রিয়ন্তি মাথা তুলে তাকালো। বৃষ্টির ফোটা প্রিয়ন্তির গালে পড়তেই হাসল সে ।
– অভ্র , স্কুলে থাকতে কত ভিজেছি আমরা । মনে আছে?
– আমার সব মনে আছে প্রিয়ন্তি।
বৃষ্টির দিনে খুব ভিজতাম আমরা। বৃষ্টি হলেই স্কুল বারান্দায় দৌড়ে আসতো প্রিয়ন্তি। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি স্পর্শ করতো। আমি সে দৃশ্যটিও গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকাতাম।
একবার ক্লাসে টিচার এলো না। বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছিল খুব। প্রিয়ন্তি আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে বলল কিছু একটা। আমি ইশারা বুঝে হাসলাম ।
ক্লাসের পিছনের দিকে জানালায় গ্রীলগুলো অনায়েসে খোলা যেতো। সেদিন সেদিকটাই স্কুল পালিয়েছিলাম দুজন । বৃষ্টিতে হাটতে হাটতে হঠাত্ প্রিয়ন্তি কিছু একটা দেখে থামল।
– আমার কদম ফুল লাগবে রে- প্রিয়ন্তি মুখ কালো করে বলেছিল সেদিন।
আমি সামনে তাকালাম । স্কুলের পিছনের দিকটায় কদম ফুলের গাছটিতে কদম ফুলগুলো একটু বেশি সুন্দর। নিতে হলে গাছ বেয়ে উঠতে হবে। আমি গাছে চড়তে জানতাম না। তার উপর বৃষ্টিতে গাছ পা পিছলে পরে যাওয়ার সম্ভবনা ছিলো। আমার ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে প্রিয়ন্তি বলল-
– হয়েছে , আর ভয় পেতে হবে না।
– ভয় পাবো কেন?
– তুই গাছটিতে উঠতে পারবিনা অভ্র !
প্রিয়ন্তির কথা শুনে রাগ হলো খুব। পারব না কেন? নিজের মনকেই জিজ্ঞেস করলাম। পরক্ষণে গাছের দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল মুখটা। প্রিয়ন্তি তখন গাছের উপর ডালটিতে কদম ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে বিষ্ময় নিয়ে । প্রিয়ন্তির সে চেহারার দিকে তাকিয়ে কি মনে করে যেন উঠে দাঁড়ালাম।
– অভ্র ! ফিরে আস , লাগবা না আমার। প্রিয়ন্তি তখন পিছন থেকে ডাকছিল । আমি তাকায়নি, আমার চোখে তখন কদমফুলটি হাতে পাওয়ার পরের মুহুর্তে প্রিয়ন্তির হাসিটি ভাসছে।
কদম ফুলগুলো যখন প্রিয়ন্তির হাতে দিলাম তখন তার চোখে রাজ্যের বিষ্ময়। প্রিয়ন্তির চেহারায় হাসি। আমি সে হাসির দিকে তাকিয়ে ছিলাম অপলক।
“অভ্র তোর হাতের অবস্থা দেখেছিস?” চিত্কার দিয়ে বলল প্রিয়ন্তি। পরক্ষণে হাতে তীব্র ব্যাথা অনুভব করলাম। গাছে উঠতে গিয়ে চামড়া ছিলে রক্ত পরছে। প্রিয়ন্তি তার ব্যাগে থাকা রুমাল বের করে হাতে বাঁধতে লাগল । সে দৃশ্য দেখে মনে হয়েছিল প্রিয়ন্তি আমাকে ভালোবাসে ।
– অভ্র ! চুপ করে আছ কেন? প্রিয়ন্তির কথায় ভাবনা থেকে ফিরলাম ।
“আচ্ছা প্রিয়ন্তি , রুদ্র তোমার প্রথম ভালোবাসা? প্রিয়ন্তির দিকে তাকিয়ে কি মনে করে যেন বললাম। প্রিয়ন্তি না তাকিয়ে মুখ অন্য দিকে ফিরালো। আকাশে তখন মেঘ গর্জন তুলে ডাকছে।
সেদিন ভিষণ বৃষ্টি হচ্ছিলো । ক্লাসে তখনো কেউ আসেনি । ছাতা হাতে স্কুলের পাশের রাস্তা ধরে হাটছি। কিছুদূর যেতেই থমকে দাঁড়ালাম । প্রিয়ন্তি দাঁড়িয়ে , সাথে কেউ একজন। সে কেউ একজনের নাম রুদ্র , প্রিয়ন্তির ভালোবাসা।
“জানিস অভ্র তোকে বলব করেও বলা হয়নি । রুদ্র সাথে আমার বছর দুইয়ের প্রেম”। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলেছিল প্রিয়ন্তি । আমি কি ভেবে যেন হেসেছিলাম।
রিক্সার টুংটাং শব্দে ভাবনা থেকে ফিরলাম। প্রিয়ন্তি তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
– অভ্র ! হঠাত্ রুদ্রের কথা কেনো জিজ্ঞেস করলে?
আমি প্রিয়ন্তির দিকে ফিরলাম। যথেষ্ট অস্বস্তি প্রিয়ন্তির চেহারায় । আমি হেসে বললাম , “এমনিতেই”।
বাকি রাস্তাটুকুতে আমরা কেউ কারো সাথে কথা বলিনি। রিক্সা তখন সিআরবি রাস্তায় ঢুকছিল, তখন প্রিয়ন্তি চেহারায় হাসি । প্রিয়ন্তি সে হাসির অর্থ জানা আছে আমার। আমাদের প্রিয় একটি জায়গা এটি।
রিক্সা থেকে নেমে আমরা দুজন হাটছি গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে। প্রিয়ন্তি চেহারায় খুশির ছাপটা স্পষ্ট বুঝে নেয়া যায়। মোবাইলে রিং হচ্ছিল তার। আমার দিকে তাকিয়ে ফোনটি ব্যাগে গুজে রাখল সে।
– রুদ্র জায়গাটি ঠিক আগের মতোই আছে। তাই না?
– হ্যা প্রিয়ন্তি! শুধু আমরা ছাড়া।
প্রিয়ন্তি মুখের হাসি কোথায় যেন হারিয়ে গেলো। আমার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ , বলল না কিছুই ।
প্রিয়ন্তির ভালোবাসার মানুষটি আমি নয়, জানার পর নিজেকে গোছাতে শুরু করলাম। একটা ব্যাপার মাথায় গেথে গেলো , যেভাবেই হোক প্রিয়ন্তি থেকে দূরে থাকতে হবে।
পরিক্ষার তখন বেশিদিন বাকি নেই। স্কুল থেকে বিদায় নিতে হবে। ততক্ষণে প্রিয়ন্তির থেকে অনেকক্ষানি দূরত্ব! আমি ভেবে রেখেছি , স্কুলের শেষ দিনটায় আমাদের শেষ দেখা হবে।
স্কুলের বিদায়ের দিনটি আমার খুব মনে পরে । সন্ধায় যখন ১০ টি বছরের স্মৃতিকে পিছে ফেলে ফিরছিলাম তখন আমার চোখ প্রিয়ন্তিকে খুঁজছিলো। প্রিয়ন্তির সাথে দেখা হলো বাড়ি ফেরার ঠিক আগ মুহুর্তে। আমার দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো। হাত মিলানোর সময় কে জানতো স্রষ্টা অন্য কিছু ভেবে রেখেছিলেন।
– আজ কোথায় এত হারাচ্ছ অভ্র? হাত নাড়িয়ে জানতে চায় প্রিয়ন্তি । আমি হেসে বললাম- অতীতে।
প্রিয়ন্তি মুখ বাকিয়ে হাসল। আমরা যে জায়গাটায় বসে আছি, তার কিছু দূরে ছাউনীতে একজন ঝুড়িতে হরেক রকম রেশমী চুড়ি নিয়ে বসে আছে।
– আমার চুড়ি লাগবে; সেই দিকটায় দেখিয়ে বলল প্রিয়ন্তি। আমি কিছু না বলে উঠে গেলাম। প্রিয়ন্তির জন্য রেশমী চুড়ি কেনার সখ আমার বহু আগের ।
স্কুলের বিদায় দেয়ার পর থেকে প্রিয়ন্তির সাথে আমার দেখা হয়নি। নিজেকে তিনটা মাসে গুটিয়ে নিয়েছিলাম সবকিছু থেকে। কলেজে যেদিন প্রথম গেলাম তখন মনে একটাই ইচ্ছে ছিলো , নতুন করে শুরু করতে হবে আমাকে । একদম নতুন করে।
বন্ধুরা সবাই যখন ভাল ভাল কলেজে ভর্তি হলো, আমি নিজেকে লুকাতে প্রাইভেট কলেজ বেছে নিলাম । কলেজের প্রথম দিনটির কথা আজো মনে আছে। ওরিয়েন্টেশন ক্লাসে ঢুকে বসে আছি। পিছন দিক থেকে কেউ একজন এসে আমার চোখ বুজে ধরল । ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখলাম প্রিয়ন্তি দাঁড়িয়ে। স্রষ্টার রসিকতায় নিজেকে সামলে নিতে সময় লেগেছিল অনেক।
প্রিয়ন্তি, সেদিন ওরিয়েন্টেশনে তোমার সাথে দেখা না হলেই ভালো হতো।
প্রিয়ন্তি এনে দেয়া রেশমী চুড়ি গুলো পড়ছিল হাতে । আমি সেদিকে তাকিয়ে বললাম কথাটি। প্রিয়ন্তি আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালো।
– হাহাহা , দেখা না হলো তোমার পাগলামো থেকে বাঁচতাম। পরিস্থিতি সামাল দিতে বললাম আমি। প্রিয়ন্তির চেহারায় পরিবর্তন এলো না।
আমি আর প্রিয়ন্তি একটা ক্যাফেটেরিয়া বসে আছি। কফি কাপে চুমুক দিলো প্রিয়ন্তি । চেহারায় চিন্তার ছাপ আছে এখনো। তাকে চমকে দেয়ার জন্য ওয়েটার তাকে একটি বাক্স দিয়ে গেলো । হাসলাম আমি , প্রিয়ন্তির চেহারায় এখন হাসি ফুটবে।
– এটা কি অভ্র?
– আমি কি করে বলব?
প্রিয়ন্তি ভুর কুচকে তাকালো। বাহিরে তখন ঝুম বৃষ্টি। প্রিয়ন্তির সামনের বাক্সটিতে এক গুচ্ছ কদম।
প্রিয়ন্তি বাক্সটি খুলে আমার দিকে তাকালো । তার চোখের হাসিটি ঠিক পড়ে নেয়া যায়। আমার দিকে সেই চোখ নিয়ে তাকিয়ে ছিলো অনেকক্ষণ। আমি বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারিনি । দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম।
প্রিয়ন্তির হাতে কদমগুলো মুঠোবন্দী করে রেখেছে। আমি আর প্রিয়ন্তি পাশাপাশি হাটছি। সামনে আইসক্রিমের গাড়ি দেখে চোখ নাচিয়ে হাসল প্রিয়ন্তি। দুজনেই হাসলাম অতীতের কথা ভেবে ।
কলেজে উঠার পর প্রিয়ন্তিকে এড়িয়ে চলতাম। প্রিয়ন্তি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল আমার থেকে। একদিন খেয়াল করলাম প্রিয়ন্তি অনেক দিন হয়ে গেলো ক্লাসে আসছে না। ভাবলাম , কি হলো মেয়েটার? ফোনে না পেয়ে চিন্তা হলো খুব। মনের সাথে তর্কে হেরে প্রিয়ন্তির বাড়ির পথ ধরলাম ।
সেদিন প্রিয়ন্তির বাসায় আমাকে দেখে প্রিয়ন্তির মা অবাক হলেন। সে স্কুলে থাকতে গিয়েছিলাম আর যাইনি।
– অভ্র! কি মনে করে আন্টির কথা মনে পড়ল? হেসে বললেন প্রিয়ন্তির মা ।
উত্তরে হাসলাম আমি। আন্টি হেসে দরোজা থেকে সরে গিয়ে বাসায় যাওয়ার জায়গা করে দিলেন।
– আন্টি প্রিয়ন্তি কোথায়?
– ওর রুমেই আছে।
প্রিয়ন্তির রুমের দিকে পা বাড়ালাম। মনে রাজ্যের প্রশ্ন। হঠাত্ আমাকে দেখে প্রিয়ন্তি কিছু ভাববে না তো?
প্রিয়ন্তির রুমে ঢুকে তাকে দেখে অবাক হলাম খুব । চেহারা বিধ্বস্থ, রাতে ঘুম হয়নি তা দেখে বুঝে নেয়া যায় । চোখের নিচে কালি জমেছে । আমাকে দেখে উঠে বসল শোয়া থেকে ।
– কি খবর তোর? কন্ঠস্বর যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে জানতে চাইলাম।
– ভালো !
ভ্রুর কুচকে তাকালাম আমি। প্রিয়ন্তি কিছু না বলে উঠে বারান্দায় গেলো । পিছু পিছু আমি উঠলাম প্রিয়ন্তির সাথে।
হুট করে আসা মানুষগুলো হুট করে হারিয়ে যায়। রুদ্রের সাথে করা বিচ্ছেদের গল্প প্রিয়ন্তির মুখ থেকে শোনার পর আমার কেনো যেন একটুও কষ্ট হচ্ছিল না। বলার পর চুপ হয়ে গেল প্রিয়ন্তি।
বারান্দায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা দুজন। কেউ কারো সাথে কথা বলছিলাম না। কিসের যেন জড়তা । একটা সময় নিরবতা ভাঙ্গল প্রিয়ন্তির কান্নার শব্দে। প্রিয়ন্তিকে সেবার ঐভাবে কাঁদতে দেখে ভেতরটা হুহু করে কেঁদে উঠল। কেন জানি না, প্রিয়ন্তির হাতটি স্পর্শ করলাম। প্রিয়ন্তি তখনো কাঁদছিল।
আকাশে কোথায় যেন মেঘ গর্জন তুলে ডাকল । আমি চমকে তাকালাম । প্রিয়ন্তি আমার পাশে বসা, দুটো সময়ের মাঝে প্রিয়ন্তির এখন বিস্তর তফাত্ । সেদিনের মতো আমার হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে প্রিয়ন্তির হাত স্পর্শ করি। অনুভুতিটা ভিন্ন একেবারে!
ঐদিনটার পর প্রিয়ন্তির সাথে দিনগুলো যেন স্কুলে কাটানো প্রিয় দিনগুলোর মতো । পুরোটা কলেজ ঘুড়ে বেড়াতাম আমরা। কলেজ গেইটে দাঁড়িয়ে থাকতাম আমার পাগলী প্রিয়ন্তির জন্য। একই সাথে ক্লাসে যেতাম দুজন। ক্লাসে শান্ত ছেলেটা হঠাত্ বাকপটু হয়ে গেলো। প্রিয়ন্তি আমার করা ছোটছোট পাগলামো দেখে অবাক হাসতো । এত কিছুর পরেও প্রিয়ন্তিকে বুঝতে দেইনি তাকে নিয়ে আমার ছোট্ট একটি রাজ্য আছে যার পুরোটা জুড়ে সে।
অভ্র আইসক্রিম খাবো !
সিআরবির রাস্তা ঘেষে হাটছিলাম। গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে মৃদু বাতাস শীত করছে । এর মাঝে প্রিয়ন্তির কথায় ভাবনা থেকে ফিরে হাসলাম। হাসির পিছনে কারন ছিলো ।
কলেজ গন্ডি পেরিয়ে তখন ভার্সেটিতে উঠেছি। এক সকালে প্রিয়ন্তি জ্বর নিয়ে ক্যাম্পাসে এলো। প্রিয়ন্তি ক্যাম্পাসে আসার পর ঝুম বৃষ্টি নামলো। প্রিয়ন্তি বসে ছিলো বারান্দায়। আমি বাহিরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে। প্রিয়ন্তি তাঁকিয়ে ছিলো মন খারাপ করে। সত্যি বলতে কি, আমি প্রিয়ন্তিকে জ্বালাতে বৃষ্টিতে ভিজছিলাম। একটা সময় প্রিয়ন্তি আর না পেরে উঠে এলো।
– কি রে তুই বৃষ্টিতে কেন?
– তোর সাথে ভিজব অভ্র ,
– তোর জ্বর , যা এখান থেকে ।
প্রিয়ন্তি রাগী রাগী চেহারায় তাকাল । আমি চুপ হতেই হাসল প্রিয়ন্তি। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজলাম খুব। মাঝ পথে আইসক্রিম দেখে , নিলাম । সেইদিন ঝুম বৃষ্টিতে জ্বর নিয়ে আইসক্রিম খাওয়া পাগলী মেয়েটার চেহারার উচ্ছ্বাসটা আমার আজো চোখে ভাসে।
অভ্র , বলছি আইসক্রিম খাবো।
আমি হেসে কথা না বাড়িয়ে আইসক্রিম নিলাম। কোথায় যেন বাজ পড়ে ঝুম বৃষ্টি নামল। সে বৃষ্টিতে হাসছিলাম দুজন দুজনের পাগলামো । প্রিয়ন্তির হাসির দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, হাসির পিছনে কতশত গল্প থাকে। প্রতরণার গল্প, ভালো লাগার গল্প , বিরহের গল্প আর? কিছু ভালোবাসার গল্প।
৩
রিক্সায় করে যখন বাড়ি ফিরছিলাম তখন ভিজে চুপসে গেছি। বাসায় এসে ঢুকতেই প্রিয়ন্তি হাঁচি দিলো। কি মনে করে যেন হাসলাম দুজন।
– আজ তোমার সারপ্রাইজড শেষ হলো অভ্র?
– উহু! বলে এপাশ ওপাশ মাথা দুলালাম আমি।
সারপ্রাইজড এখনো শেষ হয়নি। আরো অনেকটাই বাকি।
– আরো কিছু আছে? অবাক হয়ে জানতে চায় প্রিয়ন্তি। আমি মুচকি হাসি।
– বলো অভ্র। প্রিয়ন্তির চেহারায় বিষ্ময় ।
– উপরে যা রাখা আছে, তা ঠিক সেইভাবে পরে তৈরী হয়ে এসো। প্রিয়ন্তিকে বলে অন্য রুমে চলে এলাম আমি । প্রিয়ন্তি তখন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ।
আজ এই রুমটিতে পুরোটা লাল। প্রত্যেকটা ক্যান্ডেলের রঙ ও লাল। চারপাশে ক্যান্ডেলের মাঝে ছোট একটা টেবিলে খাবার সাজানো । প্রিয়ন্তির এই আবহাওয়াটা খুব পছন্দের।
প্রিয়ন্তি তার একটি জন্মদিন কখনো ভুলবে না । তার জন্মদিনে এমন ই করে সারপ্রাইজড দিয়েছিলাম। আমার দেয়া গিফট ছিলো ছোট্ট একটা ডায়েরী। প্রিয়ন্তি জুড়ে গল্প
একটা সময় মনে হলো প্রিয়ন্তিকে ভালোবাসার কথা বলা দরকার। প্রিয়ন্তি যেদিন ডায়িরীটা পড়ে নিয়ে এলো পড়নে ছিলো লাল শাড়ি কপালে লাল টিপ। খুব মায়াবী লাগছিল তাকে। আমাকে দেখে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল-
– এতটা ভালোবাসিস? আমি শুধু হেসেছিলাম।
সেদিন প্রিয়ন্তির দেয়া থাপ্পর দেয়ার কথা মনে পড়লে আমার আজও হাসি পাই । প্রিয়ন্তিকে সেইদিন গভীর ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরেছিলাম। মনে পড়ে সেইদিন রাতে খুব কেঁদেছিলাম, যদিও কান্নার কারণটা খুশির। আমি দুইবার কেঁদেছি এমন । একবার সেইদিন আর শেষবারেরটা গতকাল রাতে। আমি আর কাঁদবনা।
প্রিয়ন্তি যখন রুমে ঢুকল তখন রুমের চারদিকে মোমের আলো। সেই আলোয় আমি স্বর্গ থেকে নেমে আসা এক অপ্সরীকে দেথেছিলাম, আমার প্রিয়ন্তি।
লাল শাড়িতে প্রিয়ন্তিকে মানিয়েছে খুব। কপালে ছোট্ট লাল টিপ। এইবার প্রিয়ন্তি বসানো টিপ নিয়ে অভিযোগ নেই । চোখে হালকা কাজল দেয়া। গোলাপী ঠোঁটের উপর তিলটা তার সৌন্দর্য্য বাড়িয়ে দিচ্ছিল। খোলা চুলে ঘ্রানে আমি হারাচ্ছিলাম কোথায় যেন। আমি সামনে এগিয়ে গিয়ে প্রিয়ন্তির হাত ধরলাম, বাড়িয়ে দিলো সে ।
– অভ্র! তুমি পাগল হয়ে গেছ?
– বউয়ের জন্য পাগল হয়েছি পরকীয়া তো করছিনা? চোখ টিপে বললাম আমি। হাসল প্রিয়ন্তি। আমি প্রিয়ন্তির দিকে ওয়াইনের গ্লাসটি এগিয়ে দেই। প্রিয়ন্তি হাত বাড়িয়ে নেই সেটি।
– প্রিয়ন্তি
– বলো
– আজ কেনো এতো কিছু করলাম বলো তো।
প্রিয়ন্তি কিছুক্ষণ চুপ হয়ে থাকে। কিছুতে মনে করতে পারে না।
– কেনো?
প্রিয়ন্তির পাল্টা প্রশ্নে হাসলাম আমি। মোটেও অবাক হয়নি।
– প্রিয়ন্তি , দিনটি অনেক স্পেশাল। মাথায় ছোটছোট বেণী করে আসা মেয়েটির পিছু পিছু নিয়ে ছিলাম এইদিনটিতে। ঝুম বৃষ্টিতে এই দিনেই ভিজেছিলাম প্রথম। ভালোবাসি বলার পরে এইদিনে চড় মেরে বুকে জড়িয়েছিলে আমাকে ।
প্রিয়ন্তি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে । আমি ম্লান হাসলাম। প্রিয়ন্তির হাত ধরে পাশে থাকা সোফায় বসলাম। সামনে এলইডি স্ক্রিন প্রিয়ন্তি আর আমার ছবি একে একে ভাসছে । সেই ছোট্ট থেকে আজ অবদি। সেই ছোট্ট রাজ্যের গল্পের টুকরো স্মৃতি গুলো। প্রিয়ন্তি স্মৃতিগুলোর দিকে অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে ওয়াইনে চুমুক দিতে থাকলো। আমি তাকিয়ে থাকি প্রিয়ন্তির দিকে। প্রিয়ন্তির চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো ধিরে ধিরে। ঘুমে লুটিয়ে পড়ার আগে সেই ঘুমন্ত মায়াবী চেহারাটির দিকে আমি শেষবারের মতো গভীর ভালোবাসা নিয়ে তাকালাম।
৪
প্রিয়ন্তির মাথে দুলছে । বুঝলাম জ্ঞান ফিরছে তার । রুমে তখন দরজা সব বন্ধ শুধু পূর্ব দিকের জানালাটি ছাড়া। আকাশ দেখে বোঝার উপায় নেই আজ সারারাত বৃষ্টি হয়েছিল।
প্রিয়ন্তির হাত আর পা দুটো শক্ত করে বাধা আছে চেয়ারটিতে। সে যেদিকে বসে আছে তার সামনে ড্রেসিং টেবিল। সে চোখ খুলে পরিস্থিতি বুঝতে কিছুটা সময় নিলো। ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। অস্ফুট কন্ঠস্বর ভেসে এলো কানে। সে স্বরে ভয় মিশ্রিত। প্রিয়ন্তির কন্ঠস্বর কাঁপছে ।
প্রিয়ন্তির দিকে তাকালাম আমি। প্রিয়ন্তির সে কালো চুল গুলো আগের মতো সুন্দর দেখাচ্ছে না। ছোটছোট কাটছাট চুলে ভয়ংকর লাগছিল প্রিয়ন্তিকে।
– ইশশশশশ! শব্দ করো না প্রিয়ন্তি। শান্ত হও।
প্রিয়ন্তির আয়নায় নিজেকে দেখছে তখনো। বুঝে উঠতে পারছে না কি হতে যাচ্ছে তার সাথে ।
– কেমন দেখাচ্ছে প্রিয়ন্তি? প্রিয়ন্তির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি। প্রিয়ন্তি তাকিয়ে রইল। সে দৃষ্টিতে যথেষ্ট ভয় দেখতে পাচ্ছি আমি ।
টিভি স্ক্রিনে তখনো আমাদের ছবি গুলো চলছিল। সেগুলো অফ করলাম আমি। দেখতে বিরক্ত লাগছে ।
– ছবি গুলো বড্ড বেশি বিরক্তর তাই না প্রিয়ন্তি? প্রিয়ন্তি কিছু বলল না ।
– তোমার পছন্দের কিছু ছবি দেখবে প্রিয়ন্তি?? তাকে চুপ করে থাকতে দেখে বললাম আমি।
টিভি স্ক্রিনে তখন নতুন ছবি ভাসছে । অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে প্রিয়ন্তি। আমি প্রিয়ন্তির পাশে ইজি চেয়ারে বসে দুলছি ।
টিভি স্ক্রিনে প্রিয়ন্তি আর রুদ্রের ছবি। ঘনিষ্ট দুজনের চেহারায় হাসি। রুদ্রের বাহুতে প্রিয়ন্তিকে দেখে আমার কষ্ট হচ্ছিল না কেন যেন ।
ছবি গুলো প্লে হচ্ছে একের পর এক। প্রিয়ন্তির দৃষ্টি তখন নিচে। কাঁদছিল সে। সে কান্নার অশ্রু কোন অনুভুতি জন্মাতে পারেনি আমার ।
আমি ইজি চেয়ার থেকে উঠে প্রিয়ন্তির সামনে হাটু গেড়ে বসলাম। সমস্ত শক্তি দিয়ে ডান হাত ধরে তাকালাম তার দিকে।
– লজ্জার কিছু নেই প্রিয়ন্তি। দেখছনা তুমি? চিত্কার দিয়ে বলি আমি। প্রিয়ন্তি তখন কাঁদতে থাকে । কন্ঠে অস্ফুট স্যরি বের হয়ে আসে । স্বজোড়ে আঘাত করি আমি। প্রিয়ন্তির ঠোঁট ফেটে রক্ত ঝড়ে ।
প্রিয়ন্তির সাথে রুদ্রের পরিচয় ফের হুট করে। যেদিন প্রথম বুঝলাম প্রিয়ন্তির মোবাইলে রুদ্রের ফোন বিন্দুমাত্র বিচলিত হইনি আমি। বিশ্বাস ছিলো , খুব বিশ্বাস ছিলো।
– প্রিয়ন্তি , পৃথিবীতে জঘন্যতম অপরাধ কোনটি জানো?
প্রিয়ন্তিকে প্রশ্নটি করি আমি। প্রিয়ন্তি দুই হাতে জোড় দিয়ে ছুটার চেষ্টা করে। চুল ধরে হেচকা টানে আমার দিকে ফেরায় প্রিয়ন্তিকে। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে যায় প্রিয়ন্তি। তাতে আজ শুধু ঘৃণায় দেখতে পাবে সে ।
– রুদ্রের সাথে কতবার বিছানায় গিয়েছ প্রিয়ন্তি?
কথাটি বলতে আটকায় এটুকুও । টিভিস্ক্রিনে তখন রুদ্র আর প্রিয়ন্তির কন্ঠস্বর ভাসছে । কি বলে যেন হাসছিল দুজন। প্রিয়ন্তির হাসির দিকে চোখ যায়। একটাবারের জন্য সে হাসিটির জন্য মায়া জন্মায় নিই ।
– এমন কেন করলে?
– আমার ভুল হয়েছে অভ্র ! প্লিজ ক্ষমা করে দাও।
“ক্ষমা” শব্দটি খুব বিশ্রী শোনায়। প্রিয়ন্তির ঠোঁটের উপর তিলটির দিকে চোখ আটকে যায় আমার। এই তিলটি না থাকলে প্রিয়ন্তি হাসির মায়ায় কেউ আটকাবেনা।
আমার হাতে প্লাস দেখে প্রিয়ন্তির চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে আসে। কি করতে যাচ্ছি আমি, বুঝেছ যেন। হাত দুটো ছাড়াতে নাড়াচাড়া করে পরক্ষণে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে যায়। আমার প্রিয়ন্তির পিছে গিয়ে কানে পাশে মুখ নেই।
– প্রিয়ন্তি তোমার স্কুলে সেই ফেস্টিবলের কথা মনে পড়ে? খোপায় দেয়া ফুলের মালা চুড়ি হয়ে যাওয়ায় কেঁদেছিলে? ঘামে ল্যাপ্টে থাকা শরীরে যখন নতুন ফুলের মালা খোপায় পড়ানোর পরের হাসিটি?
প্রিয়ন্তি গুজড়ে কাঁদতে থাকে। নিজের ভুল বুঝতে পারে যেন। আমার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরে। সেই অশ্রু পুরোটায় ঘৃনা ভরা।
– তোমার ঠোটের উপরের তিলটি তোমার হাসিতে মায়ায় ছড়িয়ে দেয়। আমি সে মায়া থেকে কখনো বের হতে পারিনি।
প্রিয়ন্তির তিলে প্লাস বসিয়ে টান দিতেই উঠে এলো। ঠোট দুটো লাল রক্তে চুপসে গেছে। প্রিয়ন্তির চিত্কার দিয়ে থেমে যায়। কাঁদার শক্তি হারায় যেন। এটুকুও কষ্ট লাগছে না আমার। চেয়ার সামনে এনে তাঁকিয়ে থাকি প্রিয়ন্তির দিকে।
– খুব কষ্ট লাগছে প্রিয়ন্তি?? আমার তেমন কষ্ট হয়েছিল জানো? তোমার ভিতরে কখনো রক্তক্ষরণ হয়েছে? তোমার এই ব্যাথা থেকেও তীব্র সেই ব্যাথা!
প্রিয়ন্তি ধীরে ধীরে মাথা তোলার চেষ্টা করে । লাল শাড়ি বেয়ে রক্তের ফোটে বৃষ্টি ভেজা কদম ফুলে পড়ে । আমি হাত বাড়িয়ে সেটি তুলে নেই।
– প্রিয়ন্তি , তোমার মনে আছে স্কুল ফাঁকি দিয়ে তোমার জন্য কদম পেরেছিলাম? হাতে ছিলে রক্ত ঝড়ছিল আমার? তুমি সাদা রুমালে বেধে দিয়েছিলে সে হাত? কান্না আটকিয়ে বলি কথাগুলো প্রিয়ন্তি কিছু বলছে না।
আমি ডান পকেট থেকে সেই দিনের রুমালটি বের করি। এতবছর পরেও যত্ন করে রেখে দিয়েছি সেটি। আমার হাতে সেটি দেখে কেঁদে দেয় প্রিয়ন্তি। এটুকু মায়া হয়না আমার । আমি ঐ রুমাল দিয়ে তার ক্ষত স্থানে চেপে ধরি। পরক্ষণে সরিয়ে নিয়ে চড় বসায় প্রিয়ন্তির গালে। প্রিয়ন্তির প্রতি মায়া বোকা বানিয়ে রেখেছিল আমাকে ।
প্রিয়ন্তি আর রুদ্রের ছবি যেদিন পেলাম , প্রিয়ন্তির ঘুমন্ত চেহার দিকে তাকিয়ে ছিলাম সারারাত। প্রিয়ন্তির মায়ভরা চেহারার পিছনের দিকটি মিলাতে পারছিলাম না ।
প্রিয়ন্তির ফোনের দিকে তাকিয়ে চোখ আটকে যায় । হাত বাড়িয়ে নেই সেটি। সকালে প্রিয়ন্তির তোলা ছবি গুলো রুদ্রকে পাঠিয়ে রেখেছে সে। সকালে দেখে বুঝেছিলাম প্রিয়ন্তির চেহারায় অস্বস্তি দেখে
– প্রিয়ন্তি তোমাকে দেখার অধিকার অন্যকে কেন দিলে? ঐ অধিকার তো শুধু আমার। প্রিয়ন্তির হাত ধরি আমি। প্রিয়ন্তির হাত ছাড়ার চেষ্টা করে।
হাতে থাকা প্লাস দিয়ে প্রিয়ন্তির ডান হাতে বৃদ্ধা আংগুলে নোখে বসিয়ে হেচকা টান দেয় । রক্ত বের হয়ে আসে। চিত্কার দেয় প্রিয়ন্তি।
নখটা খুলে প্লার্সের সাথে চলে এসেছে। গোড়ার কাছে থেকে শেকড় পর্যন্ত উপড়ে গেছে। একটু একটু লাফাচ্ছে আঙুলটা। প্লার্সের সঙ্গে লাগানো নখটা একবার দেখলাম। নেইলপলিশের লালে মিশে যাওয়া অন্যরকম লাল। অদ্ভুত মায়াবী রঙ। ঘরের সঙ্গে মানিয়ে গেছে একেবারে।
প্রিয়ন্তির চিৎকারে ঘরে টেকা যাবে না মনে হচ্ছে। আরেকবার থাপ্পড় মারলাম, শুধুমাত্র ওর মুখ বন্ধ করানোর জন্য। আমার কথা এখনও শেষ হয়নি। কথা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত মেয়েটাকে শান্ত রাখতে হবে। এখনও কিছুই দেখেনি সে, অবাক হওয়ার মতো কিচ্ছুটি না। আমার গল্প বলা এখনও শেষ হয়নি যে!
– কই, বললে না যে। ওর দিকে তাকিয়ে বললাম। পৃথিবীতে জঘন্য অপরাধ কোনটা?
শেষ মারটা খাওয়ার পর থেকে প্রিয়ন্তি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে শব্দ বন্ধ করার চেষ্টা করছে। অস্ফূট গোঙ্গানি তবুও বের হয়ে আসছে বার বার। আয়নায় নিজের চেহারাটা সে দেখতে পাচ্ছে। বাজি ধরে বলতে পারি ওই চেহারা দেখার ইচ্ছে ওর হচ্ছে না। তবে দেখতে হচ্ছে। দেখতে হবেও। যতক্ষণ না অন্য কিছু করার অনুমতি দেব আমি।
রুদ্রের সঙ্গে তোমার আবারও মিল হয়েছে সেটা আমাকে বললেও পারতে, প্রিয়ন্তি। বললাম তাকে। তারপর নিজের প্রশ্নটা উত্তর নিজেই দিলাম, পৃথিবীর জঘন্যতম অপরাধ একজন মানুষের বিশ্বাস নিয়ে খেলা করা।
প্রিয়ন্তি কোন কথা বললো না। গোঙ্গানির আওয়াজ বেড়ে যাচ্ছে। আরেকবার হাত তুললাম। নিমেষে থেমে গেলো শব্দটা। ম্যাজিক যেন! হাসি পেল আমার। হা হা করে হেসে ফেললাম। প্রিয়ন্তির চোখে এখন যন্ত্রণা, ভয়। ভয়ের পরিমাণটা যন্ত্রণা থেকে কয়েকগুণে বেশি।
আমাকে যদি বলতে, আমি তোমাকে যেতে দিতাম। তোমার সুখই আমার সবকিছু ছিল, প্রিয়ন্তি; একসময়। মনে নেই, স্কুলের পাট চুকিয়ে তোমার থেকে সরে আসতে চেয়েছিলাম? আমি কাজটা আরেকবার করতে পারতাম। তুমি রুদ্রের সাথে থাকতে চাইলে আমি আটকাব কেন?
প্রিয়ন্তি কিছু বলছে না। বোবা বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে।
– তুমি তা করলে না। আমার সাথে এক ছাদে থেকে আমাকেই ঠকালে। বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি কি জান তো?
– প্লিজ… কাঁদতে কাঁদতে উচ্চারণ করল আমার একসময়ের ভালবাসা। আমাকে ছেড়ে দাও, প্লিজ!
– তোমার জন্য আরেকটা চমক বাকি থেকে গেছে যে, দেখবে না? যেতে চাইছ কেন? এসো আমার সাথে।।
চেয়ারের সঙ্গে নিজেকে নিয়ে টানাহ্যাচড়া করছে এখন আমার স্ত্রী। পালিয়ে যেতে চাইছে আমার কাছ থেকে; দূরে। কেন সে পালিয়ে যেতে চাইছে?
চেয়ারের পেছন দিকটা ধরে ঠেলা দিলাম। মেঝের সাথে বিদঘুটে শব্দ করে হেঁচড়ে চলল চেয়ারটা।
বাথরুমের চৌকাঠটা তিন ইঞ্চি উঁচু। ওখানটা পার করার জন্য প্রথমে চেয়ারের সামনের দুই পা ঢোকাতে হলো। তারপর পেছনের দু’পা। প্রিয়ন্তির চিৎকার এখন বাথরুমের ছোট্ট গণ্ডিতে প্রতিধ্বনী তুলছে। আরেকবার হাত তুলতেই থেমে গেল ওই চিৎকার। নাকি সামনের দৃশ্যটা দেখে? আমি নিশ্চিত হতে পারলাম না। এতদিন ওর সাথে প্রেম করেও এই ব্যাপারটা আমি আজও নিশ্চিত হতে পারিনি।
প্রিয়ন্তি বাথটাবের দিকে তাকিয়ে আছে। তামার বাথটাবটা ওর প্রিয় ছিল খুব। গোসল করতো লম্বা সময় নিয়ে। কতদিন ওর সাথে আমিও নেমেছি এখানে। দু’জনে যতটা না গোসল করেছি তার চেয়ে বেশি করেছি খুনসুটি। আজ প্রিয়ন্তির মুখে বাথটাব দেখে হাসি ফুটছে না। মেঝেতে রাখা বড় দুটো ড্রামই এর কারণ।
একটা ড্রামের মুখ খুললাম আমি।
– হাউড্রফ্লুরিক এসিড, প্রিয়ন্তি। দাম অনেক।
– অভ্র, কাজটা কর না। অভ্র প্লিজ।
একদম সুস্থ মানুষের মত কথা বলছে, এখন সে। মৃত্যুভয় তাকে জাকিয়ে ধরেছে একেবারে।
– এই এসিডের দুটো বৈশিষ্ট্য আছে। শুনবে প্রিয়ন্তি?
– অভ্র, প্লিজ, শান্ত হও। আমাকে ছেড়ে দাও। হাত খুলে দাও আমার। আমি কাওকে বলব না আজকের কথা।
– এক. প্লাস্টিকের সাথে এই এসিড বিক্রিয়া করে না। আর করে না তামার সাথে। যেমন আমাদের বাথটাব। বিক্রিয়া করবে না এটা এই টাবের সাথে।
– অভ্র, আমি বলব রান্নাঘরে খুব খারাপ অ্যাকসিডেন্ট করে এমনটা হয়েছে। আমি বলব এটা। প্লিজ…
– দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটা শোন তাহলে। এই এসিড মানুষের হাড়কে পুরোপুরি দ্রবীভূত করে ফেলে। পুরোপুরি। একটা কণাও অবশিষ্ট থাকে না এতে ডুবে গেলে। পানি হয়ে যায়। মানে, পানির মতো আরকি।
ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল প্রিয়ন্তি। এতক্ষণও কাঁদছিল, তবে চোখের পানির বেগ আরও বেড়ে গেছে হঠাত করে!
– রুদ্রের সাথে আমি আর যোগাযোগ রাখব না, আমার মায়ের কসম, অভ্র। অভ্র…
ঘুষিটা খুব জোরে মারলাম। নাকের হাড় ভাঙ্গার শব্দ পরিষ্কার কানে এল। একেবারে মাথার ভেতর ঢুকে গেছে যেন নাকটা। বিচ্ছিরি ভঙ্গিতে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। মুখ থেকে দমকে রক্ত বের হয়ে এল ওর।
– মা … মা গো-
আর্তচিৎকার দিচ্ছে প্রিয়ন্তি, ওর দেহটা দুলছে ফলা তোলা সাপের মত, বাথরুমের ভেতর থেকে বের হয়ে গেলাম আমি। বেডরুম থেকে ওর ফোনটা নিয়ে বের হয়ে আসলাম আবার।
এখনও সমানে চিৎকার দিচ্ছে সে। আল্লাহকে ডাকছে, মাকে ডাকছে। সে মনে হয় জানেও না কাকে কাকে ডাকছে এখন। যন্ত্রণা ওকে পাগল করে দিয়েছে।
– এই যে রুদ্রের নাম্বার। আমি এখন ওকে একটা মেসেজ দেব।
প্রিয়ন্তির চিৎকার থেমে গেছে। আমার অন্য হাতে একটা ছুরি ধরা।
-তোমার জন্য আনিনি আমি এটা। অভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে বললাম, মেসেজ টাইপ করছি এক হাতে। “অভ্র আজ রাতে থাকছে না। আসবে তুমি?” – উচ্চারণ করলাম মেসেজটা।
– আহ…
কিছু বলতেই পারছে না অকর্মণ্য মেয়েটা।
– আসবে ও। তোমার শরীরে একবার অভ্যস্ত হলে কেউ সেটা এড়াতে পারবে না। আমি জানি ও আসবে।
– অভ্র রে…
ওর পেছনে দাঁড়িয়ে দুই পোঁচে দড়ি দুটো কেটে ফেললাম।
চমকে আরেকটা চিৎকার দিল সে। গলা ভেঙ্গে গেছে। এটা হল একটা ভাঙ্গা গলার চিৎকার।
পরমুহূর্তে একটা ধাক্কা দিলাম। একটু জোরেই।
ধাক্কা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাথরুম থেকে বের হয়ে এসেছি।
ছলাত করে শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসিডের যে ফোঁটাগুলো ছিটকে বের হল, তারা আমার শরীরটা নাগালে পেল না।
শিস বাজাতে বাজাতে এগিয়ে যাচ্ছি ড্রউং রুমের দিকে। কয়েক মিনিট খেলা দেখবো। আজকে ব্রাজিলের সাথে উরুগুয়ের ম্যাচ আছে।
পেছনে আর কোন চিৎকার শোনা যাচ্ছে না।
৫
প্রিয়ন্তির মা আমার হাত ধরে কাঁদছে খুব। কান্না ধরে রাখতে পারছি না আমিও। বাসা ভর্তি মানুষ। একজন পুলিশও আছে। সে আমার থেকে একটু আগে ইন্টারভিউ নিয়েছে। বিষণ্ণ মুখে ইন্টারভিউ দেওয়ার এক পর্যায়ে কেঁদেও ফেলেছি। সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকিয়েছে পুলিশ অফিসার। লোকটার নাম রায়হান। যথেষ্ট ভদ্র একজন মানুষ। বাড়ি ঢুঁড়ে আলামত খুঁজেছে বটে, তবে পায়নি কিছুই। সেজন্যও ভদ্রতা দেখাতে পারে।
.
বন্ধুদের অনেকে এসেছে। ওরা আমার ব্যাপারটা পুরোপুরিই জানে। স্কুল থেকে ওদের চোখের সামনেই তো প্রিয়ন্তির জন্য কত পাগলামি করেছি। আমাকে শক্ত হতে বলছে কেউ। সাহস যোগাচ্ছে। কেউ কেউ প্রিয়ন্তিকে খুঁজে এনে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করছে। কেউ কেউ উদাহরণ দিচ্ছে আরও অনেকের। যারা এমন পরিস্থিতিতে পড়েছিল কিন্তু পরে সংসার করেছে বহুদিন, সুখে।
আমি তাদের কথা শোনার ভান করে যাচ্ছিন
বৃষ্টি পড়ছে।
রাস্তায় নেমে একটা সিগারেট ধরাল রায়হান।
ওপরতলার ভদ্রলোকের জন্য মায়া হচ্ছে তার। লোকটা একেবারে সহজ সরল। ক্লাস সিক্স থেকে নাকি মেয়েটার পেছনে পড়ে ছিল। এ যুগে কয়জন করে?
হতাশায় মাথা নাড়ল রায়হান।
সহজ সরল হবে এতে আশ্চর্যের কি?
সহজ সরল মানুষ ছাড়া আর কার বউ পুরানো প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে যায়?
গল্পশেষে সহজ সরলেরা কদাচিৎ জেতে। এটা সেই কদাচিৎ-এর মধ্যে পড়া কোন ঘটনা না।
রায়হান জানত না, তার ধারণা সঠিক নয়।
(সমাপ্ত)
অভয় হলে, ভৌতিক গল্প ‘নীরু’ পড়ুন >> নীরু – মাহমুদা মিনি।
গল্পশেষে । লেখক পরিচিতি । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প
লেখকঃ আশরাফ মামুন
ছোটগল্পঃ গল্পশেষে গল্পের
জনরাঃ রোমান্স, সাইকো থ্রিলার।
দেশের বাড়িঃ চট্টগ্রাম
পড়াশোনাঃ BSC In EEE (graduated), ২০১৯।
লেখকের কথাঃ আমার কাছে লেখালেখি বিষয়টি নিয়ে আগ্রহ জন্মেছিল যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। প্রথম বই ছিলো হুমায়ুন আহমেদ স্যারের একটি বই। ধিরে ধিরে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ জন্মে। শৈশবে গরমের দিনে কাথা গায়ে দিয়ে ছোট টচ জ্বালিয়ে আম্মুর ভয়ে তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা পড়তাম। মার ও খেয়েছি। বড় হতে হতে যখন অনেক লেখকের লেখনীর সাথে পরিচয় ঘটল তখন মনে হলো আমি কি লিখতে পারি? সেই ভাবনা থেকে লেখালেখির শুরু। আমার প্রথম ছোট গল্পের নাম “মা”। লেখালেখিটা আমার অনেকটা ডিপ্রেশন কিলার হিসেবে কাজ করে৷ যখন আমি লিখার জগতে ঢুকি তখন বাহিরের অন্য কিছুই টানে না। মানুষের মনে আমার লেখার মাঝে যদি আমার নামের কিঞ্চিচ ছাপ রাখতে পারি তাহলে আমি মনে করি সেটাই আমার স্বার্থকতা। লেখনীতে ভুল পেলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পড়ুন, নিজে লেখুন৷ অন্যদের উৎসাহ দিন