বেদনা বিধুর >> আরাফাত তন্ময় (বুনোহাঁস) । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প
আরাফাত তন্ময়ের (বুনোহাঁস) লেখা ‘বেদনা বিধুর‘ সামাজিক ছোটগল্পটি আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প প্রতিযোগিতা – ০২ এ চতুর্থ স্থান অর্জন করে এবং পুরষ্কার হিসেবে আহমেদ ছফা রচিত ‘ওঙ্কার‘ উপন্যাসটি জিতে নেয়।
চৈত্রের দুপুর, প্রচণ্ড গরম পড়ছে। উপজেলার পাশে অবস্থিত এলাকার একমাত্র স্বনামধন্য রেল ষ্টেশনটি। ষ্টেশনের পাশের ভাগাড়ে একজন সুশ্রী মহিলা সবেমাত্র একটি ব্যাগ ফেলে গেলেন। খাবারের অবশিষ্টাংশ! মাতাল করে দেয়া বিরিয়ানির ঘ্রাণ। খানিক অপেক্ষা না করেই ব্যাগটি কুড়িয়ে নিজের করে নিলো হেম। রাফায়াত হাসনান হেম, নামটি মা-বাবার দেয়া নয়। সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন দুই বছর আগে এখানে এসেছিলেন ষ্টেশন মাস্টার হয়ে। তিনিই বোবা ছেলেটির নাম দিয়েছিলেন। বলেছিলেন হেম শব্দের অর্থ স্বর্ণ। একটি বাল্যশিক্ষা বই কিনে হেমকে পড়তে শিখিয়েছিলেন তিনি। কথা বলতে না পারলেও হেমের ইন্দ্রিয়গত জ্ঞান মুহূর্তেই মানুষের মন মোহিত করে তুলতে যথেষ্ট। মাঝে মাঝে সে ভাবে, মন ভোলা পণ্ডিতের মতো ভাবে, ভাবে আর অবাক হয়। কেন যে মাস্টার মহাশয় তাকে স্বর্ণের সাথে তুলনা করে হেম নাম রাখলেন! অথচ কচু পাতার মতো দু’পয়সা দামই নেই তার জীবনের…
মহিলা যখন ব্যাগটি ফেলে গেলেন তখন হেমের সাথে আরও কিছু কুকুরেরও দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। তাই হেমকে কুড়িয়ে নিতে দেখে আর স্থির থাকতে পারলো না কুকুরের দল। শুরু করে দিলো দৌড়ানি। যদি ভয় পেয়ে হেম ব্যাগ ছেড়ে পালায়। কিন্তু হেম ছাড় দেয়ার পাত্র নয়। প্রতিনিয়ত তাকে কুকুরের সাথে দৌড় খেলে বিজয়ী হতে হয়। নতুবা খালি পেটেই থাকতে হবে। স্রষ্টার বিশাল এই ভবে অসহায়দের দিকে মুখ তুলে তাকানোর সময় যে অনেকেরই নেই। কোনো এক পুরুষের বীর্যের শত-কোটি শুক্রাণু নষ্ট হয়ে একটিমাত্র বিজয়ী ক্রোমোজোম নিষেক ঘটিয়েছিল অচেনা এক মহিলার ডিম্বাণু থেকে আসা ‘এক্স’ ক্রোমোজোমের সাথে। সেটি বৃদ্ধি পেয়েছিল সেই মহিলার জরায়ুতে। তার প্রতিফলন আজকের রাফায়াত হাসনান হেম। অথচ প্রকৃতির কি নিষ্ঠুর পরিহাস, নির্দোষ ছেলেটির নেই কোনো জন্ম পরিচয়! যার শুরুই হয়েছিল বিজয়ীর বেশে দিনশেষে সে এক পরাজিত সৈনিক। এই আক্ষেপের মর্ম বুঝানোর মতো শব্দ ধরার কোনো অভিধানে নেই।
কুকুরের দৌড়ানিতে অবশ্য খানিক লাভ হয় হেমের। ক্ষিপ্রতা বাড়ে। যা ফুটবল খেলায় অন্য সবের চেয়ে তাকে আলাদা করে রাখে। দৌড়াতে দৌড়াতে এক পর্যায়ে কুকুরগুলো হাল ছেড়ে অন্য পথ ধরে। হাঁপাতে হাঁপাতে তাড়াহুড়ো করে খেয়ে নেয় হেম। তারপর পেট ভরে অতৃপ্তির পানি খেয়ে তৃপ্তিজনক ঢেকুর তুলে প্রাকৃতিক নিয়মে। কিছুদিন আগে যখন রেল রাস্তার কাজ হয়েছিল তখন সে বড় কয়েক সাইজের পাথর উনাদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিল। পাথরগুলো দিয়ে সে একটি সিংহাসন বানায়। ভরা পূর্ণিমায় যখন চাঁদ রূপালী আলোয় আলোকিত করে পৃথিবী তখন পায়ের উপরে পা তুলে রাজার মতো করে সেখানে বসে হেম। তখন সেও একজন রাজ্যবিহীন রাজা!
মাঝারী সবচেয়ে সুন্দর পাথরটি বালিশ হিসেবে ব্যবহার করে সে। প্ল্যাটফর্ম থেকে খানিক দূরে নির্জন একটি জায়গায় থাকে হেম। কোলাহল তার কাছে খুবই বিরক্তিকর লাগে। যত সত্বর সম্ভব জন্মের পর তার অভিভাবক তাকে নির্জন কোনো জায়গায় ফেলে গিয়েছিল, কাজেই নির্জনতাকে আপন করে নিয়েছে সে। পাথরটি শিমুল তুলার কোমল বালিশের চেয়েও বেশি কাজে দেয় হেমের বেলায়। মাথা লাগালেই ঘুম চলে আসে।
পাঁচ মিনিটও হয়নি, রাফি এসে ডাকাডাকি শুরু করলো। আড়মোড় ভেঙে উঠে বসলো হেম। যেন অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে।
রাফি- কি রে, আজকে না বহরমপুর ক্লাবের সাথে খেলা আছে?
হেমের মুখশ্রী দেখে রাফি বুঝতে পারলো, যেন বলতে চাইছে,” ইশ রে খেলার কথা তো ভুলেই গেলাম!”
সেইদিন দুপুরবেলায় ট্রেন যখন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো, হেমের বয়সী একটি ছেলে খাবার খাওয়ার পর তার মা তাকে বললো, “একটু বিশ্রাম কর বাবা, দুপুরে খেয়ে বিশ্রাম করা শরীরের জন্য ভালো।”
হেমের মা থাকলে তাকে এখন কোনোভাবেই খেলতে যেতে দিতো না।
বিষণ্ণতা নেমে এলো তার মাঝে। অতঃপর রাফির কাঁধে হাত রেখে মাঠের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। পথিমধ্যে মাঝবয়সী একজন লোক সবার নিকট লিফলেট বিতরণ করছেন। মাঝে মাঝে কোমরে গুঁজে রাখা গামছা দিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়ন যুগল মুছে নিচ্ছেন। উৎসুক জনতার মতো হেম আগ বাড়িয়ে একটি লিফলেট নিলো। বড় অক্ষরে লেখা আছে ‘রক্ত দিন, জীবন বাঁচান’ আর বেশি কিছু সে বুঝতে পারলো না। মনস্থির করলো, বিকেলবেলা যখন মারিয়া পথ শিশুদের গান শেখাতে আসবে তখন তার কাছে জানতে চাইবে। মাস্টার মহাশয়ের পরে এই মারিয়াই হেমকে ভালোভাবে বুঝে। পরম যত্নে ভাঁজ করে লিফলেটখানি প্যান্টের পকেটে রাখলো সে।
ফুটবল খেলায় দলের হয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় খেলে হেম। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। বোবা হলেও তার অধিনায়ক বন্ধু রাফিকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে, সে তেইশ নম্বর জার্সি ছাড়া খেলার সময় তার শরীরে উদ্যম ঠিকমতো আসে না।
সুন্দর এবং গোছালো ফুটবল খেলা উপহার দিয়ে হেমের দল ৩-০ গোলে জয়লাভ করে। এর মধ্যে একটি গোল দেয়ার সময় অ্যাসিস্ট করেছিল সে। দলের প্রয়োজনে নিচে এসে বিপক্ষ দলকে দারুণভাবে ডিফেন্ড করেছিল। ফলপ্রসূ ম্যাচ সেরা পুরস্কার পেল। সম্মানী হিসেবে একশত পঞ্চাশ টাকা উপহার দিল কতৃপক্ষ। খুশি মনে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ষ্টেশনে পৌঁছালো সে। এর আগে দুইশ পঞ্চাশ গ্রাম আঙ্গুর কিনলো। সে শুনেছিল, আঙ্গুর খেলে নাকি রক্ত পরিষ্কার হয়।
মারিয়া ছেলে-মেয়েদের গান শেখাচ্ছে। অসাধারণ মিহি গলা তার! শুনে মন-প্রাণ জুড়িয়ে যায়। মারিয়ার গলায় গান শোনার সময় কেবল গান গাওয়ার তীব্র আগ্রহ জাগে হেমের। সেও শিখতে চায় গান। তার গান শুনে কারোর মন খারাপের কথা হারিয়ে যাবে হাজার তাঁরার ভিড়ে… দু’ফোঁটা অশ্রু তার গাল বেয়ে পড়লো।
হায়রে বিধির বিধান! ব্যথা পেলে ‘উহ্’ কিংবা তীব্র আনন্দে ‘আহা’ বলে প্রকাশ করতে পারে না হেম।
তার মন খারাপ দেখে মারিয়া এগিয়ে আসলো। হেমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মন খারাপের কথা জানতে চাইলো। নিশ্চুপ সে। মুখভঙ্গি দেখে মারিয়া বুঝতে পারলো তাকে কিছু বলতে চাইছে না। আসলেই তো, সুখের কথা সবাইকে বললে হাসিমুখে তা ভাগ করে নেয়। কিন্তু দুঃখের কথা বললে? চোখের পানি মুছে পলিথিন থেকে আঙ্গুর বের করে পথ শিশুদের মাঝে বিলি করলো হেম। ঘটনাটি চোখের সামনে ঘটতে দেখে ভাবনার অথৈ সাগরে ডুবে গেল মারিয়া। যাদের ঢের আছে তারা এসব দিকে ফিরেও তাকায় না। আর হেম? অল্পের মাঝেই ভাগ করে খেতে কত আনন্দ পায়!
মারিয়া তার পাশে এসে বসতেই পকেট থেকে লিফলেট বের করে দেখালো। জানতে চাইলো এটা কেন বিলি করা হচ্ছিল। মারিয়া পুরোটা পড়ে, সুন্দরভাবে তাকে বুঝিয়ে দিলো। লোকটার মেয়ে ভীষণ অসুস্থ, তাড়াতাড়ি এক ব্যাগ বি(+) রক্ত লাগবে। ঠিকানা দেয়া আছে রেলওয়ে হাসপাতাল। বি(+) শুনেই আনন্দে তার চোখ দুটো নেচে উঠলো। সেবার যখন একটি মানবাধিকার সংস্থা ষ্টেশনের পাশে ক্যাম্প করেছিল তখন বিনে পয়সায় অনেকের রক্ত গ্রুপ নির্ণয় করে দিয়েছিল। তখন লাইনে দাঁড়িয়ে অনেকের মতো নিজের রক্তের গ্রুপ সম্পর্কে জানতে পেরেছিল হেম। বি(+), তার রক্তের গ্রুপ বি(+)। স্পষ্ট মনে আছে। কি মনে করে দৌড়ে গেল তার থাকার জায়গায়। সেখান থেকে একটি কার্ড এনে মারিয়াকে দেখালো। মারিয়া দেখতে পেল রক্তের গ্রুপ বি(+) লেখা। নিচে মানবাধিকার সংস্থার সিল সাথে একজন কর্মীর সাক্ষর। আকারে ইঙ্গিতে হেম বুঝালো সে রক্ত দিতে আগ্রহী। শুনে মারিয়ার চোখ চড়কগাছে! আর কোনো কথা বলতে পারলো না মারিয়া। টের পেল তার ঠোঁট দুটো কাঁপছে…
হেম ধীরেসুস্থে হাসপাতালের দিকে হাঁটা শুরু করলো। মনে তার বিষম ভয়। অচেনা এক রাস্তার ছেলের কাছ থেকে তারা রক্ত নিবে তো? হাজারো সংশয় মনে নিয়ে হাসপাতালে উপস্থিত হলো সে। হাতে লিফলেট আর সেই কার্ড। মাঝবয়সী যে লোকের কাছ থেকে লিফলেট নিয়েছিল তিনি রাজ্যের ভাবনা-চিন্তা নিয়ে হাসপাতালের ফ্লোরে এলোমেলো হাঁটছেন। তার সামনে দাঁড়াতেই তিনি হেমের দু’হাত চেপে ধরে বললেন, বাবা আপনিই রক্ত দিবেন? যেন হেমের অপেক্ষায় ছিলেন। কিছু বুঝতে পারলো না সে। তখনও লোকটি জানতো না যে হেম কথা বলতে অপারগ। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে তিনি নাম জানতে চাইলেন। হেম একটি কলম নিয়ে কোনোরকম লিখে দিলো, রাফায়াত হাসনান হেম। তখন ডাক্তার এবং লোকটি বুঝতে পারলো ছেলেটি আসলে কথা বলতে পারে না। ডাক্তার সাহেব মিনিট খানেক আনমনে ভাবলেন। তারপর হেমের হাতে ধরে বুকে টেনে নিলেন। পরম উষ্ণতায় মন আনন্দে ভরে গেল তার। ডাক্তার সাহেব নার্সকে ডেকে হেমকে নিয়ে যেতে বললেন। আর পরীক্ষা করে দেখতে বললেন, তার রক্ত নেয়ার উপযোগী কিনা।
পাশের বেডে শুয়ে আছে রুগ্ন মেয়েটি। পিঠের সাথে লেগে আছে পেট। অপলকে তার দিকে তাকিয়ে আছে হেম। কোন ফাঁকে যে রক্ত নেয়া হয়ে গেল সে বুঝতেই পারলো না। ডাক্তার সাহেব ইশারা করলেন উঠে যেতে। বিছানা থেকে উঠতেই মাথা চক্কর দিলো তার। আবার বসে পড়লো। একজন নার্স একগ্লাস শরবত আর এক বোতল পানি দিয়ে গেল। শরবত পান করে পানির বোতল হাতে করে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসলো হেম। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে আসলো। আঙ্গুর কিনে পনেরো টাকা বেঁচেছিল। পকেটে হাত দিতেই টের পায় পাঁচ টাকার কয়েনটি নেই। ছেঁড়া পকেট থেকে পড়ে গিয়েছে। দশ টাকার লালা নোটখানা একবার নেড়ে-চেড়ে দেখলো। প্রাণ খুলে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো। হাসেম চাচার টঙ দোকানে গিয়ে একটি রুটি এক কাপ রঙ চায়ে ভিজিয়ে খেল। তারপর তিন গ্লাস পানি… রাতের খাবার ওই এতটুকুই।
খোলা আকাশের নিচে রেল লাইন ধরে হাঁটছে সে। যখন অনেকে ছোট ছিল তখন পাথরের উপর দিয়ে হাঁটতে বেশ কষ্ট হতো তার। এখন যেন তার পায়ের নিচে পড়তেই ভয় পায় পাথরগুলো। ভেঙে যাবার ভয়। মনে মনে হাসে হেম। খানিক পরেই হুইসেল বাজিয়ে রাতের ট্রেন চলে গেল পাশ কাটিয়ে। মুহূর্তেই জনশূন্য হয়ে পড়লো ষ্টেশন। কয়েকজন রেল কর্মচারী গাল-গপ্পে ব্যস্ত হয়ে পড়বে এখন। হেম যদি কথা বলতে পারতো তাহলে তাদের সাথে গিয়ে গলা মেলাতো। কথা বললে নাকি মন হালকা হয়। এতসব ভাবতে ভাবতে তার চোখ চলে জোনাকির দিকে। ভাবে, ইশ আমি যদি জোনাকি হতাম! তাহলে উড়ে যেতাম সেসব অন্ধকারে যেখানে…
আচমকা কোন দিক থেকে আসলো রাফি। এই মুহূর্তে তার আগমন ঠিক মেনে নিতে পারলো না হেম। খুব বিরক্তি প্রকাশ করলো। রাফি তার পিঠ চাপড়ে বললো, বন্ধু দারুণ একটা সুখবর আছে। অভিমানের সুরেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো হেম। রাফি তার হাত ধরে টেনে নিয়ে রেল লাইনের উপর বসলো। অনেকটা আনন্দ চেপে রেখে আস্তে আস্তে বললো, ”আগামীকাল সকালে একজন কোচ আসবেন বড় একটা ক্লাবের। ক্লাবটি জেলা পর্যায়ের একটি খেলায় ফাইনাল খেলবে। আমাদের এখানে থেকে বাছাই করে তিনজন খেলোয়াড় নিয়ে যাবেন ফাইনাল খেলাতে। নির্বাচিত তিনজন খেলোয়াড়কে তাদের খরচে জেলায় নিয়ে গিয়ে চার দিনের ট্রেনিং করাবে। সেই টুর্নামেন্ট বিজয়ী দল থেকে কিছু খেলোয়াড় জাতীয় লীগ খেলে এমন ক্লাবে নিয়ে যাওয়া হবে।”
তুই তৈরি থাকিস, আমরা দু’জনে একসাথেই যাবো। চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়ালো রাফি। খানিক গিয়ে পাছে চেয়ে আবার বললো, মনে থাকে যেন। দূরের জঙ্গল থেকে শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে। সাথে ঝিঁঝিঁপোকার ডাক রাতের পরিবেশ থমথমে করে তুলছে। হেম উঠে তার আবাস্থলে গেল। শুয়ে পড়লো।
ফজরের আযানের আগেই ঘুম ভেঙে গেল তার। ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ বসে থাকলো। তারপর নদীতে গিয়ে অনেক সময় নিয়ে গোসল করলো। শরীর অনেক হালকা হয়ে আসলো তার। মসজিদের মাইক থেকে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ এসে তার মনে বিঁধলো। নামাজ পড়তে গেল হেম। ঈমামের তিলাওয়াত শুনে গরগর করে পানির স্রোতধারা বয়ে গেল তার আঁখি যুগলে। না, আরবী ভাষা সে বুঝে না। তবে ইন্দ্রিয়গত জ্ঞান দিয়ে সূরার মাহাত্ম্য ঠিকই বুঝে নিলো সে। নামাজ শেষে কেউ একজন মিলাদ পড়ালো। মিলাদের শেষে সবাইকে চারটি করে বিস্কুট দেয়া হলো। হেম বিস্কুটগুলো মনের আনন্দে খেয়ে নিলো। কল থেকে পানি পান করে মসজিদের বারান্দায় এসে শুয়ে থাকলো। পুব আকাশে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো। অন্য কোথাও শুয়ে থাকলে রাজ্যের ভাবনা এসে মাথা উপস্থিত হয়। কিন্তু মসজিদের বারান্দায় অনেকক্ষণ নিরবে শুয়ে থাকার পরেও কোনো চিন্তা আসলো না তার! অবাক হয়ে গেল হেম। খানিক পর মসজিদের ভিতর থেকে আওয়াজ শুনতে পেল সে। গিয়ে দেখে অনেকগুলো ছেলে-মেয়ে বসে আছে। হাতে নানান ধরণের বই। এই চিত্র জীবনেও দেখেনি সে। সব ছেলের মাথায় টুপি আর মেয়েদের মাথায় ঘোমটা দেয়া। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হেম। ঈমাম সাহেব এসে তাদের মাঝে বসলেন। প্রধান ফটকের কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইলো সে। দুটো ছেলে পাশ কাটিয়ে গেল, সে শুনতে পেল তাদের একজন বলছে, ‘আজ মক্তবে আসতে দেরি হয়ে গেল রে।’ এতক্ষণে হেম বুঝতে পারলো এটা ধর্মীয় শিক্ষালয়। মারিয়া একবার বলেছিল, মক্তবে যেভাবে শেখানো হয় সেভাবে কিছু শিখলে অনেকদিন মনে রাখা যায়। ভয়ে ভয়ে পা টিপে টিপে ভিতরে ঢুকে একপাশে গুটিসুটি মেরে বসে পড়লো হেম। কিছুক্ষণ পর একটি ছেলে তাকে দেখতে পেয়ে জোরে বলতে লাগলো, হুজুর দেখেন বোবা ছেলেটা এখানে এসে পড়েছে। ভয়ে, লজ্জায় উঠে দাঁড়ালো হেম। হুজুর ছেলেটিকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে ইশারায় হেমকে ডাকলেন। টেনে নিয়ে পাশে বসালেন। হেমের চেহারার দিকে তাকিয়ে বললেন, মাশাল্লা। তারপর সবার উদ্দেশ্যে হুজুর বলতে লাগলেন,
“আঠারো হাজার মাখলুকাতের মাঝে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। খোদা অনেক ভালোবেসে মানুষকে তৈরি করেছেন। সে যেমনই হোক। এই পৃথিবীতে কেউই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। অপ্রকৃতিস্থ কিংবা শারীরিকভাবে অক্ষম কাউকে দেখলে কখনো অবজ্ঞা করবে না। ভালোবেসে তাদের পাশে টেনে নিবে। মহান আল্লাহ্ বলেছেন, আমাকে ভালোবাসার উদাহরণ হলো আমার সৃষ্টিকে ভালোবাসা।”
হুজুরের কথাগুলো শুনে গর্বে বুক ভরে গেল হেমের। বোবা হয়ে জন্মানোতে এতদিন সে নিজেই নিজেকে অবজ্ঞা করতো। সেই ছেলেটি হুজুরের নিকট মাফ চাইতে গেলে হুজুর তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, তুমি হেমের কাছে মাফ চাও। কেননা খারাপ ব্যবহার তুমি তার সাথেই করেছ। ছেলেটি হেমের কাছে মাফ চেয়ে নিলো। আর সবাই প্রতিজ্ঞা করলো কখনো এমন কারোর সাথে খারাপ ব্যবহার কিংবা অবজ্ঞা করবে না। মুচকি হাসলো হেম।
আজ নতুন করে পৃথিবীতে বেঁচে থালার প্রয়াস পেল সে। মসজিদ থেকে বেরিয়ে রাফির জন্য অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পরে রাফি আসলো। দুই বন্ধু মিলে চলে গেল উপজেলার মাঠে। এসেই তারা অবাক হলো। শত শত ছেলে এসে উপস্থিত। একটু ভয় পেল তারা। এতজনের মাঝে সুযোগ পাবে তো? সবার সাথে লাইনে দাঁড়ালো তারা।
অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। আনুমানিক বারোটার দিকে কোচ হেমের সামনে এসে উপস্থিত হলো। দুপুরের তপ্ত রোদ ঘায়েল করতে পারলো না হেমের মনোবল। ফুটবল পায়ে এগিয়ে গেল মাঠের দিকে। দেখাতে শুরু করলো তার কসরত। কোচ হতভম্ব! ফুটবলের ভাষা পড়তে পারে হেম। বলটিও যেন তার পায়ের কথা শুনে। নিদারুণ ক্ষিপ্রতা, অগাধ দক্ষতা বলের উপর। দশ মিনিটের মাঝে একবারের জন্যও তার পা ছেড়ে যায়নি বল! অনবদ্য তার ফুটবল নৈপুণ্য। কোচ মনে মনে হাসলেন।
বিকেল চারটার দিকে কোচ পনেরো জনের নাম প্রকাশ করলেন। যারা চার দিনের জন্য জেলায় যাবে। নির্বাচিত পনেরো জনের উদ্দশ্যে বললেন, তারা যেন আগামীকাল বিকেলে রেল ষ্টেশনে এসে পৌঁছায়। সন্ধ্যার ট্রেনেই জেলায় যাবে। খুশিমনে ফিরলো রাফি আর হেম। হেম মনস্থির করলো মারিয়াকে সুখবরটা জানাবে।
কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা’ হলো মারিয়ার আসার কোনো নামগন্ধ নেই। মনে বড় আঘাত পেল হেম। অবশেষে মারিয়াকে না জানিয়েই পরদিন বিকেলে ষ্টেশনে উপস্থিত হলো।
জেলায় চার দিনের ট্রেনিং শেষে ফিরলো হেম। শহর থেকে মারিয়ার জন্য এক জোড়া নূপুর আনলো। ভাবছে আর মিটিমিটি হাসছে, নূপুর জোড়া লাগিয়ে মারিয়া হাঁটবে আর ঝুনঝুন আওয়াজে মুখরিত করবে চারপাশ।
যে জায়গায় মারিয়া প্রতিদিন পথ শিশুদের গান শেখাতো সেখানে শিশুরা এসে মন খারাপ করে বসে আছে, হেম কিছু বুঝতে পারলো না। তাদের কাছে জানতে পারলো গত কয়েকদিন মারিয়া গান শেখাতে আসেনি। হেমের দূরন্ত মন আর বাধা মানলো না। দৌড়ে চলে গেল মারিয়ার বাসায়। কিন্তু বাসায় তালা দেয়া! পাশের বাসায় এসে জানতে পারলো মারিয়া খুব অসুস্থ। তার পরিবার এখন রেলওয়ে হাসপাতালে।
হাসপাতালে গিয়ে যা শুনলো তার জন্য প্রস্তুত ছিল না হেম। মারিয়ার ব্লাড ক্যান্সার…
মারিয়া বাবা চেয়েছিল মেয়েটিকে সংগীতের উপর পড়িয়ে বড় শিল্পী বানাবে। এই কথা হেমের অজানা নয়। প্রায় সময় হেমক বলতো মারিয়া, তার সোনালী স্বপ্নের কথা।
ডাক্তার জানিয়েছেন, প্রথম স্টেজে। অপারেশন করালে বেঁচে যাবে মারিয়া। তার জন্য প্রায় দুই লাখ টাকার প্রয়োজন। হেম জানে এত টাকা জোগাড় করা সত্যিই দুঃসাধ্য। মারিয়ার বেডের কাছে এসে দাঁড়াতেই মেয়েটি তার দু’হাত চেপে ধরলো। হেমের দু’চোখ যেন বলতে চাইছে, ‘আমাদের ছেড়ে যেও না মারিয়া!’ ভাবছে মারিয়ার স্বপ্নের কি হবে। তখন মাস্ক খুলে হেমের উদ্দেশ্যে বললো, “মধবিত্ত পরিবারের আশা সবাইকে ঘিরে থাকে না; একজনকে ঘিরেই সবার আশা থাকে। সেই একজন মানুষটাই কেবল জানে কতটা কষ্ট,গ্লানি প্রতিদিন তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে শেষ করে দেয়। এই অসহায় হাহাকার কেউ দেখে না। মানুষের অবয়ব বাইরের দেহটাকে নিয়েই সবাই মেতে থাকে।” দু’জনের নয়ন অশ্রুসিক্ত।
হেম প্রতিজ্ঞা করলো, তার সর্বস্ব দিয়ে খেলবে সে। দলকে জিতিয়ে জাতীয় লীগের ক্লাবে ঢুকতে পারলেই সাইনিং মানি হিসেবে বেশ কিছু টাকা পাবে সে। সেই টাকা দিয়ে হবে মারিয়ার অপারেশন। বেঁচে যাবে আরও একটি প্রাণ সাথে একমুঠো স্বপ্ন।
তেরো দিন পর আসলো সেই মুক্ষম সময়। ফাইনাল খেলা। খেলার শুরু থেকেই মাঠে নেমেছিল হেম। দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের মাঝে সেও একজন। প্রাণপণ দিয়ে খেলছে সে। যে করেই হোক তার দলকে চ্যাম্পিয়ন করাতেই হবে। মারিয়াকে বাঁচাতে হবে। খেলার ষাট মিনিট অতিবাহিত হলো গোল শূন্য ড্র। বিপক্ষ দলের মুহুর্মুহু আক্রমণে হেমের দল ডিফেন্স করতে ব্যাকুল। দলের প্রয়োজনে সে নিচে নেমে খেললো। বিপত্তি ঘটলো সেখানেই। খেলার প্রায় পনেরো মিনিট বাকি। সেই সময় বিপক্ষ দলের আক্রমণ ঠেকাতে পেনাল্টি এরিয়ায় খেলছে হেম। একটি বল গোল লাইন অতিক্রম করে যাবার সময় লাগলো হেমের হাতে। বিপক্ষ দলের খেলোয়াড় উল্লাসে মাতোয়ারা। হেম জানে, পেনাল্টি এরিয়ায় অনিচ্ছাকৃত হ্যাণ্ডবল হলে কিছু হয় না। কিন্তু রেফারি নির্দেশ দিলেন পেনাল্টি কিকের। প্রাণ চলে যাবার অবস্থা তখন হেমের। খেলতে হলে রেফারির নির্দেশ মানতেই হবে। তবুও হাল ছাড়লো না তার দল। হেমকে পাঠিয়ে দিলো উপরের দিকে খেলতে। খেলার পাঁচ মিনিট বাকি। যে করেই হোক একটি গোল পরিশোধ করতে হবে। তাহলে অতিরিক্ত সময়ে গড়াবে খেলা। তখন কিছু একটা করা যাবে। প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছে হেম। তার দলের একজন বল নিয়ে ঢুকে পড়লো বিপক্ষ দলের পেনাল্টি বক্সে। ডান পাশ দিয়ে ঢুকল হেম। তাকে উদ্দেশ্য করে বাড়িয়ে দেয়া হলো। হেমে কোনোরকম পা লাগাতে পারলেই বল ঢুকে যাবে গোল পোস্টে। কিন্তু বল থেকে প্রায় পাঁচ ফিট দূরে হেম। বল চলে যাচ্ছে গোল লাইন অতিক্রম করে। উপায়ন্তর না দেখে বাম পা বাড়িয়ে দিলো হেম। কিন্তু বল ছুঁতে পারলো না। পা পিছলে প্রচণ্ড ব্যথা পেল হেম। সাথে সাথে তাকে তুলে নেয়া হলো। হাসপাতালে পাঠিয়ে পরীক্ষা করে দেখলো জীবনে আর সোজা হয়ে হাঁটতে পারবে না সে। হাতল দিয়ে হাঁটতে হবে তাকে। ততক্ষণে সব শেষ। ১-০ গোলে পরাজিত হলো হেমের দল। জাতীয় লীগে দল পাওয়া হলো না তার। হয়নি মারিয়ার অপারেশন।
খেলা শেষে কোচ সকলের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বললেন, “এক একটা তালিকায় নাম না আসা মানে পরাজয় নয়, তার মাঝেও প্রাপ্তি থাকে। থাকে শেখার আকাঙ্খা। জ্বলে ওঠে অন্তরাত্মা; শেখার নেশায় বুদ হয়ে থাকা যায়। নিজেকে ভালো করে চেনানোর জন্য আরও একটি দুর্গম পথ সুন্দরভাবে পাড়ি দেয়ার প্রস্তুতি নেয়া যায় সুনিপুণভাবে। অতঃপর নিশ্চয়, নির্দ্বিধায় পৌঁছে যাওয়া যাবে সফলতার শেখরে। এটাই সফল হওয়ার চাবিকাঠি, যদি সহজভাবে মেনে নেওয়া যায়!”
কিন্তু হেমের যে সব শেষ…
দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে হাজির হলো হাসপাতালে। শুয়ে আছে মারিয়া। কোনো সাড়া-শব্দ নেই। শেষবারের মতো দেখে বিদায় নিলো হেম। চোখে দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লে অঝর ধারায়।
হ্যাঁ, মারিয়া শেষ পর্যন্ত নিয়তির কাছে হার মেনে চলে গেল জীবন নদীর ওপারে। এখন আর কুকুরের সাথে দৌড়ে বিজয়ী হয়ে খেতে পারে না হেম। কুকুর দলের সাথে কাড়াকাড়ি করেই খেতেই হয় তার। যা ভাগে পায়… তবে স্বার্থান্ধ মানুষদের চেয়েও অধিক মায়া আছে কুকুরের মনে। তাই তো অচল হেমকে তারা ভাগিয়ে দেয় না।
দিন শেষে দুই হাতলে ভর দিয়ে হাঁটে হেম। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কোথাও এসে তা আঁটকে যায়…
(সমাপ্ত)
আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প প্রতিযোগিতা – ০২ এ পঞ্চম স্থান অর্জন করে অনুষ্কা সাহা ঋতু রচিত >> ধোঁয়াশা
বেদনা বিধুর । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প । লেখক পরিচিত
লেখকঃ আরাফাত তন্ময় বুনোহাঁস
ছোটগল্পঃ বেদনা বিধুর
গল্পের জনরাঃ সামাজিক ছোটগল্প
দেশের বাড়িঃ বাকিহাটি, বক্সগঞ্জ, নাঙ্গলকোট, কুমিল্লা
পড়াশোনাঃ বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ, ঢাকা (দ্বাদশ শ্রেণি) ২০১৯।
লেখকের কথাঃ বনলতা সেন বেড়ে উঠেছিলেন শ্রাবস্তী নদীর তীরে আর বুনোহাঁসের বেড়ে ওঠা ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে। মুক্তমনা মানুষটি এখনো বেঁচে আছেন স্রষ্টার নিষ্ঠুর এই ভবে….
1 Comment
[…] বেদনা বিধুর – আরাফাত তন্ময় (বুনোহাঁস… […]