ধোঁয়াশা >> অনুষ্কা সাহা ঋতু । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প
অনুষ্কা সাহা ঋতু রচিত ‘ধোঁয়াশা’ সামাজিক ছোটগল্পটি আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প প্রতিযোগিতা- ০২ এ পঞ্চম স্থান অর্জন করে।
“হঠাৎ মনে হল জিনিসটা পায়ের তালুতে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। ধীরে ধীরে পা বেয়ে উপরে আসছে, ঘেন্নায় বড্ড গা গোলাচ্ছে। কাটাকাটা পা গুলো দিয়ে টিক টিক করে উপরে আসছে, কাটাগুলো যেন বিঁধছে নরম শরীরে।
হঠাৎই চোখ খুলে গেল পিপিনের।একটা না হাজারো তেলাপোকায় ঘর ভরে গেছে। সদ্য লাগানো হালকা নীল রংয়ের দেয়ালগুলোর জায়গায় জায়গায় কালো হয়ে আছে। নয়নটা পাশেই হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে,অথচ একটা তেলাপোকাও ওকে স্পর্শ করছে না। সবগুলো বরং পিপিনের দিকেই ধেয়ে আসছে।
হাত পা জমে গেছে, কোনমতেই নড়তে পারছে না যেন কেউ চেপে ধরেছে,গলা দিয়ে স্বরও বেরুচ্ছে না।মনে হচ্ছে মুখটা কোন দানবীয় হাত চেপে ধরেছে, লোমশ একটা হাত। তেলাপোকার স্তুপ মাড়িয়ে কে যেন এগিয়ে আসছে, স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না অবয়বটা। নয়ন তো নয়, ওতো পাশে ঘুমাচ্ছে। তবে কী বাবা এলেন? না তো! বাবা তো এত স্বাস্থ্যবান না,তবে কে?
তেলাপোকা গুলোকে বড্ড ঘেন্না করছে, সমস্ত শরীর বায়ছে যেন।মাথার ফাঁক দিয়ে সবগুলো ভেতরে ঢুকছে, তীক্ষ্ম কাটায় শরীরটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ সেগুলোকে তেলাপোকা মনে হইলেও এখন মনে হচ্ছে দু’টো শক্ত লোমশ হাত পুরো শরীরময় ঘুরছে। নিষিদ্ধ স্থানে হাত লাগাচ্ছে। মুখে ঘাড়ে কেউ নিঃশ্বাস ফেলছে, নিঃশ্বাসে পোড়া বাজে গন্ধ, সস্তা…সিগারেট। গিলে খেতে চাইছে যেন, অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে ছাড়ানো যাচ্ছে না।অশুভ সেই নিশ্বাস যেন কানে কানে বলছে,” নেংটু দেখবি?”
অশ্রুলিপ্ত চোখে অসহায় দৃষ্টিতে কেবল আকুতি,”ছাড়ো আমায়াশ
“কি বিচ্ছিরি গন্ধ! আমাকে কেন ধরে রেখেছ! লাগছে খুব! ওমাহ…..! তেলাপোকাআআআ! সড়াও ওটাকে! দাদু ছাড়ো না! লাগছে খুব! মা……!
সারা রাত প্রলাপ বকে ভোর রাতে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা। সারা রাত কী সব যে বলেছে কিছুই মাথায় ঢুকেনি। খন্ড খন্ড কথা গুলো মিলিয়েও লাভ নেই।ভাবার বিষয় শুধু, যে মেয়েটা সারাদিন পুরো শহর দাপিয়ে বেড়ায়, রাতের আঁধারে কেন সে মিইয়ে যায়! সেটা অজানায় থেকে গেল।
.
পিপিনের এই অদ্ভুত সমস্যাটা বিয়ের পর থেকেই দেখছে নয়ন। কিসের এত ভয় ওর রাতের আঁধারে সেটাই বুঝতে পারে না। ঠিক রাত ১২ টা থেকে টানা ভোর ৪টা পর্যন্ত প্রলাপ বকতে থাকে। খানিক বাদে স্বামীর বুকে গুটিশুটি মেরে লেপ্টে থাকে। ভুমিকম্প আসুক বা চোর, ওকে তখন নয়নের কাছ থেকে আলাদা করা অসম্ভব।
.
বহুবার বহুভাবে এই সমস্যার কারন উদ্ধার করার চেষ্টা করেও কোন লাভ হয়নি। সকাল বেলা পিপিনের রাতের কোন কথায় মনেই থাকে না। পিপিনের বাড়ির লোকেরাও তেমন কোন সাহায্য করতে পারল না এব্যাপারে। অথচ, দিনকে দিন পিপিনের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকল। কেউ যেন আড়াল থেকে সমস্ত প্রাণ শক্তি শুষে নিচ্ছে।
.
পিপিনের কাকা এসেছে হঠাৎ ছেলের বিয়ের নিমন্ত্রণ জানাতে।ছোটবেলার বেশ কিছু সময় পিপিন ওখানেই কাটিয়েছে। আর নতুন কুটুম হিসেবে বিয়েতে যাওয়াটা নয়নদের দায়িত্বও বটে। পিপিনের অনুপস্থিতিতেই নয়ন নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে নিল। সারারাত ঘুমােয়নি মেয়েটা,তাই এখন ঘুমানোটা খুব দরকার ওর।
.
দূর থেকেই আদরের ভাইঝিকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কমলবাবু। ভাইঝিকে এই রকম যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে না পারার আক্ষেপ হয়ত। কিন্তু চোখের টলমলে জলে হয়ত অন্য কোন দুশ্চিন্তার আভাস ছিল, সেটা কেউ বুঝতে পারল না।
.
কাকার বাড়ি যাবার নাম শুনে হঠাৎই আঁতকে উঠল পিপিন, কিন্তু কিছু জানাল না কাওকে। বিয়ের দিনও কাকার বাড়ির আত্মীয় এসেছে শুনেই আঁতকে উঠেছিল। সারাদিন মেয়েটা কোন ঘোরে ডুবে ছিল কেউ জানেনা। হঠাৎ ছোট টেবিল ঘড়িটা টিং টিং করে বেজে উঠল, জানান দিল সময় এখন রাত ১২ টা।
.
ঘড়িটা তাদের বিয়েতে উপহার পাওয়া। দেখতে বেশ মনোমুগ্ধকর তাই ওটা একদম শোবার ঘরে মাথার পাশের ছোট্ট টেবিলটাই সাজিয়ে রেখেছে পিপিন।
.
সারাদিন অফিসেও বেশ ধকল গেছে। ঘুমাবে না প্রতিজ্ঞা করেও, ক্লান্ত নয়ন বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমে তলিয়ে গেল।
কে একটা জানালা দিয়ে উঁকি দিল যেন। ছায়াটা লম্বা হয়ে শোবার ঘরের দেয়াল পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে।
দরজার ছিটকিনিটা সাধারণত লাগানো হয় না। অটো লকটাই লাগানো। খুব ধীরে সন্তর্পণে লকটা ঘুরে কট করে খুলে গেল।
.
বাতাসে একটা পোড়া অসহ্যকর গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। এটা সিগারেটের গন্ধ নিঃসন্দেহে বলা যায়। সস্তা ২টাকা দামের সিগারেটগুলো। গন্ধটা মগজে গিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে যেন। ফতফত করে কী যেন উড়ছে,এ দেয়াল থেকে ও দেয়াল ছিটকে পড়ছে। আজ মশারিটা টানানো হয়নি, হয়ত বাহির থেকে তেলাপোকা এসেছে। বড্ড ঘেন্না লাগে তেলাপোকা জিনিসটাকে।
.
নিস্তব্ধ চারদিক। রাত পাখিরাও হয়ত ঘুমে মগ্ন। সুশীল সমাজ গভীর ঘুমে তলিয়ে। টেবিল ঘড়িটা টিং টিং করে জানান দিলো, “রাতের ধ্বংসযজ্ঞ শেষ হয়েছে, সুশীল সমাজ জাগো, ভোর হলো”।
জ্ঞানহীন দেহটা এখনও বিছানায় চাদর আঁকড়ে পড়ে আছে, মুখে এক রাশ আতঙ্ক জড়িয়ে।
১৮বছর আগের কথা,
চার বছরের ভাইঝিটা এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। একদৌড়ে কাকার ঘাড়ে ওঠে, আবার দৌড়ে গিয়ে কাকিমা’র কোলে শুয়ে যায়,খানিকবাদেই দৌড়ে দাদার কাঁধে উঠে মুকুটহীন রাজার মতো রাজ্য চষে বেড়ায়।
পাশের বাড়ির পার্বতী দিদা ডাক দেয়,
-“কই রে মিষ্টি ছানা, আয় এদিকে। আমপানা বানিয়েছি তোর জন্য আর মুড়ি ভাজছি। তাড়াতাড়ি আয়”।
টুকটুক পায়ে স্যান্ডো গেঞ্জির ছোট্ট কোছর পেতে দিদা সামনে দাঁড়ায় সে। তারপর মুড়ি ক’টা নিয়ে দৌড় দেয় পার্বতী দিদার ঘরের ভেতর, পলাশ দাদুর কাছে।
.
উন্নত গ্রীবা, চওড়া বক্ষ, আপাদমস্তক লোমে ভরা ফর্সা পলাশ দাদু ওকে ডাকে “দুষ্টু বুড়ি” বলে। আজ হয়ত ছোট্ট পায়ের নূপুরের ধ্বনি শুনতে পাননি। ওইই এসে ডাক দিলো,
-“দাদু, কী দেখছ? এমাহ…..এরা তো সবাই নেংটু! হিহিহি। ওদের বুঝি জামা নেই? আমার থেকে একটা দিই?”
পলাশ দাদু হঠাৎ হকচকিয়ে উঠলেন। তাড়াতাড়ি টিভি সুইচটা বন্ধ করে ছোট্ট মনকে বুঝ দিতে লাগলেন,
-“ওরা নেংটু কেন হবে? পোশাকটা ওরকম, দূর থেকে দেখলে নেংটু মনে হয়। কাওকে বলিস না আবার। তোর কথায় কে আবার কী মনে করে! তুই যা খেলা কর।”
.
পার্বতী আজ ওর মিষ্টি ছানাকে বুকে জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরলে কী যে শান্তি লাগে! ঈশ্বর কেন ওর বুকটা খালি করে দিল কে জানে?
মাথার ওপরে রাখা টেবিল ঘড়িটা বেজে উঠল। টিংটং শব্দের গুণতি জানান দিল, ১২টা বেজে গেছে। প্রকৃতিও তখন ঘুমের মাঝে আড়াল করেছে নিজেকে।
চারবছরের কোমল শরীরটা হাওয়ায় ভাসছে, কেউ সন্তর্পণে উঠিয়ে নিল যেন। বুকে জড়িয়ে গুদামঘরের দিকে নিয়ে চলল তাকে, ধীরে ধীরে। তেলাপোকার আড্ডাখানা ভেঙে সেইখানে স্থাপন করল ছোট্ট শরীরটা,খুব বেশি জায়গা লাগেনি। মেয়েটা তখনও ঘুমুচ্ছে, নিস্পাপ আবেশে।
.
একটানে নরম প্যান্টটা খুলে ফেলল কেউ, স্যান্ডোগেঞ্জির হাত দুটো ধীর ধীরে নামিয়ে নিল। ছোট্ট শরীরের ওপর লোমশ একটা শরীর চড়ে বসল। ঘুম ভাঙতেই গায়ের ওপর দাদুকে দেখে অবাক দুটো চোখ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে।
তেলাপোকাগুলো প্রতিশোধ নিচ্ছে যেন। শরীরে উঠে আসছে, ঘাম আর সস্তা সিগেরেটের গন্ধ মিশে বিচ্ছিরি একটা গন্ধ ভেসে আসছে দাদুর শরীর থেকে। লোমশ হাত দু’টো ঘুরে বেড়াচ্ছে কোমল শরীরটাতে, আর অশ্লীলতা ভরা কিছু কথা বা গালিগালাজ।
রাতপাখিরাও হঠাৎ ছটফট করে উঠল। ছোট্ট একটা কণ্ঠের তীব্র আর্তনাদ, “কি বিচ্ছিরি গন্ধ! আমাকে কেন ধরে রেখেছ! লাগছে খুব! ওমাআআআ…..! তেলাপোকাআআআ! সড়াও ওটাকে! দাদু ছাড়ো না! লাগছে খুব! মা……! ”
.
টেবিলঘড়িতে দম পড়ল আবার। টিংটং শব্দটা প্রকৃতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বলল, “মনুষ্যত্বের বলির সাক্ষী রইলে তুমি। ভোর চারটে বাজে, চার বছরের শরীরে কামনা রস খুঁজে ক্লান্ত দেহের বিশ্রামের পালা এখন।”
ধ্বংসলীলার অবসান হল, অথচ কেউ জানতেও পারল না।”
আরো পড়ে নিতে পারেন, অনুষ্কা সাহা ঋতু রচিত সামাজিক ছোটগল্প >> বাঁধন
আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প প্রতিযোগিতা – ০২ এ ষষ্ঠ স্থান অর্জন করে মোঃ ফারুক রচিত >> বেলাশেষে
ধোঁয়াশা । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প । লেখক পরিচিতি
লেখকঃ অনুষ্কা সাহা ঋতু
ছোটগল্পঃ ধোঁয়াশা
গল্পের জনরাঃ সামাজিক
দেশের বাড়িঃ পটিয়া,চট্টগ্রাম।
পড়াশোনাঃ অনার্স ২য় বর্ষ,সরকারী কমার্স কলেজ, চট্টগ্রাম, ২০১৮।
লেখকের কথাঃ বই পড়ার প্রবল আকর্ষণ থেকে সাহিত্য জগতে পদার্পণ। এছাড়া গান গাওয়া ছবি আঁকা আর নাচের প্রতিও প্রবল ঝোঁক নিয়ে এগিয়ে চলা। তবে সবটাই শখের বশে।
1 Comment
[…] ধোঁয়াশা – অনুষ্কা সাহা ঋতু । আত্মপ্র… […]