জীবন ও জীবনবোধ নিয়ে জীবনানন্দ দাশের উক্তি । আলোচিত বাণী সম্ভার
১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ সালে জন্ম নেয়া নির্জনতম এবং আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক জীবনানন্দ দাশ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যকে দিয়ে গেছেন অসাধারণ সব গল্প, কবিতা। মূলত কবি জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যে কাজী নজরুল ইসলামের ছোঁয়া পাওয়া গেলেও দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ থেকে তিনি তাঁর মৌলিক স্বত্বা নিয়ে বেরিয়ে আসেন। লিখেন অসাধারণ সব জনপ্রিয় কবিতা। যদিও তাঁর সব কবিতাই জনপ্রিয় হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পর। তিনি বাংলা সাহিত্যকে দিয়ে গেছেন অনন্য সব প্রেম, জীবনবোধ, মানুষ, প্রকৃতি নিয়ে কবিতা ও দর্শন। বরেণ্য এই কবি ২২ অক্টোবর ১৯৫৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। জীবন ও জীবনবোধ নিয়ে জীবনানন্দ দাশের উক্তি এবং কবিতাংশ নিয়েই আত্মপ্রকাশের আজকের আয়োজন। এছাড়াও প্রেম ও ভালোবাসা নিয়ে কবির বানীগুলো পড়ে নিতে পারেন এই লিংকে > প্রেম ও ভালোবাসা নিয়ে জীবনানন্দ দাশের হৃদয়গ্রাহী উক্তিসমূহ
জীবন ও জীবনবোধ নিয়ে জীবনানন্দ দাশের উক্তি
জীবন, জীবনবোধ ও জীবনদর্শন নিয়ে লিখে গেছেন প্রায় সব কবিই। তাঁদের মাঝেই নিজস্ব স্বত্বা নিয়ে নিজেকে আলাদা করেছেন জীবনানন্দ দাশ। লিখে গেছেন অসংখ্য কবিতা, করে গিয়েছেন অনবদ্য সব উক্তি।
“জীবন গিয়েছে চ’লে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার—
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার”!
“ভেবে ভেবে ব্যথা পাব- মনে হবে পৃথিবীর পথে যদি থাকিতাম বেঁচে!”
“আমরা যাই নি মরে আজও–তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়:
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জোছনার প্রান্তরে,
প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন–এখনও ঘাসের লোভে চরে
পৃথিবীর কিমাবার ডাইনামোর ‘পরে।”
“আরম্ভ হয় না কিছু — সমস্তের তবু শেষ হয় —
কীট যে ব্যর্থতা জানে পৃথিবীর ধুলো মাটি ঘাসে
তারও বড় ব্যর্থতার সাথে রোজ হয় পরিচয়!
যা হয়েছে শেষ হয়; শেষ হয় কোনোদিন যা হবার নয়!”
“আলো — অন্ধকারে যাই — মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে!
স্বপ্ন নয় — শান্তি নয় — ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
আমি তারে পারি না এড়াতে
সে আমার হাত রাখে হাতে;”
“একবার যখন দেহ থেকে বা’র হয়ে যাব
আবার কি ফিরে আসবো না আমি পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোন এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে।”
উপরোক্ত উক্তিটি জীবনানন্দ দাশের উক্তি, তাঁর রচিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থ থেকে চয়ন করা হয়েছে।
“সব কাছ তুচ্ছ হয়, পন্ড মনে হয়,
সব চিন্তা — প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়!”
“পৃথিবী প্রবীণ আরো হ’য়ে যায় মিরুজিন নদীটির তীরে;
বিবর্ণ প্রাসাদ তার ছায়া ফেলে জলে।
ও-প্রাসাদে কারা থাকে? কেউ নেই- সোনালি আগুন চুপে জলের শরীরে
নড়িতেছে- জ্বলিতেছে- মায়াবীর মতো জাদুবলে”.
“পেঁচার ধূসর পাখা উড়ে যায় নক্ষত্রের পানে-
জলা মাঠ ছেড়ে দিয়ে চাঁদের আহবানে”
“ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন – যেন কোন বির্কীন জীবন
অধিকার ক’রে আছে ইহাদের মন;
চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বথের কাছে
একগাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা – একা,
যে জীবন ফড়িঙের,দোয়েলের-মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা
এই জেনে।”
“আমি পথ ভুলে
আসিব কি এ-পথে আবার!
ধুলো-বিছানার
কীটদের মতো
হবো কি আহত
ঘাসের আঘাতে!
বেদনার সাথে
সুখ পাব!”
“সব ছেড়ে আমাদের মন
ধরা দিতো যদি এই স্বপনের হাতে!
পৃথিবীর রাত আর দিনের আঘাতে
বেদনা পেত না তবে কেউ আর,-
থাকিত না হৃদয়ের জরা,-
সবাই স্বপ্নের হাতে দিতো যদি ধরা”!…
“আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত রাত্রিটিরে ভালো,
খড়ের চালের ’পরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার;
পুরোনা পেঁচার ঘ্রাণ;- অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো?
বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ,- মাঠে-মাঠে ডানা ভাসাবার
গভীর আহ্লাদে ভরা; অশত্থের ডালে-ডালে ডাকিয়াছে বক;
আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এই সব নিভৃত কুহক;”
“মাঝে-মাঝে মনে হয় এ-জীবন হংসীর মতন-
হয়তো-বা কোনো-এক কৃপণের ঘরে;
প্রভাতে সোনার ডিম রেখে যায় খড়ের ভিতরে;
পরিচিত বিস্ময়ের অনুভবে ক্রমে-ক্রমে দৃঢ় হয় গৃহস্থের মন।
তাই সে হংসীরে আর চায় নাকো দুপুরে নদীর ঢালু জ’লে
নিজেকে বিম্বিত ক’রে;- ক্রমে দূরে-দূরে
হয়তো-বা মিশে যাবে অশিষ্ট মুকুরেঃ
ছবির বইয়ের দেশে চিরকাল- ক্রুর মায়াবীর জাদুবলে”।
“একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি আহিরীটোলায়,
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি বাদুড়বাগানে,
একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো—
তবে আমি হেঁটে চ’লে যাবো মানে-মানে।
—ব’লে সে বাড়ায়ে দিলো অন্ধকারে হাত”।
“আকাশে সূর্য্যের আলো থাকুক না— তবু—
দণ্ডাজ্ঞার ছায়া আছে চিরদিন মাথার উপরে।
আমরা দণ্ডিত হ’য়ে জীবনের শোভা দেখে যাই।
মহাপুরুষের উক্তি চারিদিকে কোলাহল করে”।
“ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন— যেন কোন্ বিকীর্ণ জীবন
অধিকার ক’রে আছে ইহাদের মন;
দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘন শিহরণ
মরণের সাথে লড়িয়াছে;”
“হে পৃথিবী,
হে বিপাশামদির নাগপাশ, – তুমি
পাশ ফিরে শোও,
কোনোদিন কিছু খুঁজে পাবে না আর”।
“পৃথিবীতে তামাশার সুর ক্রমে পরিচ্ছন্ন হ’য়ে
জন্ম নেবে একদিন। আমোদ গভীর হ’লে সব
বিভিন্ন মানুষ মিলে মিশে গিয়ে যে-কোনো আকাশে
মনে হবে পরস্পরের প্রিয়প্রতিষ্ঠ মানব”।
“ঘাসের ভিতরে নীল শাদা ফুল ফোটে হেমন্তরাগে;
সময়ের এই স্থির এক দিক,
তবু স্থিরতর নয়;
প্রতিটি দিনের নতুন জীবাণু আবার স্থাপিত হয়”।
“আমরা যাইনি ম’রে আজো— তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়:
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে,”
“একদিন এ-জীবন সত্য ছিলো শিশিরের মতো স্বচ্ছতায়;
কোনো নীল নতুন সাগরে
ছিলাম- তুমিও ছিলে ঝিনুকের ঘরে
সেই জোড়া মুক্তো মিথ্যে বন্দরে বিকিয়ে গেল হায়”।
“আবার বিকেল বেলা নিভে যায় নদীর খাড়িতে;
একটি কৃষক শুধু খেতের ভিতরে
তার বলদের সাথে সারাদিন কাজ ক’রে গেছে;
শতাব্দী তীক্ষ্ণ হ’য়ে পড়ে।
সমস্ত গাছের দীর্ঘ ছায়া
বাংলার প্রান্তরে পড়েছে;
এ-দিকের দিনমান— এ-যুগের মতো শেষ হ’য়ে গেছে,
না জেনে কৃষক চোত বোশেখের সন্ধ্যার বিলম্বনে প’ড়ে
চেয়ে দেখে থেমে আছে তবুও বিকাল;
উনিশশো বেয়াল্লিশ ব’লে মনে হয়
তবুও কি উনিশশো বেয়াল্লিশ সাল”।
“কোথাও শান্তির কথা নেই তার, উদ্দীপ্তিও নেই;
একদিন মুত্যু হবে, জন্ম হয়েছে;
সূর্য উদয়ের সাথে এসেছিলো খেতে;
সূর্যাস্তের সাথে চ’লে গেছে।
সূর্য উঠবে জেনে স্থির হ’য়ে ঘুমায়ে রয়েছে”।
“আমিও ফিয়ার লেন ছেড়ে দিয়ে— হঠকারিতায়
মাইল-মাইল পথ হেঁটে— দেয়ালের পাশে
দাঁড়ালাম বেণ্টিঙ্ক স্ট্রিটে গিয়ে— টেরিটিবাজারে;
চীনেবাদামের মতো বিশুষ্ক বাতাসে”।
“আমার এমন কাছে— আশ্বিনের এত বড়ো অকূল আকাশে
আর কাকে পাবো এই সহজ গভীর অনায়াসে—’
বলতেই নিখিলের অন্ধকার দরকারে পাখি গেল উড়ে
প্রকৃতিস্থ প্রকৃতির মতো শব্দে— প্রেম অপ্রেম থেকে দূরে”।
“ওইখানে একজন শুয়ে আছে— দিনরাত দেখা হ’তো কতো কতো দিন,
হৃদয়ের খেলা নিয়ে তার কাছে করেছি যে কতো অপরাধ;
শান্তি তবু: গভীর সবুজ ঘাস ঘাসের ফড়িং
আজ ঢেকে আছে তার চিন্তা আর জিজ্ঞাসার অন্ধকার স্বাদ”।
“কথা ভেবে — কথা ভেবে — ভেবে।
এই ব্যথা এই প্রেম সব দিকে রয়ে গেছে —
কোথাও ফড়িঙে — কীটে, মানুষের বুকের ভিতরে,
আমাদের সবের জীবনে।
বসন্তের জোছনায় অই মৃত মৃগদের মতো
আমরা সবাই”।
“একটি পৃথিবী নষ্ট হয়ে গেলে এবারে মানুষ
চেয়ে দেখে আরেক পৃথিবী বুঝি ধ্বংসপ্রায়;
লোভ থেকে লোভে তবু– ভুল থেকে ভুলে
শূন্যতার থেকে আরো অবিকল শূন্যতার দিকে
আবর্ত ক্রমেই আরো দ্রুত হয়ে আসে।”
“ভুলে যাও পৃথিবীর ঐ ব্যথা – ব্যাঘাত – বাস্তব!…
সকল সময়
স্বপ্ন – শুধু স্বপ্ন জন্ম লয়
যাদের অন্তরে ,-
পরস্পরে যারা হাত ধরে
নিরালা ঢেউয়ের পাশে পাশে ,-
গোধূলির অস্পষ্ট আকাশে
যাহাদের আকাঙ্ক্ষার জন্ম- মৃত্যু ,- সব,-
পৃথিবীর দিন আর রাত্রির রব
শোনে না তাহারা!”
“এখন ওরা ভোরের বেলা সবুজ ঘাসের মাঠে
হো-হো ক’রে হাসে- হো-হো হি-হি ক’রে,
অসংখ্য কাল ভোর এসেছে- আজকে তবু ভোরে
সময় যেন ঘোড়ার মত নিজের খুরের নাল
হারিয়ে ফেলে চমকে গিয়ে অনন্ত সকাল
হয়ে এখন বিভোর হয়ে আছে;
মাঠের শেষে ঐ ছেলেটি রোদে
শুয়ে আছে ঐ মেয়েটির কাছে।”
“পাড়াগাঁর দু’পহর ভালোবাসি—রৌদ্রে যেন গন্ধ লেগে আছে
স্বপনের ;– কোন গল্প, কি কাহিনী, কি স্বপ্ন যে বাধিয়াছে ঘর
আমার হৃদয়ে, আহা, কেউ তাহা জানে নাকো—কেবল প্রান্তর
জানে তাহা, আর ঐ প্রান্তরের শঙ্খচিল;”
“ঘড়ির দুইটি ছোটো কালো হাত ধীরে
আমাদের দুজনকে নিতে চায় যেই শব্দহীন মাটি ঘাসে
সাহস সংকল্প প্রেম আমাদের কোনোদিন সেদিকে যাবে না
তবুও পায়ের চিহ্ন সেদিকেই চলে যায় কি গভীর সহজ অভ্যাসে”।
“নক্ষত্র আকাশ নদী পাহাড়ের বধির গরিমা
দূরে যায়, কাছে এসে করে যায় ভাব,
নিজেকে শত্রুর মতো মনে করে চিরদিন যদি
নষ্ট করে দেওয়া যেত তাহাদের মিথ্যা প্রভাব
নিজেকে বন্ধুর মত মনে করে যদি অপলক
অনুভব করা যেত তাহাদের অবহিত মন;-
অনেক চতুরানন মরে গেছে এইসব ভেবে;-
জেনে হো হো করে হাসে একজন চতুর আনন”।
“হয়তো বা হাঁস হব — কিশোরীর — ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,
সারা দিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে-ভেসে;
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়”।
“মনে প’ড়ে গেল এক রূপকথা ঢের আগেকার,
কহিলাম,- শোনো তবে,-
শুনিতে লাগিল সবে,
শুনিল কুমার;
কহিলাম,- দেখেছি সে চোখ বুজে আছে,
ঘুমানো সে এক মেয়ে,- নিঃসাড় পুরীতে এক পাহাড়ের কাছে;
সেইখানে আর নাই কেহ,-
এক ঘরে পালঙ্কের ’পরে শুধু একখানা দেহ
প’ড়ে আছে;- পৃথিবীর পথে- পথে রূপ খুঁজে- খুঁজে-
তারপর,- তারে আমি দেখেছিগো-সেও চোখ বুজে
প’ড়েছিলো;- মসৃণ হাড়ের মতো শাদা হাত দুটি
বুকের উপরে তার রয়েছিলো উঠি!”
“গভীর শীতের রাত এই সব,- তবু
চারিদিকে যুবাদের হৃদয়ের জীবনের কথা
মৃত্যুর উপর দিয়ে সাঁকোর মতন
চেয়ে দেখে মরণের অপ্রমেয়তা
সেতুর ছবির মত মিলে গিয়ে জলের ভিতরে
জীবনের জয়-
আর মরণের স্তব্ধতাকে অনুভব করে।
অনুভব করে এই জীবনই মহৎ,
মরণের চেয়ে বড় জীবনের সুর;
যদিও অন্ন আজ ভূমি নয়- তবুও মৈত্রেয়ী
অন্নলোভাতুর;
হৃদয়বিহীনভাবে- দশ বিশ শত কোটি টন
চলে আজ পঙ্গপাল,- নিজেকে উজাড় করে;- জেনে
জীবন হতাশ নয় ব’লেই জীবন”।
“শরীরে এসেছে স্বাদ বসন্তের রাতে,
চোখ আর চায় না ঘুমাতে;
জানালার থেকে অই নক্ষত্রের আলো নেমে আসে,
সাগরের জলের বাতাসে
আমার হৃদয় সুস্থ হয়;”
“স্থান থেকে স্থানচ্যুত হ’য়ে
চিহ্ন ছেড়ে অন্য চিহ্নে গিয়ে
ঘড়ির কাঁটার থেকে সময়ের স্নায়ুর স্পন্দন
খসিয়ে বিমুক্ত ক’রে তাকে
দেখা যায় অবিরল শাদা কালো সময়ের ফাঁকে
সৈকত কেবলি দূর সৈকতে ফুরায়;
পটভূমি বার-বার পটভূমিচ্ছেদ
ক’রে ফেলে আঁধারকে আলোর বিলয়
আলোককে আঁধারের ক্ষয়
শেখায় শুক্ল সূর্যে; গ্লানি রক্তসাগরের জয়
দেখায় কৃষ্ণ সূর্যে; ক্রমেই গভীর কৃষ্ণ হয়”।
“অতীত নিশি গেছে চলে
চিরবিদায় বার্তা বলে,
কোন্ আঁধারের গভীর তলে
রেখে স্মৃতিলেখা,
এসো এসো ওগো নবীন,
চলে গেছে জীর্ণ মলিন-
আজকে তুমি মৃত্যুবিহীন
মুক্ত সীমারেখা”।
“এই জল ভালো লাগে; বৃষ্টির রূপালি জল কত দিন এসে
ধুয়েছে আমার দেহ — বুলায়ে দিয়েছে চুল — চোখের উপরে
তার শান্ত — স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে, — আবেগের ভরে
ঠোঁটে এসে চুমো দিয়ে চলে গেছে কুমারীর মতো ভালোবেসে;”
“এই জল ভালো লাগে; — নীলপাতা মৃদু ঘাস রৌদ্রের দেশে
ফিঙা যেমন তার দিনগুলো ভালোবাসে — বনের ভিতর
বার বার উড়ে যায়, — তেমনি গোপন প্রেমে এই জল ঝরে
আমার দেহের পরে আমার চোখের পরে ধানের আবেশে”
“হে পাবক, অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি, অন্ধকারে
তোমার পবিত্র অগ্নি জ্বলে।
অমাময়ী নিশি যদি সৃজনের শেষ কথা হয়,
আর তার প্রতিবিম্ব হয় যদি মানব-হৃদয়,
তবুও আবার জ্যোতি সৃষ্টির নিবিড় মনোবলে
জ্বলে ওঠে, সময়ের আকাশের পৃথিবীর মনে :
বুঝেছি ভোরের বেলা রোদে নীলিমায়,
আঁধার অরব রাতে অগণন জ্যোতিষ্কশিখায়;
মহাবিশ্ব একদিন তমিস্রার মতো হ’য়ে গেলে
মুখে যা বলোনি, নারি, মনে যা ভেবেছো তার প্রতি
লক্ষ্য রেখে অন্ধকার শক্তি অগ্নি সুবর্ণের মতো
দেহ হবে মন হবে- তুমি হবে সে-সবের জ্যোতি”।
“এই জীবনের সত্য তবু পেয়েছি এক তিল,
পদ্মপাতায় তোমার আমার মিল ।
আকাশ নীল,পৃথিবী এই মিঠে,
রোদ ভেসেছে,ঢেঁকিতে পাড় পড়ে;
পদ্মপত্র জল নিয়ে তার-জল নিয়ে তার নড়ে;
পদ্মপত্রে জল ফুরিয়ে যায়”।
“আমাদের এই শতকের
বিজ্ঞান তো সংকলিত জিনিসের ভিড় শুধু- বেড়ে যায় শুধু;
তবুও কোথাও তার প্রাণ নেই ব’লে অর্থময়
জ্ঞান নেই আজ এই পৃথিবীতে; জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই”।
“নদী সাগর কোথায় চলে ব’য়ে
পদ্মপাতায় জলের বিন্দু হ’য়ে
জানি না কিছু- দেখি না কিছু আর
এতদিনে মিল হয়েছে তোমার আমার
পদ্মপাতার বুকের ভিতর এসে”।
“হেমন্তের ঝড়ে আমি ঝরিব যখন
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের ’পরে শুয়ে রবে?
অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন
সেদিন তোমার।
তোমার আকাশ—আলো—জীবনের ধার
ক্ষ’য়ে যাবে সেদিন সকল?
আমার বুকের ’পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই, শুধু তার স্বাদ
তোমারে কি শান্তি দেবে।
আমি চ’লে যাবো—তবু জীবন অগাধ”
উপরোক্ত উক্তিটি জীবনানন্দ দাশের উক্তি, তাঁর রচিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ থেকে চয়ন করা হয়েছে।
“চারিদিকে এখন সকাল—
রোদের নরম রং শিশুর গালের মতো লাল;
মাঠের ঘাসের প’রে শৈশবের ঘ্রাণ—
পাড়াগাঁর পথে ক্ষান্ত উৎসবের এসেছে আহ্বান।”
“চারিদিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল,
তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা-ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল;
প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে-থেকে আসিতেছে ভেসে
পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে!”
উপরোক্ত উক্তিটি জীবনানন্দ দাশের বাণী, তাঁর রচিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ থেকে চয়ন করা হয়েছে।
“এ-যুগে কোথাও কোনো আলো— কোনো কান্তিময় আলো
চোখের সুমুখে নেই যাত্রিকের; নেই তো নিঃসৃত অন্ধকার
রাত্রির মায়ের মতো: মানুষের বিহ্বল দেহের
সব দোষ প্রক্ষালিত ক’রে দেয়— মানুষের বিহ্বল আত্মাকে
লোকসমাগমহীন একান্তের অন্ধকারে অন্তঃশীল ক’রে
তাকে আর সুধায় না— অতীতের সুধানো প্রশ্নের
উত্তর চায় না আর— শুধু শব্দহীন মৃত্যুহীন
অন্ধকারে ঘিরে রাখে, সব অপরাধ ক্লান্তি ভয় ভুল পাপ
বীতকাম হয় যাতে— এ-জীবন ধীরে-ধীরে বীতশোক হয়”
উপরোক্ত জীবনানন্দ দাশের বাণী, তাঁর রচিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ সাতটি তারার তিমির’ পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ থেকে চয়ন করা হয়েছে।
“নিমীল আগুনে অই আমার হৃদয়
মৃত এক সারসের মত
পৃথিবীর রাজহাঁস নয়-
নিবিড় নক্ষত্র থেকে যেন সমাগত।”
“সন্ধ্যার নদীর জলে এক ভিড় হাঁস অই- একা;
এখানে পেল না কিছু; করুণ পাখায়
তাই তারা ব’লে যায় শাদা, নিঃসহায়।
মূল সারসের সাথে হ’লো মুখ দেখন।”
উপরোক্ত জীবনানন্দ দাশের বাণী, তাঁর রচিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ সাতটি তারার তিমির’ পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ থেকে চয়ন করা হয়েছে।
“জানো কি অনেক যুগ চলে গেছে?
মরে গেছে অনেক নৃপতি?
অনেক সোনার ধান ঝরে গেছে জানো না কি? ”
“আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীতরাত্রিটিরে ভালো,
খড়ের চালের পরে শুনিয়াছি মুগ্ধ রাতে ডানার সঞ্চার;
পুরোনা পেঁচার ঘ্রাণ — অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো!
বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ — মাঠে মাঠে ডানা ভাসাবার
গভীর আহ্লাদে ভরা; অশত্থের ডালে ডালে ডাকিয়াছে বক;
আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এই সব নিভৃত কুহক ”
“জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে”
“অনেক রাজার শাসন ভেঙে গেছে;
অনেক নদীর বদলে গেছে গতি;
আবহমান কালের থেকে পুরুষ-এয়োতি
এই পৃথিবীর তুলোর দণ্ডে সোনা
সবার চেয়ে দামী ভেবে সুখের সাধনা
নষ্ট ক’রে গিয়েছে তবু লোভে;
ওরা দু’জন ভালোবাসে অনন্ত ভোর ভ’রে
এ ছাড়া ‘আজ সকল সূর্য ডোবে।”
“সেইখানে নাই আর –
রূপ যেই স্বপ্ন আনে, স্বপ্নে বুকে জাগায় যে রস
সেইখানে নাই তাহা কিছু;
ঢেউয়ের গানের শব্দ
যেখানে ফেনার গন্ধ নাই –
ঘুমাতে চাও কি তুমি?
সেই অন্ধকারে আমি ঘুমাতে কি চাই!”
“ঢের আগেকার কথা এই সব- তখন বালক আমি পৃথিবীর কোণে।
অশ্বত্থের ত্রিকোণ পাতায় যেন মনে হত বালিকার মুখ
মিষ্টি হয়ে নেমে আসে হৃদয়ের দিকে,
নদীর ভিতরে জলে যেন তার করুণ চিবুক
স্থিরতর কথা ভাবে- সমস্ত নদীর ঘ্রাণ আরো
অধিক উদ্ভিদ মাটি মাংস- ধূসর হয়ে থাকে;
যেন আমি জলের শিকড় ছিঁড়ে একদিন হয়েছি মানুষ,
কাতর আমোদ সব ফিরে চায় আবার আমাকে।”
“নিত্য প্রেমের ইচ্ছা তবুও চঞ্চল
পদ্মপাতায় তোমার জলে মিশে গেলাম জল –
তোমার আলোয় আলো হলাম
তোমার গুণে গুণ;
অনন্তকাল স্থায়ী প্রেমের আশ্বাসে করুণ
জীবন ক্ষণস্থায়ী তবু হায়।”
জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যে রেখে গেছেন অসংখ্য কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ। যদিও কবির ব্যক্তিজীবন কেটেছে দরিদ্রতার মাঝে। আর্থিক কষ্টের মূল্য তাকে কড়ায় গন্ডায় চুকাতে হয়েছে। এতস্বত্বেও তিনি বাংলা সাহিত্যে টিকে রয়েছেন তাঁর নিজস্ব প্রাঞ্জলতায়, অনন্য সব কবিতায়। জীবনানন্দ দাশ বেঁচে থাকবেন তাঁর অনবদ্য সব সৃষ্টিতে, উক্তিতে, কবিতায়।
উপরোক্ত উক্তিগুলো বিভিন্ন বাংলা ব্লগ এবং জীবনানন্দ দাশের কবিতা, গল্প থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
3 Comments
খুব ভালো পোস্ট ।
[…] […]
[…] তাঁর রচিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থ […]