ঘোরপাক >> মোঃ ওয়ালীউল্লাহ অলি । রহস্য গল্প । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প
“পাশের বিল্ডিং এর ছাদে, বাবা এবং ছেলে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। কথা বলার বিষয় বুঝা না গেলেও; বাবাটি বেশ খুশ মেজাজে কথা বলছে। ছেলেটি রেলিঙে পিঠ ঠেকিয়ে বাবার মুখ বরাবর হাসছে। মনে হলো, অনেক বছর এমন ভালো কোনো দৃশ্য দেখা হয়নি।
হঠাৎ বিল্ডিংটি নড়েচড়ে উঠলো, কিছু বুঝে উঠার আগেই হেলান দেয়া রেলিঙের একটা অংশ ভেঙ্গে পড়লো। ছেলেটি কোনো রকমে ছাদের একটি অংশ ধরে নিজের পড়ে যাওয়া ঠেকিয়ে, ঝুলে রইলো ছাদের দেয়াল বরাবর। নীচে সসীম শুন্যতা। কিন্তু পড়ে গেলে যে অসীম শূন্যতা এসে গ্রাস করবে, তা ছেলেটির চোখে মুখে ভেসে উঠছে।
ছাদের একপাশে ছিটকে পড়া, কিংকর্তব্যবিমূঢ় বাবা সম্বিৎ ফিরে পেয়ে কুনুই মুড়িয়েই এগিয়ে গেলেন ছেলের দিকে। ছেলের হাত ধরে উপরে তুলতে চেষ্টা করছেন।
আতংকগ্রস্থ বাবা চোখ মুখ শক্ত করে বললেন- বাবা ভয় পাস না, শক্ত করে ধরে রাখ, আমি আছি।
ঠিক সেই মুহূর্তে, পুরো বিল্ডিংটি বড়সড় একটি ঝাঁকি খেল। বাবা-ছেলে ছিটকে পড়ছে মাটির দিকে, বিল্ডিংটিও সমানতালে ধেয়ে আসছে বাবা-ছেলের অস্তিত্ব মুছে দিতে। পুরো বিল্ডিংটি মাটি ছোঁয়ার আগেই ধরমড় করে ঘুম ভেঙ্গে গেল।
কপাল ছুঁয়ে দেখি, ঘামের বিন্দুরা সযত্নে ঝড়ে পড়ার অপেক্ষা করছে। স্বপ্নের শেষ টুকু ব্রেইন নিতে পারেনি বা তার মেনে নেয়ার ইচ্ছা ছিলনা বলেই হয়ত ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। চোখ বন্ধ করে পুরো বিষয়টা আবার ভাবতে লাগলাম।
ভোরবেলা ঘুম ভেঙ্গে যাবার একটা অসুবিধা আছে। ক্ষুধার কিরারা কিলবিল করতে থাকে। ভাবটা এমন, তারা এই মাত্র রফিক আজাদের কবিতা পড়ে এসেছে এবং সমস্বরে বলছে- ভাত দে হারামজাদা! নয়ত পেট চিবিয়ে খাবো।
সাতপাঁচ না ভেবে কাঁথা সরিয়ে উঠে পড়লাম। বিস্কিটের বোয়াম খুলে কিছু পেলাম না। হতাশ হবার কিছু নেই, বাসায় মুড়ি থাকে। মামের ৫ লিটার বোতল ভর্তি করে থাকে। শেষ হতে হতে ভাইয়া আবার এনে রাখে।
দূর্ভাগ্য কিনা জানিনা, তবে আজ মুড়িও নেই। এদিকে ক্ষুদার কিরারা মনে হচ্ছে, মাংস ভেদ করে চামড়ায় হাতুরি ঠুকছে।
উপায়ন্তর না পেয়ে, এক গ্লাস পানি খেলাম। টিভি সুইচটা অন করে, সোফাসদৃশ চেয়ারটায় বসে ভাবতে লাগলাম। ইদানিং টিভি ছেড়ে প্রায়ই ভাবতে বসে যাই। রঙ্গলীলা কানে আসে কিন্তু মনে ভাসে না। মাঠের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সবুজের মত, আমার চারপাশ জুড়েও আজকাল টেনশন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সোফা সদৃশ চেয়ারটায় হেলান দিয়ে ভাবতে ভালোই লাগে। বড় ভাবি, বেচারির সোফার খুব সখ। ভাইয়া তালবাহানা করে আনছে না। ঠিক আনছে না, এটা বলাও গভীর নিঃশ্বাসসাধ্য কাজ। তার মুখ পানে চেয়ে থাকা মুখগুলোর দিকে তাকিয়েই হয়ত আনতে পারছে না।
ক্ষুধার কিরারা এরইমধ্যে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। হয়তোবা শালা ফকিন্নি! বলে হাল ছেড়ে দিয়েছে। হঠাৎ মাথায় এলো, রান্না ঘরে নুডুলস থাকতে পারে। ভাবি, প্রায়ই ভাতিজি জায়মার জন্য এনে রাখে। দৌড়ে রান্না ঘরে গেলাম। প্রথম দুই তাকে না পেয়ে তিন নাম্বার তাকের একটা সবুজ ঝুড়ির দিকে হাত বাড়ালাম। ম্যাগি মিনি ফ্যামিলি প্যাক নুডুলসের একটাই বাকি আছে। যাক আলহামদুলিল্লাহ। কিরাদের মাঝেও উচ্ছ্বাস ফিরে এসেছে। তারা যে আনন্দে লাফাচ্ছে সেটা অনুভব করতে পারছি।
নুডুলস রান্না শেষ হবার আগেই কারেন্ট চলে গেল। অন্ধকার বা আলো, নিজের ঘরের মাপ সব সময়ই নখদর্পণে থাকে। তাছাড়া ভরা জ্যোৎস্না না হলেও চাঁদের আলো রয়েছে। তাই সমস্যাবোধ হলো না।
রোলিং চেয়ারটায় হেলান দিয়ে, পা দুটি বিছানায় তুলে দিয়ে, নুডুলসটা খুব আয়েশে খেলাম। আগে থেকে এনে রাখা পানিটা মুখে দিয়েই কম্পিউটার টেবিলের ড্রয়ার টান দিলাম। অনেক কাগজের সাথে বেড়িয়ে আসলো একটা আধপোড়া ব্যানসন সিগারেট। টাকা থাকলে মাঝে মাঝে রাতে একটা সিগারেট নিয়ে ঘরে ঢুকি। অর্ধেকটা মধ্য প্রহর শেষে খাই, বাকিটা ঘুমানোর আগে। যদিও ভাইয়ার বিষয়টা একদম না-পছন্দ। কিন্তু ভবের লীলায় সাঙ্গ লীন হয়ে যাওয়া পথিকের পুনরায় পথে ফিরে আসা খুবই কষ্টসাধ্য কাজ। হুমায়ূন আহমদের সৃষ্টি মহাপুরুষ হিমুরা হয়ত সহজেই ছাড়তে পারে। আবার অলৌকিক কোনো অপ্সরীর টানেও হয়ত ছাড়া যায়। অলৌকিক কোনো অপ্সরি এখনো আমার কাছে এসে পৌঁছায়নি।
পোড়া সিগারেটটা পুনরায় ধরালাম। প্রথম টানে মুখপোড়া একটা অনুভূতি হলো। পরিচিত অনুভূতি, পোড়া সিগারেট দ্বিতীয় বার ধরালে এমন অনুভূতি হবেই। তাই পাত্তা না দিয়ে টানতে থাকলাম। দুই তিন টানের পর ব্যাপারটা স্বাভাবিক হয়ে আসে।
সব কিছু শান্ত, এবার ঘুমানো যায়। বিছানা থেকে পা নামিয়ে রোলিং চেয়ারটা থেকে উঠতে যাবো, ছিটকে উঠলাম। পায়ে পানি পানি লাগছে। এটা নিশ্চয়ই ভাতিজার কাজ। মেঝো ভাইয়ের ছেলে তাফসির, সুযোগ পেলেই ফিল্টারের কল ছেড়ে রাখে। পানি সারা ঘরময় ছড়িয়ে যায়।
ফিল্টারের কল বন্ধ করতে যাবো, অনুভূত হলো, পানির পরিমাণটা স্বাভাবিক না।
জানালা দিয়ে চাঁদের আলো কিছুটা ঘরে ঢুকছে কিন্ত মশার যন্ত্রনায় জানালা বন্ধ, আবার বিদ্যুৎ আসার নাম নেই। তাই বিষয়টা স্বষ্ট হচ্ছে না। আমার পায়ের গোড়ালি ঢুবে যাচ্ছে।
তাড়াহুড়ো করে জানালার কাছে গিয়ে আৎকে উঠলাম। চারদিকে পানি, পাশের বিল্ডিং এর মানুষজন সব ছাদে। পানি চারতলা পর্যন্ত ছুঁয়েছে। কিছু মানুষ খড়কুটোর ভাসছে। যে যা কাছে পেয়েছে, তাই নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে তাদের আর্তনাদ আমার কানে পৌঁছাচ্ছে না। আমি হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছি। মনে হচ্ছে, কি পরিচিত এক দৃশ্য। কোন সিনেমায় দেখেছি, মনে করতে পারছি না।
মনে নানা প্রশ্ন জাগছে, কোন প্রকার আবহাওয়ার পুর্বাবাস না দিয়ে কিভাবে ঢাকা শহর এভাবে তলিয়ে যেতে পারে। শহর রক্ষা বাঁধ কি ভেঙ্গে গেল? আর ভেঙ্গে গেলেই কি তার পানি চারতলা পর্যন্ত পৌঁছাবে!
এসব ভাবনার মাঝেই মনে হলো বাসায় মেঝো ভাই-ভাবি আছে, ভাতিজা আছে। ওদের কি অবস্থা দেখার জন্য দৌড়ে গেলাম। ওদের রুমে পেলাম না। পুরো বাসায় ওদের দেখা পেলাম না। ওদিকে পানি হাটু সমান এখন। যত দ্রুত সম্ভব পানি আউরিয়ে সিঁড়ির দিকে গেলাম। দ্রুত বেগে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে গিয়ে দেখি পুরো বিল্ডিং এর মানুষজন একসাথে। কিন্তু মেঝো ভাই-ভাবি, তাফসির তো নেই।
তিনতলার ভাবিকে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। ভাবি এসেই বললেন- অলি, এইডা কিসের আলামত কউতো? কেয়ামত কি আইসা পড়লো?
আমি সরাসরি উত্তর দিলাম- না ভাবি, কেয়ামতে এত সুন্দর চাঁদ আর জ্যোৎস্না থাকার কথা নয়। এখন আমার ভাই ভাবি কই দেখছেন? ওদের তো দেখছি না।
– ওরা তো বিকেলেই ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে বাড়িতে চলে গেল দেখলাম। কেন তুমি জানতা না? আর এসব হেয়ালী কথা রাইখা আল্লাহ খোদার নাম নাও। আল্লাহ মালুম, কোন পাপের ফল এই গুলা।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। ফোন বের করে কল দিলাম। কল ঢুকছে না। বড় ভাই-ভাবিকে কল দিলাম, ওদের অবস্থা জানার জন্য। কিন্তু কল কিছুতেই ঢুকানো যাচ্ছে না। পুরো নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা অচল হয়ে গেছে বুঝাই যাচ্ছে। এই অবস্থায় প্রচন্ড টেনশন হওয়া উচিত, কিন্তু আমার হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, এটাই হওয়ার ছিল। এটাই হবে। সব কিছু একদিন ভেসে যাওয়ার কথা। তাই আজ সব ভেসে যাচ্ছে।
আব্বা-আম্মার কথা খুব মনে পড়ছে। কিন্তু সে মনে পড়াও বেশিক্ষণ ঠিকলো না। হেয়ালী ঝেঁকে বসেছে। এমন ঠান্ডা, শান্ত, নিবিড় জলোচ্ছ্বাস টিভি বা ইউটিউবেও দেখিনি। আকাশে জ্যোৎস্না, নীচে শান্ত জলোচ্ছ্বাস। এমন অদ্ভুত কম্বিনেশন পৃথিবীতে কমই দেখা যায়, হয়ত এটাই প্রথম। ভিডিও করে রাখলে ভালো ভিউ পাওয়া যেত।
এসব ভাবতে ভাবতে পরিবেশ পালটে গেল, ঢেউ গুলো আগের মত শান্ত নেই। বড়সড় ধাক্কা দিয়ে বারি খাচ্ছে বিল্ডিং এ। একটু পর পর কেঁপে উঠছে বিল্ডিং। এই প্রথম মানুষের আর্তনাদ আমার কানে ঢুকছে, শিরশির করে ঢুকছে। পৃথিবীর উপর মায়া বাড়ছে। বাবা-মা-ভাই-বোন-আত্মীয়স্বজন-বন্ধু-বান্ধবের চেহারাগুলো আমার চারপাশ ঘিরে থ্রিডি ইফেক্ট দিয়ে ঘোরছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীতে এত মায়া রয়েছে যে, তাতে সুতি কাপড় ভিজিয়ে ছিপলে, তা কখনো ঝড়ঝড়ে হবে না। অনন্তকাল মায়া ঝড়ে পড়বে।
মুহূর্তেই আরেকটি বড় ধাক্কায়, সব চিন্তা মাথা থেকে উবে গেল। ছিটকে পড়লাম ছাদে। বিল্ডিংটি নড়বড়ে অবস্থায় চলে এসেছে। পাশের বেশ কিছু বিল্ডিং এর মধ্যে তলিয়ে গিয়েছে পানির নীচে। ছাদের মানুষের ভয়ে আতংকিত চেহারা, মায়াময় রোদন, চারপাশের পরিবেশকে ভয়ানক ভুতুড়ে করে দিয়েছে। উৎকণ্ঠা এখন ঝাপটে ধরেছে। কোনো চিন্তা কাজ করছে না মাথায়, কারো চিন্তা এখন ভাবাচ্ছে না আমাকে। বাঁচতে হবে, এইটাই মনে হয়, একমাত্র ধ্রুব সত্য।
আরেকটি মৃদু কাঁপনে বিল্ডিংটি কিছুটা ঢেবে গেল। কিছু মানুষ ছিটকে পড়লো পানিতে। খুবই দ্রুততায় বিল্ডিংটি বা দিকে হেলে যেতে থাকলো, এবং চোখের নিমিষে তলিয়ে গেল পানিতে।
ছাদে থাকা প্রতিটা মানুষ এখন ভাসমান, কেউ কেউ পানির সাথে যুদ্ধে ঠিকতে না পেরে ডুবছে। আমি অদূরেই একটা ড্রাম ভাসতে দেখে সেদিকে সাঁতরে ছুটলাম। সেই একক ড্রামে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী তিন জন। তারাও ছুটছে ড্রাম বরাবর। আমারই জিত হলো, এটাই হবার কথা।
ড্রামে ভাসতে থাকলাম, অজানা অদৃষ্ট পানে। চোখের সামনে মানুষগুলো ডুবছে, আমার কিছু করার নেই। আমি নির্বিকার চেয়ে দেখছি। এরজন্যই আমার জন্ম হয়েছে। আর এটাই হবার কথা ছিল।
সারারাত-দিন পানিতে ভাসার পর আমি খুবই ক্লান্ত, ক্ষুধায় অবসন্ন হয়ে আসছে আমার চৈতন্য। আমি ঘুমের ঘোরে চলে যাচ্ছি…
এমন অবস্থায় আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে বেশ আশ্চর্য হলাম। হন্যে হয়ে পুরো বিছানা হাতরালাম, কিন্তু পানির অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না। তাহলে আমি আবার স্বপ্ন দেখছিলাম। এ স্বপ্নের শেষ কোথায়?
তবে এটা যে স্বপ্ন ছিল, তা ভেবে ভালো বোধ করছি। পাশাপাশি আরেকটা কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। স্বপ্নের মধ্যে ঘুমানো যায় না। ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখা যায়, আবার স্বপ্নের মাঝে ঘুমাতে গেলে ঘুম ভেঙ্গে যায়।
বেশ বেলা হয়েছে। এবার উঠা উচিত। শুয়ে শুয়েই সবার কথা ভাবতে লাগলাম। জায়মাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে, আম্মার জন্যও মনটা পুড়ছে। ঠিক করলাম জায়মাকে দেখে সরাসরি কিশোরগঞ্জ চলে যাবো, আম্মার কাছে। ভেবেই একধরণের সুখ অনুভব করলাম। এ সুখ বাবা-মা থেকে দূরে থাকা মানুষগুলো ক্ষনিকের জন্য রগে রগে অনুভব করতে পারে।
এক ল্যাপটপ ভরার পর, ল্যাপটপ ব্যাগে আর তেমন জায়গা থাকে না। আর দুই তিনটার বেশি কাপড় নেয়ার প্রয়োজনও তেমন দেখিনা, থাকবো মাত্র দুই তিন দিন।এমন অনেক হয়েছে, গিয়েছি ব্যাগ ভর্তি কাপড় নিয়ে, অথচ এক কাপড়েই দিব্যি চলে গেছে। বাকিগুলো ছুঁয়েও দেখা হয়নি।
ব্যাগ গুছিয়ে, রেডি হয়ে চলে গেলাম বড় ভাবিদের বাসায়। ভাবি বেশ কিছুদিন বাবার বাড়িতে আছেন। আন্টি বেশ অসুস্থ। গোল্ড ব্লাডারের পাথর অপারেশন করেছেন। যে পাথর তিনি ১৫ বছর লালন পালন করেছেন। আন্টিকে সুস্থ অবস্থায় দেখলে, এক ধরনের প্রাণচাঞ্চল্যতা কাজ করে। অসুস্থ আন্টির মাঝে মুটেই তা নেই। দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই যে প্রাণখোলা হাসিটা দেখতে পাই, আজ তার দেখা নেই। তিনি ভেতরের ঘরে খাটের কোনায় শুয়ে আছেন। ঘরের কোনায় উকি দিলাম, দেখা মাত্রই হাসি দিলেন। কিন্তু সে হাসি মলিন, নিষ্প্রাণ। বলা হয়ে থাকে, সুস্থতার চেয়ে বড় নিয়ামত আর নেই। অসুস্থতার সব চেয়ে বাজে দিক হলো, তা মানুষের অকৃতিম হাসিটা কেড়ে নেয়।
কুশলাদি জিজ্ঞেস করে ভাবির কাছে গেলাম। খুব ইচ্ছে হলো- স্বপ্নটা বলি। কিন্তু অজানা কারণে বলতে ইচ্ছে হলো না। নানা কথার মাঝে, কাকা কাকা বলে জায়মা ছুটে আসলো। জায়মার প্রতি অন্যরকম একটা টান কাজ করে। চাচা-ভাতিজির মাঝে কেমন টান হতে পারে, ভালোবাসার জায়গাটা কত গভীর হতে পারে, জায়মা না হলে বুঝতাম না। জায়মার সাথে কিছুটা সময় কাটিয়ে বিদায় নিলাম।
বাসের বাতাসে এক ধরণের সজীবতা কাজ করছে। গতকাল রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। ঘুম আর স্বপ্নের বেড়াজালে কিছুই টের পায়নি। তবে পরিবেশটার প্রতি নিদারুণ ভালো লাগা কাজ করছে। জানালার পাশে বসায় ভালো লাগার পরিমানটা বেশি। তবে বিরক্তি একটাই, পাশে একটা গোমড়ামুখো মানুষ বসে আছে। যেকোনো ভ্রমনে গোমড়ামুখী মানুষ আমার বিরক্ত লাগে। আমার পাশে কোনো সুন্দরী মেয়ে বসবে, সে প্রত্যাশা করা ছেড়ে দিয়েছি। কোনো দিন বসেনি। তবে ইদানিং প্রত্যাশা করি, ভ্রমনের সময় এমন কেউ বসবে, যে বাকপটু হবে। যার সাথে নানাবিধ কথা বলতে বলতে অনায়াসে জার্নিটা শেষ করা যাবে। চলমান প্রকৃতি দেখতে বেশি সময় ভাল লাগে না। প্রকৃতি হবে শান্ত, নিবিড়, মহিমান্বিত। দেখতে দেখতে চোখে কোনো ক্লান্তি আসবে না। চলমান অবস্থায় প্রকৃতি কিছু সময় দেখার পরেই চোখ ভেঙ্গে ঘুম আসে নয়ত অদ্ভুতুড়ে মাথা ব্যাথা ধরে। আর এর কোনোটাই পছন্দ না।
উপায়ান্তর না দেখে এই গোমড়ামুখোকেই খুঁচাতে থাকলাম। তিনবার আঙ্কেল কেমন আছেন? জিজ্ঞেস করাতেই তিনি ঘুরে শুধু আমার চেহারা মাপলেন। বড় বড় সাদা কালো গোঁফের ফাঁকে মোটা বলিষ্ট ঠোঁটে হাসির ছিটেফোঁটা নেই। এই প্রথমবার নিজের চেহারা নিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী হলাম। একটু খারাপ হলেই সম্ভবত মেরে বসতেন নাক বরাবর এক ঘুষি।
চতুর্থবার আর জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না। হেডফোন কানে দিয়ে, সামনের সিটের পিঠে মাথা রেখে আনমনে ভাবতে লাগলাম। নানা বিষয় নিয়ে ভাবছি, তবে ঘুরেফিরে গত রাতের স্বপ্নই প্রাধান্য পাচ্ছে। মনে মনে সিদ্ধান্তও নিলাম বাড়িতে গিয়েই আম্মাকে পুরো স্বপ্নটা বলবো। আম্মা স্বপ্নের সুন্দর ব্যাখ্যা দিতে জানে। যদি নাও দিতে পারেন, তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে তা বের করে আনেন।
ভাবতে ভাবতে গোমড়ামুখো চেহারা দেখি, আবার ভাবি। এসবের মাঝেই চলে আসলাম ময়মনসিংহ বাসস্ট্যান্ড।
ছোটবেলায় এই বাসস্ট্যান্ড নিয়ে বেশ বিড়ম্বনায় পড়তাম। ভেবে পেতাম না, কিশোরগঞ্জের বাসস্ট্যান্ডের নাম ময়মনসিংহ বাসস্ট্যান্ড কেন হবে? পরে জানতে পারি, একসময় বেশি ভাগ বাস ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে এখান থেকে ছেড়ে যেত। তাই সময়ের পালাক্রমে এর নাম ময়মনসিংহ বাসস্ট্যান্ড হয়ে গেছে। তবে এর নাম আগে কি ছিল বা শুরু থেকেই কি ময়মনসিংহ বাসস্ট্যান্ড ছিল কিনা, সেটা জানতে পারিনি।
অনন্যা সুপার বাস, স্ট্যান্ডে ঢুকার আগেই নেমে পড়লাম। উত্তেজনার মাত্রা একটু বেশিই কাজ করছে। রিক্সা ঠিক করে চললাম বাড়ির দিকে। নরসুন্দা নদীতে সংযোজিত একটা খালের পাড়েই আমার বাড়ি। চরপাড়া, মহিনন্দ নামে খ্যাত। বাড়ি যেতে একটা সরু ব্রিজ পার হতে হয়। এই সরু, নড়বড়ে ব্রিজ বড় করার জন্য বাপ-চাচাদের অনেক দৌড়াদৌড়ি দেখেছি। বিলও পাশ হয়েছে, কিন্তু আব্বা দেখে যেতে পারেননি। ক্যান্সারের স্বীকার হয়ে চোখের সামনে তিলেতিলে অবধারিত মৃত্যুমুখে পতিত হলেন।
ব্রীজের গোড়ায় দেখা হলো মেঝো ভাইয়ের সাথে, হাসিমুখে এগিয়ে আসলেন। আমি বাড়ি আসলে সবাই খুব আশ্চর্য হয়। খুব কম আসার দরুন এমনটা হয়েছে। দুই ভাই মিলে বাড়ির দিকে হাটা দিলাম। বাড়ির সামনেই চাল ভাঙ্গানোর কল আছে, সেখানে গ্রামের উঠতি বয়সের ছেলেদের একটা ভদ্র আড্ডাও আছে। সম্মানের কমতি না থাকায়, আমরাও তেমন কিছু বলিনা। সেখানে তাফসিরকে খেলতে দেখলাম ওদের সাথে। আমাকে দেখা মাত্রই, চাচ্চু চাচ্চু আধো বোলে ছুটে আসলো। ভীষণ রকম অমায়িক একটা হাসি আছে তাফসিরের। সব শিশুদেরই থাকে, তবে নিজের ভাতিজা বলে আহ্লাদটা একটু বেশি, এই যা। কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বাড়ির দিকে আগাচ্ছি। প্রতি পদে পদে অন্যরকম শান্তিবোধ করছি। এ শান্তির সাথে অন্য কিছুর তুলনা হয় না।
হঠাৎ একটা বিকট শব্দে আত্মা কেঁপে উঠলো। সেটা আমাদের ঘরের ভিতর থেকে এসেছে, সন্দেহ না থাকায় দুই ভাই দৌড় দিলাম ঘরের দিকে। গ্রীলের কাছে এসেই দেখলাম, গ্রীলে তালা দেয়া। বাড়িতে লোকজন কম থাকায়, বেশি ভাগ সময় গ্রীল তালা মারা অবস্থাতেই থাকে। রান্না ঘরের দিকে আগুন লক্ষ্য করলাম। বুঝতে বাকি রইলো না, সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়েছে। গ্রীল ধরে টানছি, আর আম্মা আম্মা বলে চিৎকার করছি। মেঝো ভাই দৌড়ে গেলেন রান্না ঘরের দিকের দরজার দিকে। আগুন পুরো ঘরময় ছড়িয়ে পড়েছে। আম্মার এখনো দেখা পায়নি। আমরাও ঘরে ঢুকতে পারছি না। চাচাত ভাইকে দেখলাম একটা শাবল নিয়ে এসেছে গ্রীলের তালা ভাঙ্গার জন্য। যে দিক থেকে পারছে ঘরের ভিতর পানি দিচ্ছে। সে সময় মেঝো ভাবি দৌড়ে আসলো, উনিও চিৎকার করতে করতে বলছেন, মা রান্না ঘরে ছিলেন। আমি আসছি শুনে মুরগীর মসলা মাখাচ্ছিলেন।
আমি এই মুহুর্তে শুধু গ্রীল ঝাঁকাচ্ছি আর উন্মাদের মত চিৎকার করছি আম্মা আম্মা বলে। কিন্তু আমার গলা দিয়ে আর স্বর বের হচ্ছে না।
শরীরে প্রচন্ড ঝাঁকুনি অনুভব করায়, চোখে মেলে তাকালাম। আমার বোন আর বোন জামাইয়ের চেহারা অস্পষ্টভাবে ভাসছে। তারা কি বলছে কানে ঢুকছে না। শুধু ঝাঁকাচ্ছে আর কিছু বলছে। পাশে ভাগিনাদ্বয়কেও উৎকন্ঠা নিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম। কখনোই এত শান্ত অবস্থায় দেখিনি ওদের।
ঘোর কাটতে কিছুটা সময় নিলো। বুঝতে পারলাম আমি আবারো স্বপ্ন দেখেছি। অন্যভাবে বললে, আমি এখনো স্বপ্ন থেকে বের হতে পারিনি। উঠে বসার চেষ্টা করছি, কিন্তু শক্তি পাচ্ছি না। বোনের কথাগুলো এখন কানে আসছে ঠিকঠাকভাবেই।
– কিরে দুঃস্বপ্ন দেখেছিস কোনো? আম্মাকে ডাকতেছিলি। আমরা অনেক ভয় পেয়েছি। ১০ মিনিট ঝাঁকানোর পর উঠলি। কাপড় ও ভিজিয়ে ফেলছিস।
আমি কিছু বলতে যাবো, গলায় প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলাম। ভ্যাবলার মত তাকিয়ে রইলাম বোন-দুলাভাইয়ের মুখের দিকে। আমি কিছু বলতে পারছি না।
– সেই সন্ধায় এলি, এসেই ঘুম দিলি। আর এখন সকাল হয়ে গেছে। বিভোর হয়ে ঘুমাচ্ছিলি। কি হয়েছে তোর?
আমি কিছু না বলে, চোখ নামিয়ে নিলাম। ঘটনার বিশ্লেষণ করবো, সে অবস্থায় নেই আমি। প্রচণ্ড ঘোরের ভেতর ডুবে যাচ্ছি আবার।
– আম্মা ফোন দিয়েছিল। যেভাবে কাঁপছিলি আর চিৎকার করছিলি, ভয়ে আম্মাকে ফোন দিয়েছিলাম। উঠে নাস্তা কর। আম্মাকে ফোন দে।
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বসে রইলাম। আমার কিছু বলার নেই। আমার কিছু বলার ছিল না। এমনি হবার কথা ছিল।
নাস্তা করতে করতে ভাবছি, কি করে বোনের বাসায় এলাম। মাথা কিছুতেই কাজ করছে না। একটা ভ্রম ঝেঁকে বসেছে। বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবাইকে দেখছি। ভাগিনাদ্বয় আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। ঘরময় দৌড়াদৌড়ি, মারামারি করেই যাচ্ছে। বোন রান্নায় ব্যস্ত হয়েছে। বোন জামাই পিসিতে গান শুনছে। কিন্তু আমি, আমার আমি থেকে বের হতে পারছি না। কিছুতেই আলাদা করতে পারছি না, এটা স্বপ্ন নাকি বাস্তব। চারপাশে টেনশনের বালাইও নেই। আছে শুধু ভ্রম, আমি ভ্রমের ভিতরেই ঘোরপাক খাচ্ছি…” (সমাপ্ত)
মোঃ ওয়ালীউল্লাহ অলি রচিত আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প >> সুখ
ঘোরপাক । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প । লেখক পরিচিতি
লেখকঃ মোঃ ওয়ালীউল্লাহ অলি
ছোটগল্পঃ ঘোরপাক
গল্পের জনরাঃ রহস্য গল্প
দেশের বাড়িঃ কিশোরগঞ্জ
পড়াশোনাঃ ভূগোল পরিবেশ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, (মাস্টার্সে অধ্যয়নরত রয়েছেন) ২০১৯।
মোঃ ওয়ালীউল্লাহ অলি সাহিত্যের সাথে জড়িয়ে আছেন ছোটবেলা থেকেই। লেখালেখি তাঁর পছন্দের বিষয়, পাশাপাশি তিনি ব্লগিং করতেও পছন্দ করেনি।
2 Comments
ভালো লেগেছে বেশ।
[…] মোঃ ওয়ালীউল্লাহ অলি রচিত আত্মপ্রকাশ ব্লগ নির্বাচিত গল্প >> ঘোরপাক […]