সন্ধ্যা মালতী >> মোঃ ফারুক । সামাজিক ছোটগল্প । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প
“রোজ কাকের ডাক আর গাড়ির হর্ন দিয়ে ঢাকা শহরে দিনের শুরু হয়। এক এক করে রাজপথ গুলো ব্যস্ত হতে থাকে। বুকপকেটে কিছু স্বপ্ন নিয়ে মানুষ গুলো ছুটে অবিরাম। তারপর দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বিকেল গড়িয়ে নামে সন্ধ্যা। রাত শেষে কাকের ডাক আর গাড়ির হর্ন জানান দেয় আরেকটা দিনের শুরু। অসংখ্য অগণিত বুকপকেটের স্বপ্ন গুলো স্বপ্নই থেকে যায়।
এক ঝলক রোদ এসে আনিসের ঘরে উঁকি দিচ্ছে। আনিস ছেঁড়া কাঁথা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে আর স্বপ্ন দেখছে। ‘সন্ধ্যা মালতী’ উপন্যাসের স্ক্রিপ্ট নিয়ে ‘শ্রাবণ’ প্রকাশনীতে বসে আছে। আনিস শুনেছেন প্রকাশক নবীন আহসান সাহেব প্রচণ্ড ভালো মনের মানুষ। নবীন আহসান সাহেব ভালো মানুষ, না খারাপ মানুষ সেটা আনিসের চিন্তার বিষয় না। আনিস ভাবছেন প্রকাশক নবীন আহসান সাহেব তার স্ক্রিপ্ট হাতে নিয়ে কয়েক লাইন পড়লেই হয়। কারণ আনিসের বিশ্বাস, তার উপন্যাসের স্ক্রিপ্ট মন দিয়ে যে পড়বে। সে কোনো শর্ত ছাড়াই উপন্যাস বের করতে রাজি হয়ে যাবে। প্রতিটা লেখক তার সর্বোচ্চ চিন্তা দিয়ে লিখে থাকেন। তাই কোনো লেখকের কাছে তাঁর লেখা খারাপ হওয়ার কথা না।
নবীন আহসান সাহেব আনিসের স্ক্রিপ্ট হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন।
“মহন খেয়াল করে দেখেছে সন্ধ্যার পর থেকে মালতী সাজগোজ করতে ব্যস্ত আছে। আজকে কি কোন বিশেষ দিন! মালতী হঠাৎ এমন সাজগোজ করছে কেন? মহন ব্যাপারটা দেখেও না দেখার ভান করে মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়ছে। চেহারায় সিরিয়াস ভাব ফুটিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। মেয়ে মানুষ হয় আবেগী। পুরুষ মানুষ এদের সাথে তালে তাল মিলানো ঠিক না। মালতী মহনের হাত থেকে পত্রিকা কেড়ে নিয়ে বলল, পত্রিকা বেশি পড়লে মানুষ পণ্ডিত হইয়া যায়। আমার জামাই এত পণ্ডিত হইতে হইবো না। দোকানে যান। গিয়ে দুইটা পান নিয়া আসেন। মহন অবাক হয়ে বলল, পান দিয়ে কি করবে? মালতী ফিক করে হেসে বলল, দেখেন না সাজগোজ করছি। পান খেতে খেতে আইজকা আপনার সাথে জোৎস্ন্যা দেখমু”
প্রকাশক নবীন আহসান সাহেবের মনোযোগ দিয়ে স্ক্রিপ্ট পড়া দেখে আনিস ধরেই নিয়েছে এবার বই মেলায় তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস ‘সন্ধ্যা মালতী’ বের হতে যাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ মোবাইলের শব্দে আনিসের ঘুম ভেঙে যায়। সুন্দর স্বপ্নটাও আর পুরা হয় না। আনিস ছোট বেলা থেকে এই ব্যাপারটা খেয়াল করে আসছে, যখনি কোনো সুন্দর স্বপ্ন দেখে তখনি একটা অঘটন ঘটে ঘুম ভেঙে যাবে। সুন্দর স্বপ্নটা আর পুরা হয় না। একবার আনিস স্বপ্ন দেখছিল, রুমার বাবা আনিসকে তাদের বাড়িতে দাওয়াত করে আদরযত্ন করে খাওয়াচ্ছে। খাওয়া শেষে রুমার বাবা বলল, শুনেছি তুমি রুমাকে ভালবাসো। রুমাও তোমাকে ভালবাসে। তুমি প্রতিষ্ঠিত না তাতে কি হয়েছে! আমার মেয়ে তো তোমাকে ভালবাসে। তাই আমি বেঁচে থাকতে তোমাদের বিয়ে দিয়ে যেতে চাই। এর মধ্যেই আনিসের মা আনিসকে ডেকে বলল, বাপজান উঠ। তোর জন্য ভাপা পিঠা বানাইছি। গরম গরম ভাপা পিঠা। ঘুম থেকে উইঠা দুইখান ভাপা পিঠা খা। আনিস চোখ ডলতে ডলতে বলল, ভাপা পিঠা বানিয়েছ ভালো কথা। দুই দিন পরে বানালে কি হত?
নামকরা লেখক ও প্রকাশক রব্বানি সাহেবের সাথে আনিসের দেখা করার কথা আজ। রব্বানি সাহেবও নাকি অনেক ভালো মানুষ। কোন শর্ত ছাড়াই তিনি নতুন লেখকদের বই প্রকাশ করেন। প্রতি বছর বই মেলায় চার পাঁচটা লেখক সাপ্লাই করা রব্বানি সাহেবের জন্য কোন ব্যাপারই না। আনিস এর আগেও আরো কয়েকজন প্রকাশকের কাছে ‘সন্ধ্যা মালতী’ উপন্যাসের স্ক্রিপ্ট নিয়ে গেছেন। দুই একজন স্ক্রিপ্ট খুলে দেখলেও বাকিরা “সাহিত্য হইল সাধনার জিনিশ। আগে সাধনা করতে শিখো” টাইপের জ্ঞান দিয়ে আনিসকে বিদায় করেছেন। আনিস সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রকাশক রব্বানি সাহেব যদি কোনো শর্ত ছাড়া তাঁর উপন্যাস বের করতে রাজি না হয়। তাহলে আর কোনদিন কোন প্রকাশকের কাছে স্ক্রিপ্ট নিয়ে যাবে না।
আনিস নিজস্ব স্বপ্ন গুলো ‘সন্ধ্যা মালতী’ উপন্যাসে লিখেছে। মানুষ বাস্তব জীবনে যা ছুঁতে পারে না সেটা কল্পনাতে ছুঁতে চায়। আনিসের তীব্র ইচ্ছে, নিজের সাজানো ব্যর্থ স্বপ্ন গুলো এই শহরে ছড়িয়ে যাক। তাছাড়া আনিস রুমাকে একদিন বলেছিল, তোমায় নিয়ে আমার যত স্বপ্ন একদিন ছড়িয়ে যাবে এই শহরে। রুমা এখন আনিসের জীবনে নেই। কিন্তু রাফখাতায় লিখা স্বপ্ন গুলো রয়ে গেছে।
রব্বানি সাহেব আনিসের স্ক্রিপ্ট হাতে নিয়ে দুই এক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে আনিসের দিকে তাকিয়ে বললেন।
‘কবে থেকে লেখালেখি করো?”
‘যেদিন থেকে কল্পনার প্রেমে পড়তে শিখেছি।’
‘সাহিত্যের মানে বুঝো?’
‘জ্বী বুঝি। সাহিত্য মানে শিল্প। সাহিত্যের মধ্যে আমরা আমাদের কল্পনার বিস্তার ঘটাই।’
‘ফেসবুকে follower কত? লাইক কমেন্ট কেমন পাও?’
‘follower সাড়ে ছয়শ ছুঁই ছুঁই। লাইক এখনো একশ ছুঁতে পারিনি। কমেন্ট যা কয়েকটা পাই বেশিরভাগ “শুভ কামনা” টাইপের।’
‘এই সাড়ে ছয়শ follower নিয়ে বই বের করলে তোমার বই কিনবে কে তুমি?’
‘ফেসবুকের যোগ্যতা দিয়ে সাহিত্যের বিচার হয় না স্যার।’
আনিসের কথা শুনে রব্বানি সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন। আনিসের দীর্ঘশ্বাস বুকের মধ্যে জমে থাকলো। হতাশার দীর্ঘশ্বাসগুলো যত্রতত্র ছাড়া নিষেধ। রব্বানি সাহেব ভাবছেন, আনিস তো সঠিক বলেছে। ফেসবুকের যোগ্যতা দিয়ে সাহিত্যের বিচার করা যায় না। অথচ মানুষ বই না পড়ে চেহারা পড়েই বই কিনছে। ফেসবুকে যে যত সেলেব্রিটি তাঁর বই বেশি বিক্রি হচ্ছে। এটা সাহিত্যের জন্য হুমকি।
‘ফেসবুক যোগ্যতা দিয়ে সাহিত্যের বিচার হয় না এটা যেমন তুমি বুঝো আমিও বুঝি। কিন্তু সেটা মানুষ বুঝে না।’
‘তাহলে কী আমার বই বের হবে না?’
‘আমি বলছি না তোমার বই বের হবে না। একটা কথা মনে রাখবে। ফেসবুক যোগ্যতা দিয়ে সাহিত্যের বিচার না হলেও বর্তমানে ফেসবুক বই বিক্রির বড় প্লাটফর্ম। ফেসবুকে যার যত জনপ্রিয়তা বেশি, কোন সন্দেহ ছাড়াই তাঁর বই বেশি বিক্রি হবে। যতদিন তুমি “সহমত ভাই। ভালবাসা ভাই” টাইপের কমেন্ট না পাবে, ততদিন তোমার বই কোনো প্রকাশক বের করতে চাইবে না।’
রব্বানি সাহেবের অফিস থেকে বেরিয়ে এসে শাহবাগের রাস্তা দিয়ে হাঁটছে আনিস। একটু সামনে গেলে বাংলা একাডেমী। এইত মাত্র বছর খানেক আগে রুমার সাথে আনিসের এখানে শেষ দেখা হয়েছিল। রুমা বিদায় নেওয়ার আগমুহূর্তে হঠাৎ আকাশ মেঘে ঢেকে যায়। বিধাতা সেদিন আনিসের মনের কথা শুনেছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামে, সেই বৃষ্টিতে আনিসের চোখের জ্বল ভেসে যায়। আনিসের নীরব কান্না রুমার চোখে ধরা পড়ল না।
আনিস স্ক্রিপ্টটা শেষ বারের জন্য খুলে দেখলো।
“মালতী মহনের গায়ের সাথে হেলান দিয়ে আয়েশ করে পান খাচ্ছে। খুব ছোট বেলায় মহনের দাদী আদর করে মহনকে পান খাওয়াত। দাদী মারা যাওয়ার পর এই প্রথম মহন মুখে পান নিয়েছে। কী তিক্ত স্বাদ। এই তিক্ত জিনিস এত আয়েশ করে খাওয়ার মানে কী? ইচ্ছে করছে মুখ থেকে পান ফেলে দিতে। কিন্তু পান ফেলে দিলে মালতী কষ্ট পাবে। জগতের কিছু তিক্ত ব্যাপার আমরা আনন্দের সাথে গ্রহণ করি। এতে ভালবাসা শব্দটা গভীর হয়, অতল গভীর।
মহন খেয়াল করে দেখলো, মালতীর ঠোঁট লাল হয়েছে কিন্তু মহনেরটা হয়নি। একই জিনিশ দুজনে খাচ্ছে। অথচ একজনের ঠোঁট লাল হয়েছে অন্য জনেরটা হয়নি। মহনের কাছে ব্যাপারটা এক জটিল অঙ্ক মনে হল। এই জটিল অঙ্কের সমাধান হচ্ছে, কিছু করার আগে পুরোপুরি ভক্তি নিয়ে করতে হয়। এতে আপনি সফল না হলেও মনের দিক থেকে তৃপ্তি পাবেন।
‘মালতী!’
‘কী?’
‘আজকের রাতটা অনেক সুন্দর তাইনা?’
‘হুম।’
‘যদি এই রাত কখনো শেষ না হয়?’
‘তাহলে আপনি একটা পান ক্ষেত করবেন। পান খেতে খেতে আপনার সাথে সারারাত সারাজীবন কাটিয়ে দিবো।”
আনিস স্ক্রিপ্ট বন্ধ করে স্ক্রিপ্ট এর উপর লিখে দিলো,
” প্রিয় রাফখাতার ব্যর্থ স্বপ্ন গুলো আর কখনো কোনদিন খুলে দেখা হবে না।” (সমাপ্ত)”
মোঃ ফারুক রচিত আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প >> বেলা শেষে
সন্ধ্যা মালতী । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প । লেখক পরিচিত
লেখকঃ মোঃ ফারুক
ছোটগল্পঃ সন্ধ্যা মালতী
গল্পের জনরাঃ সামাজিক ছোটগল্প
দেশের বাড়িঃ কুমিল্লা।
পড়াশোনা/চাকরিঃ প্রবাসী
লেখকের কথাঃ ছোট বেলা থেকে বই পড়তে ভালোবাসি। বাংলা সাহিত্যের জন্য মনের গভীরে একটা টান আছে। লেখালেখি করতে পছন্দ করি।