বাংলা বানান বিভ্রান্তি । সেলিম রেজার ধারাবাহিক বানান শিক্ষা। পর্ব – ০৬

সমৃদ্ধ বাংলা ভাষায় অসংখ্য বানান নিয়েই আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে। যা কোনো ক্ষেত্রে আমাদের বানানের ব্যবহার না জানার কারণে হয়ে থাকে। আবার কিছু বানান বিভ্রান্তি ব্যকরণ গঠিত কারণেও হয়ে থাকে। সেলিম রেজার ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত, বাংলা বানান নিয়ে বিভ্রান্তিকর কিছু পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার তথ্যমূলক পোস্টের ষষ্ঠ পর্ব আত্মপ্রকাশে প্রকাশ করা হচ্ছে। বাকী পর্বগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ করা হবে।

বাংলা বানান বিভ্রান্তি এবং বানান সংশোধন । সেলিম রেজা । পর্ব – ০৩

রচনার ভাগসমূহ

উল্লেখ্য যে, আমি কোনো ভাষাবিদ বা বানান বিশেষজ্ঞ নই। ভাষা ও বানান নিয়ে লিখিত বিভিন্ন, বইপুস্তক, জার্নাল থেকে সংগ্রহ এবং গুণীজনদের সাথে আলোচনা করে আপনাদের সুবিধার্থে এই পোস্টটি সাজানোর চেষ্টা করেছি। কারো কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট বক্সে করতে পারেন। যথাযথ উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবো। এই পোস্টে কি কি জানতে পারবেন তার একটি তালিকা নিচে দেয়া হলো –

  • সুধী এবং সুধি এর ব্যবহার
  • কৃতী এবং কৃতি এর ব্যবহার
  • নির্দেশক অব্যয় টি টা খানা খানি
  • গত এবং বিগত এর ব্যবহার
  • কেন না এবং কেননা এর ব্যবহার
  • বাধ এবং বাঁধা এর ব্যবহার
  • সঙ্গে এবং সাথে এর ব্যবহার
  • উপ, সহ, যুগ্ম এর ব্যবহার
  • দূর এবং দুর এর ব্যবহার

সুধী এবং সুধি এর ব্যবহার

‘সুধি’ ও ‘সুধী’ দুটি প্রায় অভিন্ন উচ্চারণের দুটি ভিন্ন অর্থ-জ্ঞাপক শব্দ।
‘সুধি’ বাংলা শব্দ এবং ‘সুধী’ তৎসম শব্দ।

‘সুধি’ শব্দের আভিধানিক অর্থ বোধ, চেতনা, চৈতন্য, হুঁশ, স্মৃতি, অনুভব, শুভবুদ্ধি, সহজ-সরল, স্মরণশক্তি, অনুধাবন প্রভৃতি।

অন্যদিকে ‘সুধী’ শব্দের অর্থ মান্যবর, বিচক্ষণ, বিদ্বান, জ্ঞানী, পণ্ডিত, উত্তম ইত্যাদি।

অতএব আমন্ত্রণপত্রে যে অর্থ-প্রকাশে ‘সুধি’ লেখা হয় তা ভুল। আমন্ত্রণপত্রে সম্বোধন-জ্ঞাপক শব্দ হিসাবে ‘সুধী’ লিখুন, ‘সুধি’ নয়।

কৃতী এবং কৃতি এর ব্যবহার

‘কৃতী’ বিশেষণ কিন্তু ‘কৃতি’ বিশেষ্য।

কৃতিজনের গুণাবলি প্রকাশে ‘কৃতী’ শব্দ ব্যবহৃত হয়।
পক্ষান্তরে ব্যক্তি প্রশংসাযোগ্য যা করে তা ঐ ব্যক্তির ‘কৃতি’ এবং ঐ ‘কৃতি’ ব্যক্তিকে প্রকাশের লক্ষ্যে ‘কৃতী’ বিশেষণ ব্যবহার করা হয়।

উদাহরণ:
বাংলা সাহিত্যে ‘হিমু’ চরিত্রটি সৃষ্টি করেছিলেন কৃতী লেখক হুমায়ূন আহমেদ।

নির্দেশক অব্যয় টি টা খানা খানি

টা, টি, টে, টো, খান, খানা, খানি, টুকু, গুলি, গুলো, রা, এরা, আবলি, কুল, গণ, গুচ্ছ, চয়, দল(বহুবচন অর্থে), পুঞ্জ, বর্গ, বৃন্দ, মণ্ডলী, রাজি, রাশি, মালা, সকল, সমুচ্চয়, সমূহ- শব্দের পরে বসে। কথনও পৃথক বসে না।
যেমন: আমটি, দশখানা, আমগুলো, মেঘমালা, গল্পসমূচ্চয়, গ্রন্থসমূহ ইত্যাদি।
অনেকে সমূহ-কে শব্দের সাথে যুক্ত রাখতে কেন জানি ভয় পায়। এটি অবশ্য অজ্ঞতা।
তবে খান, সমূহ, সকল- ইত্যাদি শব্দের শুরুতে বসলে কখনও একসাথে বসাবেন না।
যেমন: খান বিশেক, সমূহ বিপদ, সকল শিক্ষক।

গত এবং বিগত এর ব্যবহার

বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান অনুযায়ী, সংস্কৃত ‘গত’ শব্দের অর্থ চলে গেছে এমন, অতীত, বর্তমানকালের পূর্ববর্তী, অব্যবহিত পূর্ববর্তী (গতমাস), মৃত প্রভৃতি।

অন্যদিকে, বিগত শব্দের অর্থ অতিক্রান্ত (বিগত যৌবন, বিগত সমৃদ্ধি), বিফল, মৃত প্রভৃতি। এটি বিশেষণ। ব্যুৎপত্তি এবং অর্থ বিচার করলে দেখা যায়, দুটি শব্দই সমার্থক। তবে প্রয়োগে কিছু বিশেষত্ব, প্রচলনরুচি এবং সূক্ষ্ম পার্থক্য লক্ষ করা যায়।

অব্যবহিত পূর্ববর্তী বা নিকট অতীত বোঝাতে ‘গত’ শব্দের প্রয়োগ বেশি।
অন্যদিকে, অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ অতীত প্রকাশে ‘বিগত’ শব্দের ব্যবহার অধিক। অব্যবহতি পূর্ব প্রকাশে সাধারণত ‘বিগত’ শব্দের প্রযোগ কমই দেখা যায়।

যেমন :
‘গতবছর তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন’ বাক্য দেখা গেলেও ‘বিগত বছর তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন’ বাক্য দেখা যায় না। অব্যবহিত এর পূর্ব সময় প্রকাশ করা হলে বছর সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়।
যেমন : রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

‘গত’ যে কোনো বচনে প্রয়োগ করা হয় কিন্তু ‘বিগত’ সাধারণত বহুবচনে এবং ব্যাপ্তি ও অবিরামত্ব প্রকাশে অধিক ব্যবহৃত হয়। যদিও এর কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই। তবে প্রচলনাধিক্য রয়েছে।

যেমন : গত বছর আমি ভুটান গিয়েছিলাম। ‘বিগত/ গত’ কয়েক বছরে ঋতু পরিবর্তনের পূর্বরীতি অনেকটা পাল্টে গিয়েছে।

‘গত’ ও ‘বিগত’ শব্দের একটি সাধারণ অর্থ মৃত। কিন্তু এই অর্থে গত শব্দের প্রয়োগই বেশি দেখা যায়।

যেমন : তার পিতা গতকাল ‘গত’ হয়েছেন যত বেশি বলা হয় বা লেখা হয় তার পিতা গতকাল ‘বিগত’ হয়েছেন তত বলা বা লেখা হয় না।

কেন না এবং কেননা এর ব্যবহার

‘কেননা’ শব্দের অর্থ যেহেতু।
কারণ বা ব্যখ্যা প্রকাশে ‘কেননা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়।

যেমন:
আমি যাব ‘কেননা’ আমি না গেলে সে আসতে পারবে না।

অন্যদিকে ‘কেন না’ শব্দটি ‘না’ শব্দের কারণ ব্যখ্যায় ব্যবহৃত হয়।

যেমন:
আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না, কেন না তুমি একটা মিথ্যুক।

বাধ এবং বাঁধা এর ব্যবহার

বাধা- অর্থ বিঘ্ন ঘটানো, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি
উদহারন: চলাচলে বাধা, কাজকর্মে বাধা, কথা বলতে বাধা ইত্যাদি
বাঁধা- বেঁধে ফেলা, বন্ধন, রশি দিয়ে বাঁধা
উদহারন: বস্তা বাঁধা, হাত বাঁধা, গান বাঁধা, জোট বাঁধা ইত্যাদি।


সঙ্গে এবং সাথে এর ব্যবহার

দুটির অর্থ একই।
সাথে শব্দটি কথা বলার সময়, কবিতায় ব্যবহার করা হয়।
যেমন- অর্ণা বললো, ছেলেটির সাথে তার কোনো সম্পর্ক নাই।’ (কারও প্রত্যক্ষ উক্তি লেখার সময়)

কবিতায় প্রয়োগ – এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ।
সাধারণ প্রয়োগ- ইতির সঙ্গে স্বর্ণা যাচ্ছে না।

উপ, সহ, যুগ্ম এর ব্যবহার

উপ এবং সহ বিশেষণ সূচক শব্দ তাদের পরের শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বসে।
যেমন-
সহসভাপতি, উপসচিব, সহসম্পাদক, উপসম্পাদকীয় ইত্যাদি।

তবে যুগ্ম শব্দটি আলাদা বসবে।

যেমন-
যুগ্ম সচিব, যুগ্ম মহাসচিব, যুগ্ম সম্পাদক ইত্যাদি।

দূর এবং দুর এর ব্যবহার

দু এবং দূ নিয়ে সমস্যা খুবই বেশি তৈরী হয়।

দু
সহজ উপায় আছে মনে রাখার জন্য।
খারাপ, নেগেটিভ, মন্দ, কষ্টকর ইত্যাদি বুঝালে “দু’
ব্যবহার করবেন।
যেমন-
দুর্নীতি, দুর্বল, দুরন্ত, দুশ্চিন্তা, দুঃখ, দুঃখিত, দুঃস্বপ্ন, দুঃসাহস ইত্যাদি।

দূ
দুরত্ব বুঝাতে ‘দূ’ শব্দটি বসাবেন।
যেমন-
দূর, দূরে, দূরাগত, দূরত্ব, দূরবীক্ষণ, দূরবর্তী, দূরালাপনী ইত্যাদি

আবার ব্যতিক্রম হিসাবে দূষণ, দূষিত, বিদূষণ শব্দেও দূ হবে।

কিছু কিছু ভুল এবং সংশোধন

১. অর্থ বুঝতে অসুবিধা না হলে উর্ধ্বকমা ব্যবহার করা যাবে না। সংখ্যা বুঝাতে যেমন দু, ন, ছ, শ ইত্যাদি পর উর্ধ্বকমা দেয়া যাবে না।
যেমন- দু’জন নয় হবে দুজন।

২. খৈ, কৈ, দৈ, বৌ এগুলো বদলে লিখতে হবে খই, কই, দই, বউ।
তবে মৌ লেখার সময় ঔ-কার থাকবে।

৩. গুলি, গুলা না লিখে লিখতে হবে গুলো

৪. হয়তো, নয়তো থেকে ও-কার বাদ যাবে না।

৫. হাজার হাজার, লাখ লাখ না লিখে হাজারো, লাখো লিখতে হবে।

৬. তফাৎ, বহুৎ নয়, লিখতে হবে তফাত, বহুত।

৭. শব্দের শেষে বিসর্গ লেখা যাবে না।
যেমন- মূলতঃ, ক্রমশঃ প্রধানতঃ না লিখে লিখুন মূলত, ক্রমশ, প্রধানত।

৮. নারী বুঝাতে তৎসম শব্দে ঈ-কার হবে।
যেমন- সুন্দরী, তরুণী, মানবী, কল্যানী।

৯. সাধু ভাষা এবং দেশীয় শব্দে ‘ঙ্গ’ এর পরিবর্তে ‘ঙ’ ব্যবহার হবে।
যেমন- আঙুল, ঘুঙুর, মাছরাঙা, রঙিন, লাঙল, হাঙর, আঙিনা ইত্যাদি।

১০. ১-৯ পর্যন্ত সংখ্যা গুলো কথায় লিখতে হবে। আবার ৯ এর উপরে ১০- ৯৯৯ পর্যন্ত অঙ্কে লিখতে হবে। তবে হাজারের উপরে চলে গেলে দুইভাবেই লেখা যাবে।

বাংলা বানান বিভ্রান্তি । সেলিম রেজার ধারাবাহিক বানান শিক্ষা। পর্ব – ০৭

বাংলা বানান নিয়ে বিভ্রান্তির হার বেশ ভয়াবহ। সেখান থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিবে সেলিম রেজার সহজ বানান শিক্ষা। পরবর্তী পর্বগুলো ক্রমানুসারে প্রকাশ করা হবে।

আত্মপ্রকাশ সম্পাদক

http://attoprokash.com

আত্মপ্রকাশে অপ্রকাশিত গল্প এবং বুক রিভিউ এবং প্রবন্ধ প্রকাশ করতে যোগাযোগ করুন (ইমেইল-attoprokash.blog@gmail.com) অথবা ফেইসবুক পেইজ ইনবক্স। সর্বনিম্ন ১০০০ শব্দ হতে যেকোনো ঊর্ধ্ব সীমার ছোট গল্প গ্রহণযোগ্য। আপনার গল্প আত্মপ্রকাশ বিচারকদের দ্বারা নির্বাচিত হলে আপনাকে জানানো হবে এবং তা সরাসরি প্রকাশ করা হবে আত্মপ্রকাশে। আপডেট জানতে ফেইসবুক গ্রুপে সক্রিয় থাকুন।

1 Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *