জোছনায় ফেরা – তানভীর তূর্য । সামাজিক ছোটগল্প । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প

পেছনে ফেলে আসা জোছনা রাতগুলোর কথা প্রচণ্ড রকমভাবে মনে পড়ে। পূর্ণ চাঁদের আলোয় চারপাশ যখন থৈ থৈ করতো তখন যেন আমাদের বাড়িতে উৎসব শুরু হয়ে যেত। রাত বাড়ার সাথে সাথে সোনা রঙে মোড়ানো চাঁদটা যেমনি তার উজ্জ্বল আলো ছড়াতে শুরু করতো অমনি বাবা গলা ছেড়ে আমাদের ডাকতে আরম্ভ করতেন। উঠোনে বেশ কয়েকটা মাদুর পাতা হতো। বাবা সবার আগে গিয়ে সেখানে বসে পড়তেন। বাবার গলা পেতেই আপা তার হারমোনিয়াম নিয়ে উঠোনে গিয়ে হাজির হতো। এরপর আমি বিলুকে ডাকতে যেতাম। আমি ডাকতে গেলেই বিলু আমার ওপর রেগে যেত। বিলুটা খুব মুখচোরা স্বভাবের। হৈ হুল্লোড় মোটেই পছন্দ করতো না। উঠোনে যাওয়ার জন্য ওকে অনেক সাধাসাধি করতে হতো। কিন্তু যেমনই বাবা জোরে ডাক দিয়ে বলতেন, “কই রে বিলু মা, আয় তাড়াতাড়ি।”
বিলু তখন বিষণ্ণ বদনে নূপুর জোড়া নিয়ে উঠোনের দিকে অগ্রসর হতো। তিন ভাইবোনের মধ্যে আপা যেমন দারুণ গাইতো বিলুও তেমনি দারুণ নাচতো। আপা অবশ্য গানটা বাবার কাছ থেকেই শিখেছিল। আর আমি শুধু দর্শক হয়ে জোরেজোরে হাত তালি দিতাম।
রেনু আপা, মিলি আপা, শাহেদ ভাই, তারেক, সুমনা, দিলু, ঝুনুরা সবাই চলে আসতো। সবাই আসার পর একসাথে বসে শুরু হয়ে যেতো আমাদের আনন্দ আসর। বাবা হারমোনিয়াম বাজাতেন আর আপা প্রাণখুলে গাইতো, “আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে।” কখনও কখনও বাবার গাওয়া “তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে” সাথে বিলুর নূপুরের ধ্বনি কোথায় যেন আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেতো। যেখানে মন খারাপের গল্পেরা বাসা বাঁধতো না। শাহেদ ভাইয়ের কৌতুক শুনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তাম। রেনু আপা কী সুন্দর করেই না আবৃত্তি করতো, “বল বীর, বল উন্নত মম শির”। যে আবৃত্তি শুনে সত্যি সত্যিই বিদ্রোহ করতে ইচ্ছা করতো। বাবা অত বড় মানুষ হয়েও আমাদের সাথে কত সহজেই না মিশে যেতেন! বাবার ছেলেমানুষিগুলো দেখতে বড় ভালো লাগতো।
মা পেঁয়াজ মরিচ আর চানাচুর দিয়ে ঝাল ঝাল করে মুড়ি মাখানো সাথে গরম গরম চা নিয়ে আসতেন। মা চা মুড়ি নিয়ে আসলেই বাবা বলতেন, “এই শোনো, ছেলেমেয়েরা তোমার আর আমার যুগল নাচ দেখবে বলে বায়না ধরেছে। শীলু গাইবে তুমি আর আমি নাচবো, কেমন? হা হা হা।”
মা চোখ কটমট করে বলতেন, “তোমার না হয় বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরেছে আমার তো আর ধরেনি। তোরা আমাকে নিয়ে টানাটানি করিস না বাবা। যা করবি তোদের চাচার সাথেই কর।”
এরপর মা হেঁসেলে গিয়ে খিচুড়ি রান্নার আয়োজন করতেন। রান্না শেষ হতেই সবাই গরম গরম খিচুড়ি সাথে ডিমভাজি চেটেপুটে খেয়ে নিতাম। আহ্‌! কি স্বাদ। অনেক রাত পর্যন্ত চলতো আমাদের গান গল্প আর আড্ডার আসর। সেখানে কোনো ক্লান্তি থাকতো না বরং সকলে চাইতাম রাতটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে যাক। সোনালি চাঁদের আলোয় আমরা ভিজে যেতাম। যে ভিজে যাওয়ার তৃষ্ণা কখনও মিটতো না বরং বাড়তেই থাকতো একটু একটু করে।

সময় বয়ে যায় সময়ের নিয়মে। বর্তমান সময়টা যেন প্রচণ্ড ম্লান আর স্থবির। ইট কাঠের শহরে উঁচু উঁচু দালানের আড়ালে উঁকি দেয়া চাঁদটাকে মনে হয় কেমন যেন ফ্যাকাসে। এখন তাই জোছনা রাতগুলোও বড্ড ম্রীয়মান আর রঙহীন। কতগুলো বছর হয়ে গেল একসাথে বসে আর জোছনা দেখা হয় না। জোছনা দেখার তৃষ্ণার্ত পাখিটা বুকের মধ্যে ডানা ঝাপটায়। আপার বিয়ে হয়ে গেছে সেই কবে। একদিন আপাকে বলেছিলাম, “আচ্ছা আপা, এখনও কি তুই গান করিস আর জোছনা দেখিস?” আপা হেসে বলেছিল, “এখন যদি আমি গান করতে করতে জোছনা দেখি তাহলে সবাই বলবে এই মেয়ের নির্ঘাত মাথার ব্যামো হয়েছে। অতি শীঘ্রই ডাক্তার দেখাতে হবে। জানিস তো বাপন, সংসারে মেয়েদের শখ আহ্লাদগুলোকে বাড়তে দেয়া যায় না। চেপে রাখতে হয়। না হলে এই সমাজের ছন্দপতন হবে যে।” এরপর আমি আর আপাকে কিছুই বলতে পারিনি।

বিলুরও বিয়ে হয়েছে। ওর বর দেশের বাইরে চলে যাওয়ার পর বিলু এখন আরও চুপচাপ হয়ে গেছে। অনেকদিন ওর নাচ দেখা হয় না। কানাঘুষো শোনা যায় বিলুর বর ওখানে কোনো এক বিদেশিনীকে বিয়ে করে নতুন সংসার পেতেছে। বিলু এসবের কিছুই বিশ্বাস করে না। সে বিশ্বাস করে কোনো এক জোছনা রাতে ওর বর ফিরে এসে ওকে বলবে, “এভাবে মুখ গোমড়া করে বসে আছো কেন, বিলু? বাইরে উথাল পাথাল জোছনা উঠেছে। এসো, দুজনে আজ হাতে হাত ধরে অনন্ত অসীমের পথে হেঁটে যাব।” বিলুর কত স্বপ্ন ছিল বিয়ে নিয়ে। কত গল্প করতো আমার সাথে। সে স্বপ্নগুলো ধীরে ধীরে ওর বিশ্বাসে পরিণত হয়েছিল। আমি মনে মনে প্রার্থনা করি বিলুর বিশ্বাসগুলো যেন সত্যি হয়ে ওর কাছে ফিরে আসে। বিশ্বাস ভঙ্গের যন্ত্রণায় যেন ওকে ক্ষত বিক্ষত হতে না হয়।



রেনু আপার কথা খুব মনে পড়ে। ওর কথা মনে পড়লেই বুকের মধ্যে চিনচিন করে ওঠে। হঠাৎ কী এক কঠিন অসুখে পড়ে কোথায় হারিয়ে গেল রেনু আপা। রেনু আপার জীবনের শেষদিনগুলো কেটেছে হাসপাতালের ছোট্ট কেবিনে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে। একদিন হাসপাতালে রেনু আপাকে দেখতে গিয়ে প্রচণ্ড ধাক্কা খাই। ক্রমশ শুকিয়ে শুকিয়ে কঙ্কাল হয়ে যাওয়া রেনু আপাকে চিনতে বড্ড কষ্ট হচ্ছিল। আমি বেদনা লুকিয়ে রেনু আপার হাত ধরে বলেছিলাম, “তোমার কিচ্ছু হবে না রেনু আপা। আমরা আবার একসাথে জোছনা দেখবো। তুমি আবার আবৃত্তি করবে ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির’। রেনু আপা অনেক কষ্টে হেসেছিল। প্রাণহীন নীরস হাসি। আসলে বুকে ব্যথার মহাসমুদ্র ধারণ করে কি আর প্রাণোচ্ছল হাসি হাসা যায়? আমি যখন চলে আসছিলাম তখন খেয়াল করলাম রেনু আপার চোখ দিয়ে বেদনার অশ্রু গড়িয়ে যাচ্ছে। সে দৃশ্য আমার পক্ষে দেখা সম্ভব ছিল না বলে অতি দ্রুত চলে আসি। এরপর রেনু আপার সাথে আর দেখা হয়নি। এখন হয়তো রেনু আপা কোনো এক অদেখা ভুবনে বসে তার দরাজ গলায় আবৃত্তি করতে করতে জোছনায় ভিজে যায়। রেনু আপা মারা যাওয়ার পর তারেক ভাই হঠাৎ করেই কেমন যেন হয়ে গেল। প্রচণ্ড ভালোবাসতো রেনু আপাকে। শুনেছি কোনো এক মানসিক হাসপাতালে রেনু আপার একটা ছবি হাতে নিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করতে করতেই তারেক ভাইয়ের সকাল সন্ধ্যাগুলো একাকার হয়ে যায়।

শাহেদ ভাই আর মিলি আপার সাথে বহুকাল দেখা হয়নি। তারা দুজনে বিয়ে করে দেশের বাইরে বেশ ভালোই আছে। ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে তাদের। মিলি আপা তার প্রিয় বান্ধবী রেনুর নামে মেয়ের নাম রেখেছে রেনু। ছোট্ট রেনুকে যখন ছবিতে দেখি সত্যি সত্যিই রেনু আপার সাথে কোথায় যেন মিল খুঁজে পাই। কেন এমন হয় জানি না। প্রকৃতি কি কোনো অদ্ভুত রহস্য লুকিয়ে রেখেছে? জানতে ইচ্ছে করে।
সুমনা, দিলু, মিঠু, ঝুনু এদের কোনো খোঁজ নেই। কে কোথায় আছে তাও জানি না। কেমন করে যেন এক নিমিষেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে।

এখন জোছনা রাতে বাবা প্রায়ই বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত বের করে অদ্ভুত ভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন। বাবাকে দেখে মনে হয় জেলখানার কোনো কয়েদি মুক্তির আশায় বসে আছে। আমি যদি বলি, “কি করছো বাবা?” বাবা মুখ কাঁচুমাচু করে বলেন, “জোছনা ধরি রে। খোলা আকাশের নিচে যেয়ে তো আর জোছনা মাখতে পারি না, তাই কী আর করবো বলতো?” আমাদের এই বিশাল বহুতল ভবনের ছাদে যাওয়া যায় না। বাড়িওয়ালার তরফ থেকে কঠিনভাবে মানা করে দেওয়া হয়েছে। তাই বাবা মাঝে মাঝেই এই ছেলেমানুষিগুলো করেন। বাবার জন্য বড্ড মায়া হয়। মাকেও দেখি খাঁচায় বন্দি পাখির মতো ছটফট করতে। কিন্তু কিচ্ছু বলতে পারেন না। শহুরে যান্ত্রিক জীবনের যান্ত্রিকতার সাথে মানিয়ে নেওয়ার লড়াই চালিয়ে যান।

আমরা সকলেই একটা অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা ছিলাম। মায়াময় ভালোবাসার শক্ত বাঁধন। দুরন্ত সময়ের সাথে পাল্লা দিতে দিতে দূরত্ব আমাদের সেই বাঁধনকে কিছুটা নড়বড়ে করে দিলেও ছিন্ন হয়ে যায়নি একদম। হৃদয়ের বাঁধন কখনও ছিন্ন করা যায় না। আর এই বিশ্বাসটুকু অন্তরের মণিকোঠায় জ্বলজ্বল করছে বলেই আমি অপার হয়ে বসে থাকি একদিন নিশ্চয় কোনো এক উথাল পাথাল জোছনা রাতে আমাদের সেই বাড়ির উঠোনে আবার মাদুর পাতা হবে। আবার আমাদের আনন্দ আসর বসবে। বাবা আবার হারমোনিয়াম বাজাবেন, মা আবার খিচুড়ি রান্না করবেন, আপা আবার প্রাণ খুলে গাইবে, বিলু আবার নূপুরের ধ্বনি তুলে নাচবে আর ওর বর মিটমিটিয়ে হাসবে, রেনু আপার মতো করেই ছোট্ট রেনু আবৃত্তি করবে, আনন্দে তারেক ভাইয়ের চোখে জল চলে আসবে, ভালোবাসা আর ভরসায় শাহেদ ভাই এবং মিলি আপা একজন আরেকজনের হাত শক্ত করে ধরে থাকবে আর আমি, দিলু, মিঠু, সুমনারা আবার দর্শক হয়ে জোরেসোরে হাততালি দিতে থাকবো। আমরা সবাই হাসবো, আমরা সবাই ভাসবো। আমরা আবার একসাথে জোছনায় ফিরবো। ফিরতে যে আমাদের হবেই। (সমাপ্ত)

তানভীর তুর্য রচিত ভালোবাসার গল্প >> হৃদমাঝারে

হৃদমাঝারে-তানভীর-তূর্য-আত্মপ্রকাশ-নির্বাচিত-গল্প-hrrid-majharey-tanvir-turza-attoprokash-selected-story (1)-min
হৃদমাঝারে-তানভীর-তূর্য-আত্মপ্রকাশ-নির্বাচিত-গল্প

হৃদমাঝারে । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প । লেখক পরিচিতি

রচনার ভাগসমূহ

লেখকঃ তানভীর তূর্য
ছোটগল্পঃ জোছনায় ফেরা
গল্পের জনরাঃ সামাজিক গল্প
দেশের বাড়িঃ কাদিরগঞ্জ, রাজশাহী।
পড়াশোনাঃ এমবিএ, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (২০১৯)।

tanvir-turzo-attoprokash-writter-তানভীর-তূর্য-আত্মপ্রকাশ-নির্বাচিত-গল্প-লেখক

লেখক- তানভীর তূর্য

লেখকের কথা

একটা সময় মনে হতো কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছি। নিজেকে আর খুঁজে পাচ্ছি না। নিজেকে আবার খুঁজে পাওয়ার  অদম্য ইচ্ছা থেকেই লেখালেখির শুরু। মনের তৃপ্তির জন্যই লেখালেখি করি। পড়তেও অসম্ভব ভালোবাসি। আমি মূলত ছোট গল্প লিখি। গল্পের মধ্য দিয়েই আমি আমাদের চারপাশের গল্প, জীবনের গল্পগুলোর প্রতিচ্ছবি আঁকতে চেষ্টা করি।

আত্মপ্রকাশ সম্পাদক

http://attoprokash.com

আত্মপ্রকাশে অপ্রকাশিত গল্প এবং বুক রিভিউ এবং প্রবন্ধ প্রকাশ করতে যোগাযোগ করুন (ইমেইল-attoprokash.blog@gmail.com) অথবা ফেইসবুক পেইজ ইনবক্স। সর্বনিম্ন ১০০০ শব্দ হতে যেকোনো ঊর্ধ্ব সীমার ছোট গল্প গ্রহণযোগ্য। আপনার গল্প আত্মপ্রকাশ বিচারকদের দ্বারা নির্বাচিত হলে আপনাকে জানানো হবে এবং তা সরাসরি প্রকাশ করা হবে আত্মপ্রকাশে। আপডেট জানতে ফেইসবুক গ্রুপে সক্রিয় থাকুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *