অন্দরমহল বুক রিভিউ । সাদাত হোসাইন। রিভিউয়ার >> তানজিনা তানিয়া

সাদাত হোসাইন রচিত অন্দরমহল বুক রিভিউ নিয়েই আত্মপ্রকাশের এই আয়োজন। বইটির রিভিউ করেছেন তানজিনা তানিয়া।

বইয়ের নাম: অন্দরমহল
লেখক: সাদাত হোসাইন
বইয়ের ধরণ: সমকালীন উপন্যাস
প্রকাশনা: ভাষাচিত্র প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ: অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬
প্রচ্ছদ: হাসিবুল ইসলাম নাসিম
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৪৩৮
মুদ্রিত মূল্য: ৬৫০ টাকা

[taq_review]

রচনার ভাগসমূহ

অন্দরমহল বুক রিভিউ । সাদাত হোসাইনের সমকালীন উপন্যাস

“গঙ্গামহল অথবা অন্দরমহলের গল্প” . “আমাদের কিছুই নেই, অথচ সবটা সময়জুড়ে ভাবি, এই বুঝি নিঃস্ব হলাম। ” ৪৩৮ পৃষ্ঠার উপন্যাসের একেবারেই শেষের লাইনটি দিয়ে শুরু করলাম রিভিউ লেখা। কারণ এই একটি লাইন বা উক্তির মর্মার্থ যদি বীণাবালা বুঝতে পারতো তবে গোটা বইটাই সৃষ্টি হত না বোধহয়। “অন্দরমহলের বাতাসে-বাতাসে ভয়ানক দুর্যোগের আভাস। এই দুর্যোগ কালব্যধি গুটিবসন্তের চেয়েও ভয়ঙ্কর।” ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তির নেশা বড় নেশা। বর্তমান সময়ের তরুণ প্রজন্মের জনপ্রিয় লেখক সাদাত হোসাইনের দীর্ঘ কলেবরের বইগুলো পড়ার সাহস করে উঠতে পারিনি আগে। কারণ বড় কলেবরের বই দেখলেই ভয় লাগে আমার। কিন্তু এই অন্দরমহলের প্রথম পাতা খোলে কয়েক লাইন পড়তেই আমি পুরো বইটা পড়ার তীব্র ইচ্ছা বোধ করলাম। কারণ এরপর কি হবে? এই একটি প্রশ্নে পুরো বইতে আমার ভিতরের চোখ অসংখ্যবার লেখা দেখেলো।

অন্দরমহল বুক রিভিউ । কাহিনী সংক্ষেপ

ক্ষমতার জন্য কৌশলে লড়াই। তবে কোনো শক্ত প্রতিপক্ষের সাথে নয়। কারণ বীনাবালা যেভাবে ক্ষমতাটা চেয়েছে সেভাবে চায়নি দেবেন্দ্রনারায়ণ বা দীপেন্দ্রনারায়ণ। বিষ্ণুনারায়ণের তিন পুত্রের মধ্যে মোজো পুত্র দেবেন্দ্রনারায়ণই অধিক যোগ্য সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে। দেবেন্দ্রনারায়ণের বড় ভাই অবনীন্দ্রনারায়ণেরও জমিদারির প্রতি কোনো লোভ নেই। উনি হচ্ছেন গানপ্রিয় মানুষ। ঝামেলা উনার পছন্দ নয়। এদিকে কনিষ্ঠ দীপেন্দ্রনারায়ণ বড় দুই ভাইকে রেখে তার পিতা পরবর্তী জমিদার হওয়ার কথা ভাবতেই পারে না। কিন্তু জমিদার পরিবারের রক্ত বহমান দীপেন্দ্র’র মনে কি জমিদার হওয়ার সুপ্ত বাসনা লুকায়িত নেই? আর অবনীন্দ্রনারায়ণের স্ত্রী বীণাবালা, সেও তো অন্য এক জমিদারের কন্যা। তাহলে সে কি চায় না তার স্বামী-পুত্র তার শ্বশুড় পরবর্তী জমিদার মনোনীত হোক? এই জমিদারির প্রতি লোভ থেকে ঘটমান ঘটনাগুলকে ঘিরেই এগিয়ে গেছে বইয়ের গল্প। জমিদার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা হচ্ছে রেণুকা, সর্বজয়া, সুদক্ষিনা,দ্বিজ েন্দ্র। এই বাড়ির সাথে বিভিন্নভাবে জড়িত অন্যান্যদের ভূমিকাও কিন্তু বইতে গৌন নয়। হরিহরণ, হেমাঙ্গিনী দেবী, রতনকান্তি, বিভূতিনাথ, গৌরাঙ্গ বারুজ্জে, দিবাকর চাটুজ্জে প্রমুখ।

অন্দরমহল মহল বুক রিভিউ । সাদাত হোসাইন উক্তি

সাদাত হোসাইনের কিছু ভালো লাগা উক্তি ও বাণী নিয়েই অংশটি। পড়ে ভালো লাগবে আশা করি।

“প্রতিশোধের নেশা বড় ধ্বংসের নেশা”।

 

“মানুষের জীবনে সময়ের চেয়ে এত মূল্যবান কিছু নেই”।

 

“জগতে একমাত্র ভালোবাসা আর মমতারাই বেঁচে থাকে। এগুলো ছাড়া মানুষ একা একা কখনও বেঁচে থাকতে পারে না”।

 

“যে মানুষ তার ঘৃণ্য কাজের জন্য যুগ যুগ ধরে মানুষের ঘৃণাতে সওয়ার হয়ে বেঁচে থাকে, সেই বেঁচে থাকাকে বেঁচে থাকা বলে না।”

 

“মানুষের জন্মই বিভ্রমকে মায়া ভেবে ভুলে থাকার জন্য।”

 

“মৃত্যু ভয়ংকর কারণ মৃত্যু যন্ত্রণাময়।”

 

“জগৎ সংসারের হিসেব নিকেশ ভুলে থাকা সহজ নয়। এ বড় কঠিন হিসেব। সেই কঠিন হিসেবের ভিতর থাকে মস্ত বড় ফাঁকি।”

অন্দরমহল বুক রিভিউ । পাঠ প্রতিক্রিয়া

জমিদারি নিয়ে পড়া প্রথম বই এটি আমার। মুহুর্তে মুহুর্তে চমকে উঠছিলাম বইটি পড়ে। জমিদারি হাতানোর জন্য মানুষ কতটা নির্দয় নৃশংস হয় সেটা এই বই না পড়লে জানতে পারতাম না। সিংহের মতো দাম্ভিক দেবেন্দ্রনারায়ণের গুটিবসন্তের মতো রোগের কবলে পড়ে নীরবে পরাস্ত হতে হয় ভাবী বীণাবালার কাছে। একজন মানুষ কোনো কারণে একটু দুর্বল হয়ে গেলে তাকে আসলেই সবাই ঠেলে দেয় নীচের দিকে। জমিদারদের স্বভাবে একটু আধটু দোষ থাকে বলে প্রচলিত আছে। বিষ্ণুপুর জমিদার পরিবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। হঠাৎ করে নৌকাতে পাওয়া গুটিবসন্তে আক্রান্ত পিচ্চি ছেলে বিভুঁই এই জমিদার পরিবারেরই কারোর রং তামাশার ফল৷ কিন্তু কে বিভুঁইয়ের বাবা? এটা চমৎকার একটা টুইস্ট। এই বিষয়টা পড়তে গিয়ে দারুণ পুলকিত হয়েছি। হেমাঙ্গিনী দেবী আর হরিহরণের সম্পর্কটা যে এত কাছের সেটা লেখক প্রথমেই বুঝতে দেয়নি। বজরাডুবির চরে জমিদার যোগেন্দ্রনারায়ণের আক্রমণের শিকারে অনেকেই নিজেদের সাজানো জীবন হারিয়েছে৷ জমিদারদের এই নৃশংসতা পড়তে গিয়ে জমিদারি প্রথার উপর রাগ ধরেছে বেশ। বারোহাটিতে বাগানবাড়ি করার সময় সেই বাড়ি দেবেন্দ্রনারায়ণের পছন্দ হয়নি বলে কারিগরকে আজীবন কাজ করতে নিষেধাজ্ঞা দেয় দেবেন্দ্রনারায়ণ। মনে মনে মানুষগুলোর অনেক ক্ষোভ পুষা থাকে জমিদারদের উপর৷ থাকবেই তো। জমিদার যোগেন্দ্রনারায়ণের রাক্ষসী থাবা’র কবলে পড়েই তো হেমাঙ্গিনী আজ বাইজি, হরিহরণ ছোট-খাটো দোকানদার। চিরায়ত জমিদারি প্রথার রীতিনীতি যেমন ঠাঁই পেয়েছে বইতে, তেমনি ঠাঁই পেয়েছে কঠিন মনের জমিদারদের ভিতরেও যে অল্প হলেও ভালোবাসা আর মায়ে লুকিয়ে থাকে সেই বিষয়টিও। জমিদারি রক্ত শরীরে থাকলেই যে আবার সবাই ক্ষমতা আর নষ্টামিতে বুঁদ হয়ে থাকে না তার উদাহরণ অবনীন্দ্রনারায়ণ। যে জমিদার হয়েও সেই ভার কাঁধ থেকে ফেলে দিতে মরিয়া। সে হচ্ছে ভাবের মানুষ। তার ভিতরে বাস করে একজন গানের বাউল। তার কাছে সবার পরিচয় কেবল মানুষ। রাজা-প্রজা নয়। সহজ সরল এই মানুষটা নিজের স্ত্রী’র কাছে প্রতারিত হয়ে এসেছে সারাটি জীবন। অথচ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সে কোনোকিছুই। অন্য বংশের রক্ত নীরবে বড় হয়ে উঠেছে জমিদার পরিবারে। সেটাও কেউ টের পায়নি। এই সবকিছুই টুইস্ট আর টুইস্ট। সমকালীন উপন্যাসে জীবনবোধের কাহিনীর ভিতরে টুইস্ট দিলে বইটা কতটা অসাধারণ হয়ে উঠে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও গঙ্গামহলের ভিতরের গল্পই ফোকাস করা হয়েছে বইতে। তবুও এই বইয়ের গল্পের অনেকটা জুড়েই ছড়িয়ে আছে হরিহরণ বণিক আর হেমাঙ্গিনী। বইটা পড়ার সময় অন্য এক জগতে হারিয়ে গিয়েছিলাম যেন। . প্রিয় অপ্রিয় চরিত্র : আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে হরিহরণ চরিত্র। এই মানুষটা ভিতরে ভিতরে কতটা দুঃখ বইয়ে বেড়িয়েও জমিদার বাড়ির জন্য আলাদা মায়া পুষে রাখে বুকের ভিতর। এই জমিদার বাড়িই নিঃস্ব করেছে হেমাঙ্গিনী আর হরিহরণকে। তবুও এই দুইজনের জগতের আর সকল মায়া আর নিয়মের গণ্ডি ভেদ করে ভালোবাসা আগলে রেখেছে বুকের কোণে৷ সারাজীবন ঠকে যাওয়া হেমাঙ্গিনী দেবী শেষবার দেবেন্দ্রনারায়ণকে না দেখতে পারার বেদনায় আকুলি বিকুলি করে। হরিহরণের পরে এই অসহায় মেয়েটি আমার মনে আঁচড় কেটেছে। সহজ সরল অবনীন্দ্রনারায়ণের জন্য আফসোস হয় আমার। মানুষ এত সরল হয় কেন? উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র দেবেন্দ্রনারায়ণের প্রেমে পড়বে হয়তো অনেক যুবতী। জমিদারদের গতানুগতিক দোষের ধারা অব্যাহত রেখে দেবেন্দ্রনারায়ণেরও ছিল মেয়ে মানুষের নেশা । নয়তো এই দেবেন্দ্রনারায়ণ হয়তো বইতে আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্রটি হত। বিশেষ করে তপতীর সাথে করা ঘটনাটির জন্য দেবেন্দ্রনারায়ণ আমার মনে তেমন জায়গা করে নিতে পারেনি। গঙ্গামহলের কিছু লোভী কুচক্রি দাস-দাসী আর কাজের লোকের লোভাতুর মন মানসিকতার জন্য তাদের উপর রাগ হয়েছে। আর সব নষ্টের গোড়া বীণাবালাকে তো অসহ্য লাগছিলো আমার। অপ্রিয়’র তালিকায় তার পুত্র দ্বিজেন্দ্রও রয়েছে। সবশেষে একটি কথাই বলবো যে, জমিদারি নিয়ে লেখা অসাধারণ এবং অসাধারণ একটি বই। সবাই বইটি পড়ার চেষ্টা করবেন। আপনার পাঠ শুভ হোক।

অন্দরমহল লেখক পরিচিতি ও লেখকের প্রাপ্ত পুরস্কার

বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় তরুণ লেখক সাদাত হোসাইনের জন্ম ১৯৮৪ সালের ২১ মে মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলার কয়ারিয়া গ্রামে। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন। ভষাচিত্র প্রকাশনী থেকে প্রথম বের হয় তার আলোকচিত্রের গল্পের বই “গল্পছবি”। তারপর প্রকাশিত হয় তার ছোটগল্পের বই “জানালার ওপাশে”। ছোট কলেবরে মাত্র ৭৯ পৃষ্ঠায় আবদ্ধ করেছেন ” আমার আর কোথাও যাওয়ার নেই” ।এরপর একে একে প্রকাশ করেছেন অন্দরমহল, আড়শিনগর, মানবজনম, নিঃসঙ্গ নক্ষত্রের মত বড় কলেবরের সব উপন্যাস। এই পর্যন্ত বের হয়েছে উনার তিনটি কবিতার বই এবং ছবি ও গল্পের সমন্বয়ে বই গল্পছবি। শুধু সাহিত্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে এগিয়ে গেছেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণেও। চ্যানেল নাইনে প্রচারিত তার “বোধ” শর্টফিল্মটি প্রশংসার ঝড় তুলেছে। আলোকচিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র,লেখালেখির জন্য কালচারালার এচিভম্যান্ট ক্যাটাগরিতে জিতেছেন “জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ২০১৩।

[taq_review]

বইটি যেকোনো অনলাইন মাধ্যম থেকে সহজেই সংগ্রহ করে নিতে পারেন।

তানজিনা তানিয়া

http://www.attoprokash.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *