সুখ – মোঃ ওয়ালীউল্লাহ অলি । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প

ফোনে কথা বলতে বলতে হন্যে হয়ে ছুটছে ফারহান। রকেট চালাইয়া কই যান ভাই? রিন্টুর ডাকে থামতে হলো।
পিছন ফিরে রিন্টুকে দেখলো ঢাকা মেডিকেল ইমারজেন্সির গেইটের চায়ের দোকানের সামনে বাইকে বসে আড্ডা দিচ্ছে। দেখামাত্রই, তাড়াহুড়া করে রিন্টুর কাছে গেল।
ভালো হইছে তরে পাইছি। তোর ফোন বন্ধ কেন? তোর রক্তের গ্রুপ এ নেগেটিভ তো? রক্ত দিবার পারবি? ঢাকা মেডিকেলেই। সিজারের রোগী, সিরিয়াস অবস্থা, আর্জেন্ট রক্ত লাগে। একটানে বলে হাফাতে থাকলো ফারহান।
– না ভাই, আমিতো এক সপ্তাহ আগেই রক্ত দিলাম। আপনিইতো ফোন দিছিলেন – রক্ত লাগবে, ব্রেইন টিউমারের রোগী। ভুইলা গেলেন।
অহহো, ভুইলাই গেছিলাম, এত জনের লিস্ট, মাথায় সব সময় থাকে না।
– সিজারের রোগী রক্ত ম্যানেজ কইরা রাখে নাই? তাও আবার রেয়ার গ্রুপ।
রাখছিল। কিন্তু বাথরুমে পইরা গেছে গেছে হুট কইরা, ডেলিভারি ডেইটের আগেই সিজার করা লাগবো। আর ২ ঘন্টার মধ্যে রক্ত লাগে। দুর্ভাগ্যবশত যাদের বলে রাখছিল, তাদের দুইজন ঢাকায় নাই আর ১ জন বাইক এক্সিডেন্ট কইরা নিজের অবস্থাই খারাপ। সকাল থাইকাই দৌড়াইতেছি ফোন নিয়া। পাচ্ছি না কোথাও। আমার লিস্টের সব ডোনার হয় দিয়া দিছে নয়ত দেওয়ার মত অবস্থা নাই।
– পরিচিত, ভাই? ফারহানের বিচলিত অবস্থা দেখে রিন্টো জিজ্ঞেস করলো।
খুব পরিচিত, বলেই ফারহান আবার ফোন লিস্ট স্ক্রল করতে থাকলো। এরই মধ্যে কয়েকবার পুরো লিস্ট চেক করা হয়ে গিয়েছে। ব্যাপারটা ভ্রমের মত ধরে বসেছে ফারহানকে।

রিন্টু, ফারহানকে ফ্রিতে অনেক মানুষের দায়বদ্ধতা নিতে দেখেছে, কখনো এত বিচলিত হতে দেখে নি। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে বললো – ভাই, বাইকে বহেন। নদীর অই পাড়ে আমার এক বন্ধুর এ নেগেটিভ রক্ত। অই রক্ত দিতে ভয় পায়। ধইরা লইয়া আসুম। বেশি সময় লাগবো না।
জোর করে কি রক্ত নেয়া যায়। দায়বদ্ধতা না থাকলে জোর করে লাভ নাই।
আরে ভাই চলেন। আইজকা দায়বদ্ধতা না থাকলেও দিতে হইবো।
ফারহানও আর কথা বাড়ালো না। বাইকের পিছনে উঠে বসলো।

আজ প্রায় আট বছর, ফারহান ফ্রিতে অসহায় মানুষদের রক্ত ম্যানেজ করে দিচ্ছে। আট বছর আগে রক্তের অভাবে, বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর ফারহান প্রতিজ্ঞা করেছিল, চোখের সামনে কাউকে রক্তের অভাবে মরতে দিবে না।

এক ঘন্টার মধ্যেই ওরা ডোনার নিয়ে ঢাকা মেডিকেল পৌছালো। ব্লাড ব্যাংকের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল রিমা। ফারহানকে দেখে এগিয়ে আসলো।
ফারহান ভাই, আপনার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। ডাক্তারের অ্যাসিস্ট্যান্ট দুই বার রক্তের কথা জিজ্ঞেস করে গিয়েছে। আধা ঘন্টার মধ্যে অপারেশন। আপুকে অটিতে নিয়ে গিয়েছে এর মধ্যে।
ডোনার ম্যানেজ হয়ে গিয়েছে। টেনশন করো না, বলে ফারহান রিমার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা বিচলিত ভদ্রলোকের দিকে তাকালো।
রিমা দৃষ্টি অনুসরণ করে ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। ফারহান ভাই, উনি রফিক ভাই। রোদেলা আপুর হাসবেন্ড।

রফিক সাহেব হাত বাড়িয়ে দিলেন। হাতজোড় করে করমর্দন করতে করতে বললেন- ফারহান ভাই, আপনাকে কি বলে ধন্যবাদ দিবো বুঝে উঠতে পারছি না। আজ সকালেই আপনার নাম প্রথম শোনলাম, অপারগ হয়ে সকাল থেকে আপনার আশায় বসে আছি। আজ আপনি আমাদের জন্য যে কষ্ট করলেন। আজীবন ঋণী হয়ে থাকবো।
ফারহান এক পলকেই রফিক সাহেবের চোখে আতংক দেখতে পেয়েছিল।
আপনি কোনো টেনশন করবেন না। ইনশাল্লাহ, সব ঠিক হয়ে যাবে। আর কষ্ট কিছুই না, জীবন বাঁচানোর সুখ ঢের বেশি। এখানকার ডাক্তার, নার্সরা আমার পরিচিত। আশা করছি, কোনো সমস্যা হবে না।

অপারেশন শুরু হলো, রফিক সাহেব এবং রিমার পরিবারের বাকি সদস্যরা অটির সামনে অপেক্ষারত। ফারহানও সেখানে রয়েছে।
অপারেশন শুরু হবার ২০ মিনিট পর একজন নার্স বের হয়ে আসলো।
দরজার সামনেই ফারহানকে দেখেই বললো- ফারহান, তোমার রোগীর মেয়ে হয়েছে। ভালো আছে তবে কিছু সময় অবজারবেশনে রাখতে হবে।
রোদেলার কি অবস্থা? বললেন না! উৎকন্ঠ হয়ে জিজ্ঞেস করলো ফারহান।
একটু ক্রিটিক্যাল। ব্লিডিং হচ্ছে, আমরা দেখছি। আরো রক্ত লাগতে পারে। ম্যানেজ করো। আগেই দুই ব্যাগের কথা বলা হয়েছিল। এক ব্যাগ এনেছো কেন? আর এক ব্যাগ লাগতে পারে। ডোনার রেডি করো কুইক্লি।
আচ্ছা, আমি দেখছি, বলেই ফারহান রিন্টোকে ফোন দিলো – কিরে তোরা কই?
কাছেই আছি ভাই, ইমারজেন্সি গেইটের সামনে চায়ের দোকানে।
– আচ্ছা শোন, রক্ত আর এক ব্যাগ লাগতে পারে। আর কোনো রাস্তা পাচ্ছি না।
সমস্যা নাই ভাই, আমি আছি। আপনি টেনশন নিয়েন না।
আচ্ছা, তুই ব্লাড ব্যাংকের সামনে আয় জলদি। ফোন কেটে দিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখলো- প্রতিটা মানুষ নির্বাক হয়ে আছে। রফিক সাহেব কি বলবেন, না বলবেন বুঝে পাচ্ছেন না। পড়ে যাওয়ার মত অবস্থা হলো।
ফারহান দ্রুত রফিক সাহেবকে ধরে বসালো। আপনি টেনশন করবেন না। রক্ত ম্যানেজ হয়েছে, আসছে।
রফিক সাহেব তবুও নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছেন।

প্রায় ২ ঘন্টার মত উৎকন্ঠায় কাটার পর আবার সেই নার্স বেড়িয়ে এসে বললো- ফারহান, রোগী আগের চেয়ে ভালো আছে। বাচ্চাও ভালো আছে। দুই জনকেই অবজারভেশন রুমে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তোমাদের মধ্য সর্বোচ্চ দুই জন ভিতরে গিয়ে দেখে আসো।
রফিক সাহেব, ফারহানের হাত ধরে বললেন – ফারহান ভাই চলেন। ফারহানও না করলো না।

রোদেলা, ফারহানকে দেখে চমকে উঠলো। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো না। ফারহান স্থির দাঁড়িয়ে আছে। রফিক সাহেব পাশে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
চোখের কোনে পানি জমার উপস্থিত টের পেয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে চোখের পানি বিসর্জন দিলো রোদেলা।
তুমি কান্না করতেছো কেন? এখনতো, আমাদের সুখী হবার সময়, বলে সান্তনা দিতে থাকলেন রফিক সাহেব।

নার্স, মেয়েকে টাওয়াল দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে আসলো। রফিক সাহেবের হাত কাঁপছে। মেয়েকে কোলে নিতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু উনি নিলেন না। নার্সকে ফারহানের দিকে ইংগিত দিয়ে বললেন- ফারহান ভাই, আজ আপনি আমার পরিবার এবং মেয়ের জন্য ফেরেশতা রুপে এসেছেন। আমার মেয়েকে প্রথম কোলে নেয়ার অধিকার আপনার।



ফারহান কিছুটা অবাক হলেও আনন্দেই ফুটফুটে মেয়েটাকে কোলে নিল। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। ফারহানের মধ্যে অন্যরকম তৃপ্তিবোধ কাজ করছে। চোখে মুখে তা খেলছে। মেয়েটা রোদেলার চোখ পেয়েছে। এমন নিস্পাপ একটা মুখ, চোখ সরাতে মন চায় না ।
রোদেলা আর নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে অকপটেই কেঁদে উঠলো। রোদেলার চোখের সামনে ভেসে উঠলো কিছু মুহুর্ত।

ফারহানের প্রথম সন্তান হিসেবে বরাবরই মেয়ে পছন্দ ছিল। কিন্ত রোদেলার সাথে ঝগড়া টিকিয়ে রাখার জন্য ছেলের কথা বলতো। ছেলেই লাগবে।
রোদেলা সবসময় বলতো – আমার মেয়েই হবে, তোমাকে ধরতে দিবো না আমার মেয়েকে।
তখন ফারহান হারার সুরে ঝগড়া বজায় রেখে বলতো- তোমার মেয়েকে আমিই প্রথম কোলে নিবো।

ফারহান, মেয়েকে রোদেলার পাশে শুইয়ে দিয়ে হাসিমুখে বললো- রোদেলা, আমি আসি। আমাকে আবার ব্লাড ডোনেট করতে যেতে হবে।
রোদেলার এত কথা অস্ফুষ্ট স্বরে নির্বাক হয়ে গেল। চাপা কান্না, ঠোটের কামড়ে আটকে গেল। একটি শব্দও বের হলো না।

রফিক সাহেব কিছু বুঝতে না পেরে, বুঝার চেষ্টা না করেই বললেন- ফারহান ভাই, আমার মেয়ের একটা নাম দিয়ে যান।
ফারহান এক নজর রফিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো- আপনার মেয়ের নাম হবে সুখ। বলে হাসিমুখে বের হয়ে গেল ফারহান।

অটির দরজা খুলেই রিমাকে দেখতে পেল ফারহান। রিমা রোদেলার ছোট বোন। ফারহান আর রোদেলার সম্পর্কের ব্যাপারটা শুধু রিমাই জানতো।
রিমা মায়ার চোখে তাকিয়ে বললো- ফারহান ভাই, চলে যাচ্ছেন?
– হা, রিমা। আমাকে যেতে হবে।
কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে আপনাকে কল দিলাম। ভেবেছিলাম পাবো না। আপনার আগের নাম্বারটা এখনো চালু রেখেছেন দেখে অবাক হয়েছি।
– রাখতেই হয়। কি করা বলো। কেউ ফোন করে না পেলে এর দায়ভার চলে আসে আমার মাথায়।
আপনি অনেক ভালো ফারহান ভাই। আপুকে কেমন দেখলেন?
– তোমার আপু ভালো আছে। সুখের সাথে আছে। তুমি যাও ভেতরে। আমি যাই, বলেই হেটে চললো ফারহান।
কিছু সময় ফারহানের হাটা পথ দেখে রিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেতরে চলে গেল।

মেডিকেল ইমারজেন্সি গেইট পার হয়েই চানখারপুল মোড়ে টং দোকানের টোলে বসলো ফারহান। একটা বেনসন দাও মামা।
রোদেলার সাথে সম্পর্কের শেষ মুহুর্তটা বার বার মাথায় খেলছে। কিছুতেই দূর হচ্ছে না। সিগারেটে টান দিয়ে রোদেলায় ডুবে গেল ফারহান।

তুমি শেষবারের মত ভেবে বলো আমাদের সম্পর্কের শেষ পরিনতি কি?
শেষ পরিনতি আবার কেমন কথা! শুরু, শেষ বলে কিছু নাই। ভালবাসা অনন্তকাল ধরেই ভালবাসা।
হেয়ালি রাখো। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে। পাত্র পক্ষ দেখে গিয়েছে। সেটা তোমাকে আগেই বলেছি। কথাবার্তায় মনে হচ্ছে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। তুমি কিছু করো।
আর কত মানুষকে রক্ত দিয়ে বেড়াবে। সেখান থেকে কোনো ইনকামও আসে না। এভাবে জীবন চলতে পারে না। কি পরিচয় দিবো বাবা-মার কাছে। ছেলে ফ্রিতে রক্ত দিয়ে বেড়ায় মানুষকে।

ফারহান, মাথা নিচু করে শোনলো। কিছু বলছে না। বলার ইচ্ছেও হচ্ছে না। সমাজের চোখে মিথ্যেতো কিছু বলেনি রোদেলা।
কি হলো কিছু বলছো না কেন? চুপ করে থাকার সময় এটা নয়।
– কি বলবো বুঝতে পারছি না।
এমন সময় ফারহানের ফোন বেজে উঠলো। কথা শেষ করে ফারহান বললো- দেখো রোদেলা, ছেলে ব্যাংকার। তার সামাজিক স্বীকৃতি আছে। তোমার তাকেই বিয়ে করা উচিত। একটি গরীব রোগী এসেছে। অবস্থা ভালো নয়, আমাকে যেতে হবে। ভালো থাকো, সুখে থাকো।

ফারহান ভাই, কি ভাবেন মিয়া এত। রোগী ভালা আছে। আমি খবর লইয়া আইছি।
রিন্টোর ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেল ফারহান।
তেমন কিছু না। আর একটা রোগী আছে। ও পজিটিভ রক্ত লাগে। সমস্যা নাই। ও পজিটিভ কালেকশনে আছে। আর ধন্যবাদ ভাই তোরে। অহন, যাই।
– ধন্যবাদ দিলেন না মজা লইয়া লইলেন। খারান, আর একটা বিড়ি খাইয়া যান। বহেন।”

মোঃ ওয়ালীউল্লাহ অলি রচিত আত্মপ্রকাশ ব্লগ নির্বাচিত গল্প >> ঘোরপাক

ঘোরপাক-মোঃ-ওয়ালীউল্লাহ-অলি-আত্মপ্রকাশ-নির্বাচিত-গল্প-ghurpak-md-woaliulah-olee-attoprokash-selected-story
ঘোরপাক-মোঃ ওয়ালীউল্লাহ অলি

সুখ । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প । লেখক পরিচিতি

লেখকঃ মোঃ ওয়ালীউল্লাহ অলি
ছোটগল্পঃ সুখ
গল্পের জনরাঃ রোমান্টিক ছোট গল্প
দেশের বাড়িঃ কিশোরগঞ্জ
পড়াশোনাঃ ভূগোল পরিবেশ বিভাগ, জগনাথ বিশ্ববিদ্যালয়, (মাস্টার্সে অধ্যয়নরত রয়েছেন) ২০১৮।

মোঃ-ওয়ালীউল্লাহ-Md.-Woaliullah Olee
মোঃ ওয়ালীউল্লাহ অলি

মোঃ ওয়ালীউল্লাহ অলি সাহিত্যের সাথে জড়িয়ে আছেন ছোটবেলা থেকেই। লেখালেখি তাঁর পছন্দের বিষয়, পাশাপাশি তিনি ব্লগিং করতেও পছন্দ করেন।

আত্মপ্রকাশ সম্পাদক

http://attoprokash.com

আত্মপ্রকাশে অপ্রকাশিত গল্প এবং বুক রিভিউ এবং প্রবন্ধ প্রকাশ করতে যোগাযোগ করুন (ইমেইল-attoprokash.blog@gmail.com) অথবা ফেইসবুক পেইজ ইনবক্স। সর্বনিম্ন ১০০০ শব্দ হতে যেকোনো ঊর্ধ্ব সীমার ছোট গল্প গ্রহণযোগ্য। আপনার গল্প আত্মপ্রকাশ বিচারকদের দ্বারা নির্বাচিত হলে আপনাকে জানানো হবে এবং তা সরাসরি প্রকাশ করা হবে আত্মপ্রকাশে। আপডেট জানতে ফেইসবুক গ্রুপে সক্রিয় থাকুন।

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *