রক্ত মাতৃকা >> অঙ্কিতা ঘোষ | আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প

“অনীশা শোনো আমার কথা, বোঝার চেষ্টা কর। তুমি যেটা ভাবছো, সেটা ঠিক নয়। আমি অন‍্য টেনশনে আছি, তুমি না বুঝলে কে বুঝবে বলো তো!”…
“আমি তোমাকে এত ভালো একটা খবর দিলাম অরণ‍্য!আর তুমি…!
তুমি পাল্টে গেছো। একদম আগের মতো নেই । আমি আগে বুঝতে পারলে এরকম সব ছেড়ে, মা-বাবাকে ছেড়ে কখনও আসতাম না তোমার সাথে, কখনও না। এখন আমার কাছে একটাই উপায়।”
“অনীশা তোমার এই ঘ‍্যান ঘ‍্যানানি বন্ধ করো প্লিজ, রোজ রোজ ভালো লাগে না।”
“ওহহ! তাই বুঝি, ঠিক আছে করলাম বন্ধ।” ফোনটা রেখে দিল অনীশা। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে অরণ‍্য বেশ কয়েকবার বললো,”হ‍্যালো। হ‍্যালো অনীশা। অনীশা।”

(১)

গরমের ছুটি মানেই দিশার মামাবাড়ি যাওয়ার সময় হওয়া। দিশা, কলকাতার বেথুন স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে। পড়াশোনায় মনোযোগী হলেও গরমের ছুটিতে মামাবাড়ির আদর না খেলে ঠিক চলে না, তাই দিশা আর ওর মা এই সময় চলে যায় দিশার মামাবাড়ি। এই কদিন দিশার বাবা, শৌর্য কলকাতার বাড়ির পাহাড়াদার। দিশার মামাবাড়ি মুর্শিদাবাদের বহরমপুর থেকে আরো মিনিট ৪৫, যদিও এতদিন  মামা কর্মসূত্রে জলপাইগুড়ি থাকতেন; এ বছরই, এই বাড়িটা কিনেছেন। তাই এ বছরই প্রথম যাবে ওরা ওখানে।

গরমের ছুটি পরার পর দিনই দিশা আর ওর মা অনন‍্যা রওনা দেয়, মামাবাড়ির উদ্দেশ্যে। এবার তো নতুন বাড়ি। মামার কাছে গল্প শুনেছে, বাড়িটা নাকি বাগান বাড়ির মতো।
তাই কী করবে, কোথায় যাবে এসব আকাশ কুসুম ভেবে চলছে দিশা। ওর মামা মামীরও নিজের কোনো সন্তান না থাকায়, ওর আদরের ভাগীদারও কেউ তেমন নেই। প্রকৃতপক্ষে,” মামার বাড়ি ভারী মজা।” কবিতাটা দিশার জন্য ভীষণভাবে খাটে।

অবশেষে দিশার দিন গোনা শেষ হলো, যখন শিয়ালদহ স্টেশন থেকে হুইসেল বাজলো লালগোলা প‍্যাসেঞ্জারের। সারারাত এক্সসাইটমেন্টে দিশার ঘুম হলো না, কিছুক্ষণ পর পরই মাকে বলতে থাকলো,” ও মা কখন পৌঁছবে ট্রেন?” অনন‍্যা কখনো ভালোভাবে বললো আবার কখনও দিল ধমক। শেষ পর্যন্ত ট্রেন পৌঁছলো বহরমপুর স্টেশনে। মামা আগে থেকেই ছিলেন সেখানে।

বেশ ভোর বেলায় বাড়িতে পৌঁছলো ওরা। অনন‍্যা ওর দাদাকে বললো,”দাদাভাই, এ তো বিশাল বাড়ি রে।”
“হ‍্যা রে, বেশ কমেই পেলাম, বল।” মানে বাড়ির ইন্টেরিয়র??”
“ইন্টেরিয়র কিছুটা ঠিক করতে হয়েছে বটে। চল দেখবি চল, ভিতরে।”

বাড়ির সামনে বেশ বড়ো বাগান। সরু রাস্তার দুধারে সারিবদ্ধ দোপাটি আর নয়নতারা। দিশা ঢুকেই বাগানে দেখলো একটা কাঠবিড়ালি ঘুরে বেড়াচ্ছে, দৌড়ে গিয়ে সেটাকে ধরার অনেক চেষ্টা করলো কিন্তু ধরতে পারলো না। বাগানের মতো বাড়িটাও বেশ বড়ো, পুরোনো দালান বাড়ির মতো। অনন‍্যা দেখে বললো,”দাদাভাই, এতো বড়ো বাড়ির মেনটেনেন্স কিন্তু বেশ ঝক্কির ব‍্যাপার।”
“তোর বৌদিকে বল। এটাই পছন্দ তার। বুঝবে বয়স বাড়লে।”
“সেটাই।” কথা শেষ হওয়ার আগেই অনন‍্যার বৌদি ইপ্সিতা এলো সেখানে, “কতদিন পর দেখলাম তোদের, দিশা কত্ত বড়ো হয়ে গেছিস। চল ভিতরে চল। অনেক রান্না করেছি, সব তোর ফেভারিট।”

বড় বারান্দা পেরিয়ে ঘর। দিশা ভিতরে গেল মামির সাথে। ঘরে ঢোকার চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল অনন‍্যা, দিশার মামা সুব্রত বাবু পিছন থেকে এসে বললেন, “আরে দেখি দেখি! কী করছিস!”
একটু সামলে নিয়ে অনন‍্যা বললো,”হ‍্যা মানে দাদাভাই, আমার মনে হলো কেউ…!”
“কী মনে হলো? সেই ছোট্টবেলা থেকে দুমদাম পড়ে যাওয়ার অভ‍্যাসটা  যাইনি দেখছি এখনো।”
অনন‍্যা একটা ম্লান হাসি হেসে ভিতরে ঢুকলো।

(২)

বাড়িটায় মোট ৬টা ঘর। নীচের তলায় একটা বিশাল বড় ড্রয়িং, ডাইনিং আর রান্নাঘর। চারটে বেডরুম সবই দোতলায়। দিশা এসে হাত পা ধুয়েই মামীর রান্না করা খাবার গুছিয়ে খেল। তারপর ওরা সবাই
দোতলায় গেল। দোতলার বারান্দা থেকে পুরো বাগানটা খুব সুন্দর দেখা যায়। দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়া সেরে সকলে আড্ডা দিতে বসলো দোতলার বারান্দায়। অনন‍্যা, দিশার জামাকাপড় গুছিয়ে ঘর থেকে বেরোতে যাবে, কী যেন মনে হতে পিছন ফিরে তাকালো। ওর হঠাৎ মনে হল ওর ঠিক পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে; কিন্তু নাহ। মনের ভুল, এত বড় বাড়ি, তাও আবার পুরোনো। কেমন একটা গা ছমছমে ব‍্যাপার আছে বাড়িটায়। এত বড়ো বাড়িতে এমন ভুল হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।

বারান্দায় বসে দিশা বললো,”মাম মাম একটু বাগানে যাবো?”
গম্ভীর গলায় উত্তর দিল অনন‍্যা, “না না, কোনো দরকার নেই, একা কোথাও যাওয়ার।”
সুব্রত বাবু বললেন, “আরে বাগানেই তো যেতে চেয়েছে। যাক না।” কথাটা শুনে একগাল হেসে দিশা দৌড় দিল সিঁড়ির দিকে, অনন‍্যা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে বললো,”দিশা! দিশা শোন!”

“থাক না। চল আমরা ভাই বোন আড্ডা দিই একটু।” সুব্রত বাবুর কথা শুনে অনন‍্যা আর আপত্তি করলো না। খানিকক্ষণ পর অনন‍্যা হঠাৎ দেখতে পেল বাগানের এক কোণে দিশা যেন কারুর সাথে কথা বলছে। অনন‍্যা বারান্দা থেকেই চিৎকার করলো,”দিশা…! দিশা…! কে আছে ওখানে?” প্রত্যুত্তরে দিশা বললো,”কই কেউ না তো!” তাই অনন‍্যাও আর পাত্তা দিল না ব‍্যাপারটা।

দিশা বাগানের বেশ কোণায় গিয়ে কিছু একটা করছিল, অনন‍্যা এবার স্পষ্ট দেখলো একজন মহিলা যেন ঝুঁকে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে। অনন‍্যা আবার চিৎকার করে উঠলো, “কে?কে আছ?” বলেই ছুটে নীচে নেমে গেল। কিন্তু কেউ কোথাও নেই।
অনন‍্যা দিশাকে ওর বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বললো, “ভিতরে চলো, আর নয় এখানে।” হঠাৎই চোখে পড়লো অনন‍্যার, বাগানের পাঁচিলে যেন এক আবছায়া মূর্তি মিলিয়ে গেল। অনন‍্যা দিশাকে নিয়ে ঘরে চলে এলো সাথে সাথেই। এসে দাদা বৌদিকে কথাটা বললো, দুজনেই মনের ভুল বলে উড়িয়ে দিলেন।

বাগানের থেকে আসার পর থেকেই অনন‍্যা কেমন একটা চুপ হয়ে গেছে। ওর বারবার মনে হতে থাকে, কী দেখলো ও! কী ছিল ওটা! যাই হোক, আর বেশি না ভেবে খাওয়া দাওয়া সেরে শুতে গেলো ওরা।দিশাও ভোরবেলা উঠেছে, ঘুমও পেয়েছে ওর। ওপরের কোণার ঘরে ওদের শোওয়ার ব‍্যবস্থা হলো। ঘরটা উত্তর-পূর্ব দিকে, ঘরের জানালা দিয়ে একটা বড়ো শিরীষ গাছ রয়েছে। চাঁদের হাল্কা আলো ওই জানালা দিয়ে খাটে এসে পড়ে। ঘরটাতে বেশ একটা আলো আঁধারি অনুভূতির সৃষ্টি করে। দিশা এসেই বললো, “এই ঘরটাই আমার সবচেয়ে পছন্দ।”
সুব্রত বাবুও বললেন, “তাই তো এই ঘরেই থাকবে তোমরা।” ঘরের মাঝখানে একটা বড়ো খাট, একটা পুরোনো দিনের আলমারি, একটা আলনা আর একটা বই-এর দেরাজ।
অনন‍্যা জিজ্ঞেস করলো,”দাদাভাই এই ফার্নিচারগুলো নতুন কিনলি??”
“নারে, এই ঘরের ফার্নিচারগুলো ছিলই।
“ওহ। বেশ সুন্দর কিন্তু।”…বলেই অনন‍্যা হাত বোলাতে গেল আলমারিটাতে। মনে হলো কেউ এক ঝটকায় সরিয়ে দিলো ওকে। কিন্তু অনন‍্যা নিজের অনুভূতির কথা আর বললো না। কারণ কেউ তো পাত্তাই দেবে না, এই ভেবে চুপচাপ শুয়ে পড়লো। দিশা বিছানায় শুয়েই অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে। সারাদিনের ক্লান্তিতে অনন‍্যারও কখন যে চোখ দুটো বুজে গেল, বুঝতে পারলো না।

(৩)

মাঝরাতে হঠাৎ দিশার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম চোখেই বললো,”উফফফ কী ঠান্ডা।” চোখ খুলে দেখলো দিশা, পায়ের ধারের জানলাটা খোলা, সেই জানলা দিয়ে এক বিভৎস ঠান্ডা হিমেল হাওয়া আসছে ঘরের ভিতর। পা-গুলো যেন বরফ হয়ে গেছে দিশার, নড়তে পারছে না। কিন্তু এই গরমকালে ঘরে এসিও নেই। ঘরটা এত ঠান্ডা হলো কী করে। কোনো মতে মায়ের দিকে তাকালো দিশা, দেখল ওর মা-ও একদৃষ্টিতে দেখছে জানলার দিকে। ঠিক তখনই দিশা শুনতে পেল এক মারাত্মক গোঙানির শব্দ। কেউ যেন ওর কানে এসে ফ‍্যাসফ‍্যাসে গলায় বললো, “আয়…আয় আমার কাছে, আয়। কী রে আমি মা তো।” দিশা সোজা উঠে বসলো বিছানায়। ঠিক সেই সময় অনন‍্যা ওকে টেনে ধরে শুইয়ে দিল, অনন‍্যার মনে হলো দিশার সারা শরীর পাথরের মতো ঠান্ডা আর ভারী। অনন‍্যা বুকের মধ্যে আগলে নিল দিশাকে তারপর বললো, ” দিশা তুই মায়ের কাছে আছিস, কেউ নিতে পারবে না তোকে আমার কাছে থেকে।” কথাটা শেষ হওয়ার আগেই গোঙানির মাত্রা যেন আরও ভয়াবহ হল। ঘরটা ক্রমশ ঠান্ডা হয়েই চলেছে। পর্দাটা এক ভাবে উড়ছে। হঠাৎই যেন একটা কালো ছায়া ঢুকলো জানলা দিয়ে। দিশার কানে এসে বললো ফ‍্যাসফ‍্যাসে স্বরে বললো, “দিশা….দিশা….। মায়ের কাছে আয়।”

দিশা অনন‍্যার মুখের দিকে তাকালো, কিন্তু কে এটা! এটা তো ওর মা নয়। যে ওকে জড়িয়ে আছে তার চোখদুটো কোটরে ঢোকা আগুনে গোলার মতো মুখটা ফ‍্যাকাশে, ওকে জড়িয়ে রয়েছে একটা সাদা ফ‍্যাকাশে হাত, দিশার ঠোঁটটা কাঁপতে থাকলো, সারা শরীর ভয়ে কুকড়ে গেল, অস্ফুট স্বরে বললো,”মাম মাম।”

একটা হ‍্যাচকা টানে অনন‍্যা টেনে নিল দিশাকে,”এই তো মা। আমি তোর মা।” সেই ফ‍্যাকাশে মূর্তি এক ঝটকায় সরে গেল। অনন‍্যা কোনোক্রমে চিৎকার করলো, “দাদা…দাদা…” কোনো সাড়া এলো না। ওই ছায়ামূর্তি আবারো হাত বাড়ালো। ঘরের শীতলতা আরও বাড়লো। অনন‍্যা আবারও চেঁচিয়ে ডাকল,”দা….দা….।”
সুব্রত বাবু লাফিয়ে উঠলেন বিছানায়। ওনার স্ত্রীকে বললেন, “এটা অনন‍্যার গলা না!”…”হুমম তাই তো মনে হলো। কী হলো বলোতো। শিগগির চলো।” পাশের ঘর থেকে সুব্রত বাবু ছুটে এসে লাইট জ্বালালেন। পর্দাটা এক ঝটকায় নেমে গেল। সুব্রত বাবু বললেন,”কী হয়েছে? ঘরটা এত ঠান্ডা কেন? ফ‍্যানের সুইচ তো অন। অথচ ফ‍্যানটা চলছে না। কিন্তু ঘরটা…!” বলেই তাকালেন, দিশা অনন‍্যার দিকে ওদের চোখ মুখ ফ‍্যাকাশে হয়ে গেছে। সে রাতে আর কারো ঘুম হলো না।
সকাল উঠেই অনন‍্যা বললো,”এখানে আর এক মূহুর্ত নয়। আজই চলে যাবো আমরা।”
অনন‍্যার বৌদি ইপ্সিতা বললো,”তুমি যা বলছো! মানে আমরা কিন্তু কিছুই ফিল করি নি।”
সুব্রত বাবু বললেন,”তবে কালকের ঘটনা আমাকেও একটু ভাবাচ্ছে।”

“আমি দিশাকে ডাকি দাদাভাই। এখানে এমন কিছু আছে, যেটা তোদের ক্ষতি না করলেও আমার দিশার ক্ষতি চাইছে। আমি এখানে আর থাকবো না দাদাভাই।” বলেই অনন‍্যা সুব্রত বাবুর বেডরুমে গেল। দিশার গায়ে হাত দিয়ে ডাকতে গেল, একি ওর গা তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। অনন‍্যা চিৎকার করে ডাক দিল, “বৌদি! ও বৌদি! একটা থার্মোমিটার আনো না!” দিশার জ্বর ১০৪ ডিগ্রি।

অনন‍্যা মাথায় হাত দিয়ে বসে বললো,”কী করে নিয়ে যাবো আমি এই মেয়েকে।” সুব্রত বাবু বললেন,”কোথাও নিতে হবে না, ও সুস্থ না হলে কোথায় নিয়ে যাবি ওকে। আমি এক্ষুনি ডাক্তার ডেকে আনছি।” অনন‍্যা বললো,”আমিও যাবো দাদাভাই।”
“না তুই ওর কাছে থাক। আমার মনে হয় তোর থাকাটা দরকার।”

সুব্রত বাবু গেলেন ডাক্তারের খোঁজে। ইপ্সিতা আর অনন‍্যা জলপট্টি দিতে লাগলো দিশার মাথায়। কিন্তু জ্বর কমার কোনো নাম গন্ধ নেই। মাঝে মাঝে কাঁপুনি হতে লাগলো দিশার।
ইপ্সিতা অনন‍্যাকে বললো,”আমি কিছু খাবার নিয়ে আসি রে তুই বোস।”
“আচ্ছা বৌদি তোমার কোনো কাজের লোক দেখছি না! এত বড়ো বাড়ির কাজ তুমি একা করো!”
“এসে অনেক খোঁজ করেছি রে কাজের লোকের, কেউ কাজে আসতে চায় না এ বাড়িতে। সবাই নানা অজুহাতে কাটিয়ে দেয়। তোমার কিছুই অদ্ভুত লাগেনি কখনও?”
“নারে এ কদিনে তেমন তো কিছু বুঝিনি।”

“তুমি একটু বসো দিশার কাছে। আমি আসছি একটু।” বলেই পাশের ঘর মানে যে ঘরে ওরা রাতে ছিল সেই ঘরে গেল অনন‍্যা। ঘরের দরজা খুলে ভিতরে ঢোকার আগে ইপ্সিতাকে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা এই বই-এর শেল্ফটা বা এই আলমারিটা ব‍্যবহার করো তোমরা?”
“না রে আমাদের নিজেদের এতো ফার্নিচার, কতো গোছাবো বলতো? তাই আর ব‍্যবহার করিনা। আর এলামও তো কদিন হলো। তোর দাদাকে বলেছি সব ধরে বেঁচে দিতে, তাই আর ঘেঁটে দেখিনি। কিছু পুরোনো জিনিস পত্র আছে বোধ হয় পুরোনো ভাড়াটের।” কথাগুলো শুনতে শুনতেই ঘরটাতে ঢুকলো অনন‍্যা।

আলমারিটা খুলতেই একটা বোটকা পুরোনো গন্ধ এলো নাকে। আলমারির ভিতরে বেশ কিছু শাড়ি আর শার্ট প‍্যান্ট দেখে বোঝা যায়, যারা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্তত একজন পুরুষ আর একজন মহিলা ছিলেন। হঠাৎই একটা গোঙানির শব্দ পেল অনন‍্যা, কোনো মহিলা যেন গোঙাচ্ছে, আওয়াজটা ক্রমাগত তীব্র হচ্ছে। আলমারি ঘাটতে ঘাটতে  বেশ কয়েকটা ব্লাড রিপোর্ট খুঁজে পেল অনন‍্যা, তার মধ্যে একটা প্রেগনেন্সি রিপোর্ট, পজেটিভ‌, তারিখটা ১৩ বছর আগের। হঠাৎই আলমারির পাল্লাটা বন্ধ হয়ে গেল, আলমারির কাঁচে সেই ছায়ামূর্তি, খাটের ওপর বসা, অনন‍্যা ঘুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলো,”কে? কে তুমি?”

গোঙানির আওয়াজটা আরও তীব্রতর হলো। ঘরের দরজার দিকে এগোতে গেল অনন‍্যা, দরজাটা এক ঝটকায় বন্ধ হয়ে গেল। ও দিক থেকে চিৎকার করলো ইপ্সিতা, “কী হলো? হঠাৎ!”

“বৌদি দরজা খোলো। খোলো…!” কথা শেষ করার আগেই কেউ যেন এক ঝটকায় মাটিতে ফেলে দিল অনন‍্যাকে। ইপ্সিতা চিৎকার করলো,”দরজা তো ভিতর থেকে বন্ধ।” একটা অদ্ভুত শব্দ হতে থাকলো। বারবার কাঁচি খোলা বন্ধ করলে যেমন শব্দ হয় ঠিক তেমনি। সাথে একটা চাপা কান্না। হঠাৎই অনন‍্যার পা-টা হিরহির করে টানলো কেউ, অন‍্য একটা ঘরে নিয়ে গেল, যেখানে অসম্ভব আলো। কারো কথপোকথন কানে এলো।
“অরণ‍্য শেষ পর্যন্ত আমরা আমাদের নতুন বাড়িতে।”
“ইয়েস। এতদিনে শান্তি। এবার আমরা আমাদের মতো বাঁচব। একদম নিজেদের মতো অনীশা, কোনো বাধা নেই কোনো নিষেধ নেই।”

অনন‍্যা যেন অন‍্য কোনো পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে। কেউ কিছু দেখাতে চাইছে ওকে। সব ঘটনা ওর চোখের সামনে ঘটছে।
একটা খুশি পরিবার। দুটো মানুষের সুখী সংসার। কিন্তু বড়ো বাড়ির মেয়ে অনীশার পছন্দ অপছন্দের তালিকা অতি দীর্ঘ। সেই চাহিদা মেটাতে মেটাতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে অরণ‍্য। দূরত্ব বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে মনোমালিন্য।
“না না আমি পারবো না অনীশা। আমার পক্ষে তোমার এত চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। আমার মাইনেতে যেটুকু কুলোবে আমি তো সেটাই করবো।”
“তাহলে বিয়ে কেন করলে? বউ-এর চাহিদা মেটাতে হয় জানো না।”
“আমি পারবো না অনীশা,আমি পারবো না। এত বড় বাড়ি ভাড়া করতে কত টাকা লাগে জানো?”
“যখন অত বড়ো বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করে রাখার মুরোদ নেই, বিয়ে করলে কেন?”
“নেই নেই। ফিরে যাও, সেখানেই। পারছি না আমিও আর।”
ডুকরে কেঁদে অনীশা বললো,”আজ এত ভালো একটা খবর দিলাম, তা সত্ত্বেও এমন ব‍্যবহার তোমার। কী করে যাবো এ অবস্থায়।”
“আমি চাই না এই বাচ্চা। ক্যারিয়ারের এই অবস্থায় আমার পক্ষে এত বড়ো দায়িত্ব সম্ভব নয়। সামর্থ্য নেই আমার।”

হঠাৎই ঘরের আলো কমে গেল, আবার সেই চাপা কান্না আর গোঙানির আওয়াজ আর কাঁচির সেই কচকচানিটা যেন আরও বেড়ে গেল। ঘরের মধ্যে গম গম করতে থাকলো দুজনের কথা কাটাকাটি, চিৎকার। আবার হালকা আলোয় অনন‍্যা দেখলো অন্তঃসত্ত্বা অনীশাকে বেশ অনেক মাস দেখে মনে হলো। অরণ‍্য ঢুকলো ঘরে মদ‍্যপ অবস্থায়, “আমার চাকরিটা চলে গেছে অনীশা।”
“কী তাহলে?”
“জানিনা।”
অনীশা অরণ‍্যর কাঁধে হাত রেখে বললো, “অরণ‍্য কিছু হবে না।”

এক ঝটকায় কাঁধ সরিয়ে ধাক্কা মারলো অরণ‍্য, মাটিতে উপড় হয়ে পড়লো অনীশা। অনন‍্যা হাত দিয়ে বাধার মতো ভঙ্গিতে এগিয়ে বললো,”আহা।” ছটফট করতে থাকলো অনীশা, রক্তে ভেসে গেল ঘর। অরণ‍্য ডাক্তার নিয়ে এলো কিন্তু অনীশা আর তার বাচ্চাকে বাঁচানো গেল না। পাগলের মতো অরণ‍্য ঘরের রক্ত মুছতে থাকলো, “অনীশা আমি আর পারছিলাম না। আর পারছিলাম না। আমি চাইনি, আমি চাইনি। বিশ্বাস করো। এত রক্ত মুছছে না, মুছছে না। কী করবো আমি! কী করবো আমি!” পাগলের মতো ঘরের এদিক ওদিক অপ্রকৃতস্থর মতো ঘুরতে থাকল অরণ‍্য। চোখের নিমিষে  টেবিলের ওপর বড়ো লোহার কাঁচিটা অরণ‍্য নিজের গলায় চালালো। মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো অরণ‍্য।

অনন‍্যা নিথর মূর্তির মতো দেখছিল এসব, পিছনের দেওয়ালে ক‍্যালেন্ডারে একটা তারিখ জ্বলজ্বল করে উঠলো, ১৩ই ডিসেম্বর ২০০৬। আঁতকে উঠলো অনন‍্যা, মনে মনে বললো,”এটা তো দিশার জন্মদিন।”
কাঁচির আওয়াজটা আরো তীব্রতর হলো, সাথে চাপা গোঙানির। অনন‍্যা চিৎকার করে বললো,”দিশা আমার মেয়ে তোমাদের নয়।”
যেন একটা দমকা হাওয়া এসে অনন‍্যাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। দৌড়ে দরজা খুলতে গেল অনন‍্যা, পারলো না। অনন‍্যা ঘর থেকে চিৎকার করে বললো,”বৌদি দাদা…!”
ইপ্সিতা আর সুব্রত চিৎকার করলেন,”দরজাটা খোল অনন‍্যা। কোথায় গেলি তুই।”
খাটের ওপর দেখা সেই মূর্তি এগিয়ে এলো অনন‍্যার কাছে, আবার সেই ফ‍্যাসফ‍্যাসে গলায় বললো, “আমার, ও আমার মেয়ে। নিয়ে যাব। নিয়ে যাবোই।”
এবার অনন‍্যা স্পষ্ট দেখলো ওই মূর্তি অন্তঃস্বত্তা, বুঝতে বাকি রইলো না এরাই ওকে এসব দেখাচ্ছিল। এরা কখনোই মানুষ নয়। দিশাকে বাঁচাতেই হবে, যে ভাবে হোক।

(৪)

দিশা উঠে বসলো বিছানায়। চিৎকার করে উঠলো,”মা…!মা…!”
ইপ্সিতা এসে বললো,” ডাক্তার তোমায় ওষুধ দিয়েছেন, তুমি ঘুমাও, মা এসে যাবে।”
এক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল ইপ্সিতাকে দিশা। তারপর আগুন চোখে তাকালো ওর দিকে। ইপ্সিতা ভয়ে দু-পা পিছিয়ে গেল। সন্ধ‍্যে হয়ে এসেছে, বিছানা থেকে নামলো দিশা, ফ‍্যাসফ‍্যাসে গলায় বললো,”মা কোথায়?”
দুপুর থেকে থেকে দরজা ভাঙার চেষ্টা করেও ভাঙা যায়নি দরজাটা। দিশা গিয়ে দাঁড়ালো দরজার সামনে। খুলে গেল দরজা। সুব্রত বাবু আর ইপ্সিতা যেন পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। দিশা ঢুকলো ঘরে। বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

অনন‍্যা মেঝেতে অচৈতন্য। দিশা অনন‍্যার মাথায় হাত রাখতেই একটা তীব্র আর্তনাদে চমকে গেল দিশা, জ্ঞান ফিরলো অনন‍্যার. “দিশা কেন এলি তুই!”
“তুমি কোথায় ছিলে মা।”
“এই তো মা!”
আবার ঘরটা প্রচন্ড ঠান্ডা হতে লাগলো, দিশা মুখ গুজলো অনন‍্যার কোলে। ওই ছায়ামূর্তি এসে টানতে থাকলো দিশাকে। ওই কাঁচির আওয়াজটা বাড়তে থাকলো, সাথে একটি পুরুষ ছায়ামূর্তি। অনন‍্যা বুঝতে পারলো অরণ‍্য আর অনীশা দুজনেই চায় দিশাকে। অনন‍্যা প্রাণপনে চেপে ধরে রাখতে চেষ্টা করলো দিশাকে। দিশার শরীর ক্রমশ শীতল হচ্ছে। ছায়া দুটো ক্রমশ বড়ো হচ্ছে। গোঙানির শব্দ আরও তীব্র হচ্ছে। হঠাৎই বাইরে থেকে মন্ত্রচ্চারণের শব্দ এলো,”ক্রিং ক্রিং ক্রিং হিং ক্রিং দক্ষিণে কালিকে ক্রিং ক্রিং ক্রিং হিং হিং হুং সহা।”
সাথে সাথেই পিছিয়ে গেল ওই দুই মূর্তি কিন্তু কয়েক মূহুর্তের মধ‍্যেই  আবার এগিয়ে এলো। দিশার শ্বাস প্রশ্বাসের গতি কমে এলো, বাইরে মন্ত্রপাঠ সত্ত্বেও বিভৎস অট্টহাসিতে ভরে উঠলো ঘর। অনন‍্যা পাথরের মতো বসে আছে, হঠাৎই দরজা খুললো, ঘরে ঢুকলো দিশার বাবা শৌর্য, জড়িয়ে ধরলো দিশাকে। ওই দুই মূর্তি আবারও ঝাঁপিয়ে পড়লো শৌর্যর ওপর। শৌর্য চিৎকার করে বলে উঠলো,”আমার প্রাণ থাকতে আমি আমার সন্তানের কোনো ক্ষতি হতে দেবো না। কখনও না।”
শৌর্যর এই কথায় পুরুষ মূর্তিটা পিছিয়ে গেল। তারপর প্রবল বেগে ধাক্কা মারল শৌর্যকে। ছিটকে পড়লো শৌর্য। অনীশার ছায়া এগিয়ে এলো দিশার দিকে। শৌর্য আবারও আগলে ধরলো ওই দুজনকে।
অনন‍্যা দিশাকে আগলে বললো,”আমরা থাকতে তোমরা দিশাকে কখনো নিতে পারবে না, কখনও না।” বাইরের মন্ত্রচ্চারণ আরো প্রবল হলো। অনীশার ছায়ার সেই বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা যেন কেউ প্রবলভাবে আটকে দিল কেউ। দিশাকে জড়িয়ে ধরলো শৌর্য আর অনন‍্যা। দরজাটা খুলে গেল ধীরে ধীরে, ভোরের আলো ফুটছে আকাশে। ঘর থেকে বেরোলো ওরা।

(৫)

আজ অনেকটা সুস্থ দিশা। সেদিন পরিস্থিতি বুঝেই সুব্রত বাবু শৌর্যকে খবর দেন। আর মন্দিরের পুরোহিত মশাইকেও নিয়ে আসেন। ডাক্তারের খোঁজে তিনি একে ওকে জিজ্ঞাসা করতে এই বাড়ির ইতিহাস জানতে পারেন। অনীশা আর অরণ‍্য ১৪-১৫ বছর আগে এই বাড়িতে ভাড়া আসে আর এক বছরের মধ্যেই দুজনেই মারা যায়। শোনা যায় বাড়ির ওই ঘরটাতেই অরণ‍্য তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে মেরে নিজে আত্মহত্যা করে। সেই থেকে এই বাড়িতে যখনি কোনো বাচ্চা সমেত দম্পতি আসে তারাই এ ধরনের অশরীরীর উপস্থিতি অনুভব করেছে। বাড়ির পুরোনো মালিক সম্ভবত ব‍্যাপারটা জানতেন কিছুটা। তাই নিঃসন্তান সুব্রত বাবুকে বাড়িটি জলের দরে ছেড়ে দেন। কিন্তু বাড়ি বিক্রির পর আর কোনো যোগাযোগ তিনি রাখেন নি। সেদিন পুরোহিত মশাই জানান,”দেবী মন্ত্রপাঠের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী হলো পিতা মাতার স্নেহ। যে স্নেহ দিশাকে ফিরিয়ে এনেছে।”
শৌর্য বললো,”তাই অরণ‍্য বাবার দায়িত্ব পালনে অক্ষম ছিল, তাই আমায় দেখে পিছিয়ে যায়, তবে ওদের সন্তান হয়তো পরিস্থিতির বিপাকে জন্ম নেয়নি কিন্তু মা-বাবাতো ওরাও। যাই হোক, আসি ঠাকুর মশাই। বেরোই এবার। বাড়িটায় একটা পূজো দিয়ে কিছু ব‍্যবস্থা করতে হবে।”
সুব্রত বাবু বললেন,”হুমম। দেখি ফিরে। উফফফ যা গেল দুটো দিন।”

সকাল হতেই দিশা ছুটে এলো বাবার কাছে। ওর বাবা বললো,”রেডি?”
“একদম। হাজার দুয়ারী যাবো তো আজ।”
“ইয়েস! ওটা দেখেই বাড়ি।”
“এখানে আর-একটু থাকি না বাবাই।”
” না মা। মামা মামীও যাবে আমাদের সাথেই। তারপর ওরা অন‍্য বাড়ি দেখবে।” দিশা কোনো উত্তর করলো না আর।

বেরোনোর সময়, সবাই যখন লাগেজ গাড়িতে তুলতে ব‍্যস্ত দিশা হঠাৎ বাড়িটার গেটের দিকে এগিয়ে গেল, দিশার চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। ওর ঠোঁটে একটা অদ্ভুত হাসি আর চোখের মণিতে স্পষ্ট ফুটে উঠলো, দুটো ছায়া মূর্তি। তারা আর কেউ নয় অরণ‍্য আর অনীশা।
(সমাপ্ত)

রহস্য গল্প ভালোবাসুন, তাহলে পড়ুন >> গল্পশেষে – আশরাফ মামুন

গল্পশেষে-আশরাফ-মামুন-ছোটগল্প-আত্মপ্রকাশ-golpo-sheshe-ashraf-mamun-short-story-attoprokash-৩-min
গল্পশেষে – আশরাফ মামুন

গল্পশেষে । লেখক পরিচিতি । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প

লেখকঃ অঙ্কিতা ঘোষ
ছোটগল্পঃ রক্ত মাতৃকা
জনরাঃ ভৌতিক গল্প।
দেশের বাড়িঃ ভারতবর্ষ
পড়াশোনাঃ এম এস সি ফিজিওলজি
চাকরিঃ স্কুল শিক্ষিকা, ২০১৯।

ankita-ghosh-attoprokash-অঙ্কিতা-ঘোষ-আত্মপ্রকাশ (1)
লেখকঃ অঙ্কিতা ঘোষ

লেখকের কথাঃ কল্পনায় বাঁচতে ভালোবাসি, কল্পনা ভিত্তিক গল্প লিখি।

Ankita Ghosh

কল্পনায় বাঁচতে ভালোবাসি, কল্পনা ভিত্তিক গল্প লিখি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *