বাঁধন । অনুষ্কা সাহা ঋতু । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প

অনুষ্কা সাহা ঋতুর লেখা ‘বাঁধন ’ সামাজিক ছোটগল্পটি ‘ আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প প্রতিযোগিতা-১’ এ ষষ্ঠ স্থান অর্জন করে।

“সে কাঁদছে অঝোর ধারায়। ছোট্ট মেয়েটা বাবাকে জড়িয়ে নীরবে অশ্রুপাত করছে। পাঁচ বছরের মেয়েটা এখনই নিজেকে সামলাতে শিখে গেছে। বুক ভরা অভিমান কিন্তু মুখের বাক্যতে সান্ত্বনার ছোঁয়া।ছোট ছোট হাত দুটি দিয়ে বাবার চোখ দুটি মুছে দিয়ে বলে,” আব্বা তুমি কাইন্দো না। লালু আবার তোমার কাছে চইলা আইবো দেইখো তুমি, ওই তো তোমার কলিজার টুকরা”। অবুঝ মেয়েটাকে কী করে বুঝাবে গফুর, লালুর ভবিষ্যৎ যে এটাই!

পরিবারের একমাত্র সম্বল দুধেল গাই কাজল পোয়াতি। গফুরের বউটাও সন্তানসম্ভবা। দুজনেই ঘরের লক্ষী, দুজনেই একসাথে মা হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করছে ভেবেই খুশিতে নেচে উঠেছিলো গফুরের মন। অথচ এক বারো মনে হয় নি অভাবের সংসারে নতুন দুটো প্রাণকে কী করে বাঁচাবে। সে আজ হতে আরো পাঁচ বছর আগের কথা।

টাকা গুলো গুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না। নিজেকে অনেক বড় পাপী মনে হচ্ছে। তীব্র অপরাধবোধ তার ভেতরটা ঘুণপোকার মত কাটছে যেন। অভাব জিনিসটা বড়ই খারাপ। অন্তরের বাঁধন আলগা করে দিতেও সময় নেয় না। ওরা ভাবে মোটা টাকার পশু কিনে পূন্য করতে যাচ্ছে কিন্তু সন্তানস্নেহে বড় করা মানুষটা যে কলিজা ছিঁড়ে দিয়ে দিলো তা কেউই বুঝলো না।

গলা দিয়ে কোনমতে খাবার নামছে না।সারাদিন উপোষ থেকেও ক্ষিদেটা চাগাড় দিচ্ছে না।খাবারের কথা মনে আসলেই বারে বারে লালুর মুখটা ভেসে আসে। আচ্ছা লালুটা কি খাচ্ছে! আদৌ কি খেয়েছে কিছু! ও তো বাইরের কারো হাতে খেতে অভ্যস্ত নয়। ছোট বেলা থেকেই গফুর না হয় গফুরের বউয়ের হাতে খেয়ে বড় হয়েছে।

পরক্ষনেই মনকে বৃথা সান্ত্বনা দেয়, কষ্ট হলে হবে আর মোটে তিন দিন তারপরেই তো……..
আর কিছু ভাবা গেলো না ভাবতে গেলেই বুকের ভেতরটা খালি হয়ে যাচ্ছে। সকাল সকাল ট্রেন ধরতে হব। প্রথম ট্রেনেই ফিরতে হবে বাড়িতে। এখানে বেশিক্ষন থাকলে মায়াটা আরো বাড়তে থাকবে।পরীটা লালুর পেছন পেছন ছুটেছে। খেলার সঙ্গীটাকে কোনমতেই ছাড়তে চায় না সে। লালুটা কাঁদছে তবুও পেছন ফিরে তাকালো না।

জন্মের পরেই লালু আর পরী একসাথে বেড়ে উঠেছে। আজো স্পষ্ট আছে সেই দিনের কথা, শেষ বিকেলে হাট থেকে ফেরার পথে পাশের বাড়ির রাজু দৌড়ে আসে গফুরের কাছে দুপাটি দাত আকর্ণ বিস্তার করে বলে,”ও চাচা,তাত্তাড়ি যাইয়া দেহো, তোমার ঘরে পরীর লাহান একখান মাইয়া আইসে গো, কি সুন্দর মাশাল্লা! এদ্দুইরগা এদ্দুইরগা হাত পাও”। মুখ থেকে অজান্তেই বের হয় গফুরের,”আমগো কাজলের কি হইলোরে?” রাজু নাচতে নাচতে বলে লাল টুকটুইক্কা এঁড়ে বাছুর বিয়াইছে গো”।

রাজুকে লজেন্সের টাকা দিয়ে দৌড়ে বাড়ি গেল গফুর। ঘরে না গিয়ে আগে গোয়ালের দিকে ছুট দিলো সে। রাজু একবর্ণ ও মিথ্যা বলেনি।লাল টুকটুকে এঁড়েটার নাম দিলো “লালু”। এরপর নিজের কন্যার মুখ দেখলো গফুর। পরীর মত দেখতে বলেই নাম দিলেন “পরী”।
সেদিনের কথা সারাজীবনেও ভুলবার মতো নয়।

বাপ মেয়ে দুজনই খানিকটা জল খেয়ে শুয়ে পড়লো। ছোট্ট মেয়েকে জড়িয়ে পুরোনো কথা গুলো ভাবতে ভাবতেই ঘুমের অতল গহ্বরে তলিয়ে যায় গফুর। কষ্ট একটু বেশিই হচ্ছে। তাতে কি! বিয়ের পর বউটা সব সুখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে। ছোট্ট মেয়েটাও নতুন জামা পড়ে দেখেনি কখনো। ফ্যাল ফ্যাল করে কেবল রাস্তার দিকে নতুন পোষাক পড়ে হেঁটে যাওয়া ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকে। এবার এই টাকা দিয়ে বউ আর মেয়েকে নতুন জামা কাপড় নিয়ে দিবে। নিজেরটা না হয় তোলাই থাকলো।

সকাল বেলা রহিম মিয়ার চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গলো গফুরের। চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসলেও তখনো চোখে ঘুমের রেশ রয়ে গেছে। রহিম মিয়ার এক ধাক্কায় সংবিত ফিরে পেলো।” ওরে গফুইরা তোর সর্বনাশ হইয়া গ্যাছে রে। চোখ মেইলা দেখ, পরী আর তোর টাকার ব্যাগ নিয়া কেডাই পলায়ছে। ঐ শালা উঠ তাড়াতাড়ি”।

রহিম মিয়ার কথা গুলো আজব আজব লাগছে। হঠাৎ মনে হলো রহিম মিয়া কি পাগল হলো! এইতো আমার ব্যাগ। একি সত্যিই তো আমার ব্যাগ তো নাই। লাফ দিয়ে উঠতে গিয়ে পরনের লুঙ্গিতে পা আটকে প্রায় পড়তে পড়তে টাল সামলে নিলো। গায়ের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে পরীকে ডাকতে লাগলো। তন্ন তন্ন করে খুঁজলো আশপাশটা। পরীর দেখা মিলে না আর।

বেলা বাড়তে শুরু করছে। হাটে মানুষের ভীড় ও বাড়তে শুরু করছে।গফুরের পায়ের নিচের জমিনটা দুভাগ হয়ে যাচ্ছে যেন। চোখ মুখ অন্ধকার হতে লাগলো। মাথার উপর গনগনে সূর্যটা তাপ ছড়াতে শুরু করেছে। দেখতে দেখতেই ঢলে পড়লো গফুর।

গফুর জীবনের সব চাইতে দামী দুটো জিনিসকে খুইয়ে কি নিয়ে বাঁচবে সে! দুই মায়ের কোল খালি করার পাপ যে তাকে বাঁচতে দেবে না। এক সন্তানের কথা ভাবতে গিয়ে সন্তানসম লালুর স্নেহের লাগাম অন্যের হাতে তুলে তার বিনিময়ে মোটা টাকা চেয়ে নিয়েছে। আজ যে অভাবের কাছে স্নেহও হেরে গেলো।

জন্মের পর থেকেই লালু আর পরী গফুরের হাতেই বড় হয়েছে। গফুরের পত্নী মেয়ের পাশাপাশি এঁড়েটাকেও সমানভাবে দেখে রাখতো। মেয়েটাকে নিয়ে গোয়ালের আশেপাশে গেলেই লালু আর পরী অদ্ভুত ভাবে লাফাতো। যেন খুব আনন্দ হচ্ছে।তারপর যখন পরী হাটতে শিখলো গুটি গুটি পায়ে লালুর লম্বা পা দুটি ধরে এপাশ ওপাশ ঘুরতো আর লালু ও বেশ মজা পেতো।

শত অভাবের মধ্যেও কখন কাজল বা লালুকে বিক্রির কথা মাথায় আসেনি গফুরের।এমন ও দিন গেছে গফুরের পরিবারের সাথে প্রাণী দুটোও উপোষী কাটিয়েছে। তবুও প্রাণী দুটি গফুর অন্তপ্রাণ। লালু আর পরী একজন গফুরের প্রাণ তো অন্যজন গফুরের প্রাণের স্পন্দন।

একদিন সেই স্পন্দনটাকে জীবিত রাখার তাগিদে একদিন সবার অগোচরে সে প্রাণটাকেই বিসর্জন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো সে। যতটা সম্ভব বেশি করে যত্ন নিতে থাকলো লালুর। কেউ না বুঝলেও গফুরের চোখের জল লালুর নজর এড়ায় নি।শেষবার যখন দড়ি খুলে গোয়াল থেকে বের করে আনছিলো লালুকে, বিনা প্রতিবাদে বেরিয়ে এলো সে ভালোবাসার প্রতিদান দিতে। ডাগর চোখের জলটা গফুরের নজর এড়ায়নি।

কোরবানির জন্য গরুর হাট বসেছে। লালু গফুরের মতো বহু স্নেহময় গল্প চাপা পড়ে যাবে অভাবের তাড়নার আড়ালে। সন্তানতূল্য পশুটারও মূল্য লাগানো হবে, দর কষাকষি হবে। দামটা কাছাকাছি এলেই বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠবে, অথচ কেউ টেরও পাবে না।

লালুর জন্যও দর কষাকষি হচ্ছিলো। দামটা কাছাকাছি আসতেই বুকের ভেতরটা যেন ফাঁকা হতে থাকে। এর মধ্যেই চাপা অভিমান কণ্ঠে ভরে পরী বলে,” আব্বা, আমাগো লাইগা লালুরে বেইচা দিবা? ” গফুরও তো কখনও চায় নি। কী করে বোঝাবে সেটা!

হঠাৎই ভেতরটায় হাঁপর টানা বন্ধ হয়ে গেলো। মনে হচ্ছে কেউ এতোক্ষণ পাঁজরের ভেতরের অন্ত্রগুলো টানাটানি করছিলো, এখন বন্ধ করেছে। নাকমুখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। শব্দগুলো অস্পষ্ট, চারপাশটা ধোঁয়াশা। তারপর…..

নূরানী আলোর ছটায় ঝলমল করছে চারপাশটা। কে যেন আসছে! কোনো ফেরেশতা! তবে কী গফুর মারা যাচ্ছে! আলোর মাঝে ঐ কার অবয়ব ভাসে! একজন, দু’জন, অনেকজন। কার চুল বাতাসে উড়ছে! হেলেদুলে কারা আসছে যেন!

ছোট্ট দুটো হাতের কোমল স্পর্শে জ্ঞান ফিরতে শুরু করে গফুরের। ছোট কোল পেতে কে যেন তার মাথাটা তুলে নিয়েছে। পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলো,” আব্বা দেহো, তোমার লালুরে তোমার কাছে লইয়া আইসি। তুমি আর কাইন্দ না। আমি কসম কইতাসি, আমার নতুন জামা লাগবো না। তুমি লালুরে আর যাইতে দিও না আব্বা”।

দুজন লোক দাঁড়িয়ে এই পূণর্মিলনী দেখছিল। তাদের একজন বলে উঠল, ” রাইতে তোমার মাইয়া টেকার ব্যাগ লইয়া আমগো বাড়ি আইসিলো। হেই কয়, “টেহা লাগবো না, আমার লালুরে ফিরাইয়া দেন। আমার আব্বা কানবো”। সত্যিকারের কোরবানি তো তোমরা দিলা, মিয়া। আমরা তো টেকা খরচ কইরাই ভাবি এইডাই মনে হয় আসল কোরবানি। যাউক গা, ভালা থাইকো সবাই, আল্লাহ পাকের কাছে দোয়া করি। ”

গফুর কাঁদছে। এই কান্না দুঃখের নয়, সন্তানকে ফিরে পাওয়ার। লালুরও দু’চোখ ভেজা। কেবল পরীটাই ফিক ফিক করে হাসছে। তার লালু তারই থাকলো।”

আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প প্রতিযোগিতা – ১ এ সপ্তম স্থান অর্জনকারী ‘সাইকোসাইকো সিরিয়াল কিলার ০৭‘ গল্পটি পড়তে ক্লিক করুন >> সাইকো সিরিয়াল কিলার ০৭ । মোঃ টুটুল ইসলাম । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প

বাঁধন । আত্মপ্রকাশ নির্বাচিত গল্প । লেখক পরিচিতি

লেখকঃ অনুষ্কা সাহা ঋতু
ছোটগল্পঃ বাঁধন
গল্পের জনরাঃ সামাজিক
দেশের বাড়িঃ পটিয়া,চট্টগ্রাম।
পড়াশোনাঃ অনার্স ২য় বর্ষ,সরকারী কমার্স কলেজ, চট্টগ্রাম, ২০১৮।

অনুষ্কা-সাহা-ঋতু-Anushka-Saha-Rithi-attoprokash-writter
লেখক- অনুষ্কা সাহা ঋতু

বই পড়ার প্রবল আকর্ষণ থেকে সাহিত্য জগতে পদার্পণ। এছাড়া গান গাওয়া ছবি আঁকা আর নাচের প্রতিও প্রবল ঝোঁক নিয়ে এগিয়ে চলা। তবে সবটাই শখের বশে।

আত্মপ্রকাশ সম্পাদক

http://attoprokash.com

আত্মপ্রকাশে অপ্রকাশিত গল্প এবং বুক রিভিউ এবং প্রবন্ধ প্রকাশ করতে যোগাযোগ করুন (ইমেইল-attoprokash.blog@gmail.com) অথবা ফেইসবুক পেইজ ইনবক্স। সর্বনিম্ন ১০০০ শব্দ হতে যেকোনো ঊর্ধ্ব সীমার ছোট গল্প গ্রহণযোগ্য। আপনার গল্প আত্মপ্রকাশ বিচারকদের দ্বারা নির্বাচিত হলে আপনাকে জানানো হবে এবং তা সরাসরি প্রকাশ করা হবে আত্মপ্রকাশে। আপডেট জানতে ফেইসবুক গ্রুপে সক্রিয় থাকুন।

5 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *