দ্য কাইট রানার বুক রিভিউ । খালেদ হোসাইনির অনবদ্য উপন্যাস । আত্মপ্রকাশ

‘দ্য কাইট রানার’ গল্পের লেখক খালেদ হোসাইনি ৪ মার্চ ১৯৬৫ সালে আফগানিস্থানের কাবুলে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর লেখা দ্য কাইট রানার উপন্যাস বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২৯ মে, ২০০৩ সালে। বইটি প্রকাশ করে রিভারহেড বুকস। বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন শওকত উসমান। প্রকাশ হয়েছে কথামালা প্রকাশনা থেকে। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৫২। আত্মপ্রকাশের আজকের আয়োজন দ্য কাইট রানার বুক রিভিউ।

লেখকঃ খালেদ হোসাইনি
প্রকাশনাঃ রিভারহেড বুকস
প্রচ্ছদ শিল্পীঃ হনি ওয়েরনার
প্রকাশকালঃ ২৯ মে ২০০৩
পাতা সংখ্যাঃ ৩৭২

দ্য কাইট রানার উপন্যাসের পটভূমি

রচনার ভাগসমূহ

আঘা সাহেব বিপত্নীক, একজন ধনী আফগানী, আলী তার একজন ভৃত্য যে কি না ছোট বেলা থেকে আঘা সাহেবকে সাথ দিয়েছেন। কাকতালীয় ভাবে তাদের দুজনেরই স্ত্রী নেই কিন্তু ছেলে আছে। আমির এবং হাসান তাদের দ্বিতীয় স্বত্ত্বা।উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আঘা সাহেবের ১২ বছরের পুত্র আমির।

ছেলেবেলা সব সময় দুরন্তই হয়, কিছু কিছু বন্ধুও হয় মনের মতো আর সেরকমই একটা বন্ধু হাসান। একই সীমারেখার মধ্যে বেড়ে ওঠা দুটি স্বত্ত্বা আমির এবং হাসান। একই সাথে ঘুড়ি ওড়ানো, একই সাথে সিনেমা দেখা, খেলাধুলা করা সবই তাদের নিত্যদিনের অভ্যাস ছিলো।

ছেলেবেলায় শুধু বন্ধুই থাকে তা নয় কিছু শত্রুও থাকে। হাসান আমিরে জন্য নিবেদিত প্রান সকল সময়ে সকল বিপদে সে তার বুক পেতে দিয়েছে আমির কে রক্ষা করার জন্য, এক কথায় হাসান আমিরে জন্য ঢাল হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু আমির? কেমন ছিলো সে? সে কি আদৌ হাসান কে সাহায্য করেছে? নাকি তাকে বিপদে দেখে ফেলে এসেছে?

আঘা সাহেব আমিরের মতো হাসান কেও ভালবাসতো, হাসানের কোন সমস্যা হলে উদ্বিগ্ন হয়ে যেতো এমন যে হাসান তার আরেক টা পুত্র? এটা আমিরের পছন্দ ছিলো না। মুলত আঘা সাহেব আমির কে কিছুটা দুরে দুরেই রাখতো নিজের ভালবাসা থেকে। এটাই হাসানের প্রতি আমিরের হিংসার জায়গা ছিল। হাসানকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার জন্য সে তার জন্ম দিনে তার বাবার থেকে পাওয়া ঘড়ি আর একটা খাম (টাকার) হাসানের ঘরে রেখে আসে। আলী চুরির অপবাদ সহ্য করতে না পেরে ইচ্ছা করেই আঘা সাহেবের বাড়ি ত্যাগ করেছে। যদিও আঘা সাহেব তা চাননি, অনেক কেঁদেছেন, বুঝিয়েছেন বাড়িতে থাকার জন্য। কেন তার এতো কান্না? আর এই একটা ভুলই আমিরে জীবনে নতুন অধ্যায়ের সুচনা করবে, ভাবাবে, নতুন একজন মানুষ হতেও সাহায্য করবে।



এরপর কেটে গেছে কয়েকটা বছর। শুরু হয়েছে আফগানিস্তানের যুদ্ধ, শরনার্থী হিসেবে ১৮ বছর বয়সে আমিরকে পাড়ি জমাতে হয়েছে আমেরিকাতে। আমেরিকায় কাটানো বিশ বছরের জীবনে সে বিয়ে করে সংসার পেতেছে, তার বাবারও বিয়োগ ঘটেছে। আটত্রিশ বছর বয়সে কোন অজানা সত্যি তাকে আফগানিস্তানে ফিরিয়ে এনেছে? কোন সত্যি  হাসানের প্রতি তার  আলাদা ভালবাসার জন্ম দিয়েছে? অতীতে করা ভুলের  প্রায়শ্চিত্ত সে কিভাবে করেছে? কেন সে কাবুলের মতো তালেবানে জমাট বিপজ্জনক জায়গাতে পদার্পণ করেছে? কেন তাকে ছেলেবেলার  শত্রু আসিফের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে?
কেন সে হাসানের ছেলে সোহরাব কে উদ্ধার করার জন্য নিজের জীবন বাজি রেখেছে? সোহরাব কে আমেরিকায় নিয়ে আসার জন্য তাকে অগনিত বাঁধা পাড়ি দিতে হয়েছে, কেন তিনি এ সকল বাঁধাকে কিছুই মনে করেনি? এ সকল প্রশ্নের
উত্তর পেতে পড়ে ফেলতে পারেন খালেদ হোসাইন এর ‘দ্য কাইট রানার‘।

ট্রাজেডি শুধু নাটকে উপস্থিত তা নয়, এই উপন্যাসটিকে একটা ট্রাজেডি ক্ষেত্র বললেও কোন ভুল হবে না।

দ্য-কাইট-রানার-বুক-রিভিউ-বই-প্রচ্ছদ
দ্য-কাইট-রানার-বুক-রিভিউ-বই-প্রচ্ছদ

দ্য কাইট রানার বুক রিভিউ । উপন্যাসের প্রেক্ষাপট

উপন্যাসের প্রেক্ষাপট আফগান যুদ্ধ কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। যে সময়টাতে অনেক সাজানো গোছানো জীবন ফেলে অনেক ধনী পরিবারকেও শরনার্থী হতে হয়েছে পাকিস্তান, আমেরিকার মতো দেশ গুলোতে। আবার অনেকে আছে যারা দেশকে ভালবাসে বলে দেশের মাটি আকড়ে পড়ে থেকেছে, সহ্য করেছে তালেবানের অত্যাচার, ল্যান্ড মাইন বিস্ফোরনে হারিয়েছে স্বজনদের। ধর্মের কথা বললেও তালেবানদের কার্যাবলীর মধ্যে মানবিক কিছু ছিলো এমনটা দেখা যায়নি, দেখা গিয়েছে তাদের পাশবিক নির্যাতন, শিশু ধর্ষনের মতো জঘন্য কাজও তারা করেছে, আসলে ধর্মের নামে তারা শুধু নোংরা নির্যাতন চালিয়েছে অসহায় মানুষগুলোর উপরে।
উপন্যাসটিতে একটা বিষয় লক্ষনীয়, আপাত দৃষ্টিতে হাজারা গোত্রের লোকগুলো আফগানিস্তানের লোকদের চোখে ছোট জাত ছিলো, তারা তাদের কে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের চোখে দেখতো, বিশ্বাসঘাতক বলে বিবেচনা করতো আর তালেবান সম্প্রদায় এদেরকে আরো খারাপ নজরে রাখতো, পুরো হাজারা সম্প্রদায়কে তারা নির্মম ভাবে হত্যা করে।

দ্য কাইট রানার উপন্যাস নিয়ে নিজস্ব কিছু কথা

আমরা জেনেছি যে, আমির গল্পের প্রধান চরিত্র, তবে আমার মতে হাসান এবং আমির চরিত্রের তুলনা করলে হাসানকেই প্রধান চরিত্র হিসেবে নির্ভুল মনে হবে। যেখানে হাসান বিপদে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে, আর আমির ভীরুতার।
যখন হাসান শারীরিক নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছিলো আমির নির্বাক চেয়ে দেখেছে, মিথ্যা চুরির অপবাদ দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, এত কিছুর পরও হাসান তার বন্ধুকে আগের মতোই ভালোবেসেছে। তাই প্রথম দিক থেকে আমির চরিত্রটা প্রধান হওয়ার উপযোগী নয়।

একটা বই পড়তে যেয়ে পাঠকের মধ্যে ন্যাচারাল জাজমেন্ট চলেই আসে। সেক্ষেত্রে সোহরাবকে ধৈর্যশীলই বলা যায় কিন্তু-
যখন আমির সোহরাবকে আমেরিকায় মাইগ্রেশন করার জন্য নানা রকম বাধার সম্মুখীন হচ্ছে, সামান্য একটা কথার জন্য সোহরাব কব্জির শিরা কেটে আত্বহত্যা করতে চেষ্টা করছে। বিষয়টা খুবই হতাশাজনক যদিও আমির সেটাকে হতাশা হিসেবে নেয় নি। তাকে সুস্থ করার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে তার জীবনের প্রথম প্রার্থনাটা করেছে। বিষয়টা এমন নাও হতে পারতো সোহরাব ছোট হলেও বিবেচক ছিল, বুদ্ধিমান ছিলো। তাই সে আরো একটু বিবেচনা করতে পারতো।



উপন্যাসটিতে কয়েকটা জীবনকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আর তুলে ধরা হয়েছে তাদের জীবনের খুঁটিনাটি। লেখক তার জীবনের ৩৮ বছরের একটা সমীকরণ দাঁড় করিয়েছেন, যার কিছু অংশ আফগানিস্তান আর কিছু অংশ আমেরিকায় কাটানো। ভাইয়ের মতো বন্ধুর ছেলেকে বাঁচানোর জন্য তার মতের পরিবর্তন ,নাস্তিক থেকে আস্তিক  হওয়া। তাঁর এবং তাঁর বাবার করা ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করা, ছোট্ট মুখে একটু হাসি ফোটানের জন্য তার হাজারো প্রয়াশ, এ সবকিছুই উপন্যাসটিকে  পূর্ণতা দিয়েছে।

একজন প্রিয় লেখক হয়ে ওঠার জন্য খালেদ হোসাইনি এর “দ্য কাইট রানার” বইটি পড়াই যথেষ্ট। উপন্যাসটিতে লেখক ঘটনা গুলো কে এতটা সূক্ষ্মভাবে উপস্থাপন করেছেন যা আপনাকে ভাবাবে, আপনার ভেতরটা কেঁপে উঠবে, চোখের জল আটকিয়ে রাখতে পারবেন কিনা সেই গ্যারান্টি আমি দিতে পারছি না, যেখানে আমি পারিনি। উপন্যাসটিতে অনেক গুলো ঘটনা, যেগুলো খুবই হৃদয় বিদারক। বিচারক হিসেবে আপনি একদিক থেকে অবশ্যই ঘৃণা করবেন আর অপরদিকের প্রতি আপনার মমতার শেষ থাকবে না।
ভালবাসবেন কিছু চরিত্রকে, তাদের বিয়োগ আপনাকে অন্য রকম বেদনা দিবে। অবশেষে পাঠকের প্রতি নিবেদন রইল আকর্ষণীয় এই বইটি পড়ার জন্য।

রোজিনা খাতুন

https://www.facebook.com/groups/attoprokash/

সাহিত্য অনুরাগী রোজিনা খাতুন, সর্বদাই সাহিত্যে ডুবে থাকতে পছন্দ করেন। রোজী পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগে অধ্যয়নের পাশাপাশি লিখালিখি করে থাকেন। সাহিত্য সমালোচনা তার বিশেষ একটি দিক।

1 Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *